বৃহস্পতিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৩

বাতাসে লাশের গন্ধ


ছেলেটার ফুটফুটে চেহারা। বয়স ১০ বছর, মাদরাসার হিফজ বিভাগের ছাত্র। স্বপ্ন কুরআনে হাফেজ হওয়ার। গরিব টেম্পো চালকের ছেলে হওয়ায় দাদির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুকনো পাতা কুড়াতে যেত নাতি, এই ছোট্ট ছেলে রাব্বি। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ প্রান্তর, বিশাল বৃক্ষরাজির শ্যামল ছায়া, ঝরে পড়া পাতা, শোকাতর মা, দাদি, বাবা, আপনজন কেউ হয়তো জানত না, বুকে লালন করা হাফেজে কুরআন হওয়ার স্বপ্ন অসম্পূর্ণ রেখে ঝরে পড়বে শিশু রাব্বি। আর কখনো সে ফিরবে না। আধিপত্য বিস্তার, তুচ্ছ কোন্দল, নেতৃত্বের সঙ্ঘাতে অকালে প্রাণ গেল এই মাসুম শিশুটির। বাকৃবির ছাত্রলীগ সভাপতি সামসুদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমন কাউকে চিনত না শিশুটি। সে কারোর নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল না। তবু তার প্রাণটাই কেড়ে নিলো ঘাতকের বুলেট। মাঠে যেখানে দাদি গরু চরাচ্ছিলেন সেখানেই গোলাগুলির শব্দ শুনে, দাদিকে বাঁচাতে ছুটে যায় রাব্বি। দাদির কাছে পৌঁছে তাকে স্পর্শ করার আগেই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে সে। ‘দাদিগো, দাদি; তাড়াতাড়ি আয় গোলাগুলি অইতাছে, চল বাড়ি যাই গ্যা’ এই কথাগুলোই ছিল তার জীবনের শেষ কথা। রাব্বি ঠিকই বাড়ি ফিরেছে; মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত একটি মানবিক রাষ্ট্রে কেবল ফিরতে পারছি না আমরা, প্রিয় মাতৃভূমিকে একদল দানব পাশবিকতার নাগপাশে বন্দী করে রেখেছে। রাব্বির নিথর লাশের পাশে আর একটি লাশের ছবি ছেপেছে একই দিনের পত্রিকায়। আর এক হতভাগী শিশুকন্যা রিতু। নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর সভ্য(!) লোকদের বহুতল টাওয়ারের বাথরুম থেকে শিশু রিতুর (১০) অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, একাধিক ব্যক্তি পাশবিক নির্যাতন শেষে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করেছে। ভাত বিক্রি করা গরিব মায়ের মেয়ে রিতু। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে নির্যাতিত-নিপীড়িত লাশের মিছিল অথচ শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। ডিজিটাল দানবে পরিণত হওয়া ছাত্রলীগকে এনালগ হওয়ার নসিহত করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি বলেছেন, ‘সৌজন্যতা ও ভদ্রতায় এনালগ হও। ফরমালিনমুক্ত হও।’ কিন্তু মন্ত্রীর এই উপদেশ মনে হয় অরণ্যে রোদন হয়েছে। কারণ পাশবিকতা আর বীভৎসতায় ছাত্রলীগের ডিজিটাল হওয়ার মাত্রা যেন দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ইবিতে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তারা প্রতিপক্ষকে গুলি করেছে। বুয়েটে, জাবিতে ভিসির লাঠিয়াল বাহিনীর দায়িত্ব পালন করেছে। বঙ্গবন্ধুর কুলখানির খোরমা বণ্টন নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে হাতুড়ি পেটা করে সহপাঠীকে হত্যা করেছে রাবিতে। ভিন্ন গ্রুপের সহপাঠীকে চারতলা হলের ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আধিপত্য দেখাতে গিয়ে জবি আর কবি নজরুল কলেজের ছাত্রলীগ সঙ্ঘাতে জড়িয়ে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে শিক্ষকদের গাড়ি।

রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর ছুড়ে মেরেছে এসিড। আহত শিক্ষকেরা এখনো হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। এক দিকে পুলিশ শিক্ষকদের ওপর স্প্রে করছে বিষাক্ত ‘পিপার স্প্রে’ যার বিষাক্ততায় একজন শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। অন্য দিকে ছাত্রলীগ শিক্ষাগুরুর ওপর করছে ‘এসিড স্প্রে’। বিচিত্র গণতান্ত্রিক শাসন ‘আমি হিন্দু, কোনো রাজনীতি করি না, আমাকে মেরো না।’ এভাবে আকুতি জানিয়েও জীবন বাঁচাতে পারেনি নিরপরাধ, ‘রাজনীতি নিরপেক্ষ’ পথচারী বিশ্বজিৎ। ছাত্রলীগের হিংস্র চাপাতি-পিস্তল-রামদা-রড-কিরিচের কোপে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে বিশ্বজিতের রোগা শরীর, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, ৫৫ হাজার বর্গমাইলের প্রিয় মাতৃভূমির মানচিত্র। সাতক্ষীরায় বিবাহিত হিন্দু বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারি দ্বারা। কলামিস্ট পীর হাবিবুর রহমান ২০ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিনে বাধ্য হয়ে লিখেছেন, ‘এই ছাত্রলীগকে রুখে দাঁড়ানোর যেন কেউ নেই’। তিনি অ্যাকশন মিনিস্টার ওবায়দুল কাদেরের কাছে আকুতিও জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে এই সন্ত্রাসীদের রুখে দাঁড়ানোর, আইনের আওতার আনার। ১৯/১/১৩ তারিখে ‘একুশের রাত’-এ আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, ‘ক্ষমতার দম্ভে ছাত্রলীগ যা খুশি তা-ই করছে। নীতি, আদর্শ, পড়শোনা সব বাদ দিয়ে গোলাগুলি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, খুন, সন্ত্রাস ছাত্রলীগের কাজ হয়ে গেছে। এটা তো চরম নৈরাজ্য। আমরাও ছাত্রলীগ করেছি। কিন্তু এটা কোন ছাত্রলীগ? নিজ দলের ছাত্র সংগঠন সম্পর্কে এই প্রশ্নটা তিনি কাকে করেছেন, উত্তরটাই বা কে দেবে? জানা যায় তার পরের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘মূল নেতৃত্ব এখানে কী করছে? এ ব্যাপারে অবশ্যই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজর দেয়া উচিত। যারা মাসলম্যান তারাই নেতা। যারা টেন্ডারবাজি করতে পারে তারাই নেতা।’ মূল নেতৃত্ব বললে প্রসঙ্গতই চলে আসে দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রীর কথা। তিনি একবার ছাত্রলীগের নেতৃত্বের প্রধান থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা শাপলা চত্বরের সমাবেশে ছাত্রলীগের হাতে বই-খাতা-কলম তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বই-খাতা-কলমের পরিবর্তে ছাত্রলীগের হাতে এখন কী আছে, প্রধানমন্ত্রী কি তা দেখছেন না? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি দেখতে পাচ্ছেন না, ছাত্রলীগের হাতে শামসুল আলম গোলাপ, বিশ্বজিৎ ও রাব্বির রক্ত! ছাত্রলীগের হাতে মানুষ খুনের ছুরি, পিস্তল, রামদা, চাপাতি, লগি-বৈঠা; শিক্ষক পেটানোর লাঠি, এসিড! ছাত্রলীগের হাতে প্রতিপক্ষকে গুলি করতে পুলিশের রাইফেল, রড, হাতুড়ি-কিরিচ! সাতক্ষীরা, আনন্দমোহন কলেজের সম্ভ্রম হারানো বোনের আব্রু! প্রধানমন্ত্রী কি দেখতে পাচ্ছেন না? মানুষের নির্মম মৃত্যু চিৎকার কি পৌঁছাচ্ছে না শাসকের কুম্ভ কর্ণে? স্বজনের আর্তচিৎকার আর বেদনার্ত অশ্রু কি স্পর্শ করছে না শাসকের পাষাণ হৃদয়ের প্রাচীর! নাকি তিনি/তারা আরামের শীতনিদ্রায় আছেন?!
আমরা আর রাব্বির মতো লাশ হতে চাই না। আর একজন রাব্বিও যেন এই পশুদের হাতে মৃত্যুবরণ না করে, সে জন্য এই জঙ্গিদের রাজনীতি থেকে বাইরে রাখা হোক। বিশ্বজিৎ, রিতু বা রাব্বিকে সবাই ভুলে যাবে। তাদের সমাধি বা কবরে পড়বে না কারো পুষ্পার্ঘ্য ফুলমাল্য। পল্লী কবিরে তাই নকল করে বলতে ইচ্ছা হয়, ‘হতভাগ্য এই মজলুমদের বাসে নাই কেহ ভালো,/ কবরে তাদের জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।/ বানর পাখিরা উঁহু উঁহু করে কেঁদে মরে রাত দিন,/ পাতায় পাতায় বেজে ওঠে যেন তারই বেদনার বিণ।’ আমরা সাধারণ পাবলিক, তাদের জন্য কী-ই বা আর করার আছে?! হাতজোড় করে দোয়া মাঙ্গি শুধুÑ
হায় খোদা রহমান
বেহেশত নাজিল করিও সকল মৃত্যু ব্যথিত প্রাণ!

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads