গত ৪ জুন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২ লক্ষ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার অতি বিশাল আকৃতির যে বাজেট পেশ করেছেন তার বাস্তবায়নের সম্ভাবনাসহ নানাদিক নিয়ে দেশের সকল মহলে বিস্তারিত আলোচনা চলছে। আলোচনা ও মন্তব্যের আড়ালে বেশি করা হচ্ছে সমালোচনা। অনেকে এমনকি সরাসরি সংশয়ও প্রকাশ করেছেন। সংশয় প্রকাশ যারা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সংসদে প্রধান বিরোধী দল ও এখনো আওয়ামী মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও। বস্তুত একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া এমন কোনো দল ও মহলের কথা বলা যাবে না, যারা বাজেটের সমালোচনায় সোচ্চার না হয়েছে। অন্যদিকে বাজেটের সমর্থনে যথারীতি মাঠে নেমেছেন ক্ষমতাসীনরা। তারা এই বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন যে, যতো উচ্চাভিলাষী হিসেবেই চিহ্নিত করা হোক না কেন এবং বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান সম্পর্কে যতো সন্দেহ-সংশয়ই প্রকাশ করা হোক না কেন, সরকার এ বাজেট বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখে এবং বাজেট বাস্তবায়ন করা হবেই। বাজেটের পক্ষে প্রচারণা চালাতে গিয়ে অর্থমন্ত্রীর পর সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক এবং রাজনৈতিক অর্থে উস্কানিমূলক কিছু কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। গত ৮ জুন রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক দলীয় সমাবেশে প্রস্তাবিত বাজেটের বিরোধিতাকারীদের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, যারা এই সমালোচনা বা বিরোধিতা করছেন তারা না রাজনীতি জানেন, না বোঝেন অর্থনীতি! সৈয়দ আশরাফের এমন মন্তব্যের নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না। সহজ কথায় তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বাজেটের সমালোচনা করতে হলে রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে অন্তত তাদের অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের উচ্চতায় জ্ঞান রাখতে হবে! সৈয়দ আশরাফ আরো বলেছেন, মাত্র ‘কয়েকজন’ই নাকি বাজেটের বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের মধ্যে একমাত্র সিপিডির দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যই নাকি বাজেট ও অর্থনীতি সম্পর্কে কিছুটা বোঝেন। কিন্তু ওই একজন মানুষের কথার জবাব দেয়ার দরকার নেই!
বলার অপেক্ষা রাখে না, সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসুলভ মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কারণ, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, যতো যুক্তিসঙ্গত ও তথ্যনির্ভরই হোক না কেন, দলটি কোনো সমালোচনা সহ্য করতে রাজি নয় এবং দলটি গায়ের জোরে হলেও মিথ্যাকে সত্য বানানোর চেষ্টা করে থাকে। বর্তমান পর্যায়ে কথাটা বলার কারণ, অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে সৈয়দ আশরাফ যদি শুধু বাজারের দিকে লক্ষ্য করতেন তাহলেই তিনি জিহ্বা সামাল না দিয়ে পারতেন না। কারণ, অতীতের মতো এবারও বাজেট ঘোষণার আগে সরকার মূল্যনিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। অথচ নিয়ম হলো, অর্থমন্ত্রী প্রথমে সংসদে প্রস্তাব আকারে বাজেট পেশ করার পর প্রস্তাবের নানাদিক নিয়ে সংসদ সদস্যরা আলোচনা করবেন এবং সবশেষে ৩০ জুন বা তার দু’একদিন আগে বাজেট প্রস্তাব পাস হবে। বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলে পণ্যের দাম বাড়বে ১ জুলাই থেকে। কোনো কোনো পণ্যের তো দাম কমারও সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাজেট আসছে কথাটা প্রচারিত হতে না হতেই ব্যবসায়ী-মহাজনরা দাম বাড়ানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। এর কারণ, ব্যবসায়ী-মহাজনদের সঙ্গে চাঁদা, ঘুষ ও কমিশনসহ নানাভাবে ক্ষমতাসীনদের লেনদেনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এজন্যই বেপরোয়া হয়ে থাকেন ব্যবসায়ী-মহাজনরা, অন্যদিকে পকেট কাটা যায় সাধারণ মানুষের। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। অর্থমন্ত্রীর পাশাপাশি বাণিজ্যমন্ত্রীও হুমকি যথেষ্টই উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু যাদের উদ্দেশে এই হুমকি তারা সামান্য পরোয়া করারও তাগিদ বোধ করেনি। কারণটিও সহজবোধ্য। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের যে আগে থেকেই বোঝাপড়া রয়েছে! এটুকু বোঝার জন্য নিশ্চয়ই রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখার কোনো দরকার পড়ে না যে কথাটা খুবই অবজ্ঞার সঙ্গে বলেছেন সৈয়দ আশরাফ। তাছাড়া ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকার বিরাট ঘাটতির অর্থ কোন সূত্র থেকে যোগাড় করা হবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঠিক কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন অনেক প্রশ্ন তো রয়েছেই, পাশাপাশি রয়েছে দেশীয় শিল্পের বাধাগ্রস্ত হওয়ার মতো কিছু জরুরি বিষয়ও। কারণ, হিমায়িত খাদ্য ও মৎস্য থেকে শুরু করে চকোলেট, কোমলপানীয়, পারটেক্স বোর্ড ও চামড়াজাত পণ্যসহ এমন অনেক বিদেশী পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী আরোপিত সম্পূরক কর কমানোর প্রস্তাব করেছেন, যেগুলো দেশেই যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত হয়। কর কমানোর ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই দেশীয় পণ্য তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে এবং এক পর্যায়ে মার খেয়ে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে, কারখানা বন্ধও হয়ে যাবে। অথচ ক্ষমতাসীনদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের কোনো দেশই দেশীয় শিল্পবিরোধী এ ধরনের ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ নেয় না। সব দেশ বরং দেশীয় শিল্পকে সর্বতোভাবে প্রোটেকশন বা নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা নেয় এমন কোনো পণ্য আমদানি করতে দেয় না, যা দেশের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের এবারের বাজেটে ‘বলে-কয়েই’ দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমাদের ধারণা, এই সহজ কথাটুকু বোঝার জন্য রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে এমন কোনো জ্ঞান অর্জন করার দরকার পড়ে না যে কথাটা সৈয়দ আশরাফ বোঝাতে চেয়েছেন। আমরা আশা করতে চাই, সমালোচনার জবাবে কেবলই জ্ঞান দেয়ার ও প্রতিপক্ষকে অবজ্ঞা করার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের উচিত আরো দায়িত্বশীল হওয়া এবং গঠনমূলক সমালোচনার ভিত্তিতে বাজেটে সংশোধনী আনা। অর্থবছরের শেষে অনেক প্রকল্পই কেন মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে, কেন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে না এ ধরনের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবও সৈয়দ আশরাফদেরই দেয়া উচিত।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন