গত মঙ্গলবার হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সংরক্ষিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরে গভীর জঙ্গলের দুটি বাংকার থেকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র উদ্ধার করেছে র্যাব। বিভিন্ন উপজাতির আবাসভূমি ওই এলাকাটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষা। সেখান থেকে সীমান্তের দূরত্ব মাত্র তিন-চার কিলোমিটার। ওই উদ্যানের অভ্যন্তরে আরো কয়েকটি বাংকার বা পরিখা রয়েছে বলে র্যাব জানিয়েছে। রকেট লাঞ্চার ও ট্যাংক বিধ্বংসী বিস্ফোরক থেকে মর্টার শেল ও চার্জারসহ এমন সব ভারি সমরাস্ত্রই সেখানে পাওয়া গেছে, যেগুলো সাধারণত কোনো রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে বড় ধরনের ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, যে স্থানটিতে সমরাস্ত্রগুলো পাওয়া গেছে সেখানে এক সময় অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স বা এটিটিএফ-এর আস্তানা ছিল। সশস্ত্র এ গ্রুপটি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য তৎপরতা চালাতো। বর্তমানে এটিটিএফ দুর্বল হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালের এই জুন মাসেই বগুড়ার কাহালু থেকে একই ধরনের ও পরিমাণের সমরাস্ত্র উদ্ধার করেছিল চার দলীয় জোট সরকার। ওই সমরাস্ত্রের সঙ্গেও ত্রিপুরার এটিটিএফ-এর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। এদিকে হবিগঞ্জের সমরাস্ত্রগুলো ঠিক কোন দেশের কোন বাহিনী বা সশস্ত্র গ্রুপের সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেনি র্যাব। তবে সমরাস্ত্রের সঙ্গে পাওয়া একটি পুস্তিকার মলাটে লেখা আছে, ‘কেন ত্রিপুরীরা তাদের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার সংগ্রাম করছে’। এ থেকে ধরে নেয়া হয়েছে, সমরাস্ত্রগুলো সম্ভবত এটিটিএফ-এরই। অন্যদিকে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক যথারীতি তদন্তসাপেক্ষে বিস্তারিত তথ্য জানানোর কথা বলেছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, সমরাস্ত্রগুলো কোনো একটি দেশের নয় বরং প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের তৈরি। র্যাবের ধারণা, যে পরিমাণ উদ্ধার হয়েছে তার চাইতে দ্বিগুণেরও বেশি সমরাস্ত্র পাওয়া যেতে পারে। সে কারণে র্যাবের উদ্ধার অভিযান চলতে থাকবে। এদিকে সমরাস্ত্রগুলো তৈরির সময়কাল নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, পর্যবেক্ষণের পর র্যাবের পাশাপাশি তথ্যাভিজ্ঞরাও জানিয়েছেন, এগুলো অনেক পুরনো, এমনকি ১০-১২ বছর আগেরও হয়ে থাকতে পারে। একটি রকেট লঞ্চারের গায়ে ১৯৯০ সাল লেখা রয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, হবিগঞ্জের গভীর জঙ্গলে দুটি মাত্র বাংকার বা পরিখার ভেতর থেকে এত বিপুল পরিমাণ ভয়ংকর ধরনের ভারি সমরাস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি নিঃসন্দেহে আশংকাজনক। কারণ, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান একটি সংরক্ষিত এলাকা এবং সেখানে যার-তার বা সাধারণ মানুষের পক্ষে যাওয়া, গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংকার খনন করা এবং বাইরে থেকে সমরাস্ত্র এনে মজুত করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যখনই হয়ে থাকুক না কেন সে অসম্ভবকেই সম্ভব করা হয়েছে। অমন একটি কর্মকা- সম্পর্কে সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন বাহিনী এতদিন জানতো না কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন। তা সত্ত্বেও আমরা র্যাবকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। অনেক বিলম্বে হলেও র্যাব জাতিকে মারাত্মক কোনো পরিণতির কবল থেকে রক্ষা করেছে। কারণ, এই সমরাস্ত্রগুলো দেশের ভেতরে ব্যবহার করা হলে পুরো দেশই বিপন্ন হয়ে পড়তো। কিন্তু র্যাবের তৎপরতায় সে আশংকা দূর হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা অবশ্য বলা হচ্ছে, ঘটনাপ্রবাহে র্যাবের ইমেজ বা ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার করার এবং র্যাবকে তার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্য কাজ করতে পারে। প্রকৃত তথ্য যা কিছুই হোক না কেন, আমরা কোনো নেতিবাচক আলোচনায় যাওয়ার পক্ষপাতি নই। বর্তমান পর্যায়ে বড় কথা হলো, র্যাব একটি বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। সে কারণে র্যাবকে অবশ্যই ধন্যবাদ দেয়া দরকার। আমরা একই সঙ্গে আশা করতে চাই, হবিগঞ্জের ওই গভীর জঙ্গলে অন্য যে কয়টি বাংকার বা পরিখা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে সেগুলোর সব ক’টি থেকেই সমরাস্ত্র উদ্ধার করার ব্যাপারে র্যাবের চেষ্টা ও তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। আমরা আরো আশা করতে চাই, হবিগঞ্জে উদ্ধার করা সমরাস্ত্রগুলোকে নিয়ে কোনো নোংরা রাজনীতি করা এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালানো হবে না। কোন সরকারের আমলে ঠিক কোন দেশী বা বিদেশী গোষ্ঠীর উদ্যোগে এসব আনা হয়েছিল এবং আনার পেছনে ঠিক কোন উদ্দেশ্য ছিল এ ধরনের বিতর্কের পরিণতি জাতির জন্য শুধু অকল্যাণই বয়ে আনবে। কারণ, কোনো সরকারই নিজের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য বাইরে থেকে এত বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র আনতে এবং সেগুলো সশস্ত্র কোনো গ্রুপের হাতে তুলে দিতে পারে না। এজন্যই কোনো বিতর্কে যাওয়ার বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালানোর পরিবর্তে সরকারসহ সকল পক্ষের উচিত সতর্ক থাকা, যাতে কোনো গোষ্ঠীর পক্ষেই ভবিষ্যতে আর কখনো এভাবে সমরাস্ত্র নিয়ে আসা এবং বাংলাদেশের ভূখন্ডের কোথাও মজুত করা সম্ভব না হয়। এই সাথে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হওয়ার প্রয়োজন। অন্তত গত ৫ বছরে অনুপ্রবেশকারী বাহিনী ও অস্ত্রের সন্ধানে গোটা সীমান্ত চষে ফেলা হয়েছে। এরপরও এই অস্ত্র ধরা পড়লো না কেন। এটা একটা বড় প্রশ্ন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন