সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

মানবাধিকারের রাজনীতি


ফরহাদ মজহার

 এক.
আমি ‘মানবাধিকার’ নিয়ে কাজ করি। আরও অনেকে কাজ করেন। কিন্তু মানবাধিকারের নামে শক্তিশালী দেশগুলো দুর্বল দেশগুলোর ওপর চড়াও হয়। এমনকি মানবাধিকার রার নামে শক্তিশালী দেশগুলো দুর্বল দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও দ্বিধা করে না। ফলে ‘মানবাধিকার’ নিয়ে কাজ করা একটা ঝুঁকিও বটে। বাংলাদেশের সামনের সারির মানবাধিকার সংগঠনগুলো ২০১২ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে যেসকল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে মানবিক ও নাগরিক অধিকার লংঘনের একটা ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই যে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। আমরা কি এখন বলব যে আমাদের দেশের পরিস্থিতি যখন এতোই খারাপ তখন বিদেশীরা এসে আমাদের রা করুক। যদি আমরা তা না চাই তাহলে বুঝতে হবে ‘মানবাধিকার’ রার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা যা অর্জন করতে চাই আর তথাকথিত সার্বজনীন মানবাধিকারের কথা বলে পাশ্চাত্যের মতাবান রাষ্ট্র এবং এদেশে তাদের সহকারীদের উদ্দেশ্য এক হতে পারে না। এমনকি হয়তো ‘মানবাধিকার’ সম্পর্কে আমাদের ধারণাও ভিন্ন হতে বাধ্য। এই প্রশ্নগুলো তোলার চেষ্টা করব এখানে আমরা মানবাধিকারের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি। মানবাধিকার নিয়ে তর্ক প্রবল ভাবে হাজির আছে বলে কি আমরা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করবো না? যদি করি তাহলে ‘মানবাধিকার’ ব্যাপারটাকে আমরা কিভাবে বুঝবো? কিভাবে বিচার করব? আর বাংলাদেশে মানবাধিকারের রাজনীতিটাও কেমন হবে? যার ল্য হতে পারে অধিকারহীন সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করা এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গণশক্তির বিকাশ ও গণপ্রতিরার শর্তগুলো  তৈরী করে যাওয়া।
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের বাৎসরিক প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই পেশ করেছে। পুনরাছ্রত্তি অপ্রয়োজনীয়, তবু আমরা তাদের কিছু তথ্যের ওপর চোখ বুলিয়ে আমাদের আগ্রহের জায়গায় যাবার চেষ্টা করব।
সাংবাদিকদের অবস্থা দিয়ে শুরু করি। গত ৩ বছরের মধ্যে ২০১২ সালেই সর্বাধিক সংখ্যক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে নৃসংশভাবে হত্যা করা হলেও আজ পর্যন্ত তার কোন সুরাহা হয়নি। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ জানিয়েছে ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ জন সাংবাদিক নিহত, ১৬১ জন আহত, ৬৩ জন হুমকির সম্মুখীন, ১০ জন আক্রমণের শিকার, ৫০ জন লাঞ্ছিত এবং ১ জন র‌্যাব ও ১ জন ডিবি পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। এই হোল সাংবাদিকদের অবস্থা।
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা ও তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে কিভাবে বর্তমান সরকার মতা আসার পর থেকেই কারাগারে নিপে করেছে এবং ক্রমাগত তাকে হয়রানি করছে সেটা আমরা জানি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিমের সঙ্গে বেলজিয়াম প্রবাসী একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের মধ্যে স্কাইপ কথোপকথন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশ করাটা ছিল বিচার বিভাগের জন্য একটা কেলেংকারি। কিন্তু কেন এই কথোপকথন প্রকাশ করা হোল তার জন্য মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে রাখা হয়েছে।
যারা নিখোঁজ, অপহৃত ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন তাদের সংখ্যাকে যদি একযোগে বলি তাহলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১২ সালে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬ জন। এই সংখ্যার হিসাব দরকার আছে, যদিও এতে যারা গুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং কষ্ট দিয়ে যাদের মেরে ফেলা হয়েছে তাদের সেই অমানবিক অভিজ্ঞতার ভয়াবহতার সামান্য ইঙ্গিতও এই সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ সম্ভব না। তবুও সংখ্যা ও নাম-সাকিনসহ তথ্য নজরে রাখা মানবাধিকার কর্মীরা জরুরি মনে করেন। প্রতিটি েেত্রই সরকার ও রাষ্ট্রের দায় আছে, এই দায় থেকে কাউকেই মুক্তি দেওয়া যায় না। অন্য দিকে দেশীয় আইন (যদি আদৌ থাকে) ও আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী দায়বদ্ধতাকে সুনির্দিষ্ট করতে চাইলে, ‘গুম’-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের সংজ্ঞা এ েেত্র ব্যবহার বাঞ্ছনীয় হয়ে ওঠে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ সে দিকটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চায় বলে তারা বলছেন, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ২৪ জন ‘গুম’ হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যদর্শীরা দাবি করেছেন আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছে। অথচ সাী থাকার পরেও সরকার ও আইনশৃংখলা বাহিনী তা অস্বীকার করেছে। এই ভাবে যদি মানুষ ‘গুম’ হতে থাকে তাহলে আন্তর্জাতিক আদালতে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা যেতে পারে।
নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আর ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। কারা নিখোঁজ করেছে বা কি জন্য নিখোঁজ হয়েছে জানা নাই, কে নিয়েছে জানা নাই, কিন্তু কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। বা পাওয়া গেলেও পাওয়া যাচ্ছে তার লাশ। কে, কিভাবে কেমন করে নিয়ে গিয়ে খুন করল তা যখন অজ্ঞাত থেকে যায়, তখন একটা জটিলতা সৃষ্টি হয়। কারণ এর জন্য রাষ্ট্র বা আইনশৃংখলা বাহিনী সরাসরি দায়ী কি না সেটা অনেক সময় অনুমান করা গেলেও অভিযোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ হোল নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। এই েেত্র হয়তো সরকার দায়ী, কিম্বা দায়ী নয়।
তার পরেও যদি আমরা নীচের টেবিলটির দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে ২০০৯ সালের পর থেকে গুম হয়ে যাওয়া বিপজ্জনক ভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমেছে। এর একটা কারণ আন্তর্জাতিক ভাবে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে একটা চাপ তৈরী হয়েছে, যা এই সরকারের পে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। কিন্তু সেই চাপ সামাল দিতে গিয়ে সরকার গুম-হত্যার আশ্রয় নিয়েছে। যা আরও বিপজ্জনক।
টেবিল : ‘গুম’ আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের একটি বছরওয়ারি চিত্র
বছর    গুম     আইনবহির্ভূত      গণপিটুনিতে
হত্যাকাণ্ড মৃত্যু

২০০৯   ৩      ১৫৪    ১২৭
২০১০   ১৮     ১২৭    ১৭৪
২০১১   ৩৯     ৮৪     ১৬১
২০১২   ২৪     ৭০     ১৩২
সূত্র : অধিকার

কিভাবে মানুষ ‘গুম’ হয়ে যায় সেই সব খবর পত্রিকায় আমরা দেখেছি। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়ী চালক আনসারকে রাজধানীর বনানী এলাকার রাস্তা থেকে আইনশৃংখলা রাকারী বাহিনীর সদস্যরা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এই ভাবে তুলে নিয়ে যাবার পর তাঁদের ওপর কি ধরনের পাশবিক নির্যাত হয় সেটা আমরা বুঝতে পারি গত ৪ এপ্রিল গার্মেন্ট শ্রমিকনেতা এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির সংগঠক আমিনুল ইসলামের (৪১) নিষ্ঠুর ও নির্মম পরিণতি দেখে। তাঁকে ৫ই এপ্রিল সকালে ঘাটাইল থানা এলাকার টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে পাওয়া যায়। তার তখন দুই হাত ভাঙা, ডান হাঁটুর জয়েন্টে ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে দেওয়া, দাঁত উপড়ে ফেলা, নখ তুলে ফেলা। আশুলিয়া থেকে যারাই ধরে নিয়ে যাক এর সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, একই সঙ্গে কথা উঠেছে গার্মেন্টমালিকদের এই হত্যাকাণ্ডে কোন হাত আছে কি না খুঁজে বের করা দরকার।
যে টেবিলটি বোঝার সুবিধার জন্য পেশ করছি সেখানে গণপিটুনিতে কতজন মানুষ মারা গেছে তারও একটা হিশাব দেওয়া আছে। মনে রাখতে হবে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যাও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। রাষ্ট্র যদি বিচার ছাড়া মানুষ হত্যা করে তাহলে মানুষও দলবেঁধে পিটিয়ে অন্য মানুষকে হত্যা করবে না কেন? রাষ্ট্র যে শিাটা দেয়, নাগরিকেরা সেই শিা দ্রুতই রপ্ত করে। মানুষ পিটিয়ে মারবার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে আইনব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা উঠে যাওয়া। ‘অধিকার’-এর তথ্যানুযায়ী ২০১২ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩২ জ্যান্ত মানুষকে দলবেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
মানবাধিকার লংঘন করার ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কি দশা হতে পারে তার একটা বড় প্রমাণ হচ্ছে সভা-সমাবেশ করবার অধিকার কেড়ে নেওয়া। সরকার বিরোধী দলকে সুযোগ পেলেই পেটাচ্ছে, তাদের নেতাদের জেলে পুরছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে, এইসব তো আমরা চোখের সামনেই দেখছি গত ৩০ সেপ্টেম্বর তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রা জাতীয় কমিটির জ্বালানী মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পুলিশ লাঠিপেটা করে ও টিয়ার শেল ছুঁড়ে পন্ড করে দেয়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়া হিশাবে রাজনীতও সন্ত্রাস নির্ভর হয়ে পড়ে।
সরকার কিভাবে নাগরিকদের সভা সমাবেশের অধিকার লংঘন করছে সেটা বোঝা যায় ১৪৪ ধারা জারির হিসাব ধরলে।
গত বছর ২০১২ সালে বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন সময়ে ১০৫ বার ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। আগের বছরগুলোতে সেটা ছিল, ২৮ (২০০৯), ১১৪ (২০১০) এবং ১০৩ (২০১১)। বর্তমান সরকার মতায় আসার পর থেকে সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডের যারা বিরোধী তাদের কঠোর ভাবে দমন করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর হিংসা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা বোঝা যায় রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ও আহতদের হিসাব নিলে। অধিকার এর তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৬৯ জন নিহত এবং ১৭১৬১ জন আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৩৮২টি এবং বিএনপি’র ১৪৬টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৩৭ জন নিহত ও ৪৩৩০ জন আহত হয়েছেন। অন্য দিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৬ নিহত ও ১৬১৯ জন আহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্ত। বাংলাদেশের নাগরিকদের গুলি করে হত্যা ভারতীয় সীমান্তরী বাহিনীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ২০১২ সালে বিএসএফ ৩৮ জন বাংলাদেশীকে হত্যা ও ১০০ জন বাংলাদেশীকে আহত করেছে। গত বছরে বিএসএফ ৭৪ জন বাংলাদেশীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।। সীমান্তে নির্যাতন ও অপহরণ আগের বছরগুলোর তুলনায় ২০১২ সালে অনেক বেড়ে গেছে। বিএসএফ এখন ককটেল মারছে, দরজা খুলে ঘরে ঢুকে নির্যাতন করছে, গাছে ঝুলিয়ে পেটাচ্ছে, ন্যাংটা করে পেটাচ্ছে, বেয়নেট খুঁচিয়ে জখম করছে, কুপিয়ে মারছে।
দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালে নারীর প্রতি সহিংসতা চরম আকার ধারণ করে। ২০১২ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৮০৫ জন নারী ও মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে ২৯৯ জন নারী, ৪৭৩ জন মেয়েশিশু এবং ৩৩ জনের বয়স জানা যায়নি। ওই ২৯৯ জন নারীর মধ্যে ৩১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১০১ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ৪৭৩ জন মেয়েশিশুর মধ্যে ৩৯ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ৮৪ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এই সময়কালে ১০ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে। যে ৮০৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে ১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারাই।
দুই.
বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করবার সংগঠনের অভাব নাই। বিস্তর। সংখ্যা বোধ হয় কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এদের মধ্যে অধিকাংশই হয়তো কাগজে কলমে আছে। ‘হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার’ বা মানবাধিকার যাঁরা পাহারা ও রা করেন তাদের যে সংজ্ঞা জাতিসংঘ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, তাতে অনেকেই অনায়াসে তাদের কাজকে মানবাধিকার রার কাজ বলে এখন দাবি করতে পারেন। যেমন সাংবাদিক, আইনজীবী, মানুষের কল্যাণের জন্য যারা কাজ করেন এমন সব স্বেচ্ছাসেবক ও সংস্থাÑ এইসব।
এখন ‘মানবাধিকার’ কি আসলে মানবাধিকার লংঘনের শিকার ‘ব্যক্তি’র অধিকার রার ব্যাপার মাত্র? কারণ আমরা জানি ব্যক্তির ‘সার্বজনীন’ অধিকার রার অজুহাতে কিভাবে শক্তিশালী দেশগুলো দুর্বল দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ সংকট ও দ্বন্দ্বের সুযোগ নেয় এবং নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। তাহলে ব্যক্তির ‘সার্বজনীন’ অধিকার ধারণার মধ্যে একটা মুশকিল ও গোলমাল আছে। এই গোলমাল থেকে দূরে থাকার পথ কী? সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনকে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই-সংগ্রাম থেকে আলাদা কিছু মনে না করা। আমরা সাধারণত বলে থাকি যে এই লড়াই সংগ্রামের উদ্দেশ্য হচ্ছে গণতন্ত্র কায়েম করা। ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে আমাদের ধারণা অপরিচ্ছন্ন বলে পরিষ্কার বুঝতে পারি না আসলে কিভাবে এতে ‘গণতন্ত্র’ কায়েম হবে। তা ছাড়া এই গণতন্ত্র কি পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রই হবে? যাকে সুনির্দিষ্ট করবার জন্য অনেকে একে ইংরাজিতে ‘লিবারেলিজম’ বলে থাকেন। সেই দিক থাকে ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই (লিবারেল) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন ও সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। তাকে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের মূল কথায় পরিণত করার অর্থ হচ্ছে লিবারেলিজম কায়েম করা। কিন্তু অন্য দিকে আবার যদি তা না করি তাহলে আমরা মানবাধিকার বিরোধী বিদ্যমান রাষ্ট্রের সন্ত্রাস ও তার নির্বিচার মানবাধিকার লংঘনের শিকার হতেই থাকবো। এই গোড়ার কথাটা যদি আমরা বুঝি তাহলে পাশ্চাত্য লিবারেলিজম থেকে আমাদের দূরত্ব রাখার জন্য সার্বজনীন ব্যক্তির ধারণা বা ব্যক্তিতন্ত্র থেকে আমাদের পার্থক্য বজায় রাখতে হবে। ব্যক্তিতন্ত্র নয়, আমাদের চাই সমষ্টিতন্ত্র, কিন্তু সেটা ব্যক্তির মর্যাদা এবং তার ইনসাফ পাবার অধিকার ুণœ করে নয়। ব্যক্তির ইচ্ছা ও সংকল্পের মূল্য অপরিসীম কিন্তু তাকে সমষ্টির শক্তিতে পরিণত করতে হবে, যার নাম ‘গণশক্তি’। তার জন্য ব্যক্তির এই ইচ্ছা ও সংকল্পকে কোন ভাবেই ব্যক্তিতন্ত্রে বা সমাজ ও সমষ্টির ঊর্ধ্বে ব্যক্তির সমাজ বিচ্ছিন্ন স্বাধীন অধিকারে পর্যবসিত করা যাবে না। যদি তাই হয় তাহলে বাংলাদেশে মানবাধিকার আন্দোলন তার চরিত্রের দিক থেকে হবে ব্যক্তি ও সমষ্টির সঙ্গে নতুন ধরণের সম্পর্ক রচনার আন্দোলন, যা পাশ্চাত্যের অনুকরণ নয়, বরং তাদের নিজেদের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার মধ্যে নতুন ধরণের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন।
আমাদের সামনে এখন বাস্তব সমস্যা হচ্ছে মানবাধিকারবিরোধী ও মানবাধিকার লংঘনকারীরা ‘গণতন্ত্র’কে কেবলই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করে, বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সেটাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। পাশ্চাত্য অর্থেও গণতন্ত্র মানে নিছক নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র গঠনের-প্রক্রিয়া ও ভিত্তি নির্মাণের গোড়াতেই ব্যক্তির মর্যাদা ও তার মানবাধিকার যে অলংঘনীয় সেই সত্য নিশ্চিত না করে যাত্রা শুরু করলে তার কুফল জনগণকে বয়ে বেড়াতে হয়। সেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায় রাষ্ট্র পরিচালনার সমস্ত েেত্র নিশ্চিত করা না গেলে তাকে ‘গণতন্ত্র’ বলা যায় না। নিজের মর্যাদা ও অধিকারের উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই অপরের অধিকার এবং নিজেদের সমষ্টিগত অধিকার ও দায়দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
অতএব ব্যক্তির যে-মর্যাদা অলংঘনীয়, প্রাণ, পরিবেশ ও জীবিকার যে-নিশ্চয়তা বিধান করা ছাড়া রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতা লাভ করতে পারে না এবং যেসব নাগরিক অধিকার সংসদের কোন আইন, বিচার বিভাগীয় রায় বা নির্বাহী আদেশে রহিত করা যায় নাÑ সেই সব অলংঘনীয় অধিকার সম্পর্কে অবশ্যই আমাদের অবিলম্বে সচেতন হতে হবে এবং এই অলংঘনীয়তাকে অতি অবশ্যই রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে নাগরিক ও মানবিক অধিকার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমরা দেখি, তার বিশিষ্টতাকে মনে রেখে তার অবদানের দিকটা আমাদের গ্রহণ করতে বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু সার্বজনীনতার দাবি জানিয়ে পাশ্চাত্য আমাদের কাছে যা দাবি করে তা মেনে নেবার কোন যুক্তি নাই। সেই েেত্র পাশ্চাত্য মানবাধিকারের ধারণাকে কিভাবে আমরা বুঝব তার একটা পর্যালোচনা জরুরি।
সেটা আগামি কিস্তিতে।
১৩ জানুয়ারি ২০১৩। ৩০ পৌষ ১৪১৯

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads