সোমবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৩

পারমাণবিক কেন্দ্র ও সমরাস্ত্র ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর : একটি পর্যালোচনা



গত ১৫ জানুয়ারি ক্রেমলিনে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে তিনটি চুক্তি ও ৬টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। উভয় দেশের সরকারের পক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এ সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। স্বাক্ষরিত চুক্তির মধ্যে বহুল আলোচিত রূপপুর ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং প্রায় আট হাজার কোটি টাকার সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের চুক্তিও রয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সব অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ক্রয় করবে। অস্ত্র ক্রয়ের জন্য প্রদত্ত ১০০ কোটি ডলার ঋণ তথা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার জন্য যে সুদ ধরা হয়েছে তার হার হচ্ছে ৪ শতাংশ। অন্যদিকে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্যতা যাচাই এর লক্ষ্যে রাশিয়া বাংলাদেশকে প্রথম কিস্তিতে শতকরা এক ভাগ হারে ৫০ কোটি ডলার (প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা) ঋণ প্রদান করছে। ২য় কিস্তিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য দেশটি বাংলাদেশকে ১.৭৫ শতাংশ সুদে আরও ৩৫০ কোটি ডলার ঋণ দিবে। অর্থাৎ অস্ত্র ক্রয় ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ উভয় কাজে বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ঋণ পাবে সর্বমোট ৫০০ কোটি ডলার অর্থাৎ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য পত্র-পত্রিকাসমূহে এ ঋণের পরিমাণ দেড়শ কোটি ডলার বা প্রায় বারো হাজার কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সম্ভবত এই কারণে যে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ এই টাকাটিই পাচ্ছে এবং পরবর্তীকালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর অবশিষ্ট আটাশ হাজার কোটি টাকা পাবে। সমরাস্ত্রের ন্যায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সাজ-সরঞ্জাম এবং জনবলও বাংলাদেশকে রাশিয়া থেকেই গ্রহণ করতে হবে।
উল্লেখযোগ্য যে, গত ১৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া সফরে যান। তার এই সফরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ, বোন শেখ রেহানা, রেহানার দুই মেয়ে রেজওয়ানা সিদ্দিকী টিউলিপ ও আজমিনা সিদ্দিকী রূপন্তী সঙ্গী হিসেবে তার সাথে ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটি ছিল শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সফর। এর আগে ২০১০ সালের নবেম্বর মাসে বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক একটি ফোরামের সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য তিনি রাশিয়া গিয়েছিলেন।
সরকার কর্তৃক ক্ষমতার মেয়াদের শেষ বছরে এসে কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল দুটি বিষয়ে রাশিয়ার সাথে চুক্তি সম্পাদন দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। অবশ্য তার সফরে যাওয়ার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি জানিয়েছিলেন যে, ১৯৭১ সালে রাশিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিল। এর প্রেক্ষিতে রাশিয়ার প্রতি বাংলাদেশের অপরিসীম কৃতজ্ঞতাবোধ রয়েছে এবং এই কৃতজ্ঞতার দায় শোধ করতেই বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। রাশিয়া থেকে অস্ত্র চুক্তির কথাও তিনি বলেছিলেন। তবে ঋণের মেয়াদ ও সুদের হার সম্পর্কিত সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
কেউ কেউ রাশিয়ার সাথে এ বিশাল অংকের ঋণচুক্তি সম্পাদন এবং সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির একটি মোড় পরিবর্তন হিসেবে আখ্যায়িত করছেন এবং এটিকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করাও শুরু হয়ে গেছে। কারো কারো মতে কৌশলগত একটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা থেকে সরে এসে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে উদীয়মান সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার প্রতি আগ্রহী করে তুলছে। বলা বাহুল্য সাংহাই সহযোগিতা সংস্থাটি মুখ্যত একটি অর্থনৈতিক ব্লক হলেও অনেকের ধারণা এতে রাশিয়ার উপস্থিতি কালক্রমে একে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যাটোর সামরিক প্রভাব নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তুলবে। অবশ্য কম্যুনিজমের আত্মহত্যা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে প্রায় সোয়া ডজন খানেক স্বাধীন সার্বভৌম নতুন দেশের অভ্যুদয় পরাশক্তির মর্যাদা থেকে রাশিয়াকে সরিয়ে দেয়। এই অবস্থায় যারা মনে করেন যে বিশ্বের একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত ন্যাটোকে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার ন্যায় একটি অর্থনৈতিক জোট সামরিক জোটে রূপান্তরিত হয়ে কাবু করতে সক্ষম হবে তারা অবস্থার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম নন। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কৌশল ভিন্ন। তারা ভারতীয় অক্ষশক্তির প্রভাবে বাংলাদেশকে তার সকল স্বাভাবিক মিত্র দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতীয়, শুধু ভারতীয় বলয়ের মধ্যেই আবদ্ধ করে রাখতে চান। রাশিয়ার সাথে চুক্তি সম্পাদন এরই একটি অংশ। এর আগে ভারতীয় নির্দেশনায় বাংলাদেশের সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস-ই শুধু বাদ দেয়া হয়নি বরং ২৫ অনুচ্ছেদে বিবৃত ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করার যে বিধানটি ছিল তাও বাতিল করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত শিথিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো সরকারের দুঃশাসন, দুর্নীতি,মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের সাথে দুর্ব্যবহার ও যুদ্ধাপরাধের বিচারে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক মান সংরক্ষণে তাগিদ দেয়ায় তারা সরকারের বৈরিতে পরিণত হয়েছেন। একজন মন্ত্রী কর্তৃক মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অশালীন ভাষায় সমালোচনা করা এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সরকার এখন একদিকে দেশকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তিতে ভাগ করে ফেলেছেন। বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তারা এখন ১৯৭১ সালের ভূমিকাকে মুখ্য নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন। এতে আমাদের বন্ধুর সংখ্যা বাড়ছে না বরং কমছে। আবার '৭১-এর মানদন্ডে সরকার যে বিচার বিশ্লেষণ করছেন তার যৌক্তিকতা নিয়েও বহু প্রশ্ন উঠেছে। ১৯৭১ সালে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র যে সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলো সেই সোভিয়েত রাশিয়া আর বর্তমান রুশ প্রজাতন্ত্র এক নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে এখন ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে এর মধ্যে রুশ প্রজাতন্ত্র একটি। এই অবস্থায় সরকারের যে অংশটি ১৯৭১ সালের প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রীকে রাশিয়ার সাথে চুক্তিতে অনুপ্রাণিত করেছেন তারা প্রকৃতপক্ষে পতিত কম্যুনিস্ট শক্তির উচ্ছিষ্টভোগী। তারা সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ঝালাই করে কম্যুনিজমের পুনরুত্থানে ভূমিকা রাখতে চান। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শচ্যুত কম্যুনিস্টদের চারিত্রিক যে দুর্দশা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়ে গেছে তা দেশবাসীর কাছে আর অজানা নয়। আওয়ামী লীগ দলটি এখন নেতৃত্বের দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এবং মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাই এই দলের নীতি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করছেন বলে মনে হয়। এই অবস্থায় কৌশলগত ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাশীন দলটি ভারতীয় বলয়কে কাজে লাগানোর জন্যই রাশিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
অস্ত্র চুক্তির কথাই ধরা যাক। এই চুক্তির ব্যাপারে ইতোমধ্যে দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বিস্তর কথা-বার্তা বলেছেন। সরকার একাত্তরের ঋণ শোধের কথা বলেছেন। বিপুল অংকের সুদের বিনিময়ে ঋণ নিয়ে ঋণ শোধের বিষয়টি হাস্যকর। অস্ত্র ক্রয়ের বিষয়টি বিবেচনা করতে গেলে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে সেটি হচ্ছে আমাদের প্রতিরক্ষা নীতি। আমাদের প্রতিরক্ষা নীতিটি কি দেশবাসী সে সম্পর্কে অবহিত আছেন বলে মনে হয় না। আমাদের সীমান্তে প্রতিনিয়ত বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে। তারা গুলী করে, পিটিয়ে আমাদের নাগরিকদের হত্যা করে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য গুলী করতে বাধ্য হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা কখন কিভাবে বাংলাদেশীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে সে সম্পর্কে আমরা অবহিত নই। আবার কেউ কেউ বলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যরা যখন কথা বলেন তখন মনে হয় যেন তারা ভারতের মন্ত্রী বা নাগরিক হিসেবে কথা বলছেন। ভারতের সাথে আমাদের স্থল সীমান্তের দৈর্ঘ্য চার হাজার কিলোমিটারের বেশি। বার্মার সাথে যে সীমান্ত তা খুবই নগণ্য। দক্ষিণে আছে বিশাল বঙ্গোপসাগর। ভারত আমাদের লোকজনদের ধরে নিয়ে যায়, নির্যাতন করে। আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না। তারা আমাদের ভূখন্ডে এসে জবরদস্তি চাষাবাদ করে। ফসল কেটে নিয়ে যায়, গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যায় এবং দীঘি-পুকুরের মাছ ধরে। আমরা প্রতিবাদ করি না, করার সাহস নেই। আবার আমাদের বিডিআর জোয়ানরা যখন ভারতের জবরদখল থেকে আমাদের ভূখন্ড উদ্ধার করে তখন এই জওয়ানরা শাস্তি পায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তা ফেরত দেয়া হয়। এই অবস্থায় প্রতিরক্ষা নীতির বিষয়টি চূড়ান্ত না করে এই সরকার কর্তৃক অস্ত্র ক্রয়ের বিষয়টি নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই অস্ত্র কার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। আগ্রাসী ভারতের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই নয়। তাহলে কি দেশবাসীর বিরুদ্ধে? নাকি বঙ্গোপসাগরের বিরুদ্ধে? আমাদের সেনাবাহিনীর ওপর দেশ রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে। তারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বেরও প্রতীক এবং এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাদের আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত হতে হবে। কিন্তু এই অস্ত্র অবশ্যই কার্যকর ও আধুনিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। আন্তর্জাতিক মান ও মূল্যের দিক থেকেও তা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। যে অস্ত্র ক্রয় করা হচ্ছে তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আফ্রিকার দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেকগুলো দেশ রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এর কারণ এর অকার্যকারিতা। শেখ হাসিনা তার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শাসনামলে মিগ-২৯ সামরিক বিমান ক্রয়  করেছিলেন। সেই বিমান আকাশে ওড়েনি এবং এ সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির ঘটনা এখনো বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজার যাচাই না করে শতকরা ৪ ভাগ সুদে ঋণ নিয়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন জাতীয় স্বার্থকে বিপন্ন করে তুলবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সাবেক প্রধান এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেছেন যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ইতঃপূর্বে যত অস্ত্র সম্ভার সংগ্রহ করা হয়েছে তার বেশির ভাগই এসেছে বিনামূল্যে অথবা বন্ধুত্বপূর্ণ রেটে প্রতীকী মূল্যে। এই অবস্থায় আট হাজার কোটি টাকার ঋণ এবং তার উপর ৪% সুদ দেশকে কঠিন ঋণের জালে আবদ্ধ করে ফেলবে যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া জাতীয় অর্থনীতির উপর মারাত্মকভাবে দেখা দিতে পারে।
এখন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়ে আসা যাক। ষাটের দশক তথা পাকিস্তান আমল থেকেই আমরা এই পারমাণবিক কেন্দ্রটির কথা শুনে আসছি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি পাকিস্তান সরকার এখানে পারমাণবিক বোমা তৈরিরও পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তা আর কার্যকর হয়নি। এক সময় তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। এরশাদ আমলের শেষের দিকে সম্ভবত বর্তমান সরকারের এই শেষ বছরের ন্যায় প্রেস্টিজ প্রকল্প হিসেবে এটিকে গ্রহণ করে একবার Feasibility study'র কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু তার অগ্রগতি হয়নি। এখন এই সরকার পদ্মা সেতু তৈরিতে ব্যর্থ হয়ে আরেকটি প্রেস্টিজ প্রকল্প হিসেবে রূপপুরকে সামনে এনেছেন এবং চুক্তি সম্পাদন করেছেন। এই চুক্তির মূল্য এই দেশের মানুষকে অনেক বেশি দিতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর যে ফিজিবিলিটির কথা বলা হচ্ছে এবং যার জন্য প্রাথমিকভাবে ৫০ কোটি ডলারের ঋণও নেয়া হচ্ছে তার মধ্যে শুধু বৈজ্ঞানিক সম্ভাব্যতাই অন্তর্ভুক্ত আছে অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা নয়। পারমাণবিক বৈদ্যুতিক কেন্দ্রের জন্য সাজ-সরঞ্জাম যা দরকার তার সবকিছুই রাশিয়া থেকে আমাদের কিনতে হবে। কারোর কারোর ধারণা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানির প্রয়োজন হয় না। এ ধারণা সঠিক নয়। জ্বালানি হিসেবে এক্ষেত্রে প্লুটোনিয়াম ব্যবহৃত হয়। রাশিয়া থেকে তাও আমাদের আমদানি করতে হবে। কেন্দ্রটি তারাই তৈরি করবেন এবং তারাই পরিচালনা করবেন। ব্যবস্থাপনা থাকবে তাদেরই হাতে। জনশক্তিও তাদের। এখানে যে পারমাণবিক বর্জ্য তৈরি হবে তা অস্ত্র তৈরির জন্য রাশিয়াই নিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ কোন মূল্য পাবে না। বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুযায়ী ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক কোনও বিদ্যুৎ কেন্দ্র এই দামে দুনিয়ার কোথাও স্থাপিত হয়নি। এর Operational cost, Management cost প্রভৃতি যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে সাড়ে তিনশ কোটি ডলার এক্ষেত্রে মোটেই পর্যাপ্ত নয় এবং এ জন্যে চিরস্থায়ীভাবেই আমাদের রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। এর প্রধান কারণ বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার জন্য কোন জনবল নেই। রাশিয়ার সাথে এ জন্য যে টেকনিক্যাল চুক্তি সম্পাদিত হবে তা মূল্যায়নের জন্যও আমাদের কাছে কোন বিশেষজ্ঞ নেই। আমাদের যে এটমিক এনার্জি কমিশন আছে তাদের কাছে যেমন নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার অথবা নিউক্লিয়ার সাইন্টিষ্ট নেই তেমনি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞও নেই। এই অবস্থায় অপারেশন পর্যায়ে যদি কোন বিপর্যয় দেখা দেয় তা রোধ করা অথবা পারমাণবিক কেন্দ্রের সামগ্রিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা-শোনার জন্যে কি ব্যবস্থা গৃহীত হবে সে বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। চেরনোবিলের পারমাণবিক কেন্দ্রের লিকেইজ বিশ্বব্যাপী যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে তার রেশ এখনো চলছে। অতি সাম্প্রতিককালে জাপানের একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে অনুরূপ একটি ঘটনা সারাবিশ্বে তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছিল এবং জাপান ও বিশ্ববাসীর সৌভাগ্য যে তা মোকাবিলার জন্য যে প্রযুক্তি ও জনবলের প্রয়োজন ছিল জাপানের কাছে তা ছিল। কিন্তু আমাদের বেলায় কি হবে? পারমাণবিক কেন্দ্রের দূষণ থেকে আমরা কিভাবে নিজেদের রক্ষা করবো? উত্তরবঙ্গের যে ঘনবসতি এলাকায় এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হচ্ছে তার জনগণ পরিবেশ, প্রতিবেশ এই কেন্দ্রের রেভিয়েশন থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে। এই বিষয়গুলো সুরাহার আগে সরকার কেন এবং কার পরামর্শে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে হাত দিচ্ছেন এবং দেশবাসীকে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলছেন তা বোধগম্য নয়। আমরা মনে করি বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়া দরকার এবং বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে তা পুনর্বিবেচনা করা দরকার। তা যদি না হয় তাহলে ধরে নিতে হবে যে জাতীয় স্বার্থে নয়, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশের অতীত যে রেকর্ড রয়েছে তার যদি পুনরাবৃত্তি হয় তাহলে ৪০,০০০ কোটি টাকা দশ শতাংশ কমিশন বাবদ ৪০০০ কোটি টাকা কারুর পকেটস্থ হবার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
প্রতিবেশী ভারতের একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনা শেষ করতে চাই। ভারতের খ্যাতনামা পর্যটন শহর কন্যা কুমারী থেকে ২৪ কিঃমিঃ দূরে ভারত সরকার কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নামে একটি স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল এবং এই লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে তার চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হতে পারেনি। চেরনোবিল এবং ফুকুসিমা বিপর্যয়ের পর প্রস্তাবিত কেন্দ্রের আশপাশের গ্রামবাসীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং তাদের আন্দোলন ও বিরোধিতার মুখে এই কেন্দ্র নির্মাণ এখন ঝুলে পড়েছে।  গত নবেম্বরে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট কুদানকুলামের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে কেন্দ্র নির্মাণে অগ্রসর হবার জন্য ইউনিয়ন গভর্নমেন্টকে নির্দেশ দিয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের ভাষায় There must be no Compromise on safety and rehabilitaton. We are making it absolutely clear that all the guidelines and safety measures for handling disasters must be put in place before the plant is commissioned. আমাদের সরকার দেশবাসীকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই অবস্থায় বিরোধী দলগুলো, সুশীল সমাজ ও পরিবেশবাদীরা দেশবাসীকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।

1 টি মন্তব্য:

Ads