মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

এ কেমন সরকার?



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
সরকারের এখন আর কোনো লক্ষ্য নেই। কিংবা কখনোই তেমন কোনো লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয় না। কারণ ক্ষমতাসীন হয়েই এই সরকার বিরোধী দল দমনের কিংবা বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার নানাবিধ লক্ষ্যে এগিয়ে গেছে। যে কোনো বিষয়েই তারা বিরোধী দলকে নির্যাতনের পথ অবলম্বন করেছে প্রথম থেকেই। রাস্তায় মিছিল, পিটাও। মানববন্ধন, পিটাও। প্রেস ক্লাবে প্রতিবাদ সভা, হলের ভেতরে ঢুকে পিটাও। বিএনপি অফিসের সামনে সভা, পিটাও। গার্মেন্টস কর্মীরা আন্দোলন করছে, পিটাও। শিক্ষকরা আন্দোলন করছে, পিটাও। পুলিশ কী একা এত কাজ পারে? না পারলে কী হবে? ছাত্রলীগ, যুবলীগ আছে না? তারা পিস্তল, বন্দুক, চাপাতি, লাঠি হাতে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে। পিটাচ্ছে। সরকারে দারুণ স্বস্তি।
আমরা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের অনেক সমালোচনা করেছি। তিনি পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটিয়েছিলেন যে, এই সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণ নেতা শেষ পর্যন্ত তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন। তার জায়গায় নিয়ে আসেন ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানী শাসকদের সহযোগী ছিলেন। জিয়াউর রহমানের শাসনকালে তিনি তার অতি ঘনিষ্ঠজনও ছিলেন। তার খাল কাটা কর্মসূচিতে, যে কর্মসূচিকে শেখ হাসিনা খাল কেটে কুমির আনা বলেছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এবং যতদূর জানি জিয়াউর রহমানের উপসী-যদুনাথপুর প্রকল্পের সাফল্য বিষয়ে অভিসন্দর্ভ রচনা করে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। রাজনীতিতে তিনি অচ্ছুৎই ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চ ভাড়া করে তৎকালে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রিয়ভাজন হয়ে যান। সেই জনতার মঞ্চে তিনি সরকারি কর্মচারীদের অবিরাম বিদ্রোহের ডাক দিচ্ছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া ঠিক ঠিকই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার অফিসে কর্মরত কিছু কর্মকর্তা তাকে রক্ষার জন্য নানাবিধ আয়োজন করে। তারা এখনও তার গুলশান অফিসে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। আমার দুর্ভাগ্য এই যে, আমি তখন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতা লেখক (ডিপিএস) হিসেবে দৈনিক বাংলা থেকে ডেপুটেশনে কর্মরত ছিলাম। আমি সাদা চোখে দেখি। একটা সরকারের ভিতরে যে কত কিছু ঘটে এ বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট কোনো ধারণা আগে ছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার সে বিষয়ে কিছু কিছু ধারণা হয়েছে।
যদিও আমি খুব নিভৃত কর্মী ছিলাম। প্রতিদিনই তার জন্য কোনো না কোনো বক্তৃতা লিখতাম। আর এটা লিখে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে সেসব আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকতাম। কোন শব্দটি কিংবা কোন বাক্যটি ম্যাডামের জন্য সমস্যা তৈরি করছে, তা অনুধাবন করে  পরবর্তী বক্তৃতায় শব্দ এবং বাক্য পরিবর্তন করে দিতাম। আমি নিভৃতচারী থাকলেও এতটা বে-বোধ ছিলাম না যে, রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের গতি প্রকৃতি কিছুই বুঝতে পারবো না। জনতার মঞ্চ গঠনকারী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে যখন বেগম খালেদা জিয়া ব্যবস্থা নিতে চাইছিলেন, তখন তার অফিসেরই কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আমলা কর্মকর্তা এর বিরোধিতা করেন। এবং মহিউদ্দিন খান আলমগীর আওয়ামী লীগের কাছে হিরো হয়ে যান। এখনও সেসব আমলার কাউকে কাউকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখি। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে দেখি। নাগরিক হিসেবে ভয় পাই। না জানি এরা কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে।
এখন বিএনপির মুখপাত্র সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম মহিউদ্দিন খান আলমগীরের এমন চরম সহযোগীদের ঘোরতর বিরোধিতা করেছিলেন, ম্যাডামের সামনেই। কিন্তু তারা তো কাছেই আছেন। কেন যে আছেন! কেন যে তাদের বাদ দিয়ে চলা যায় না- তরিকুল ইসলামের সঙ্গে সে বিষয়ে আমি একমত। এদের দৃষ্টিসীমার হাজার কিলোমিটার দূরে নিক্ষেপ করা উচিত।
এটা প্রসঙ্গ ছিল না। প্রসঙ্গ ছিল বিরোধী দল বা বিরোধী মতো কিংবা সরকার বিরোধী কোনো কর্মকান্ডের উপর সরকারের দলন-নীতি। এক্ষেত্রে সরকার যে কী পরিমাণ লজ্জাহীন তার প্রমাণ ইতোমধ্যে লাখে লাখে সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দল একটা প্রতিবাদ মিছিল বা নিরীহ মানববন্ধন করলেই সরকার বলছে এরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে চায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী বলে বাংলাদেশে কেউ নেই। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার এদেশের ১৯৩ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে সিমলা চুক্তি অনুযায়ী তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়ে ঘোষণা করেন যে, বাঙালি জাতি জানে কীভাবে ক্ষমা করতে হয়।
তখন লক্ষাধিক লোককে পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের কারো শাস্তি হয়নি। শেখ মুজিবুর রহমান যখন যথার্থভাবেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, তখন তারা সবাই মুক্তি পেয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান মানবেতিহাসের পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন। পৃথিবীর কোনো বিপ্লবের ইতিহাসে প্রতিহিংসার স্থান ছিল না। কিউবার বিপ্লব করেছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও ভিনদেশের নাগরিক চে গুয়েভারা। ফিদেল ক্যাস্ট্রো চে গুয়েভারাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল যে, আগের রাত্রে যাকে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে টেলিভিশনে দেখালো, পরের রাত্রে চে গুয়েভারা তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে কার্যকর করলেন। ক্যাস্ট্রো এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ক্যাস্ট্রো বললেন, দেশ গড়ে তুলতে জাতীয় ঐক্য দরকার। কিন্তু চে গুয়েভারা ক্যাস্ট্রোকে প্রতিক্রিয়াশীল বললেন এবং মন্ত্রিসভা ত্যাগ করে বলিভিয়ার বিপ্লব করার জন্য চলে গেলেন।
সে বিবেচনায় শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এখন যারা আওয়ামী লীগ করেন তাদের হাজার হাজার লোক রাজাকার বা পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী ছিলেন। এদের বিচার কে করবে? এখন যাদের বিচারের নামে ‘প্রহসন' চলছে তাতে জবাবদিহিতা শূন্যে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ছয় শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বিএনপির দুই নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে। আমরা সাধারণ মানুষ আসলে বুঝতেই পারছি না যে, ঘটনাগুলো কী ঘটছে? যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে ফয়সালা তো শেখ মুজিবুর রহমানই করে গেছে। তিনি ১৯৩ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সম্ভবত সে কারণেই শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী দল দমনে মানবতাবিরোধী অপরাধের ইস্যু তুলেছেন। এবং সে ইস্যু তুলেছেন ঘটনার ৪০ বছর পর। প্রহসন আর কাকে বলে?
সরকারের বিরোধিতা দমনে হেন কোনো নিকৃষ্ট কাজ নেই যা শাসকগোষ্ঠী করছে না। এটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতাকারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। এটা প্রযোজ্য সকল ধরনের আন্দোলনের বিরুদ্ধে। এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশের পাশাপাশি যথারীতি ছাত্রলীগকেও লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং মাঠে শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার জন্য আন্দোলন করছে। দেশবাসী লক্ষ্য করছে যে, এসব আন্দোলনকারীদের দেখে নিতে সরকার ঘাতক ছাত্রলীগ বাহিনীকে লেলিয়ে দিচ্ছে। এসব আন্দোলনের প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই দলীয় ভিত্তি নেই। আন্দোলনগুলো হচ্ছে সর্বদলীয় ভিত্তিতে। কিন্তু নিষ্কৃতি পাচ্ছে না কেউ। বুয়েটের শিক্ষকদের উপর ছাত্রলীগের হামলা দিয়ে এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তারপর রাজপথে প্রাইমারি ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের আন্দোলন। দাবি এমপিওভুক্তি।
সে আন্দোলন দমাতে কিনা করছে সরকার। বিরোধী দলকে রাজপথে নামতেই দিচ্ছে না। এমনকি নিরীহ মানববন্ধনে পর্যন্ত পুলিশ-ছাত্রলীগ বেপরোয়া হামলা চালাচ্ছে। এর ফল যে শুভ হয় না, সেটি বুঝবার ন্যূনতম কান্ডজ্ঞানও সরকার হারিয়ে ফেলেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে অতি ঠুনকো কারণ দেখিয়ে মাসের পর মাস আটক রাখা হচ্ছে। উচ্চ আদালত থেকে তিনি জামিন পেলেও নতুন মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে জেল থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ এর শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল নেতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তের নামে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে। যে বিচার হচ্ছে তাও নানান কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। আর বিরোধী দল দমনে সরকার যেসব নিষ্ঠুর পথ অবলম্বন করছে, সেগুলো বোধ করি, সভ্য জগতে কল্পনাও করা যায় না।
এসব ঘটনা হিটলার মুসোলিনির শাসনকালে জার্মানি ও ইতালিতে সংঘটিত হয়েছিল। তারপর হয়েছিল চিলিতে। এখন আধুনিক বিশ্বে বাংলাদেশ তার নিকৃষ্ট উদাহরণ। যে ছাত্ররা শিক্ষককে পেটায়, তাদের আবার এই শিক্ষকদের কাছেই পড়তে যেতে হবে। জ্ঞান অর্জন করতে চাইলে এদেরই দ্বারস্থ হতে হবে। সে বিবেচনা বোধ করি এ ছাত্রদের হয়নি। দলীয় আনুগত্য দেখাতে তারা করছে না হেন কোনো কুকাজ নেই। বিশ্বজিৎ হত্যা তার তেমনি একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। যে পুলিশ শিক্ষকদের লাঠি বাগিয়ে ধরে বেধড়ক পিটালো তারা কি কোনোদিন স্কুলে গিয়েছে? এই শিক্ষকদের কাছেই তারা অ আ ক খ, এ বি সি ডি, আর নামতা শিখেছে। সে কথা ভুলেও মনে রাখেনি। গোটা সমাজে ছি-ছি রব পড়ে গিয়েছিল। এরা মানুষ! কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার দৃশ্য আমরা দেখেছি। ছাত্রলীগের হামলা থেকে আত্মরক্ষার জন্য শিক্ষকরা সোফার পিলো থেকে শুরু করে টেবিল- চেয়ার মাথার উপর তুলে ধরতে দেখেছি। কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছিলেন টেবিল চেয়ার সোফার নিচে। তাদের অভিশাপের দীর্ঘশ্বাস এদের কি নাড়িয়ে দেবে না? না। ছাত্রলীগ করলে এসবের ধার ধারতেই দলীয় আনুগত্য দেখাতে যা খুশি তাই করাও সম্ভব।
শুধু তাই নয়, সরকার বিরোধী যে কোনো আন্দোলন দমাতে পাগলা কুকুর কিংবা ক্ষতিকর বন্যপ্রাণী নিধনে যেসব ক্ষতিকর রসায়ন ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্যাস গ্রেনেড, সাউন্ড হ্যান্ড গ্রেনেড, কালার গ্যাস গ্রেনেড, কালার স্মোক গ্যাস গ্রেনেড, প্রভৃতি বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করতে দেখলাম। পুলিশ শিক্ষকদের চক্ষু লক্ষ্য করে সোজা মারছে তরলীকৃত মরিচের গুঁড়া যা চোখে লাগলে অন্ধ হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এর সবই ঘটছে সরকারের নির্দেশেই। পৃথিবীর কোনো স্বৈরশাসকই যে এ ধরনের গণ নির্যাতনের মাধ্যমে  ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি তার সাম্প্রতিক উদাহরণও সরকারের চৈতন্যে নাড়া দিতে পারছে না। এমনকি এরা ধারণাও করতে পারছে না যে, এতে ভবিষ্যতে তাদের পরিণতিই বা কী হতে পারে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads