বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০১৪
চীন ও জাপান সফরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
Posted on ৪:০০ PM by Abul Bashar Manik
এশিয়ার দুই জায়ান্ট চীন আর জাপান।
৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর কূটনৈতিকভাবে একঘরে হওয়ার সঙ্কট কাটাতে এই দুই জায়ান্টকে
জয় করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমেই জাপান, এরপর চীন সফর শেষ করে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী। জাপান সফর শেষে দেশে ফেরার
পর এই সফরের সাফল্য নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
বেইজিং থেকে ফেরার পর আরেকটি সংবাদ সম্মেলনে হয়তো দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রীকে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনেক
গুণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রচার-প্রচারণায় দক্ষতা। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা
নিয়ে মামলার রায়ের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সমুদ্র জয় ছিল বেশ কিছু দিন সরকারি
গণমাধ্যমের প্রধান আলোচনা। তখন মনে হয়েছিল, মিয়ানমারের সাথে সংলগ্ন সমুদ্রের
যে অংশ বাংলাদেশ চেয়েছিল তার পুরোটাই পেয়ে গেছে। পরে যখন রায়ের বস্তুনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণ
হয়, তখন কিন্তু সমুদ্র জয়ের উচ্ছ্বাস আর থাকেনি। আকাক্সা ও প্রাপ্তির
মধ্যে এক বড় ফাঁক বেরিয়ে আসে। রায়ে আন্তর্জাতিক আদালত দুই দেশের দাবিকৃত সমুদ্রসীমানার
অনেকটা মাঝামাঝি একটি রেখা টেনে বিরোধের নিষ্পত্তি করার বিষয়টি বেরিয়ে আসে।
প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের পর
ছয় বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তার প্রতিশ্রুতি বেশ প্রচার পায় বাংলাদেশে। কোন কোন প্রকল্পে
এ সহায়তা দেয়া হতে পারে তার একটি তালিকাও প্রকাশ পায়, যার মধ্যে যমুনা নদীর নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণ ও যমুনায় দ্বিতীয় রেল সেতু নির্মাণের
মতো আকর্ষণীয় প্রকল্পও রয়েছে। জাপান সফরের সাফল্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে গিয়ে
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদে জাপানকে সমর্থনের কথাও উল্লেখ করেন।
কিন্তু জাপানের এসব সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারে বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বমূলক যে সরকারের
কথা টোকিও বলেছে, সেটি উল্লেখ করা হয়নি।
জাপান বাংলাদেশের দীর্ঘ সময় ধরে
ছিল বৃহত্তম সাহায্যদাতা দেশ। এ দেশ থেকে উদার সহায়তা প্রাপ্তির অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের
আগে রয়েছে। একতরফা নির্বাচন নিয়ে অনেকটাই কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মুখে পড়ার পর এবার
প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে এই সফরকালে জাপানের
প্রতিশ্রুতির বিষয়ও আলোচিত হয়েছে বিশেষভাবে। সরকারের এই আনন্দের মধ্যে ক্ষত তৈরি করে
রেখেছে রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যারেক্টারের সরকারের শর্ত রাখাটি। বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি যে
নির্বাচন হয়েছে তাকে আন্তর্জাতিক পক্ষ প্রকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার মনে করে না। মনে
করে না বলেই জাপানের পক্ষ থেকে সহায়তার প্রতিশ্রুতির সাথে এই শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে।
প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের আয়োজন করা না হলে জাপানের প্রতিশ্রুত সহায়তা পাওয়া যাবে
কি না তা নিয়েই দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদে
জাপানকে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। নিরাপত্তা পরিষদের আগামী
নির্বাচনে এশিয়ার সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছে জাপান ও বাংলাদেশের নাম। পররাষ্ট্র
প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ এতে জাপানকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এতে জাপানকে সমর্থন করার অর্থ হলো, বাংলাদেশ সেখানে প্রার্থী হচ্ছে
না; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের ব্যাপারে এক বিদেশী পত্রিকায়
খবর বেরিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ নির্বাচনে
চীনের সমর্থন চেয়েছেন। জাপানকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি অথবা চীনের সমর্থন কামনা, এর মধ্যে কোনটি সত্য এখনো স্পষ্ট নয়। দু’টিই যদি সত্য হয়ে থাকে তবে সেটি
হবে উভয় দেশের কাছেই বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর কারণ।
এশিয়ায় দুই বৃহৎ দেশ চীন-জাপানের
মধ্যে বৈরিতা ঐতিহাসিক। সেই বৈরিতা চীন সাগরের সেনাকুক দ্বীপের মালিকানা নিয়ে নতুন
করে চাঙ্গা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার বক্তব্য অনুসারে, বাংলাদেশ এই বৈরিতাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে চায়। তিনি আশা করেছিলেন, জাপান যেখানে বাংলাদেশকে ছয় বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেখানে চীন নিশ্চয়ই আট বিলিয়ন ডলার দেবে; কিন্তু চীন সফরের যেসব খবরাখবর
পাওয়া গেছে, তাতে এর উল্টো কাজটি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এই চীন সফর থেকে
কতগুলো বিশেষ বিষয় প্রাপ্তির আশা করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল ছয়টি মেগা প্রকল্পÑ কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, যৌথ উদ্যোগে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১৩২০ মেগাওয়াট মতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে বহু লেনবিশিষ্ট টানেল নির্মাণ, রাজশাহীতে পানি শোধনাগার নির্মাণ, চট্টগ্রামের কালুরঘাটে দ্বিতীয়
রেল সেতু নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম-রামু-কক্সবাজার এবং রামু-গুনদুম (বাংলাদেশ-মিয়ানমার
বর্ডার) মিশ্রগেজ রেললাইন নির্মাণ। এর বাইরে চীনের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশে সুযোগ
সুবিধা বৃদ্ধির আশা ছিল বাংলাদেশের। ভবিষ্যতে ইউরোপ-আমেরিকার কোনো ধরনের অর্থনৈতিক
বয়কটের ঘটনা ঘটলে, এটি কাজে লাগবে বলে আশা করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে আগে চীনের প্রধানমন্ত্রীর
পক্ষ থেকে আশ্বাসও পাওয়া গিয়েছিল। এই আশ্বাসে বাংলাদেশ রীতিমতো উৎসব করবে বলে আশা করে; কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই আশ্বাস থেকে সরে আসে বেইজিং।
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ
প্রশ্নে চীনা হারবারের বিনিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগেই সবুজ সঙ্কেত দেয়া
হয়; কিন্তু এতে এমন সব শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, যাতে চীনের আগ্রহে ভাটা পড়ে। গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে কোনো চুক্তি বা সমঝোতা
তো হয়নিই, অধিকন্তু এর প্রভাব পড়েছে সফরের অন্যান্য ইস্যুর ক্ষেত্রেও। চীন
সহজশর্তে এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে সম্মত ছিল; কিন্তু এই নির্মাণকাজে তারা কোনো
অংশীদারিত্ব কামনা করেনি। ঢাকার পক্ষ থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজে জাপানের সম্পৃক্ততার
প্রস্তাব দেয়া হয়। বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব এককভাবে বাংলাদেশের হাতে রাখার শর্ত দেয়া
হয়। একই সাথে ভারতের বন্দর ব্যবহার অধিকারের নিশ্চয়তা চাওয়া হয়। এসব শর্ত চীনের কাছে
গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। শেষ পর্যন্ত যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা বলা
হচ্ছে, তাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো সহায়তা প্যাকেজ
নেই।
সবচেয়ে উদ্বেগের দিকটি হলো, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর পাশ্চাত্যের সহায়তা
কমে যাওয়ার বিষয়টি চীনের সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে পুষিয়ে নেয়ার যে আশা করেছিল তা পূরণ হচ্ছে
না। দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির সরকারের অনিশ্চিত বাংলাদেশনীতির পাশাপাশি চীনের পক্ষ থেকে
আশা ভঙ্গের বিষয়টি সরকারের আয়ু সম্পর্কেই সৃষ্টি করেছে অনিশ্চয়তা। চীনকে প্রতিরক্ষা
খাতের বেশির ভাগ কেনাকাটা থেকে বাদ দেয়ার একটি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এমনকি অযৌক্তিকভাবে
কিছু কিছু টেন্ডারে চীনা প্রতিষ্ঠানকে অংশগ্রহণই করতে দেয়া হয়নি। সরকারের এ ধরনের নানা
কাজ বেইজিংয়ের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে একের পর এক।
চীন নিয়ে আশাভঙ্গ সরকারের নীতিনির্ধারকদের
ভাবিয়ে তুলছে বিশেষভাবে। তারা মনে করছে, একতরফা নির্বাচন নিয়ে বৈরী পশ্চিমের
বিপরীতে ভারতের আগ্রাসী সমর্থন হারানোর পর চীন-রাশিয়া ছিল প্রধান ভরসা। সেই ভরসার জায়গাটি
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর সঙ্কুচিত হয়ে এলো। তিনি চীনকে খুশি করতে সাংহাই ডেইলির
সাথে সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘চীন কাউকে বিরক্ত করে না। তাই চীনের দেখানো পথেই
হাঁটবে বাংলাদেশ।’ এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে
বলে মনে করা হয়। কারণ দণি চীন সাগর নিয়ে সাম্প্রতিককালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সাথে চীনের সম্পর্কের বেশ অবনতি ঘটেছে। মাঝে মধ্যেই তিন দেশের প থেকে একে অপরকে ল্য
করে বক্তৃতা-বিবৃতিতে আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ করা হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭
কয়েক দিন আগে এক বিবৃতিতে দণি ও পূর্ব চীন সাগরে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির জন্য গভীর
উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অভিযোগ করা হয়েছে, চীন তেল ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ
দণি চীন সাগরের বেশির ভাগ এলাকাকেই নিজের বলে দাবি করছে। এই এলাকার ওপর তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করছে চীন।
পূর্ব চীন সাগর এলাকা নিয়ে চীনের সাথে জাপানের বিরোধ চলছে চরমভাবে। সম্প্রতি ভিয়েতনামের
দাবিকৃত সমুদ্রসীমায় চীন একটি অয়েল রিগ স্থাপনের উদ্যোগ নিলে তা নিয়ে পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা
ছড়িয়ে পড়ে। ফিলিপাইন বলেছে, চীন এই এলাকায় একটি এয়ারস্ট্রিপ প্রতিষ্ঠা করতে
চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাড়তি কথা বলতে গিয়ে এ টানাপড়েনের সাথে যেন নিজেকে জড়িয়ে
ফেললেন। এতে কিন্তু শঙ্কিত হলো চীনবিরোধীরা অথচ খুশি করা গেল না বেইজিংকেও।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন