বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন, ২০১৪

সোনার ছেলেদের মধ্যযুগীয় বর্বরতা


বাংলাদেশের সোনার ছেলেদের সাথে মনে হয় নতুন করে আর আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দরকার নেই। টেকনাফ-তেঁতুলিয়া, রূপসা-পাথরিয়া সবাই জানে কারা এই সোনার ছেলে। ছাত্রলীগ নামের দানব সংগঠনের কুলাঙ্গার সন্ত্রাসীরাই হলো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি আদরের সোনার ছেলে। স্বাধীনতার স্থপতি (আ’লীগের ভাষায়) শেখ মুজিবুর রহমানের পবিত্র হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটির দীর্ঘদিনের কর্মকা-ের ফিরিস্তি এখানে তুলে ধরার কোন সুযোগ নেই। ছাত্রলীগ নামক হায়েনাদের সর্বশেষ দুইটি বর্বর কর্মকা-ের ওপর কিছু লেখার চেষ্টা করবো। কারণ ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা এতই সীমাহীন অপকর্ম করেছে যা এই ক্ষুদ্র লেখার মধ্যে তুলে ধরা সম্ভব হবে না।
 বিগত ৫ বছর ৫ মাস ১৯ দিন সময়ের মধ্যে এমন দিন কমই খুঁজে পাওয়া যাবে যেদিন তারা কোন অপকর্ম করেনি। প্রতিদিন রাজধানী, দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা, থানা, ইউনিয়ন কিংবা গ্রামে খুন, হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও নারী ধর্ষণের মতো কোন না কোন ঘটনা তারা ঘটিয়েই যাচ্ছে। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া ছাত্রলীগ এখন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়েও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পরই বেপরোয়া হয়ে উঠে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। তাদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন-হত্যা আর নারী ধর্ষণ থামাতে ব্যর্থ হয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের দেখা-শোনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। আ’লীগের নেতারাও একাধিকবার বলেছিলেন তারা আর ছাত্রলীগের দায়ভার নিবেন না।
২০০৯ সালের শুরুতে ছাত্রশিবিরের ২ জন নেতাকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমেই ছাত্রলীগ তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। ২০০৯ সালের ৯ মার্চ জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার শিবির সভাপতি হাফেজ রমজান আলীকে হত্যার পর ১৩ মার্চ ছাত্রলীগের নরপশুরা নির্মমভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারি মেধাবী ছাত্র শরিফুজ্জামান নোমানীকে। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তারা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের হত্যা অব্যাহত রেখেছে। বিশ্বজিৎ কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল না। সে ছিল একজন দর্জি। ছাত্রলীগের হায়েনাদের হাত থেকে নিরপরাধ বিশ্বজিৎও রক্ষা পায়নি। বিশ্বজিৎকে নৃশংসভাবে হত্যা করার দৃশ্য দেখে গোটা দুনিয়ার মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে দিবালোকে হাতে অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর গুলী করার ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন গু-ামী শিখানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় না। গু-াদেরকে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়া হবে। আজ পর্যন্ত এই অস্ত্রবাজদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সিলেট এমসি কলেজের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসগুলো সোনার ছেলেরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সেখানে গিয়ে চোখের অশ্রু ফেলে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের মতো সুন্দরভাবে অভিনয় করে আসলেন। গণমাধ্যমে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের নাম প্রকাশের পরও আজ পর্যন্ত একজনকেও গ্রেফতার করা হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী রাজনীতি বাদ দিয়ে সিনেমার জগতে চলে গেলে দারুণ অভিনয় করতে পারবেন। নিজ দলের নেতা-কর্মীদেরকে খুন করতেও ছাত্রলীগ কোন তোয়াক্কা করেনি। দিন যত যাচ্ছে বেপরোয়া ছাত্রলীগের বর্বরতা আর সন্ত্রাসী কর্মকা- ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলের মেধাবী ছাত্রদের এখন তারা টার্গেট করে হত্যার মিশনে নেমেছ।
চলতি মাসে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের দু’টি কর্মকা- মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। ৫ জুন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র তৌহিদুর রহমানকে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ঘটনা যতটুকু জানা  গেছে, ঐদিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে কলেজের ছাত্রলীগ নেতা রাফি কাজলশাহ এলাকা থেকে ডেকে নেয় তৌহিদুর রহমানকে। সেখান থেকে তাকে আবু সিনা ছাত্রাবাসের এক হাজার তিন নম্বর রুমে নিয়ে আসা হয়। আবু সিনা ছাত্রাবাসের এই রুমেই কলেজের ছাত্রলীগ সেক্রেটারি সাইফুল হাইসহ আরো চার-পাঁচজন মিলে তৌহিদুর রহমানের কাছে এমবিবিএস ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য চাঁদা দাবি  করে। তৌহিদ চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় তারা তাকে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো শুরু করে। তার পায়ে ৮/১০টি আঘাত এবং পেটে স্টেপিং-এর দাগও পাওয়া গেছে। পরে সে অজ্ঞান হয়ে পড়লে ছাত্রলীগ ক্যাডার শরিফুল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে লাশ নিয়ে আসে এবং সেখানেই লাশ রেখে সে পালিয়ে যায়।
 তৌহিদুর রহমান ওসমানী মেডিকেলের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ছিল। মেডিকেল পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে নিশ্চয় তার বাবা-মা ও ভাই-বোনদের অনেক স্বপ্ন ছিল। হয়তো তার নিজেরও স্বপ্ন ছিল একদিন সে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবাই নিজেকে নিয়োজিত করবে। আর একজন মেধাবী ছাত্র দেশেরও সম্পদ। কিন্তু ছাত্রলীগের হায়েনারা মেধাবী ছাত্র তৌহিদকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে ভেঙ্গে দিল তার ও তার পরিবারের সকল স্বপ্ন। খালি করে দিল মায়ের বুক। ধ্বংস করে দিল দেশের সম্পদ। কী অপরাধ ছিল মেধাবী ছাত্র তৌহিদের? কেন তাকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করা হলো? জবাব একটাই সে ছাত্রলীগ নামের নরপশুদের দলভুক্ত ছিল না। সে ভিন্নমতের ছিল। ছাত্রদলের কর্মী এটাই ছিল তার বড় অপরাধ।
দ্বিতীয়ত গত ১৬ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বর্বরোচিত ঘটনাটি ঘটালো শেখ হাসিনার সোনার ছেলে নামের ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তা যেন অতীতের সকল অপকর্মের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পুলিশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের সামনে ছাত্রশিবির নেতা মেধাবী ছাত্র রাসেলকে যেভাবে কুপিয়ে তার ডান পা কেটে নিয়ে গেছে তা ভাবতেও কষ্ট লাগে। নিরপরাধ একজন মেধাবী ছাত্রের প্রকাশ্যে দিবালোকে একটি পা কেটে নিয়েও তারা ক্ষান্ত হয়নি আবার তার বুকে তিনটি গুলীও করে গেছে। গুলী করার উদ্দেশই ছিল তার মৃত্যু নিশ্চিত করা। এটা পুলিশের সামনে বলা যাবে না। পুলিশের সহযোগিতায়ই তারা এই ধরনের নৃশংস কাজটি করেছে। কারণ, পুলিশ সহযোগিতা না করলে তাদের সামনে একটি মানুষের শরীর থেকে একটি অঙ্গ কোনভাবেই কেটে নিতে পারে না। এর চেয়ে জঘন্য, নির্মম, নৃশংস আর বর্বরতা অন্য কিছু হতে পারে না। আমার জানা মতে, দুনিয়ায় এমন কোন বিবেকবান মানুষ নেই এই দৃশ্য দেখার পর যার শরীর শিউরে উঠেনি। ওরা শেখ হাসিনার কাছে সোনার ছেলে হতে পারে কিন্তু এদেশের মানুষের কাছে ওরা নরপশু-হায়েনা ছাড়া আর কিছু নয়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের দ্বারাই এমন ঘটনা সম্ভব। কারণ যারা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে নৃত্য করতে পারে তাদের পক্ষে মানুষের শরীরের অঙ্গ কাটা কোন বড় ধরনের ঘটনা না।
এই ধরনের একটি বর্বরোচিত ঘটনার পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল ছাত্রলীগের এই কুলাঙ্গার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে। কিন্তু ঘটনা হিতে বিপরীত। পা হারানো রাসেলের মা মামলা করতে আসলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। বরং উল্টো নৃশংস ও বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার রাসেলকে পুলিশ গ্রেফতার দেখিয়েছে। দুনিয়ায় এর চেয়ে অমানবিক কাজ আর কি হতে পারে? খুন, হত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি এখন ছাত্রলীগের নিত্যদিনের রুটিন কাজ। সারা দেশে আজ এই ছাত্রলীগ নামের জঙ্গি সংগঠনটির নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। এরপরও শেখ হাসিনার কাছে তারা সোনার ছেলে। আর আওয়ামী লীগের আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে পরিচিত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরতো প্রতিদিন একবার বিব্রতবোধ করে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে আমরা ছাত্রলীগের এই ধরনের অপকর্মের সাথে নেই। আওয়ামী লীগের পক্ষে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিচার করা সম্ভব হবে না। কারণ আওয়ামী লীগই হলো একটি সন্ত্রাসনির্ভর দল। মাস্তান, সন্ত্রাসী আর গু-াবাহিনীর লোকেরাই এখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখছে। সরকারকে মনে রাখতে হবে আজকের এই সময়টা চিরস্থায়ী নয়। জনগণের সময়ও সামনে আসবে। ছাত্রলীগের বিচার যদি সরকার না করে তাহলে হয়তো জনগণই একদিন ছাত্রলীগের বিচার করবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads