মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা যাবে না কেন



মেয়াদের শেষ বছরে এসে মহাজোট সরকারের মনোভাবে কিছুটা হলেও নমনীয়তা দেখা যাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। অন্যদিকে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত কারো বক্তব্য ও শারীরিক ভাষাতেই তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো সমস্যার ব্যাপারেই তারা সমঝোতামুখী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন না। যেমন গত ১৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ রীতিমতো সিদ্ধান্ত ঘোষণার সুরে জানিয়ে দিয়েছেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার নাকি আর সুযোগ নেই। সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার, বিচার বিভাগের দলীয়করণ এবং রাজনৈতিক দমন-নির্যাতনসহ অনেক বিষয়ে উত্তর এড়িয়ে গেলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিরোধী দলের দাবির জবাবে যথেষ্ট জোর দিয়েই বলেছেন আইনমন্ত্রী। ওদিকে কথায় মন্ত্রীকেও ছাড়িয়ে গেছেন আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনের পরদিনও এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বিরোধী দল নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছে। এটা আর কখনো সংবিধানের অংশ হবে না। প্রতিমন্ত্রী সেই সাথে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্য বিরোধী দলকে পরামর্শ দিয়েছেন। এসব বিষয়ে আর্থিক কেলেংকারীর কারণে অভিযুক্ত দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তসহ অন্য নেতারাও একই সুরে বলে চলেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসহ রাজনৈতিক কোনো একটি প্রধান সমস্যার ব্যাপারেই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কোনো সদিচ্ছা নেই। বলা দরকার, আইনমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন অন্য নেতারা আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকেই উৎসাহ পেয়েছেন। গত ১১ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ উদাহরণ। ভাষণটিতে তিনি শুধু তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টিকেই পাশ কটিয়ে যাননি, একই সঙ্গে ভয়ও দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মাইনাস টু ফর্মুলার প্রবর্তনকারীরা নাকি এখনও সক্রিয় রয়েছে এবং মাঝে-মধ্যেই তারা নাকি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জানাননি, কল্পিত এই মাইনাস টুওয়ালারা ঠিক কোন ধরনের কারণে বা কাদের প্রশ্রয়ে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সাহস পাচ্ছে। কথা শুধু এটুকুই নয়। মাইনাস টুওয়ালাদের দিয়ে ভয় দেখালেও জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে কোনো কথাই বলেননি। তিনি বরং বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সে সরকারই রাতারাতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে পরিণত হবে। অন্য একটি কারণেও তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে ভীতি ও সংশয় বেড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য সরকারের ‘ধারাবাহিকতা' রক্ষা করা দরকার। এর মধ্য দিয়েও প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে তাদের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। পরিষ্কার হয়েছে, তারা এমন নির্বাচনই করতে চাচ্ছেন যা তাকে আবারও ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। এই অনুমানের কারণ হলো, ভয় দেখাতে কার্পণ্য না করলেও ভাষণের কোনো অংশেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের প্রতি সহযোগিতার আহবান জানাননি। সব মিলিয়ে ভাষণটিতে যে মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে তাকে গণতন্ত্রের জন্য শুভ ইঙ্গিতবাহী বলার উপায় নেই। এদিকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরাও ধমকের একই সুরে কথা বলে চলছেন বলে ধরে নেয়া যায়, তারা আসলেও সমঝোতার পথে পা বাড়াতে রাজি নন। আমরা মনে করি, বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নেয়ার পরিণতি গণতন্ত্রের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। মাইনাস টুওয়ালাদের প্রসঙ্গই ধরা যাক। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, তেমন কোনো সম্ভাবনা সত্যি সৃষ্টি হয়ে থাকলে তার পেছনে ক্ষমতাসীনদের নীতি ও কার্যক্রমই প্রধানত দায়ী। রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু বানানোর পরিবর্তে জাতীয় সংসদকে অকার্যকর করা থেকে শুরু করে সংবিধানকে ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করা এবং বিরোধী দলের ওপর দমন-নির্যাতন চালানো পর্যন্ত সর্বতোভাবে ফ্যাসিস্ট কর্মকান্ডের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরাই সংকট ও সংঘাতকে অনিবার্য করে তুলেছেন। বিরোধী দলকে যদি সংসদের বাইরে তথা রাজপথে ঠেলে দেয়া না হতো এবং বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে যদি নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হতো তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্র যেমন বাধাগ্রস্ত হতো না তেমনি সুযোগ সৃষ্টি হতো না কল্পিত মাইনাস টুওয়ালাদের জন্যও। এটাই যুক্তির কথা। আমরা তো মনে করি, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। কারণ, বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসহ সংবিধানের প্রশ্নে ব্যাপক ছাড় দিয়েছেন। আলোচনার দরোজা খুলে দেয়ার মাধ্যমেও সরকারের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, শুধু নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে সম্মত হলেই সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে মেয়াদ পূর্ণ করার সুযোগ দেবেন তারা। এ জন্যই ধমক দেয়ার কিংবা সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার আর সুযোগ নেই ধরনের বাগাড়ম্বর করার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের উচিত বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসা এবং বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো। বলা দরকার, সদিচ্ছা থাকলে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়। কিভাবে সংবিধান সংশোধন করা যায় সেটা তো মাননীয় আইনমন্ত্রীরই ভালোভাবে জানার কথা।  এজন্য দরকার তাদের নীতি ও মনোভাবে পরিবর্তন আনা এবং সমঝোতার পথে পা বাড়ানো। আমরা শুধু এটুকুই বলতে চাই, সময় একেবারে ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সমঝোতার পথে আসতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads