অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত গত ৪ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটের খসড়া প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২০১৪-১৫ সালের বাজেটের মোট আকার হচ্ছে ২৫০,৫০৬ কোটি টাকা, যা বিগত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৩৪ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা বেশি। বাজেটে রাজস্ব ও বিদেশী অনুদান বাবদ আয় ধরা হয়েছে ১৮৯১৬০ কোটি টাকা, যা বিগত বছরের তুলনায় ২৬৫৩৩ কোটি টাকা বেশি। এতে উন্নয়ন বহির্ভূত রাজস্ব ও মূলধন ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে যথাক্রমে ১৫৪,২৪১ কোটি ও ২৬,০১০ কোটি টাকা অর্থাৎ সর্বমোট ১৮০,২৫১ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত ব্যয়ের মধ্যে দেশী-বিদেশী ঋণের ওপর পরিশোধযোগ্য সুদের পরিমাণ ধরা হয়েছে যথাক্রমে ২৯,৩০৫ কোটি ও ১৭৩৪ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট ৩১০৩৯ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় মোট বাজেটের ১২.৪%। পক্ষান্তরে সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে বাজেটের ৬.১ শতাংশ। দেশীয় ঋণ এবং অগ্রিম বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬১১ কোটি টাকা। আবার বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এর অর্থ হচ্ছে, দেশী-বিদেশী ঋণ, এর কিস্তি এবং সুদ বাবদ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারকে সর্বমোট ৪৯১০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এর সাথে যদি উন্নয়ন বহির্ভূত রাজস্ব ও মূলধন ব্যয় যোগ হয় তাহলে বাজেটে অনুৎপাদনশীল মোট বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ২২৯,৩৫১ কোটি টাকা। মোট বাজেট থেকে এই অর্থ বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে মাত্র ২১২৫৫ কোটি টাকা। এ প্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রীর এই বিশাল বাজেট দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং পেনশনসহ খাতভিত্তিক সম্পদ বিভাজনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সরকার জনপ্রশাসনকে বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ১৫.৩ শতাংশ। এর পরেই এসেছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি (১৩.১%)। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধ (১২.৪%)। পরিবহন ও যোগাযোগ পেয়েছে ৯.৮ শতাংশ, কৃষি ৭.৬%, স্থানীয় সরকর পল্লী উন্নয়ন ৭.১, প্রতিরক্ষা ৬.৬, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ ৬.১, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ৪.৬, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ৫.০ এবং স্বাস্থ্য ৪.৪%। এবার বাজেটের অন্যতম অবহেলিত খাত হচ্ছে গৃহায়ণ, এখানে বরাদ্দের পরিমাণ ০.৮%। সম্পদ বিভাজনে জনপ্রশাসন ও জনশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ এক করলে দেখা যায় যে, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এ দুটি খাতের সম্মিলিত বরাদ্দের হার হচ্ছে ২০.৩ শতাংশ। জনগণকে শাসন এবং র্যাব পুলিশ দিয়ে অবদমন ছাড়া এ দুটি খাতের দ্বিতীয় কোনো লক্ষ্য আছে বলে সরকারের গত ছয় বছরের আচরণে তা প্রমাণিত হয়নি। এই অর্থে বাজেট দেশকে একটি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবার আশঙ্কা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
বাজেটের অর্থায়নের দিক পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এ খাতে দেশী-বিদেশী ঋণের পরিমাণই ধরা হয়েছে ৬৯৭৯৬ কেটি টাকা। পূর্ববর্তী বছর এর পরিমাণ ছিল ৫৩৫৯৫ কোটি টাকা। সরকার এই বছর ব্যাংকিং খাত থেকে ৩১২২১ কোটি টাকা ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ ১৯৮২৪ কোটি, স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাবদ ১১৩৯৭ কোটি এবং ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে নিট ১২০৫৬ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করেছে। বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৬৭৫৫২ কোটি টাকা যার কার্যকর সংস্থানের কোনো দিকনির্দেশনা এতে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৭.৩ শতাংশ অর্জিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বিগত বছরসমূহে পরিবেশ অনুকূল থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাত বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, মূলধন ঘাটতি এবং সরকার কর্তৃক বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণের ফলে বেসরকারি খাত বিনিয়োগযোগ্য মূলধন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ কখনও অতিক্রম করেনি। যদিও পরিসংখ্যানের কাঠামো পরিবর্তন করে সরকার তার ব্যর্থতা ঢাকার জন্য প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি প্রদর্শন করেছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহ এর প্রতিবাদও করেছে। কিন্তু সরকার তার অবস্থান থেকে নড়েনি।
ইতোমধ্যে বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় অর্থনৈতিক বিশ্লেষকবৃন্দসহ পেশাজীবী, ব্যবসায়িক সংস্থাসমূহ এ বাজেটকে শুধু উচ্চাভিলাষী নয়, অবাস্তব বলেও আখ্যায়িত করেছেন। বাজেটের মূল সূচকসমূহকে অত্যন্ত দুর্বল আখ্যায়িত করে রাজস্ব আয়, জিডিপি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক অনুদানের প্রাক্কলন প্রভৃতিকেও তারা নড়বড়ে বলে অভিহিত করেছেন। সংস্কার ও সুশাসন নিয়ে অর্থমন্ত্রী অনেক কথা বললেও আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিষয়ে তার বক্তব্য নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানী প্রতিষ্ঠানসমূহে তিনি ভর্তুকি বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। এ প্রস্তাব অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিকে পুরস্কৃত করবে।
বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একটি জনবহুল দেশ এবং জনসংখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেটের আকারকে খুব বেশি বড় বলার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের সামর্থ্যরে। এ সামর্থ্য যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠা এবং আর্থিক সংগতির। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের পরিমাণ হচ্ছেÑ ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর বাস্তবায়ন নিয়েও জনমনে বহু প্রশ্ন রয়েছে। এ অবস্থায় এক লাফে বাজেটের আকার ১৫.৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় উত্তরণ জাতিকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এ বাজেট কার জন্য? ভাগাভাগি করে লুটপাটের জন্য, নাকি অন্যকিছু। গত কয়েক বছর ধরে সরকারি খাতে লুটপাটের যে মহোৎসব চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা সহজেই বলা চলে যে, এ বিশাল বাজেট সরকার, সরকারের অনুগ্রহভাজন কর্মকর্তা এবং সরকারি দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি ও আত্মসাতের একটা মহা সুযোগ এনে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তথা এডিপি বরাদ্দ হচ্ছে উন্নয়ন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একমাত্র সরকারি হস্তক্ষেপ। এ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকার উন্নয়ন কর্মকা-কে উজ্জীবিত করে এবং মানুষের জীবনযাত্রা-প্রণালীর উন্নয়ন ঘটায়। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা কি দেখতে পাই? গত কয়েক বছর ধরেই এডিপির অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বছরের প্রথম নয়-দশ মাস এর জড় ও আর্থিক অগ্রগতি ৩০-৩৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও সরকার তা বাড়াতে পারে না। কিন্তু বছর সমাপ্তিতে এসে তা হঠাৎ ৯০ শতাংশের ওপর চলে যায় এবং অর্থও দেদারসে ব্যয় হয়। এর রহস্য কি? সারা বছর কাজ করা ও অগ্রগতি প্রদর্শনের যাদের সামর্থ্য থাকে না, বছর শেষে হঠাৎ করে তারা সিংহের বলে বলীয়ান হয়ে যান কেমন করে? এর মূল রহস্য হচ্ছে দুর্নীতি ও অর্থের অপচয়। প্রতি বছরই এ ঘটনা ঘটে আসছে এবং প্রস্তাবিত বাজেটের বেলায়ও এর কোনো ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। এখানে সরকারি ব্যয়ের যেমন মান নেই, তেমন কাজেরও কোনো মান নেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ভোটারবিহীন পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী সরকারের জনগণেরর প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই এবং তারা জনগণকে জবাবদিহিও করে না। ফলে হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, মন্ত্রী, এমপি, সচিব ও দলীয় ক্যাডারদের দুর্নীতি। রেলগেট কেলেঙ্কারি, সোনার ক্রেস্ট কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি, আইটিসিএলসহ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং সংস্থাসমূহের প্রতারণা শেয়ারবাজারের ৩৫ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর অর্থ লোপাট প্রভৃতির কোন বিচার এই সরকার করেনি এবং লোক দেখানো যে নাটক করছেন তা মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার চার থেকে গত ৬ বছরে তারা আবাসিক খাতকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে লাখ লাখ ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো ক্রেতাদের কাছে তা হস্তান্তর করতে পারছে না এবং অনেকেই সহায়-সম্বল হারিয়ে পথে বসে পড়েছেন। ফলে এই খাতে ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী পাওয়া যেমন কঠিন হয়ে পড়েছে তেমনি সাধারণ মানুষের একটি ছোট ফ্ল্যাট বাড়ি পাওয়ার স্বপ্নও চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বাজেটে জমিজমা, ফ্ল্যাট বাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি বৃদ্ধি ও গেইনট্যাক্স আরোপের যে প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী করেছেন তা এই খাতকে আরও পঙ্গু করে দেবে। আবার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করে দেয়ার নামে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে প্রতারণার যে ব্যবসা পেতে বসেছেন তাতে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠেছে।
বাজেটে সম্পদ আহরণের প্রধান উৎস হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। বিগত বছর এই বোর্ড তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রধান কারণ তার কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতিপরায়ণতা। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করে অর্থমন্ত্রী এনবিআরের ওপর হাজার হাজার কোটি টাকার নতুন কর আদায়ের দায়িত্ব প্রদান করেছেন। এ দায়িত্ব যে তারা পালন করতে পারবেন এই ভরসা করা যায় না। বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু কিছু সুখবর আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য নয়। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক উদ্ভাবিত চচচ (চঁনষরপ ঢ়ৎরাধঃব ঢ়ধৎঃহবৎংযরঢ়) নামক বস্তুটি গত ৬ বছরে কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি। তথাপিও তিনি এই খাতে বিশাল অঙ্কের একটি বরাদ্দ রেখেছেন। তার এই বরাদ্দ রাখার পিছনে কার্যকর কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
ব্যবসায়ীদের তিনি কিছু সুখবর দিলেও ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ব্যাপক ঋণ গ্রহণের প্রস্তাবে কার্যত তাদের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পথ রুদ্ধ করে দেবে। অবশ্য এই সরকারের আমলে দলীয় নেতাদের প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট ব্যাংকসমূহ থেকে প্রচুর ঋণের আদান- প্রদান করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে এই ঋণের সুযোগ পাচ্ছেন ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের আত্মীয়-স্বজনরাই, সাধারণ কোন ব্যবসায়ী নন।
উপরোক্ত অবস্থায় করারোপ প্রস্তাব প্রত্যাহার, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সংস্কার, দুর্নীতি-আত্মসাতের পথ রুদ্ধ করা এবং আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার নামে প্রদত্ত অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রত্যাহার করে জনকল্যাণ খাতে তা বরাদ্দ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি বাজেট প্রস্তাবকে ঢেলে সাজিয়ে তাকে বাস্তবমুখী করাও অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি।
মো. নূরুল আমিন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন