শনিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩

কাণ্ডারি হুঁশিয়ার


এম. আবদুল হাফিজ

মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি তার শাসনের চার বছর পূর্তির ভাষণে তার সরকারের ‘আকাশচুম্বী’ সাফল্যের দাবির পাশাপাশি ইনিয়ে বিনিয়ে আরো যেসব কথা বলেছেন সেগুলোর সারসংক্ষেপে গণতন্ত্রের জন্য তার উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়। তিনি এ-ও দাবি করেন, তার ক্ষমতার বর্তমান মেয়াদে তিনি গণতন্ত্রকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিতের ওপর দাঁড় করাতে প্রয়াস পেয়ে যাচ্ছেন এবং রাজনীতিতে তার প্রধান প্রচেষ্টাই গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখা। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? সমাজ বা রাষ্ট্রদেহে আমরা কী দেখি? সেখানে কি প্রকৃতই গণতন্ত্রের কোনো প্রতিফলন আছে?
যে গণতন্ত্রকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সংবিধানে মূল চার স্তম্ভের প্রথম এবং প্রধান হিসেবে সন্নিবেশিত করা হলো অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামে যে গণতন্ত্র মূল চালিকাশক্তিরূপে ব্যবহার হলো এবং গণতন্ত্রপাগল দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থনে বঙ্গবন্ধু গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা পেলেন এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামও অভাবনীয়ভাবে সাফল্যমণ্ডিত হলো জাতির জনক মাত্র আড়াই বছরের মাথায় সেই গণতন্ত্রকে টুঁটি চেপে আঁতুড়ঘরেই হত্যা করার মতো করেই হত্যা করেছিলেন, তারই আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের সপক্ষে যখন কিছু বলে তা কি এক নিদারুণ পরিহাস নয়?
এ দেশের সংস্কৃতিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে সব কিছু বলা যায়, করাও যায়। তা না হলে বিএনপির প্রতিবাদে বা আন্দোলনে যেকোনো ছুতোয় জেল-জুলুমের খড়গ উঁচিয়েই রাখা আছে। ঠুনকো কারণে অসংখ্য বিরোধীদলীয়দেরকে মামলা ও রিমান্ডে জড়িয়ে বিপর্যস্ত করে রাখা হয়েছে বিরোধী দলকে। এক প্রচণ্ড দমননীতির ঝাপটায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের বা তা প্রকাশের উৎসাহও নেই অনেকের। আওয়ামী লীগের বটেই সব ক্ষমতাসীনের আমলেই গণতন্ত্র থেকেছে নিছক বহিরাবরণরূপেই। অন্দর মহলে এ দেশ সব সরকারই পরিচালনা করেছে এক ধরনের প্লুটোক্রাসি। সেই প্রবণতা এখনো অব্যাহত। রাজনীতিতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন না ঘটলে ভবিষ্যতেও যে তা থাকবে, নিরাপদেই তেমন উক্তি করা যায়।
তবে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রজাতি, যাদের শুধু ক্ষমতায়ই বিশ্বাস। এর বাইরেও যে অন্য কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে জনমনে আবেদন সৃষ্টি করা যায়, আওয়ামী অভিধানে এমন কোনো কিছু নেই। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এরাই পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের সব বৈশিষ্ট্য ও প্রতীককে এক এক করে বিলুপ্ত করেছিল। গণতন্ত্রের সে কী ভয়ানক নিধনযজ্ঞ! সেই যজ্ঞ শেষে যে দানব বেরিয়ে এসেছিল তা হলো একদলীয় বাকশালী শাসনপদ্ধতি, যার শীর্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তার বিশ্বস্ত অন্ধ সমর্থকদেরসহ স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। জনবিচ্ছিন্নতা ঘটলে এমনই রাজনৈতিক বিকৃতি নেমে আসে একজন আদর্শবাদীর সযতœলালিত আদর্শে ও বিশ্বাসে।
ক্ষমতাকে ধরে রাখার বিভিন্ন কারসাজির মধ্য দিয়ে আজকের আওয়ামী লীগও প্রকারান্তরে বাকশালী রাজনৈতিক কৌশলেরই আশ্রয় নিয়েছে। তবুও স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পরিসর আরো বিস্তৃত থাকার কারণে তখন কিছু বহিরাগতেরও ক্ষমতার বলয়ে দেখা গিয়েছে। কিন্তু আজকের শেখ হাসিনার ক্ষমতার বলয়ে পারস্পরিক স্বার্থরক্ষার ভিত্তিতে (Quid pro quo) কিছু উপদেষ্টা নামধারী আমলা, অন্দরমহল বা Inner Circle-এর কিছু রাজনৈতিক সহকর্মী ছাড়া বেশির ভাগই নাকি কোনো না কোনোভাবে পারিবারিক সূত্রে প্রধানমন্ত্রীর সাথে গ্রন্থিত। বাংলাদেশ তাদের একক সম্পত্তি। তবে দেশের ষোলো কোটি মানুষের প্রয়োজনও তার আছে যাদের উদ্দেশ্যে তিনি তার শাসনের চার বছর পূর্তির ভাষণ দিয়েছেন এবং তাকে তাদের (জনগণের) সেবার জন্য আরেকটি সুযোগ চেয়েছেন।
তবে তা আরেকটি সুযোগে শেষ হওয়ার নয়। ক্ষমতা একটি আসক্তির নাম, যা মাদকাসক্তির চেয়েও মারাত্মক। মাননীয়া শেখ হাসিনা তার ক্ষমতার প্রতিটি অনুষঙ্গ উপভোগ করেন। স্তাবকদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বন্দনাও তার প্রিয়। তিনি উপভোগ করেন সামরিক অনার গার্ড, স্যালুট এবং কুচকাওয়াজ পরিদর্শন যদিও স্বাধীনতার পর চরম অবহেলিত এক সামরিক বাহিনীর বিপরীতে তৎকালীন আওয়ামী সরকার রক্ষীবাহিনীর উৎপত্তি ঘটিয়েছিল। নিন্দুকদের কথায় ভারতীয়রা নাকি বঙ্গবন্ধুকে এই মুসিবতকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে বিরত রেখেছিলেন। তাদের পরামর্শমতো দলীয় নিয়ন্ত্রণে একটি রক্ষীবাহিনী তার ক্রমবর্ধমান বিরোধীদের নির্মূলে কার্যকর হবে। আজো মনে পড়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর একটি ইউনিফর্মের তালাশে তখন হন্যে হয়ে ঘুরেছি। অবশেষে আমার অনুজপ্রতিম তৎকালীন ডিএসআই কর্নেল সালাউদ্দিন আমাকে অনেক কষ্টে এক পাট ইউনির্ফম জোগাড় করে দিয়েছিল।
অথচ পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টে সামরিক বাহিনীর কর্নেল জামিলই বঙ্গবন্ধুর সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল, খুনি চক্র তাদের বত্রিশ নম্বরে ধাবমান বিস্ফোরকবিহীন সাঁজোয়া বহর নিয়ে ওই একই এলাকা অতিক্রম করেছিল। আগের কথায় ফিরে যাই। শক্তির প্রতীক গুলিসহ শক্তিধর সব কিছুকে আওয়ামী লীগের পছন্দ। তেমনিভাবে তৈরি হয়েছে তাদের ক্যাডার বাহিনী। এককালের আদর্শবাদী ছাত্রলীগকে সরকারি আনুকূল্যেই পরিণত করা হয়েছে এক ভয়াবহ দানবে। এমন শিক্ষাঙ্গনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাসহ স্বয়ং শিক্ষকমণ্ডলী এদের ভয়ে সন্ত্রস্ত। সেখানে এদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে পুলিশ থাকলেও তারা নীরব দর্শক বা ছাত্রলীগ মাস্তানদের সহযোগী যাতে ওই তথাকথিত ছাত্র নেতারা নির্বিবাদে তাদের বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন : ‘কোন বাণিজ্যে নিবাস তোমার, কহো আমার ধনি। তাহা হলে সেই বাণিজ্যে করবো মহাজনি।’ কবিগুরুকে দিয়ে সেই মহাজনি হয়নি। কিন্তু ছাত্রলীগওয়ালারা আলবৎ জানে কী করে সেই মহাজনি রপ্ত করতে হয়। তাদের ঝুলিতে আছে টেন্ডার, ভর্তি, সিট এবং আরো রকমারি বাণিজ্যের ব্যবস্থাপত্র। শুনেছি যে অধুনা ক্যাম্পাসে জমজমাট ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ সব মাদকের ব্যবসায় এবং সেটাও নাকি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগ ভাগবাটোয়ারা কলহ কদর্য রূপ ধারণ করলে তাদের ‘দেশরতœ’ তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের (অথবা আনুকূল্য প্রত্যাহারের) হুঙ্কার দিলেও তা সেখানেই সমাপ্তি লাভ করে। আওয়ামীরা জানে যে রাজনীতির ময়দানে এরা তাদের লাঠিয়াল। তাই তাদের বর্জন আওয়ামীদের জন্য ক্ষতিকর হবে।
শুরু করেছিলাম আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রপ্রীতির কথা দিয়ে। গণতন্ত্রের প্রথম ও শেষ কথা বহুত্ববাদী সমাজ (Plural Society) প্রতিষ্ঠার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও একজন গণতন্ত্রবাদী বঙ্গবন্ধু তা বুঝতে চাননি, কিন্তু একজন সৈনিক জিয়া তা ঠিকই বুঝেছিলেন এবং একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন। তারই বদৌলতে আজ মাননীয়া শেখ হাসিনা বা তার আওয়ামী লীগ আজ রাজনীতির অঙ্গনে। নতুবা বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর তো কোনো আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব ছিল না।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেভাবে এবং যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতার দণ্ড ধারণ করেছে, তা নিয়ে অনেক কাহিনী অনেক বিতর্ক আছে, যা দুর্ভাগা কবলিত এ দেশের মানুষ দুঃস্বপ্নের মতো ভুলে যেতে যায় এবং একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতার পালাবদল দেখতে চায়।
দশম সংসদের নির্বাচন যখন প্রায় দ্বারপ্রান্তে আওয়ামী লীগে নির্বাচনবিষয়ক গেম প্ল্যান পুরো বিষয়টিকে বিতর্কিত করেছে। সাংবিধানিক সংশোধনী এনে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করে বাজিমাৎ করার আওয়ামী পরিকল্পনা এবং বিএনপিসহ দেশবাসীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিস্তর আলোচনা ইতোমধ্যে হয়েছে, সে সবের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। তবে এটুকু বলতেই হয় যে, আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত সর্বনাশা খেলা দেশকে একটি অবধারিত সঙ্ঘাতের মধ্যে ঠেলে দেবে যা কোনো পক্ষই সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তাই এখনই সময় এ নিয়ে সব পক্ষের অংশগ্রহণে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো। যদি আওয়ামী এবং তাদের সমর্থক বা চলমান বিতর্কে ইতি টেনে তড়িঘড়ি করে তাদের পরিকল্পিত পথে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ‘ফেইট এফম্প্লি’ হাসিল করতে চায়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads