রবিবার, ১৫ জুন, ২০১৪
১৬ জুন : সংবাদপত্রের কালো দিবস
Posted on ৫:০৩ PM by Abul Bashar Manik
আমরা সবাই জানি, পুরো নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে
বন্দী ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন। এর এক দিন পর তিনি বাংলাদেশের
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ‘প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার’ ঘোষণা করে দেশে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেন। পরদিন প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে
হন প্রধানমন্ত্রী। সাথে সাথে গঠন করেন তার মন্ত্রিসভা। এর মধ্যে নানা অর্থনৈতিক সঙ্কট
ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে কয়েক বছর দেশ চালানোর পর এলো ১৯৭৫। ১৯৭৫-এর
জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে শেখ মুজিব পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন তিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে
বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ ও ‘মেহনতি মানুষের সমাজতন্ত্র’ কায়েমের জন্য ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ শুরু করতে যাচ্ছেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান
সংশোধন করে দেশে আবার চালু করা হয় রাষ্ট্রপতি শাসিত নয়া সরকারব্যবস্থা। সংসদে এ সংশোধনী
বিল উত্থাপনের আধ ঘণ্টার মাথায় তা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস করা হয়। এ সংশোধনী মতে, প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা দেয়া হয় নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের তিনি চাইলে সংসদ সদস্য নন এমন ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবেন।
তা ছাড়া, প্রেসিডেন্টের কোনো পদক্ষেপকেই আদালতের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা
যাবে না। আরো ভয়বহ বিষয় হলো, এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা দেয়া
হয় একটি একক জাতীয় দল গঠনের এবং দেশের যেসব রাজনৈতিক দল এই একক জাতীয় দলে যোগ দিতে
ব্যর্র্থ হবে, সেসব দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। শেখ মুজিব আবার প্রধানমন্ত্রী
থেকে প্রেসিডেন্ট হলেন। তার মতে, সংবিধানের এই সংশোধনের মাধ্যমে শুরু হলো কথিত দ্বিতীয়
বিপ্লব।
১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব তার কাক্সিক্ষত একক জাতীয় দল গঠনের আদেশ জারি করেন। নাম দেন ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী দল’ তথা বাকশাল। সূচিত হলো একদলীয়
বাকশালী শাসনব্যবস্থা। বাকি সব দল হারালো রাজনীতি করার অধিকার। এসব দলের নেতাকর্মীদের
বলা হলো বাকশালে যোগ দিতে। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ যেন ছিটকে পড়ল গণতন্ত্রের
সড়ক থেকে। আর জীবনের দীর্ঘ সময় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা শেখ মুজিব যেন উদ্যত হলেন
গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরতে। এখানেই শেষ নয়, বঙ্গবন্ধু তার একদলীয় বাকশালী
শাসনের সমালোচনার সব পথঘাট বন্ধ করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন
ঘোষণা করেন সংবাদপত্র (ডিকারেশন) বতিল অর্ডিন্যান্স। এ অর্ডিন্যান্সে বলা হয় ১৯৭৫ সালের ১৭ জুন থেকে দেশে শুধু চারটি জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ অবজারভার ও বাংলাদেশ টাইমস প্রকাশিত হবে
সম্পূর্ণ সরকারি ব্যবস্থাপনায়। উল্লিখিত এ চারটি দৈনিকের সম্পাদক করা হয় যথাক্রমে নুরুল
ইসলাম পাটোয়ারি, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, ওবায়দুল হক ও শেখ ফজলুল হক মণিকে।
উল্লেখ্য, এ চারটি জাতীয় দৈনিকের মধ্যে দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ অবজারভার
আগে থেকেই সরকারের মালিকানাধীন ছিল। ১৬ জুন থেকে বেসরকারি মালিকানাধীন ইত্তেফাক ও বাংলাদেশ
টাইমসও সরকারি মালিকানাধীনে নেয়া হয়। ১৬ জুনে জারি করা অর্ডিন্যান্সের আওতায় ২২২টি
সংবাদপত্র বাতিল করা হয়। তবে সরকার ১২২টি সাপ্তাহিক ও মাসিক সংবাদপত্রের ডিকারেশন বহাল
রাখে। ইত্তেফাক-এর জন্ম হয়েছিল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার জন্য, সেই ইত্তেফাককে তার প্রায় দুই যুগের ইতিহাস মুছে ফেলতে হলো ১৬ জুনের অর্ডিন্যান্সের
ফলে। ১৭ জুনে শেখ মুজিব সরকারের মালিকানাধীন যে ইত্তেফাক প্রকাশ হতে দেশবাসী দেখতে
পেল, সেই সংখ্যাটি থেকে ইত্তেফাককে আওয়ামী-বাকশালী সরকারের নির্দেশে
শুরু করতে হলো নতুন এক অভিযাত্রা। সে সংখ্যাটির প্রথম পৃষ্ঠায় লিখতে হলো প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা।
সংবাদপত্র অর্ডিন্যান্স জারি
করে তখন বলা হয়, ‘সরকার ইদানীং লক্ষ করছে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো
গজিয়ে ওঠা সংবাদপত্রগুলো দেশের স্বাধীনতা-বিরোধী সব শক্তির সাথে আঁতাত করে সংবাদপত্রের
মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের উস্কানি দিচ্ছে। মিথ্যে, বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত গল্প ফেঁদে
জনগণের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। সেই সাথে জণগণের মনে আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছে। তাই
দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সরকার এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছেন।’
১৬ জুনের গণহারে সংবাদপত্র বন্ধ
করে সাংবাদিক সমাজকে পথে বসিয়ে দেয়ার এই সরকারি উদ্যোগ ছিল এ দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
হরণের একটি উল্লেখযোগ্য দিন। সেই থেকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এ দিনটি পালিত
হয়ে আসছে সংবাদপত্রের কালো দিবস হিসেবে। কিন্তু আজকাল আওয়ামী লীগের অনেক পদলেহী পত্রিকাই
সে দিবসটিকে আর জাতির সামনে সেভাবে তুলে ধরছে না। আজকের অনেক পত্রপত্রিকারই আওয়ামী
লীগের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণের ফলে আজকের প্রজন্ম সেই কালো দিনটির কথা ভুলে যেতেই
বসেছে। এরা জানার সুযোগই পাচ্ছে না, এ দেশের সংবাদপত্র শিল্পের ওপর
কত বড় ধরনের একটা আঘাত সেদিন এসেছিল। সেদিনের আওয়ামী-বাকশালী সরকারের একটি আদেশের ফলে
বিপুলসংখ্যক সাংবাদিককে হারাতে হয়েছিল তাদের রুটিরুজির অধিকার। তখন কোনো সাংবাদিককে
প্রেসকাবের সামনে ফুটপাথে বসে ফল বিক্রি করতেও দেখা গেছে। যদিও বলা হয়েছিল যেসব কাগজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে. সেসব কাগজের সাংবাদিক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারে
ন্যস্ত করা হলো। চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত এরা ভাতা পাবেন। সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা
দেয়ার জন্য গিয়াস কামাল চৌধুরী, আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক খালেদ এবং আরো কয়েকজনকে নিয়ে
একটি কমিটিও করা হয়েছিল। কিন্তু হাতেগোনা কয়েক জনকে সরকারি চাকরি দেয়া ছাড়া কাজের কাজ
কিছুুই করা হয়নি।
দেশবাসী তখন হতবাক হয়ে দেখল, এ দেশের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ক্ষমতায়
বসেই দিন দিন বদলে যেতে লাগলেন। ক্ষমতায় বসেই তিনি বলে বসলেন. ‘বিপ্লবে সংবাদপত্র যে স্বাধীনতা পেয়েছে তা এ দেশে আর কখনো ছিল না। এ জন্যই
রাতারাতি খবরের কাগজ বের করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছাপানো হয়, এক লাখ বামপন্থী হত্যা, বিমান বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ ইত্যাদি? এসব লেখা কি উচিত? এবং এসব কার স্বার্থে ছাপানো হয়? .... কিছু সাংবাদিক নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করেন। কিন্তু এরা স্বাধীনতার
আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যান্টনমেন্টে খবর সরবরাহ করেছেন। আপনারা কি বলবেন তাদের
গায়ে হাত দিলে গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর আঘাত করা হবে? .... অনেকে ভারতীয় চক্রান্তের কথা বলেন, যারা আমাদের দুর্দিনে সাহায্য করেছে তারা নাকি আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর কাছ
থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের পকেটে ফেলে রাখার চেষ্টা করছে। এ ধরনের কথা বলা কি সংবাদপত্রের
স্বাধীনতা? এর নাম কি গণতন্ত্র? .... আয়ের প্রকাশ্য উৎস নেই, সেও দৈনিক কাগজ বের করছে। রাতারাতি কাগজটা বের হয় কোত্থেকে? পয়সা দেয় কারা? তাদের পয়সা আসে কোত্থেকে? আমি খবর পাই, বিদেশীরা এদের সাহায্য করছে এবং তখন যদি আমি তাদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই তাহলে কি আপনারা বলবেন, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের ওপর অন্যায়
হামলা করা হয়েছে?’ বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণ, পৃষ্ঠা ২৮-৩৩।
ক্ষমতায় থাকা শেখ মুজিব তার গোটা
শাসনামলে কার্যত বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পকে দেখেছেন এভাবেই। যদি এভাবে না দেখতেন
তবে হয়তো ১৬ জুনের মতো একটি কালো দিন তার হাত দিয়ে সৃষ্টি হতো না। তার শাসনামলে মাওলানা
ভাসানীকেও এ ব্যপারে চিঠি লিখে তাকে সতর্ক করতে হতো না। মাওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের
শাসনামলে সংবাদপত্রের ওপর পরিচালিত সরকারের দলন-মথন দেখে বিচলিত হয়ে তাকে একটি চিঠি
লিখেছিলেন বলে জানা যায়। সে চিঠিতে তিনি শেখ মুজিবকে লিখেছিলেন ‘.... তোমার সরকার গণতান্ত্রিক সরকার বলে দাবি করে থাকে, কিন্তু সংবাদপত্র প্রকাশ ও সংবাদপত্রে লেখার স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার এ দেশে
স্বীকৃত হচ্ছে না। পাঁচ মাস আগে টাঙ্গাইলের ডিসির কাছে আমি হককথা, সাপ্তাহিক মোবাল্লেগ ও মাসিক ওয়ার্ল্ড পিস প্রত্রিকা প্রকাশের অনুমতি চেয়ে
আবেদন করেছি। আজো এর কোনো উত্তর নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে যদি পত্রিকা প্রকাশনার সাধারণ
অধিকারটুকু না থাকে, তবে আমি এ দেশে থাকতে চাই না। হয় পত্রিকা প্রকাশের
অনুমতিদানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দাও, নয়তো আমাকে এ দেশ থেকে বহিষ্কার কর। যাতে অন্য কোনো সত্যিকারের স্বাধীন দেশে
গিয়ে বসবাস করতে পারি এবং বর্তমান মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি।’সামসুল হক, বাংলা সাময়িকপত্র, ১৯৭২-১৯৮১।
মাওলানা ভাসানীর চিঠি থেকে কারো
অনুমান করতে অসুবিধা হওয়য়ার কথা নয় সে সময়ের তথা শেখ মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের
স্বাধীনতার হালহকিকতের বিষয়টি। ১৬ জুনের আগেও কথায় কথায় পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া, সাংবাদিক গ্রেফতার, নির্যাতন ও কারাগারে পাঠানোর অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ
করা যেতে পারে।
আসলে শেখ মুজিবের আমলে গণমাধ্যম
নিয়ন্ত্রণের যে বাকশালী ভূত চেপে বসেছিল, বর্তমান আওয়ামী লীগের ঘাড় থেকে
সে ভূত আজো নামেনি; বরং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আগের সব রেকর্ড ভেঙে
গণমাধ্যম দমনে নবরূপে আবির্ভূত হয়েছে। এ সরকারের আমলে আমরা দেখেছি, বহু সাংবাদিকের ওপর হামলা চলেছে, সাংবাদিকের গাড়ির ওপর হামলা, গাড়ি অনুসরণ করা হয়েছে, টেলিফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে, সাগর-রুনিসহ অনেক সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। মাহমুদুর রহমানের মতো সাংবাদিককে
জেলজুলুম ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে কার্যত সরকারের কঠোর সমালোচনার কারণেই। তার
সম্পাদিত বহুল প্রচারিত দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর প্রেসে
তালা দেয়া হয়েছে। দৈনিক ইনকিলাব-এর প্রকাশনা একসময় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ঠুনকো অজুহাতে
এ সরকার দীঘর্ দিন ধরে বন্ধ করে রেখেছে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি। সরকারের সমালোচনার
পথ বন্ধ করে দেয়ার মানসে এ সরকারকে দেখেছি দেশে ইউ টিউব ও ফেসবুক পর্যন্ত বন্ধ করে
দিতে। আবার একসময়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে সরকারকে বাধ্য হয়ে ইউ টিউব ও ফেসবুক
খুলে দিতে হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিগত সরকার দেশের
মানুষের কথা বলার অধিকার এবং সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সীমিত করার লক্ষ্যে
২০১৩ সালের ২০ আগস্ট তাড়াহুড়ো করে এক অর্ডিনান্সের মাধ্যমে সংশোধন করে ২০০৬ সালের ইনফরমেশন
অ্যান্ড কমিউনিকেশনর টেকনোলজি অ্যাক্ট। একই বছরের ৯ অক্টোবরে তা সংশোধন করে আইনে রূপ
দেয়। এ সংশোধনীতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৩ সালের সংশোধনীর ৭৬ (১) খ-এর মাধ্যমে
সিআরপিসির ৫৪, ৫৬, ৬৭. ও ৬১ নম্বর ধারার অপরাধকে আমলযোগ্য ও জামিনের
অযোগ্য করা হয় এবং ৫৫, ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬২, ৬৩, ৬৪ ও ৬৫ নম্বর ধারার অপরাধকে
আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য করা হয়। এর ফলে মারত্মক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কে নির্ধারণ করবে কোন অপরাধ কোন পেনাল সেকশনের আওতায় পড়বে। আর পুেিলশের কি
তেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা বা বিশেষজ্ঞজ্ঞান আছে যে, ইন্টারনেটে পোস্ট করা একটি ব্লগের
কোনো মন্তব্যের ব্যাপারে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আসলে এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের
স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হলো। আর এর বিনিময়ে হরণ করা হলো নাগরিক
সাধারণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। যেখানে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিক সাধারণের
ব্যক্তিগত জীবনে পুলিশের হস্তক্ষপ কমানোর চেষ্টা চলছে, সেখানে আমরা চলছি এর উল্টো দিকে। এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিল উল্লিখিত সংশোধনীটি না আনার জন্য। কারণ এর
ফলে মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিঘিœত হতে পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব যা-ই করা হচ্ছে তা হচ্ছে কার্যত আমাদের সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে।
আমাদের সংবিধােেনর ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা
সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে : ‘০১. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার
নিশ্চয়তা দান করা হইল। ০২. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ
সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচণা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত
বাধানিষেধসাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার, এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
এর পরও কী করে আমাদের দেশের একটি
সরকার সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের ওপর দলন-মথন চালিয়ে পার
পেয়ে যায়? সাংবাদিক মহলের অনৈক্য আর বিভাজনই এর জন্য দায়ী। সাগর-রুনিসহ আরো
সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়ার জন্য মূলত সাংবাদিকদের অনৈক্যই দায়ী। পেশাজীবী সাংবাদিকদের
প্রতিটি সংগঠনে এই বিভাজন চরমে। এক পক্ষ সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিলে আরেক পক্ষ যায়
সরকারের পক্ষে। সাংবাদিকদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই চলছে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক
অবদমনের যাবতীয় সরকারি প্রক্রিয়া। যদ্দিন দেশের সাংবাদিকসমাজ ঐক্যবদ্ধ না হবে, তত দিন এই প্রক্রিয়া চলবে।
প্রতিটি দেশেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
ও বাকস্বাধীনতা প্রয়োজন। কেন দেশে দেশে এ স্বাধীনতা স্বীকৃত? কারণ, ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের এই স্বাধীনতা না থাকলে মানুষ তার মতামত অন্যের
কাছে তুলে ধরতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সমাজও প্রতিষ্ঠিত হয় না। গণতন্ত্র
ছাড়া কোনো দেশেই জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কেননা গণতন্ত্রহীন দেশে কখনোই
স্থিতিশীল পরিবেশ থাকতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান সরকারের সেই উপলব্ধিজ্ঞান
একেবারে শূন্যের কোঠায়। তাই এরা মনে করে, ভোটারবিহীন নির্বাচনসূত্রে গঠিত
এ সরকার দমনপীড়ন চালিয়ে বিরোধী দলগুলোকে ঘরবন্দী রেখে কিংবা অস্তিত্বহীন করে অন্য দিকে
দেশে চোখ ধাঁধানো কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ক্ষমতায় ঠিকে থাকবে। তা
ছাড়া এ সরকারের ভাবনা হচ্ছে কয়েকটি দর্শনীয় সেতু, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, ফাইওভার, ওভারব্রিজ ও দুয়েকটি হাতিরছিল
প্রকল্পের মধ্যেই উন্নতি নিহিত। দেশের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন, তাদের জন্য নিশ্চিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য
সুশিক্ষার ববস্থা করার চিন্তাভাবনা এদের মাথায় নেই। এরা মনে করেন, বছরের প্রথম দিন স্কুলে বই পাঠাতে পারলেই কেল্লা ফতে। এদিকে মরামারি-কাটাকাটি
করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও শিক্ষামন্ত্রীর মুখে রা নেই। এ থেকে বেরিয়ে এসে
দেশে সত্যিকারের উন্নয়ন নিশ্চিত করা, সবার আগে প্রয়োজন মানুষের বাক্স্বাধীনতা
ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে দেশে গণতন্ত্রের আবহ সৃষ্টি করা। প্রয়োজন ১৬ জুনের
কলঙ্কতিলক মুছে ফেলা। তবেই যদি দেশে আসে আমাদের কাক্সিক্ষত সত্যিকারের উন্নয়ন।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন