বিষয়বস্তু হিসেবে বাজেটের চাইতে রসকসহীন আর কিছু যে হতেই পারে না সে কথা নিশ্চয়ই বলাবাহুল্য। জীবনে যতবার এই বাজেট নিয়ে লিখতে বসেছি ততবার ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েছি। বিরক্ত এখনো না হয়ে পারি না। কিন্তু উপায় নেই, যেহেতু রাষ্ট্রের শুধু নয়, বিষয়টি প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সেহেতু বাজেটকে আবার পাশও কাটানো যায় না। সে কারণে ৫ জুন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ‘নির্বাচিত’ আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার যে বিশাল বাজেট পেশ করেছেন সে বাজেটের কিছু দিক নিয়ে সংক্ষেপে হলেও কিছু কথা বলতেই হবে। কিন্তু তারও আগে একই সরকারের আরেক কীর্তিমান মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের একটি মন্তব্য স্মরণ করা দরকার। পাঠকদেরও মনে পড়তে পারে, গত অর্থবছরের বাজেট পেশ করার পরপর অর্থমন্ত্রীকে সোজা ধোলাই করেছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী। ২০১৩ সালের ২৭ জুন ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রীর নাকি ‘মেমোরি ডাউন’ হয়ে গেছে! সহজ বাংলায় কথাটার অর্থ দাঁড়ায়, মিস্টার মুহিতের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। বয়সের ভারে অনেক সময় কথার খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। ঠিকমতো কিছু মনেও রাখতে পারেন না। সেজন্যই অর্থমন্ত্রী নাকি পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। উল্লেখ্য, এর আগেরদিন অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হলেও ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা যাবে কিনা, সে ব্যাপারে তার সন্দেহ রয়েছে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, সরকার ‘টাইট শিডিউলের’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলেই তিনি ‘নিশ্চিত’ নন। অমন মন্তব্যের জবাবেই তেড়ে উঠেছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী। অনেকাংশে শেখানোর সুরে বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রী নিজের মন্ত্রণালয় সম্পর্কে কথা বলুন এতে আপত্তি নেই। কিন্তু অন্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে তিনি এভাবে বলতে পারেন না। তাছাড়া এটা সেতু বিভাগের টেকনিক্যাল কমিটির বিষয়। সে কমিটিই শুধু বলতে পারে। এ পর্যায়ে এসেই অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে তামাশা করেছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী। বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রীর বয়স হয়ে গেছে, তার ‘মোমোরিও ডাউন’ হয়ে গেছে। মিস্টার মুহিতের বিরুদ্ধে অতিকথনের অভিযোগও এনেছিলেন ওবায়দুল কাদের।
আমাদের অবশ্য ওবায়দুল কাদেরের মতো সৎসাহস নেই। তাছাড়া গুম ও খুন ধরনের কর্মকা-ের কারণে ভয়ভীতি তো রয়েছেই। সে কারণে ব্যক্তি মুহিতের গুণকীর্তন করার পরিবর্তে সরাসরি বাজেট নিয়ে আলোচনায় যাওয়াটাই নিরাপদ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে আলোচনার আগে বলা দরকার, লাফিয়ে বেড়ে চলা পণ্যমূল্যের চাপে মানুষের জিহ্বা বেরিয়ে এলেও সরকার এবারও যথারীতি মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ফলে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করার আগেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছেও কয়েকদিন আগে থেকে। শুধু তা-ই নয়, এবারও ব্যবসায়ীরা দাম হাঁকাচ্ছেন যথেচ্ছভাবে। অথচ নিয়ম হলো অর্থমন্ত্রী প্রথমে সংসদে প্রস্তাব আকারে বাজেট পেশ করবেন। সে প্রস্তাবের নানাদিক নিয়ে সংসদ সদস্যরা আলোচনা করবেন। সবশেষে ৩০ জুন বা তার দু-একদিন আগে বাজেট প্রস্তাব পাস হবে। যদি বাড়ানো হয়, তা হলে পণ্যের দাম বাড়বে ১ জুলাই থেকে। কোনো কোনো পণ্যের এমনকি দাম কমারও সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে আমাদের দেশে বাজেট আসছে কথাটা প্রচারিত হতে না হতেই ব্যবসায়ী-মহাজনরা দাম বাড়ানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন। এ নিয়ম চলে আসছে বহুদিন ধরে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সেটা আরও দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে এজন্য যে, ব্যবসায়ী-মহাজনদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের লেনদেনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সোজা কথায়, ব্যবসায়ী-মহাজনদের কাছ থেকে চাঁদা ও কমিশন আদায় করা হয় বলে সব জেনেও সরকার একদিকে চোখ বুঁজে থাকে, অন্যদিকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ব্যবসায়ী-মহাজনরা। মাঝখান থেকে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা যায়, তাদের জিহ্বা বেরিয়ে আসে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি, বরং সরকার ও ব্যবসায়ী-মহাজনসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্যের নাম বলা যাবে না, যার দাম লাফিয়ে না বেড়েছে।
কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হলো, জনগণের এই কঠিন দুর্দশার মধ্যেও ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের চেহারায় কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। তারা বরং ষষ্ঠবারের মতো বাজেট দিতে পারার সাফল্যে উল্লসিত অবস্থায় আছেন। অর্থমন্ত্রীর কথা তো বলাই বাহুল্য। কারণ বাংলাদেশের মতো গরিব একটি দেশে তিনি এবার ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বিশাল এক বাজেট নিয়ে হাজির হয়েছেন। এত অর্থ তিনি ঠিক কোন ধরনের কতগুলো খাত থেকে জোগাড় করবেন সে প্রশ্ন তো রয়েছেই, ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকার ঘাটতি রাখার মধ্য দিয়েও তিনি গভীর সংশয়ের সৃষ্টি করেছেন। মূল্যস্ফীতির মতো অনিবার্য কিছু বিষয়ও রয়েছে, যেসব বিষয়ে সত্য এড়িয়ে যাওয়ার এবং মিথ্যা আশ্বাস দেয়ার ব্যাপারে মিস্টার মুহিত আগেই রেকর্ড করে রেখেছেন। যেমন ২০১১-১২ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার যেখানে ছিল ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ সেখানে অর্থমন্ত্রী শুনিয়েছেলেন ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশের কথা। পরবর্তীকালেও তথ্য-পরিসংখ্যান দেয়ার ক্ষেত্রে সত্য এড়িয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু এসব বিষয়ে মোটেও নজর নেই অর্থমন্ত্রীর। তিনি বরং বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানোর আয়োজন করেছেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি আয়ের পরিমাণও যখন কমতে থাকবে মানুষ, তখন কীভাবে বেশি বেশি পরিমাণের টাকা কর দেবে এবং করের পরিমাণ না বাড়লে সরকারই বা প্রকল্প বাস্তবায়নসহ ব্যয় মেটানোর অর্থ কোথায় পাবেÑ এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই বাজেটে। আরো অনেক মৌলিক প্রশ্নেরও জবাব দেননি অর্থমন্ত্রী। এসব বিষয়ে পরবর্তী সময়ে নজর দেয়া যাবে। কিন্তু যে কথাটা না বললেই নয় তা হলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেন্ডার বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা পর্যন্ত নানা ধরনের কেলেঙ্কারি অপ্রতিহতভাবে বেড়ে চলেছেÑ যার ফলে বহু প্রকল্পই অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। গত অর্থবছরের অনেক প্রকল্পও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কিন্তু এসব বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি রয়েছে বিপুল পরিমাণে রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক সাহায্য ও রফতানি আয় কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো। রয়েছে গার্মেন্ট খাতের বিরাট বিপর্যয়ও। অন্যকিছু কারণেরও উল্লেখ করা দরকার। যেমনÑ লম্বা অনেক আশ্বাস শুনিয়ে ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ সরকার এখনও গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ জ্বালানির সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে পণ্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে শিল্পপতিরা লোকসান সামাল দেয়ার জন্য পণ্যের দাম না বাড়িয়ে পারেননি। কথা শুধু এটুকুই নয়, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারলেও সরকার দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোল, অকটেন ও সিএনজিসহ জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে বাহাদুরের মতো। ফলে উৎপাদন ব্যয় তো বটেই, পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে গেছে যথেষ্ট পরিমাণে। সবকিছুর জন্যই শেষ পর্যন্ত বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনাতেও সরকার ক্ষতিকর ব্যর্থতা দেখিয়ে এসেছে। এজন্যই বলা দরকার, চারদিকে শুধু নেই আর নেই-এর মধ্যেও এত বিশাল আকারের বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী চমক সৃষ্টি করেছেন সত্য; কিন্তু জনগণকে মোটেও আশান্বিত করতে পারেননি। জনগণ বরং ভীষণভাবে হতাশ ও ভীত হয়ে পড়েছে।
এসব কারণেই বাজেটে অর্থের পরিমাণ বাড়ানোর পরিবর্তে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়াটাই অর্থমন্ত্রীর কর্তব্য ছিল। অন্যদিকে নিজে বিরাট বপুর মানুষ বলেই কিনা সেটা একটি প্রশ্ন বটে, তবে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম থেকেই বিরাট বপুর বাজেট পেশ করে চলেছেন জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত। লক্ষ হাজার কোটি টাকার নিচে কথাই বলেন না তিনি! এবার তো টাকার পরিমাণের দিক থেকে রেকর্ডই করেছেন অর্থমন্ত্রী। সংসদে দেয়া বাজেট বক্তৃতায় যথেষ্ট বাগাড়ম্বর করলেও অর্থমন্ত্রী কিন্তু তাই বলে মানুষের মনে মোটেও আস্থা সৃষ্টি করতে পারেননি। একটি কারণ হিসেবে এসেছে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকার ঘাটতির প্রসঙ্গ। বস্তুত বিরাট বপুর বাজেটের মধ্যে ঘাটতির পরিমাণও বিরাটই। প্রথম ধাক্কাটাও খেতে হয়েছে এখানেই। কারণ টাকার খবর নেই তবু মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর কসরত করেছেন অর্থমন্ত্রী। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, ঘাটতি পূরণের জন্য কল্পিত ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা যদি জোগাড় না করা যায়, তা হলে কীভাবে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবে সরকার? টাকা জোগাড়ের সম্ভাব্য খাতগুলোও লক্ষ্য করার মতো। যেমনÑ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ঘাটতি পূরণের জন্য বৈদেশিক সূত্র থেকে নাকি আসবে ২৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা! অথচ বৈদেশিক সাহায্য হিসাবে এত বেশি পরিমাণ অর্থ পাওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই বাংলাদেশের। তারওপর আবার পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা কেলেঙ্কারির কারণে অনেক আগেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে বিদেশীরা। ঘাটতির বাকি ৪৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা নাকি আসবে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খাত থেকে, যার মধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকাই সরকার ঋণ নেবে ব্যাংকিং খাত থেকে। সরকারের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়াটা স্বাভাবিক হলেও মুহিত সাহেবরা প্রথম থেকে সীমা তো ছাড়িয়েছেনই, রেকর্ডও করে ফেলেছেন। ২০১২-১৩ অর্থবছরেও তারা ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন। অথচ ওই বাজেটে ব্যাংক ঋণের প্রাক্কলনই ছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। ঋণের সুদও সরকারকে যথেষ্টই গুনতে হয়েছে। এদিকে সরকার একাই ব্যাংক থেকে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার ফলে ব্যাংকগুলো তো বিপন্ন হচ্ছে এবং হতে থাকবেই, দেশের অর্থনীতিও মারাত্মক বিপর্যয়ের অতলে হারিয়ে যাবে। কারণ সরকার বিপুল ঋণ নেয়ায় একদিকে ব্যাংকগুলোকে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদের বিনিময়ে কলমানি মার্কেট থেকে টাকা ধার করতে হয়েছে, অন্যদিকে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাননি বললেই চলে। ফলে নতুন বিনিয়োগ হয়নি, অনেকের পুরনো ব্যবসাও লাটে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের রফতানি খাত। টাকা না পাওয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। সে অনুপাতে কমেছে রফতানি আয়ও। এজন্যই শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন এবং এ কথাই সত্য যে, সরকারের নেয়া ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো চাইলেও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে পারবে না। ফলে নতুন শিল্প-কারখানা তো স্থাপন করা যাবেই না, অনেক বেশি সুদে ঋণ নিতে হবে বলে পুরনোগুলোকেও ধুঁকে ধুঁকে চলতে হবে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয়ও লাফিয়ে বাড়তে থাকবে। আর এজন্য পকেট কাটা যাবে সাধারণ মানুষের।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথায় অবশ্য পেরে ওঠা মুশকিল। যেমন সমাধানের একটি পথ বাতলাতে গিয়ে তিনি আগেভাগেই বলে রেখেছেন, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে না থেকে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা যদি বিদেশ থেকে ঋণ এনে সেই অর্থ দেশে বিনিয়োগ করেন তাহলে অর্থনীতির বিপদ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে। অর্থাৎ সরকারের নিজের হাতে বিপদ কাটিয়ে ওঠার কোনো বিশেষ পথ বা উপায় নেই। এজন্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে হবে কিছু ‘যদি’ ও ‘তবে’র ওপরÑ ‘যদি’ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে ঋণ এনে সে ঋণের অর্থ শিল্পে বিনিয়োগ করেন ‘তাহলে’ সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও হতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই ‘যদি’ও কিন্তু সর্বতোভাবেই অনিশ্চয়তাপূর্ণ। কারণ শিল্প-কারখানা স্থাপনের পরিবর্তে বিশেষ করে কালো টাকার মালিকরা বিনিয়োগও বেশি করেন আমদানি-রফতানি ধরনের বিভিন্ন ট্রেডিং-এ, যার মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয় না। তাছাড়া ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে ঋণ আনতে চাইবেন কিনা, তারা চাইলেই বিদেশীরা দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের অধীনস্থ কোনো দেশের ব্যবসায়ীদের ঋণ দেবে কিনা এবং দিলেও ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ উৎপাদনশীল ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতগুলোতে বিনিয়োগ করা হবে কিনা এ ধরনের অনেক প্রশ্নই রয়েছে। সরকার যেহেতু কিছু ‘যদি’ ও ‘তবে’র ওপর ভরসা করে বসে আছে সেহেতু বিনিয়োগ ও চাকরির ব্যাপারে আশা করার কিছু নেই বললেই চলে। ফলে আগামী অর্থবছরেও অর্থনৈতিক সঙ্কট মারাত্মকই হবে। এভাবে খাত ধরে ধরে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, মুহিত সাহেবরা কেবল বাজেট পেশ করেই ‘খালাস’ হয়ে গেছেন। ওদিকে পকেটের সঙ্গে মানুষের গলাও যে কাটা হচ্ছে এবং কাটা হতে থাকবে সেসব দিকে নজরই নেই তাদের।
সংসদে দেয়া বাজেট বক্তৃতায় শুধু নয়, তার আগের বিভিন্ন উপলক্ষেও যথেষ্টই শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এসব বক্তব্যে বাজেট প্রস্তাবের পক্ষে সাফাই-ই কেবল গাননি, এমন আরো কিছু কথাও বলেছেন যেগুলো সমালোচনার ঝড় তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরাও ব্যাখ্যা সহকারে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাজেটটি অবাস্তব কল্পনার ফসল। অর্থাৎ এর বাস্তবায়ন করা অন্তত বর্তমান সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক কারণের মধ্যে তারা বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও ঠিকাদার নামধারীদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে একটি প্রধান বিষয় হিসেবে এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কথা বলেছেন। এই খাতে ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। বলা হচ্ছে, এসব বরাদ্দের প্রধান উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগের নির্বাচনী তহবিল স্ফীত করা। আর স্ফীত করার কাজটুকু যেহেতু নেতা-কর্মীরাই করবে সেহেতু তাদের পকেটও খুব অল্প সময়ের মধ্যে ফুলে-ফেঁপে উঠবে। বলা দরকার, এমন মন্তব্যের কারণও বর্তমান সরকারই তৈরি করেছে। বিগত অর্থবছরগুলোতে দেখা গেছে, অবকাঠামো ও পল্লী উন্নয়নের জন্য নানা বাহারী নামে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পের হাজার হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগই দলীয় লোকজনের পকেটে ঢুকেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে খয়রাতি চাল, গম ও নগদ অর্থ নিয়ে হরিলুটের প্রতিযোগিতায় নেমেছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। সারা বছর বসে থাকার পর সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার প্রাক্কালে এসে হঠাৎ তারা তৎপর হয়ে ওঠে এবং প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে দেখিয়ে মে মাসেই চাল, গমসহ বরাদ্দকৃত অর্থ তুলে নেয়। বলাবাহুল্য, সব কাজেরই ঠিকাদারি পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। তাদের কারণে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলেও টাকার ‘শ্রাদ্ধ’ কিন্তু প্রতিবারই হয়েছে। এজন্যই বলা হচ্ছে, এবারের বাজেটেও আওয়ামী লীগের কর্মীদের পকেট ভারি করার ব্যবস্থা করেছেন অর্থমন্ত্রী।
এভাবে খাত ধরে ধরে আলোচনা করলে দেখা যাবে, এই বাজেট কোনোদিক থেকেই সাফল্যের কাছাকাছি যেতে পারবে না। এই না পারার প্রকৃত কারণ হলো, বাজেটের উদ্দেশ্য সমৃদ্ধি বা মন্ত্রীর কথানুযায়ী ‘জনতুষ্টি’ অর্জন নয়, জনগণের স্বার্থ দেখাও নয়, নানা চটকদার কথার আড়ালে নিজেদের পকেট এবং দলের তহবিল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েই এবারের বাজেট তৈরি করেছেন অর্থমন্ত্রী। সে কারণে ‘হরিলুট’ এবং টাকার ‘শ্রাদ্ধ’ করা কাকে বলে জনগণকে তা টের পেতে হবে হাড়ে-হাড়েই!
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন