মঙ্গলবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৩

ভয়াবহ এক মরণ খেলায় সরকার


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : 
জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট যে হরতাল ডাকবে, এ কথা নতুন নয়। একই কথা এর আগে বলে রেখেছে দেশের সরকারবান্ধব বাম দলগুলোও। এই সরকারের আমলে বাম দলগুলো আগে কখনও হরতাল ডেকেছে এবং তা সফল হয়েছে, এমন কথা স্মরণে নেই। সম্ভবত ডাকেনি। আর যদি ডেকেও থাকে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি, না সরকার, না অন্য কেউ। কিন্তু ক'দিন আগে সিপিবি এবং বামদলীয় মোর্চা দিনব্যাপী এক হরতাল ডেকেছিল। এদের সদস্য সংখ্যা হাতে গুণে বলা যায়। সেটি আমরা বিভিন্ন নির্বাচনে দেখে আসছি। সব বাম দল মিলে সম্ভবত দেশে এখন হাজার খানেক সমর্থক আছে। তাদের হঠাৎ করেই কী সাহস হলো যে, সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকে বসলো। সে হরতালের লক্ষ্য মহৎ ছিল। আর তা হলো ‘যুদ্ধাপরাধী'দের বিচার ত্বরান্বিত করা এবং অবিলম্বে তাদের ফাঁসি দেয়া।
বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে না। তারা বিচার করছে, ‘যুদ্ধাপরাধী', ‘মানবতাবিরোধী' অপরাধীদের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৪১ বছরের মধ্যে যে প্রশ্ন কখনও উত্থাপিত হয়নি, কিংবা এ প্রশ্ন এমনকি সিপিবিসহ কোনো মোর্চা-ফোর্চাও কোনোদিন উত্থাপন করেনি, সেটিরই বিচার। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কখনোই বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এমন কথা কেউ বলেনি। কেউ বলেনি যে, জামায়াত নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী। আর স্বাধীনতার পর পর যে একশ' ৯৫ জন পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তা-সদস্যকে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করেছিলেন, ১৯৭৪ সালে তাদের ক্ষমা করে দিয়ে ভারত থেকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো চুক্তি করেছিলেন এবং বীরদর্পে ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘বাঙালি জাতি জানে কীভাবে ক্ষমা করতে হয়।' তখন তিনি জাতীয় ঐক্য ও সংহতি এবং দেশ পুনর্গঠনের জন্য সবার সম্মিলিত প্রয়াসের স্বার্থে রাজাকার, আল বদরদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। যদিও সে সাধারণ ক্ষমার শর্ত ছিল এই যে, যারা খুন করেছে, মানুষের ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়েছে, নারী নির্যাতন করেছে, তাদের ক্ষমা হবে না, বিচার হবে।
কিন্তু গত ৪১ বছরে কেউ কোনোদিন সে দাবি তোলেনি। জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম আদালতের মাধ্যমে তৎকালীন সকল আইনের অধীনে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে অরাজনৈতিক জীবন-যাপন করছিলেন। এখন জামায়াতের যে ছয় নেতা ও বিএনপি'র দুইজনের বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ'-এর অভিযোগে বিচার চলছে, শেখ মুজিবের আমলে লক্ষাধিক লোকের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হয়েছিল, তার কোথায়ও এদের নাম ছিল না। অথচ রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত বর্তমান সরকার এদেরকেই ‘মানবতাবিরোধী' অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। এটি সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।
বিচারের গুণগতমান সম্পর্কে বোধ করি এখন আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কারণ বিচার করার জন্য আইন করা হয়েছে যে, বিচারের জন্য সাক্ষীকে হাজির করতে হবে না। সরকারি লোকদের নেয়া তার জবানবন্দীই যথেষ্ট। কী দারুণ বা নিদারুণ ব্যবস্থা! সাক্ষী সত্যি সত্যি সে কথা বলেছেন কিনা সেটি যাচাই করার অবস্থা নেই। নাকি সরকারের পুলিশ প্রশাসন সাক্ষীর নামে যাচ্ছে তাই লিখে এনে আদালতে জমা দেবে। আর আদালত তা হাসিমুখে গ্রহণ করবে। এটি কোনো মানবিক বা ন্যায়বিচারের বিধান হতে পারে? বর্তমান সরকারের আমলে তা হচ্ছে। এভাবেই বাংলাদেশে ‘মানবতাবিরোধী' অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার চলছে। সাক্ষীদের দু'চার জন যাদের হাজির করা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, তথাকথিত অপরাধীদের তারা চেনেনই না। নাম শুনেছেন ২০০১ সালে। অথচ তিনিই সাক্ষী। আর যারা বিবেকের তাড়নায় সত্য কথা বলতে চেয়েছেন, তাদেরকে পুলিশ আইনজীবীর গাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে গুম করে ফেলেছে। কী আশ্চর্য বিচার!
এ রকম একটি বিচার দ্রুত নিন্ন হওয়া ও এদের জন্য কাঙ্ক্ষিত ‘নিশ্চিত মৃত্যুদন্ড' অবিলম্বে কার্যকর করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি) গত ১৮ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল। সে হরতালের চমৎকার দৃশ্যাবলী আমরা টিভির পর্দায় দেখেছি। পরদিন পত্রিকায় ছবি দেখেছি। পুলিশ নিজে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে। এসব ব্যারিকেড ভেঙে কেন মিনিবাস চালকরা গাড়ি চালানোর চেষ্টা করেছে, সে জন্য তারা মিনিবাস চালকদের ধরে ঠুয়া মেরেছে। চালকরা তো অবাক। হরতালে বাস চালাচ্ছে, এটা তো গৌরবের ব্যাপার। কিন্তু পুলিশ কেনো ঠুয়া মারবে! পুলিশ রিকশা আরোহীদের রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়েছে। বলেছে, জানেন না, আজ হরতাল? কোনো কোনো যাত্রী প্রশ্ন করেছেন, হরতালে রিকশা চলতে বাধা কোথায়? কোনো হরতালেই রিকশা চলতে কেউ বাধা দেয় না। পিকেটার নেই, কিছু নেই, আপনারা কেন বাধা দিচ্ছেন? পুলিশ কনস্টেবল চুপচাপ সরে গেছে। বলেছে, ওপরের নির্দেশে করেছি। ঐ যে সামনে অফিসার আছে, তাকে জিজ্ঞেস করুন।
হ্যাঁ, সিপিবি তার চিরাচরিত কাজ করেছিল। তারা দুই একটি রাস্তার মোড়ে দুই চারটা ছেলে মেয়ে জোগাড় করে হারমোনিয়াম নিয়ে দেশাত্মবোধক গান গাইছিল। এটাই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে দেখে আসছি। আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম, তখন আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুদের নানাভাবে টিটকারী দিতাম। আমাদের স্কুল-কলেজ জীবনের অনেকেই ছাত্র ইউনিয়নের (কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের অঙ্গসংগঠন) কর্মী ছিল। তাদের কেউ কেউ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিল। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, হারমোনিয়াম কিনেছিস? তাদের কেউ কেউ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করতো, হারমোনিয়াম কিনবো কেন? আমরা বলতাম, তোরা রোগী পাবি কোথায়? তোদের হারমোনিয়াম বাজিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রোগের বর্ণনা করে রোগীদের আকৃষ্ট করতে হবে। তা না হলে তোদের কাছে কোনো রোগী যাবে না। এর কারণ ছিল এই যে, এরা যত প্রতিবাদ অনুষ্ঠানই হোক না কেন, হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাইতে বের হতো। ফলে শেষ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের নাম সত্তরের দশকে ‘হারমোনিয়াম পার্টি' হয়ে গিয়েছিল। তখন অবশ্য ছাত্র ইউনিয়ন করলে একটা সুবিধা ছিল। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারে পড়তেই তারা এক অঘোষিত স্কলারশীপে সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে যেতো। এবং একটা মোটাসোটা, গাব্দাগোব্দা রাশিয়ার বউ নিয়ে ফিরে আসতো। আর তার কিছুকাল পরেই আবার রাশিয়ায় ফেরত যেতো। কী কারণে, কে জানে?
১৯৭৩-৭৫ সালে আওয়ামী লীগের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সিপিবি। শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়োগান্তক পরিণতির জন্য সিপিবি'র দায় বিরাট, একই সঙ্গে হারমোনিয়াম পার্টিরও। তবে তাদের দায় আছে বটে, দোষী সাব্যস্ত করি না। কারণ পার্টির-বস্রা ততদিনে চরিত্রহীন হয়ে পড়েছেন। শেখ মুজিব কিভাবে এ রকম একনায়কতন্ত্রের পথে যেতে পারেন, এটা আমাদের কল্পনারও অতীত ছিল। কিন্তু যা দেখলাম, তাতে স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো যে, সিপিবি ও মোজাফফর ন্যাপের প্ররোচনায় তিনি এ রকম বাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।
এবং আরও একটি আশ্চর্য ছবি দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়েছিল। সে ছবিতে ছিল শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার পর লেনিন রচনাবলী পড়ছেন। আমার কাছে, সম্ভবত আরও অনেকের কাছে এ এক আশ্চর্য ঘটনা ছিল। আমি একেবারে প্রথম থেকেই শেখ মুজিবের অপশাসনের নানা ধরনের প্রতিবাদ করেছি। দৈনিক গণকণ্ঠে নিয়মিত লিখেছি। বয়সে তরুণ ছিলাম। হয়তো কিছু ভুলও করেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগকে জনপ্রত্যাশার দিকে রাখতে এসব লেখা কোনো অবদান রেখেছে কিনা জানি না।
বাংলাদেশে হরতাল এমন এক কালচার যে, যে সরকারই ক্ষমতায় থাকে তারা হরতালের বিরোধিতা করে এবং বিরোধী দলে গেলে হরতালের ডাক দেয়। বর্তমান সরকার  মতায় আসার পর রাজনৈতিক নিপীড়ন, হত্যা, গুম, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, একাকার হয়ে গেছে। কোথায়ও পুলিশের সহযোগী শক্তি হিসেবে ছাত্রলীগ, কোথায়ও ছাত্রলীগের সহযোগী হিসেবে পুলিশ একত্রে মাঠে নেমে বিরোধী দলকে ঠেঙ্গিয়েছে, পিটিয়েছে, কুপিয়েছে, গুলী করেছে। এর আগে কখনও এমনটি দেখা যায়নি। ছাত্রলীগ পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের উপর গুলী চালিয়েছে। পুলিশ নির্বিকার চেয়ে চেয়ে দেখেছে। এমনকি পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে পিস্তলে পুনরায় গুলী লোড করেছে। পুলিশ ভ্রূক্ষেপও করেনি। পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভিডিও ফুটেজ প্রচারিত হয়েছে। সরকার নীরব থেকেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে ছাত্রলীগ, যুবলীগকে বিরোধী দল দমনে উদাত্ত আহবান জানিয়েছে। তার পরিণতিতে আগের অবরোধের দিন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় নিরীহ দর্জি বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করেছে। সরকার নির্বিকার। এর আগে স্কুল ছাত্র পরাগ মন্ডলকে তার মা-বোনকে গুলী করে গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করেছিল যুবলীগের এক নেতা। সে মুক্তিপণ আদায়ের কথোপকথনের বিস্তারিত উদাহরণ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এখানেও মূল আসামী রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
হরতালের দিনই রাজধানীর ৫৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজুমদারের লাশ পাওয়া গেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। ঝিনাইদহের শ্বশুড়বাড়ি থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তাকে অপহরণ করা হয়। তার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো ছিল। তাতে পুলিশের মনোগ্রাম খোদাই করা ছিল। পুলিশের হ্যান্ডকাফ বিষয়ে এই বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। সরকার নীরবই রয়েছে। ৬ জানুয়ারির হরতালে আরও একটি দৃশ্য দেখা গেল। পুলিশের পোশাক পরা এক যুবক, কোমরে লাল মাফলার বাঁধা, পায়ে স্যান্ডেল, হাতে পিস্তল। এরা হরতালকারীদের প্রতিহত করছে। এ আলামত একেবারেই আত্মবিনাশী। সরকার তা মোটেও টের পাচ্ছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এতে প্রলয় বন্ধ থাকবে না। আস্তে আস্তে সরকারি বাহিনী ও ঘাতকরাও পরস্পরের হাতে খুন হতে থাকবে। সরকার হয়তো ভেবেছে সে লড়াইয়ে যে জিতবে সেই হবে তাদের লোক। এ পর্যন্ত সরকার সে রকম মনোভাবই দেখিয়ে আসছে। যা সমাজের ভেতরে চূড়ান্ত অরাজকতা ও হানাহানির সৃষ্টি করবে। সরকার সম্ভবত চাইছেও তাই। কিন্তু এ যে মরণ খেলা, সেটি এই সরকারকে কে বোঝাবে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads