বর্তমান আ’লীগ সরকারের আমলে, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, জজ, ব্যারিস্টার, উকিল, মুক্তার, সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি সরকারদলীয় লোকেরা যেন সকলেই রাজা! সরকার বা সরকারি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট নন এমন সব লোকেরাই শুধু এদেশে এখন প্রজা। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারদলীয় নেতা-কর্মী বা সমর্থক সকলেরই যেন ভাবখানা এমন।
ফখরুদ্দিন-ম ইউ আহমদের অবৈধ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন! কোন কোন কেন্দ্রে আ’লীগের পক্ষে শতভাগেরও বেশি ভোট পড়েছিল! ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীতিনির্ধারক ও তৎকালীন সেনা প্রধান ম ইউ আহমদ সে সময়ে ভারত সফরে গেলে ভারত সরকার তাকে ৬টি ঘোড়া উপঢৌকন দিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে যে, সে সকল ঘোড়ার দাপটেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দেশের অনেক জায়গায় শতভাগেরও বেশি ভোটার আ’লীগকে ভোট দিয়েছিল! আ’লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট ২৬৩ আসনের বিপুল বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করার পর দেশে শুরু হয় যতো সব অঘটন।
অঘটন যেখান থেকে শুরু। হাইকোর্টে মামলা হয়েছিল মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে। রায় হলো পঞ্চম সংশোধনী বতিল। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে এর মাধ্যমে ত্রয়োদশ সংশোধনীও বাতিল করা হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে এমন রায় এসেছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। যে রায়ের ফলে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চলে আসা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোটের উকিল-মুক্তার-ব্যারিস্টার কারোরই কোন কথায় কর্ণপাত করেননি।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ব্যাপারে টেকনোক্রেট কোঠার তখনকার আইন মন্ত্রী বলেছিলেন “সুপ্রিম কোর্ট কোন বিষয় অবৈধ ঘোষণা করলে সংসদে বসে তিনশত এমপি কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে হ্যাঁ বললেও তা বৈধ হবে না”। কারণ সুপ্রিম কোর্ট যে কোন সময় সংসদের (হ্যাঁ বলা বা পাস করা) যে কোন বিষয়কে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে; যেমন করেছে! মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে করা মামলায়, রায় দিয়েছে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী অবৈধ অতএব, এটা বাতিল।
এখন প্রশ্ন হলো যে সংসদ আইন প্রণয়ন করে সে সংসদ বড়? না যে কোর্ট সংসদের তৈরি করা আইনের প্রয়োগ করে সে কোর্ট বড়? তবে হ্যাঁ, কোন এক অশুভশক্তির ইশারায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে দেয়া হয়েছে। যার ফলে ২০১৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারির কথিত প্রহসনের নির্বাচনের কথা বলে ১৫৩ জন অনির্বাচিত দলীয় ক্যাডারকে সাথে নিয়ে অনৈতিকভাবে আ’লীগ আবারো সরকার গঠন করেছে। এ যেন গায়ে মানে না আপনি মোড়ল! এ হেন অবস্থায় আ’লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক সকলেই যেন দেশের রাজা-মহারাজা। কেউ কাউকে মানছে না, কোথাও কেউ কাউকে কোন প্রকার ছাড় দিচ্ছে না। দেশের সর্বত্রই চলছে নেতৃত্বের কোন্দল, দখল বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তার ইত্যাদি।
আ’লীগের নেতৃত্বের কোন্দল, দখল বাণিজ্য আর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দেশে চলছে খুন, গুম আর অপহরণ। নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, যশোর আর ঢাকার মিরপুরের খুনের ঘটনার পেছনেও এসব কারণই বর্তমান। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তের কথিত বড় ভাই নারায়ণগঞ্জের গডফাদারকে বাঁচাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে তার পক্ষে সাফাই গাইলেন, যা দেশের মানুষের প্রত্যাশার প্রতিকূল!
মিরপুরের ১০ হত্যাকা-ের ঘটনায়ও প্রধানমন্ত্রী মোল্লা পরিবারেরই পক্ষ নিয়েছেন। যার ফলে ঘটনার সাথে জড়িত এমন কেউ এখনো গ্রেফতার হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নীতিগত কারণেই সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিচ্ছেন বলে রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করছেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী ভালো করেই জানেন যে, তিনি বা তার দল ২০০৮ ও ২০১৪ সালে কিভাবে ক্ষমতায় এসেছেন। যাদের সহযোগিতায় আ’লীগ ক্ষমতায় এসেছে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা এটা অনৈকিত বলে প্রধানমন্ত্রী মনে করেন। যার ফলে ক্ষমতায় আসার পদ্ধতির কারণেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে র্যাব-পুলিশসহ আরো যারা সহযোগিতা করেছে তাদের যে কোন অপরাধ আমলে নেয়া যাচ্ছে না। আর গডফাদারদের তো সাথে রাখতেই হবে।
শুধু কি তাই! দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোসহ দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষের প্রত্যাশার প্রতীক পদ্মা সেতু একজন আবুল মন্ত্রী বঙ্গপোসাগরে ডুবালেন আর প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে তার পক্ষে সাফাই গাইলেন ও সততার জন্য আবুল মন্ত্রীকে উত্তম চারিত্রির সনদপত্রও দান করলেন! আর এক মন্ত্রী আবুল মাল! শেয়ার বাজার কেলেংকারীতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলো। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল হেন ভাষা নেই যা তিনি শেয়ার ব্যবসায়ীদের জন্যে প্রয়োগ করেননি। তার বক্তব্য হলো তিনি শেয়ার বাজার বুঝেন না। তার শেষ ডায়লগ হচ্ছে শেয়ার মার্কেট ও শেয়ার ব্যবসায়ীরা ‘রাবিশ’। যিনি অর্থমন্ত্রী হয়ে দেশের শেয়ার বাজার বুঝবেন না তিনি কেমন অর্থমন্ত্রী? তার এহেন কা-জ্ঞানহীন বক্তব্যের কারণে লোপাটকারীরা আরো সুযোগ করে নিয়েছিল। শেয়ার ব্যবসায়ীদের কাছে তিনি ‘রাবিশ’ মন্ত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেন। তার কা-জ্ঞাহীন ও অনর্থক কথাবার্তার জন্যে পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নির্বিকার! অর্থমন্ত্রী ছিলেন অনড়। ভাবখানা যেন, হাম কি হনুরে! আর অন্যদেরকে ভাবছেন, তুম কোন হে?
বর্তমান সরকারের আমলে আ’লীগের লোকেরা ছাড়াও যুবলীগ আর ছাত্রলীগ টেন্ডার বাণিজ্য থেকে শুরু করে হত্যা, গুম, খুন আর অপহরণসহ ছাত্র, শিক্ষক, আমলা, সেনা সদস্য, বিজিবি আর পুলিশ সদস্য এমন কেউ নেই যাদেরকে তারা পিটায়নি বা এমন কোন অঘটন নেই যা তারা ঘটায়নি। কারণ ছাত্রলীগ মনে করছে এ রাজার (শেখ হাসিনার) রাজত্বে তারা এখন সবাই রাজা! পুলিশই বা এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন? তাইতো পুলিশ সাধারণ মানুষকেতো বটেই জজ সাহেবকে পিটাতেও তারা পরোয়া করেনি। পুলিশও তো একই রাজার রাজত্বে বাস করছে, তাই তারাও রাজাতো হবেই!
আ’লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৭ হাজার ১৯৮টি মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচ হাজারেরও বেশি ফৌজদারী মামলা ও পাঁচ শতাধিক খুনের মামলা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৮টি মামলাসহ আরো আছে অস্ত্র মামলা, বিস্ফোরক আইনে মামলা, চুরি, ডাকাতি, কালোবাজারি, ধর্ষণ, দুর্নীতি, অপহরণ, আত্মসাৎ, জালিয়াতি, ঘুষ লেনদেন ইত্যাদি।
২২ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও খুনিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া মৃত্যুদ- রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলার প্রায় একলাখ আসামীকে রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তি দেয়া হয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছর পর্যন্ত দেশে প্রায় ২২ হাজার হত্যাকা- ঘটেছে। এর মূল কারণ হত্যাকারীদের সাজা না হওয়া, খুনের আসামীসহ সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তি পাওয়া ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি।
আ’লীগ সরকারের মামলা প্রত্যাহারের এই হিড়িকে হত্যাকা-ের মতো অপরাধের মামলাও তুলে নেয়া হয়েছে আর হত্যাকারীদেরও ক্ষমা করা হয়েছে। এর মধ্যে চার্জশিট দাখিল, জজকোর্টে চলমান এমনকি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলা থেকেও ব্যক্তি বিশেষকে রেহাই দেয়া হয়েছে সরকারের এই প্রক্রিয়ার আওতায়। এই প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রীর যুক্তি ছিল, মামলাগুলো জোট সরকারের আমলে ‘হয়রানিমূলকভাবে’ দায়ের করা হয়েছিল। যদিও এসব মামলার মধ্যে মইনউদ্দীন-ফখরুদ্দিনের আমলের অনেক মামলাও প্রত্যাহার করা হয়।
সার্বিকভাবে চিন্তা করলে একটা জিনিস সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, যেখানে নীতি-নৈতিকথা বলতে কিছু থাকে না সেখানে যে যা খুশি তাই করবে এটাই স্বাভাবিক। রাজা নীতি কথা শোনাবেন অথচ তিনি নীতির তোয়াক্কা করবেন না এমন হলে তো দেশের সকলেই রাজা বনে যাবেন এটাই নিয়ম। মুখে বলবেন আমি মানুষের দুঃখ-কষ্ট সইতে পারি না আর হাজারটা মামলা দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বা সাধারণ মানুষকে জেলে পুরে রাখবেন, কাউকে নিজ বাড়িতে ঘুমাতে দেবেন না আর প্রজারা মুখ বুজে তা সইতে থাকবে এটা হয় না হতে পারে না। দেশে রাজা যে চরিত্রের হবেন তার রাজ্যের একই চরিত্রে প্রজারা তাকে অনুসরণ করবে।
সরকার সমর্থিত ‘সময় টিভি’র সম্পাদকীয় অনুষ্ঠানে গত ২৮ জুন ২০১২ ইং রাত ১০টায় বিমান ও পর্যটন কর্পোরেশন সম্পর্কীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বামপন্থী নেতা মইনুদ্দিন খান বাদল এমপি সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ করে বলেছেন যে, রাষ্ট্রের বা সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সকল স্তরের লোকেরা চৌর্যবৃত্তির সাথে জড়িত। তিনি দায়িত্ব নিয়েই বারবার বলেছেন, যদি সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সকল স্তরের চুরি বন্ধ করা যায় তাহলেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বা সফলতার মুখ দেখবে। তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের বর্ণনাও দিয়েছিলেন। তার মতে সে সময় বিমানের নয় হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এখানেও বিমান মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিমান অফিসের পিয়ন ঝাড়–দার পর্যন্ত সকলেই যেন এখানকার এক একজন রাজা।
প্রধানমন্ত্রী নিজকে রাজা ভাবতে পারেন। কারণ (১) তিনি রাষ্ট্রীয় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। (২) তিনি যা খুশি তা-ই করেন, যখন যাকে খুশি রাষ্ট্রপতি বানান, মন্ত্রী বানান, এমপি বানান, সচিব বানান, জজ বানান এমনকি উকিলও বানান। (৩) তার কথায় রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে অন্য সব মন্ত্রী, এমপি, আমলা, জজ, ব্যারিস্টার, উকিল, মুক্তার, সরকারি ও আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি সরকারদলীয় লোকেরা উঠবস করে। (৩) তার পিতা বাংলাদেশের জনক! (৪) তিনিই একমাত্র কুলীন বাকি সব নমশূদ্র! ইত্যাদি।
এমন মনোভাব বা মনোবৃত্তি নিয়ে দেশ চালালে দেশে শান্তি আসতে পারে না, যদিও যে কেউ নিজকে শান্তির দূত হিসেবে পেশ করেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাজার মনোভাব নিয়ে রাজ্য শাসন নয়, আল্লাহকে ভয় করে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আগে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হযরত ওমর তাঁর বিশাল সা¤্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আগে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হযরত ওমর আল্লাহকে কতটা ভয় করতেন আর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কেমন ইনসাফের চিন্তা করতেন, তাঁর নি¤েœাক্ত বক্তব্যে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘ফোরাত নদীর তীরেও যদি একটি কুকুর না খেয়ে মারা যায়, আমি ওমরকে হাশরের দিন আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে’।
গাজী মুহাম্মদ শওকত আলী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন