কোনো কথা নেই বার্তা নেই, আকস্মিকভাবে আবারও দৃশ্যপটে এসেছেন বিদেশে ‘সোশ্যাল ওয়ার্ক’ করার নামে দেশ থেকে কেটে পড়া সাবেক সেনা প্রধান এবং তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেনের প্রধান খলনায়ক জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ। সম্প্রতি নিউইয়র্কের একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নানা কথার আড়ালে নিজের পক্ষে যথারীতি সাফাই গেয়েছেন তিনি। তার এ সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে গত ১৯ জুন। এতে তত্ত্বাধায়ক সরকারের নামে দু’ বছরের অবৈধ শাসন, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের নির্যাতন থেকে কিংস পার্টি গঠন এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা পর্যন্ত অনেক বিষয়েই বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের ওপর ‘টর্চার’ চালানোর প্রসঙ্গ। প্রশ্নের জবাবে মইন উ বলেছেন, তারেক রহমানকে যে ‘ধরে আনা’ হয়েছে তা তিনি নাকি জানতেনই না! পরে যখন জেনেছিলেন তখন নাকি ‘অনেক দেরি হয়ে’ গিয়েছিল! অবশ্য তাকে ‘টর্চার’ করা হয়েছে এমন ‘একটা খবর’ তিনি পরে জেনেছিলেন। মইন উ প্রসঙ্গত বলেছেন, তারেক রহমানকে নাকি তার নির্দেশে নির্যাতন চালানো হয়নি। নির্যাতন নাকি চালিয়েছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। সাফাই গাইতে গিয়ে মইন উ আরো বলেছেন, সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই একজন (সামান্য!) লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে সরাসরি নির্দেশ দেবেন না। তার যা কিছু করার সবই করাতেন তিনি ডিজিএফআইকে দিয়ে। এ ব্যাপারে তৎকালীন ডিজিএফআ্ই-এর ডিজিকে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন তিনি।
এখানে বলা দরকার, অন্য সব সাফাইয়ের মতো এ সাফাইয়ের ক্ষেত্রেও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন সেদিনের এই খলনায়ক। কারণ, একজন সেনাপ্রধান নিজে সাধারণত কখনো এত নিম্নমানের কোনো কাজ করেন না, করান অন্যদের তথা অধীনস্থদের দিয়ে। এ কথাটাই কিন্তু এতদিন ধরে বলা হয়েছে। ডিজিএফআই-এর হর্তাকর্তা যারা ছিলেন তাদের কারো ঘাড়েই একটির বদলে দুটি বা তার বেশি মাথা বা কল্লা ছিল না যে, তারা এই খলনায়কের ইচ্ছা বা নির্দেশের বাইরে কিছু করার দুঃসাহস দেখাবেন তাও তারেক রহমানের মতো একজন তরুণ নেতাকে যথেচ্ছভাবে নির্যাতন করার এবং প্রায় পঙ্গৃু করে ফেলার ঝুঁকি নেবেন। অমন অবস্থা ওই দিনগুলোতে কারো ছিল নাÑ বিশেষ করে বেঁটে জেনারেলের হুকুম বা ইচ্ছার বাইরে সেনাবাহিনীর কারো কিছু করার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না। এতদিন পর হঠাৎ করে মইন উ কেন তারেক রহমানের ব্যাপারে সাফাই গাইতে গেলেন এবং কেন সব দোষ চাপালেন একজ অধীনস্থ লেফটেন্যান্ট কর্নেলের ওপর সে প্রশ্নের জবাব জানার জন্য এই মুহূর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তবে একটি কথা বলে রাখা যায়। কথাটা হলো, এমন এক সময়ে তিনি সাফাই গেয়েছেন যখন তারেক রহমানকে নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে, যখন ক্ষমতাসীনরা হঠাৎ উঠে-পড়ে লেগেছেন বিএনপির এই সম্ভাবনাময় নেতার বিরুদ্ধে। হতে পারে, তারেক রহমানের সম্ভাবনা দেখে সেদিনের খলনায়ক হয়তো আগেভাগেই নিজের রাস্তা পরিষ্কার করতে চাচ্ছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এ ব্যাপারেও তিনি সেনাবাহিনীর শৃংখলাবিরোধী কাজ করেছেন। কারণ, কোনো সেনা অফিসারই ঊর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশের বাইরে কোনো কাজ করতে পারেন না। তারা শুধু ওপরের হুকুমই তামিল করেন। সুতরাং মইন উ কিছুই জানতেন না, ‘টর্চার’ চালানোার নির্দেশ তিনি দেননি এবং ‘টর্চার’ চালিয়েছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ ধরনের সাফাই কোনো কাজেই আসতে পারে না। উল্টোটিই বরং ঘটতে পারেÑ যদি কখনো ওই লেফটেন্যান্ট কর্নেলই আবার মুখ খুলে বসেন!
সাক্ষাৎকারে নিজের বর্তমান দুর্দশা, ক্যান্সারসহ শারীরিক অসুস্থতা, গাড়ি-বাড়ি না থাকায় এর-ওর আশ্রয়ে বসবাস করা এবং ধাক্কাধাক্কি করে বাসে যাতায়াত করার মতো বহু গালগল্পই শুনিয়েছেন মইন উ আহমেদ। সবচেয়ে কৌত’হলোদ্দীপক বিষয় হিসেবে আবারও এসেছে তার প্রেসিডেন্ট না হওয়ার বহুবার শোনানো কাহিনী। এই সাক্ষাৎকারেও মইন উ বলেছেন, ‘আমি কোনোদিন প্রেসিডেন্ট হতে চাইনি। প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে হতে পারতাম। সেই সুযোগ ছিল।’ কথাটা তিনি এর আগেও বলেছেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট হতে চাননি বলে যে দাবি তিনি করেছেন সেটা যেমন সত্য নয় তেমনি একথাও অত্যন্ত কঠিন সত্য যে, তিনি চাইলেই প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, ২০০৯ সালে এই মর্মে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, ওয়ান ইলেভেনের ওই দু’ বছরের মধ্যে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য মইন উ অন্তত তিনবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময়ও এক সাক্ষাৎকারে খুবই দম্ভের সঙ্গে মইন উ বলেছিলেন, ‘আমি যদি প্রেসিডেন্ট হতে চাইতাম তাহলে তো হয়েই যেতাম। কেউ আমাকে স্টপ করতে পারতো না।’ দাম্ভিকতাপূর্ণ এ কথাগুলোই কিন্তু প্রমাণ করে, দুঃশাসন এবং জুলুমবাজির দুই বছরে কতটা ক্ষমতাধর ছিলেন তিনি। হাতে বন্দুক ছিল বলে আসলেও তার কথার বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না কারো। তা সত্ত্বেও তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। কারণ, প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়টি তার একার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল না। ছিল অন্য কিছু বিশেষ ফ্যাক্টর যারা তার চাইতেও ক্ষমতাধর ছিল। ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়েছে, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং জাতিসংঘও বাংলাদেশের পটপরিবর্তনে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার রদবদলের ক্ষেত্রেও তারাই নির্ধারণী ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং এমন বোঝানোর সুযোগ নেই যে, মইন উ চাইলেই প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন এবং কেউই তাকে ‘স্টপ’ করতে পারতো না। তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনায় বরং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট হতে না চাওয়াটা মোটেও তার ইচ্ছা বা অনুগ্রহের ব্যাপার ছিল না। চেষ্টা তিনি প্রথম থেকেই করেছিলেন কিন্তু তাকে ‘স্টপ’ করা হয়েছিল। আর এই ‘স্টপ’ করানোর কাজটুকু সে শক্তিগুলোই করেছিল, মইন উ যাদের সেবাদাস ছিলেন। বস্তুত সেবাদাস ছিলেন বলেই মইন উ’র পক্ষে প্রভুদের উচ্ছা ও নির্দেশের বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না।
এখানে অন্য একটি বিশেষ তথ্য উল্লেখ করা দরকার। মইন উ বিদায় নেয়ার এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বেশ কিছু উপলক্ষে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, দুই বছরের কোনো এক পর্যায়ে তার কাছে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। শর্ত ছিল, নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি থেকে সরে আসতে হবে। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে মনোনীত প্রধানমন্ত্রী বানানো হবে। একই প্রস্তাব পরে খালেদা জিয়ার কাছেও গিয়েছিল। মইন উ’কে যখন ‘স্টপ’ করার মতো কেউ ছিল না তখন একা তিনি নিজে ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এ ধরনের প্রস্তাব পাঠানো সম্ভব কি না, যে কেউ তা ভেবে দেখতে পারেন। অর্থাৎ দুই নেত্রীর কাছে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব মইন উ’ই পাঠিয়েছিলেন। আর একথা তো ধরেই নেয়া যায় যে, দেশে একজন প্রধানমন্ত্রী থাকলে একজন প্রেসিডেন্টও থাকতে হবে। পদটি পাওয়ার ব্যাপারে তার যে খুবই আগ্রহ ছিল সে কথারও প্রমাণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন উপলক্ষে। যেমন ক্ষমতা দখল করার পর পর, ২০০৭ সালের ২ এপ্রিল পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পঠিত মূল নিবন্ধে তিনি বাংলাদেশের জন্য ‘নিজস্ব ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র’ এবং প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছিলেন। পরবর্তী দিনগুলোতেও সুযোগ পেলেই তিনি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। এ থেকেও ধরে নেয়া যায়, তিনি শুধু প্রেসিডেন্টই হতে চাননি, চেয়েছিলেন যথেষ্ট ক্ষমতাধর একজন প্রেসিডেন্ট হতেও। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ইচ্ছা তো ছিলই, চেষ্টায়ও তার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু তাকে ‘স্টপ’ করানো হয়েছিল। সুতরাং এমন কিছু বোঝানোর চেষ্টা নিতান্ত হাস্যকর যে, তিনি চাইলেই প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থে হননি।
বলা দরকার, কেবলই তারেক রহমানের ওপর নির্যাতন চালানোর এবং প্রেসিডেন্ট হওয়া না হওয়াসহ অন্য কিছু বিষয়ে তার বক্তব্য উল্লেখ করার জন্য সাবেক এই সেনাপ্রধানের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়নি। হয়েছে তার সামগ্রিক কর্মকা-ের পরিপ্রেক্ষিতেÑ যেগুলো একই সঙ্গে দেশ, গণতন্ত্র, জাতীয় অর্থনীতি এবং সেনাবাহিনীর সর্বনাশ ঘটিয়েছিল। ২০০৯ সালের ১৫ জুন অবসর নেয়ার পর পর ২৮ জুন গভীর রাতে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে, বিশেষ করে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আয়োজিত নির্বাচন নামের কার্যক্রমের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে দেশ ও জাতিকে তিনি বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ইচ্ছাধীন রেখেছিলেন। অস্ত্রের মুখে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে বাধ্য করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরবর্তীকালে বেরিয়ে এসেছে নানা অপকর্মের কেচ্ছা-কাহিনী। দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে মইন উ ও তার ঘনিষ্ঠজনেরা দেশে ‘ব্ল্যাকমেইলিং’-এর রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। ক্ষুদে ব্যবসায়ী থেকে বড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত কাউকেই রেহাই দেননি তারা। অনেকভাবেই দেশে-বিদেশে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন এবং প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর হুকুম চাপানোর মাধ্যমে রাজনীতিতে অনেক ওলট-পালট করার চেষ্টা করেছেন তিনি। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা এবং জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদসহ প্রধান নেতা-নেত্রীদের ‘জেলের ভাত’ খাইয়েছেন। দুই নেত্রীকে ‘মইনাস’ করতে চেয়েছেন। তারেক রহমানের আগে-পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলসহ অনেকের ওপর প্রচ- শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছেন। অনেককে দিয়ে জোর করে মিথ্যা বলিয়েছেন। এ উদ্দেশ্যে আরেক সাবেক সেনা প্রধানের মাধ্যমে দুদককে ‘কাজে’ লাগিয়েছেন তিনি। ‘স্বাধীন’ দুদককে দিয়ে মামলার পর মামলা চাপিয়ে নেতা-নেত্রীদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন মইন উ। রাজনীতিকদের অসম্মানতীও করেছেন তিনি যথেচ্ছভাবে। ‘জাগো বাংলাদেশ’ ধরনের বিচিত্র স্লোগান শুনিয়ে জাতিকে তিনি ‘সংস্কার’ ও ‘নিজস্ব ব্র্যান্ডের গণতন্ত্রের’ ট্যাবলেট গেলাতে চেয়েছেন। সবই করেছেন তিনি বন্দুকের ভয় দেখিয়ে এবং সামরিক স্বৈরশাসকদের স্টাইলে।
ভারতের স্বার্থে সীমান্ত খোলা রেখে বিডিআরকে দিয়ে ‘দোকানদারি’ করানোর, মাত্র তিন কেজি চালের জন্য মানুষকে ট্রাকের পেছনে দৌড়াতে বাধ্য করার এবং মানুষের বাসাবাড়ি-দোকানপাট ও বড় বড় বাণিজ্যিক ভবন ভেঙে ফেলার মতো অপকর্মগুলোও গুরুত্বের সঙ্গে এখনো আলোচিত হচ্ছে। তার হুকুমে হকার উচ্ছেদের নামে লাখ লাখ গরীব মানুষের ‘পেটে লাথি মারা’ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন তিনি সেনাবাহিনীর। রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত থাকায় মাসের পর মাস সেনাবাহিনী রুটিন অনুযায়ী এক্সারসাইজ করতে পারেনি। ফলে তাদের পেশাগত দক্ষতা কমে গেছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে চাকরির নামে সেনা সদস্যদের মধ্যে তিনি অর্থের লোভ ঢুকিয়েছেন, ব্ল্যাকমেইলিং-এর কাজে নিয়োজিত রেখে সেনাবাহিনীতে দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন। পিলখানা হত্যাকা-ের সময়ও তাকে অত্যন্ত নেতিবাচক অবস্থানে দেখা গেছে। বিপন্ন সেনা অফিসারদের জীবন বাঁচানোর চিন্তা পর্যন্ত না করে তিনি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ‘যমুনা’য় উঠেছিলেন। ভীরু-কাপুরুষের মতো সেখানেই রাত পর্যন্ত কাটিয়ে এসেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ৪৬ ব্রিগেডের সেনারা পিলখানার আশপাশে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেও জেনারেল মইন তাদের অভিযান চালাতে নিষেধ করেছেন। অথচ জেনারেল (অব.) এরশাদসহ একাধিক সাবেক সেনাপ্রধান এবং সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঘাতকরা সেনাবাহিনীর সামনে ১০ মিনিটও দাঁড়াতে পারতো না। ৪৬ ব্রিগেডকে অভিযান চালাতে দেয়া হলে এত সেনা অফিসারকে হত্যা করা সম্ভব হতো না, সাধারণ মানুষেরও প্রাণহানি ঘটতো না। এমন নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও মইন উ সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দেননি বলেই তার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচারণা রয়েছে, মইন উ’র এই ভূমিকার কারণে ঘাতকরা ‘কাজ সারার’ এবং পালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকা-ে তো বটেই, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও সেনাবাহিনীকে সর্বতোভাবে জড়িত করেছিলেন তিনি। তার নির্দেশে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাসহ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকেই সামনের কাতারে রাখা হয়েছে। জনগণকে ধারণা দেয়া হয়েছিল, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা তুলে দেয়ার বাইরে সেনাবাহিনী আর কোনো ভূমিকা পালন করবে না। অন্যদিকে ‘জুতা সেলাই থেকে গীতা পাঠ করা’ পর্যন্ত প্রতিটি কাজেই সেনাবাহিনীকে আঠার মতো লাগিয়ে রেখেছিলেন এই ‘বেঁটে জেনারেল’। তিনি যেহেতু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য ন্যক্কারজনকভাবেই কাজ করে গেছেন, সে কারণে সেনাবাহিনী সম্পর্কেও সংশয় ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল। তার ভূমিকায় গোটা সেনাবাহিনীই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সমর্থক পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে যদিও এই কর্মকা-ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর দায়দায়িত্ব ছিল না।
বর্তমান পর্যায়ে সংক্ষেপে বলা যায়, সমান্তরাল সরকার চালানোর মাধ্যমে অর্থনীতিসহ সকল বিষয়ে দেশ ও জাতিকে অনেক পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে গেছেন মইন উ। কিন্তু হাতে বন্দুক ছিল বলে তাকে কারো কাছে কখনো জবাবদিহি করতে হয়নি। বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন তিনি সুচিন্তিত আয়োজনের ভিত্তিতে। সে আয়োজনের পেছনে ছিল তার দিক থেকে আওয়ামী লীগের ‘খেদমত’। দলটিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে তার সুস্পষ্ট ‘অবদান’ রয়েছে। তাছাড়া ‘রোড ম্যাপ’ তৈরি করার সময় মূল পরিকল্পনা সেভাবেই করা হয়েছিল। পরিকল্পনায় ‘প্রয়োজনীয়’ সবাইকে ‘সঙ্গে’ রাখা হয়েছিল যাদের ওই মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল তাদেরকে তো বটেই, পরবর্তীকালে যাদের প্রয়োজন পড়বে তাদেরকেও। এজন্যই আওয়ামী লীগ সরকারের ওপরও ‘ঋণ’ পরিশোধ করার দায়ভার চেপেছিল। কিন্তু কথার নড়চড় হয়েছে শুধু একটি বিষয়ে। ‘বেঁটে জেনারেল’কে বঙ্গভবনে বসবাস করার তথা প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। মইন উ’কে বরং বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানকে স্যালুট করতে হয়েছিল। এজন্য অবশ্য মইন উ’র কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ থাকার কথা নয়। কারণ, লগি-বৈঠার হত্যা ও তা-ব থেকে ‘ডিজিটাল’ নির্বাচন পর্যন্ত সবকিছু যে ‘রোডম্যাপ’ অনুযায়ী ‘সুসম্পন্ন’ করা হয়েছে, সে ‘রোডম্যাপের’ বাস্তবায়নে প্রধান নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে গেছেন মইন উ। অঘোষিতভাবে পুরস্কৃতও যথেষ্টই হয়েছেন তিনি। এত কিছুর পরও সে একই জেনারেল এতদিন পর হঠাৎ কেন তারেক রহমানকে নির্যাতন করার প্রশ্নে সাফাই গেয়েছেন কৌত’হলোদ্দীপক সে প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমরা অপেক্ষায় রইলাম।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন