গত ৯ জুন এক সহযোগী খবর দিয়েছে যে, ইলেকট্রনিক মিডিয়া (টেলিভিশন ও বেতার) নিয়ন্ত্রণে অনেক শর্ত দিয়ে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪ চূড়ান্ত করেছে সরকার। সংশোধিত নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনোভাবেই দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। এ নিয়ে মতামত চেয়ে জনপ্রশাসন, অর্থ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে এবং মতামতসহ তিন দিনের মধ্যে তা পুনরায় তথ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠাতে বলা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকেই সরকার এ রকম একটি নীতিমালা প্রণয়নের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছিল। এটি জারির আগে আবার সংশোধন করা হয়েছে। কয়েকটি ধারা বাদ দিয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা যোগ করা হয়েছে।
নতুন নীতিমালায় সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচারে ২৯টি ও বিজ্ঞাপন সম্প্রচারে ২৪টি শর্ত দেয়া হয়েছে। নীতিমালার তৃতীয় অধ্যায়ে সংবাদ ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠান অংশের দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়েছে, আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে কোনো প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত দেয়া পরিহার করতে হবে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে সকলের পক্ষের যুক্তিগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে। সরকার অনুমোদিত বেশকিছু অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলকভাবে প্রচার করার নিয়ম নীতিমালায় যোগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান যেমন, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের ভাষণ, জরুরি আবহাওয়া বার্তা, স্বাস্থ্যবার্তা, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা, প্রেসনোট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান যথাযথভাবে প্রচার বা সম্প্রচার করতে হবে। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন, জাতীয় শোক দিবস, জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ইত্যাদি উপলক্ষে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, মানবিক অনুভূতিতে আঘাত করে এমন দৃশ্য যেমন-হত্যাকা-, দুর্ঘটনায় নিহত ও আত্মহত্যাকারীদের মৃতদেহ, মানুষ ও প্রাণী নির্যাতন এবং ধর্ষণ ও ব্যভিচারের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কোনো নারী বা শিশুর স্থির বা চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা যাবে না। এছাড়া কোনো প্রকার অশোভন উক্তি বা আচরণ করা এবং অপরাধীদের কার্যকলাপের কৌশল প্রদর্শন, যা অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনে সহায়ক হতে পারে, এমন দৃশ্য প্রচারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)-এর তালিকাভুক্ত পণ্য সামগ্রীর বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে ঐ প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণ সনদপত্র উপস্থাপন করতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মান নিয়ন্ত্রণ সনদপত্র উপস্থাপন করতে হবে। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং ভাষা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সংবাদ আকারে বা কোনো অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বিজ্ঞাপন প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। আরও অনেক শর্তের সঙ্গে বলা হয়েছে, যেকোন খাদ্য বা পানীয়ের বিজ্ঞাপনে ঐ খাদ্য ও পানীয়ের পুষ্টি ও খাদ্যগুণ এবং স্বাস্থ্যগত প্রভাব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে এবং সুপার ইস্পোজ স্পষ্টাক্ষরে দেখাতে হবে। বিজ্ঞাপনে ধর্ষণ, ব্যভিচার বা অশ্লীল চলচ্চিত্র, নির্যাতন বা স্নায়ুচাপ সৃষ্টি করতে পারে এমন দৃশ্য যেমন ফাঁসি, শ্বাসরোধ, আত্মহত্যা, অঙ্গ বিচ্ছেদ ইত্যাদি, নারী, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি সহিংসতা বা তাদের প্রতি শারীরিক, মানসিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে এ ধরনের দৃশ্য দেখানো পরিহার করতে হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, নীতিমালার কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা হবে। কমিশন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়ন, সম্প্রচারের মান নির্ধারণ ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। ভবিষ্যতে এ কমিশনের মাধ্যমে সম্প্রচার লাইসেন্স দেয়ার কার্যক্রম চলবে। তার আগে তথ্য মন্ত্রণালয় এ দায়িত্ব পালন করবে।
কিছু ভালো কথা থাকলেও এই নীতিমালার মূল উদ্দেশ যে কী, তা অস্পষ্ট থাকেনি। এটি স্পষ্টতই মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণের একটি উদ্যোগ। এটি আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই মিডিয়ার সাথে তাদের দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার সৃষ্টি হয়েছে। খুন, লুট, হত্যা, দখল, অবিচার, অত্যাচার, নিপীড়ন-আওয়ামী রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেটি আমরা ১৯৭২-’৭৫ সালেও লক্ষ্য করেছি, ১৯৯৬-২০০১ সালেও লক্ষ্য করেছি। এখন এ দেশের মানুষ একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ১৯৭২-’৭৫ সালে এ দেশে কোনো বেসরকারি বেতার টেলিভিশন ছিল না। সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে শুধু কিছু সংবাদপত্র ছিল। শেখ মুজিব শাসনামলের ভয়াবহ অত্যাচার, নির্যাতন, লুণ্ঠনের খবর সংবাদপত্রগুলোই শুধু প্রকাশ করতো। অন্য কোনো মিডিয়ায় তা প্রকাশের সুযোগ ছিল না। তখন দেশে সাক্ষর মানুষের সংখ্যা ছিল ১৭ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। লোকসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে সাত কোটি। ফলে খবরের কাগজের পাঠক সংখ্যাও ছিল অত্যন্ত সীমিত। গ্রামের সাধারণ মানুষ ঐ শাসনামলের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের কাহিনী জানতো নিজেদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা দিয়ে, সংবাদপত্র পড়ে নয়। তা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার সংবাদপত্র দলনের জন্য খড়গহস্ত হয়েছিলেন। তারা প্রতিদিন বলতেন যে, সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কিন্তু প্রতিদিনই সংবাদপত্রের উপর হামলা, সাংবাদিক নির্যাতন, গ্রেফতার চলছিল। আর অসহিষ্ণু সরকারপ্রধান একে ‘ফ্রি স্টাইল’ হিসেবে অভিহিত করে বলছিলেন, তথাকথিত প্রগতিবাদীরা সরকারের সমালোচনা শুরু করেছে। এদের সমালোচনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলে কুঠারাঘাত করেছে। কোনো সরকারই এটা সহ্য করবে না।
তারপর সংবাদপত্র দলনে শেখ মুজিবুর রহমান একের পর এক কালাকানুন জারি করতে থাকেন। একদিকে বলতে থাকেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর’। অপরদিকে পত্রিকা অফিসগুলোতে তালা লাগিয়ে, সম্পাদকদের গ্রেফতার করে সরকারের মন্ত্রীরা বলতে থাকেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বর্তমান সরকারের ঈমানের অঙ্গ’। সে সময় রাষ্ট্রপতির ৫০ নং ধারা জারি করা হয় চোরাচালানিদের গ্রেফতার করার জন্য। কিন্তু সেই ধারা বলে সাংবাদিকদের গ্রেফতার অভিযান পরিচালিত হতো। সংবাদপত্র দলনের এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট সরকার জারি করে ‘প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যা- পাবলিকেশন্স (রেজিস্ট্রেশন অ্যা- ডিক্লারেশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩’ নামে একটি গণবিরোধী কালাকানুন। অর্ডিন্যান্সটির উপর বক্তৃতাকালে তৎকালীন স্পিকার আবদুল মালেক উকিল বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রবিরোধী কোনো প্রকাশনা সহ্য করা হবে না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ এ বিলের উদ্দেশ নয়, তবে অন্যসব দেশের মতো সংবাদপত্রের যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধ থাকা বাঞ্ছনীয়’। ঐ বিলের উপর আলোচনাকালে জাসদের আবদুল্লাহ সরকার বলেছিলেন, ‘এই বিল আইয়ুব আমলে কালাকানুনের সমতুল্য। এর মাধ্যমে সরকারের গুণকীর্তন ছাড়া আর কিছুই সম্ভব নয়। রাষ্ট্রবিরোধী কিছু করলে জনগণই ঐ সংবাদপত্র প্রত্যাখ্যান করবে। আইনের দরকার হবে না’।
তারপর একে একে দেশে সংবাদপত্রবিরোধী বিভিন্ন কালাকানুন জারি হতে থাকে। সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য জারি করা হয়, ‘নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’। প্রতিদিন চলতে থাকে মিডিয়া অ্যাডভাইজ। এটা ছাপা যাবে, ওটা ছাপা যাবে না। বিজ্ঞাপনও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে সরকার। যাতে বিরোধী পত্রিকাগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। সত্য প্রকাশ করতে না পারে। এরপর ১৯৭৪ সালের ২০ নবেম্বর সংসদে পাস করা হয় ছাপাখানা ও প্রকাশনা বিল। তাতে বলা হয়, ‘যদি কোনো সংবাদপত্রে এমন কিছু প্রকাশ করা হয়, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইনের প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বা কোনো অপরাধ সংঘটনে কোনো ব্যক্তিকে প্ররোচিত করে অথবা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিঘিœত করে অথবা যেকোনো বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রীতির সম্পর্ক বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করতে পারবেন।’ বিলের উপর আলোচনাকালে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য আব্দুস সাত্তার বলেছিলেন, ‘এই আইনের বলে ইত্তেফাক বন্ধ হয়েছিল। দেশ হতে পাট পাচার, সার কারখানায় বিস্ফোরণ, বিদেশী ব্যাংকে মন্ত্রীদের অর্থ জমানোর খবর যাতে কেউ ছাপতে না পারে, তার জন্যই এই আইন’। এত কিছুর পরও সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাই ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন জারি করেছিলেন, ‘সংবাদপত্র ডিক্লারেশন বাতিল অধ্যাদেশ’। ঐ অধ্যাদেশের ফলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চারটি সংবাদপত্র রেখে দেশের বাকি সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়। এর আগেই সরকার এমনকি কবিতা লেখার স্বাধীনতাও হরণ করে নিয়েছিল।
আসলে মিডিয়া বা সংবাদপত্র সরকারের চোখ হিসাবে কাজ করে। এর মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য করণীয় সম্পর্কে সরকার অবহিত হতে পারে এবং জনকল্যাণের পদক্ষেপ নিতে পারে। জানতে পারে গোটা দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি। কিন্তু মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সরকার আসলে নিজেদের চোখে নিজেরাই অন্ধত্বের ঠুলি পরে দেশ ও জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটতে যাচ্ছে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন