শনিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৩

মুজিবের লাল বাহিনী ভাসানীকে হত্যা করতে চেয়েছিল: হাসিনা বাদ দিলেন জীবনী


আ ব দু ল হা ই শি ক দা র

খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের বহুল আলোচিত এবং আলোড়িত বই ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বরে। বছর বিচারে আমার প্রায় সমান বয়সী এই গ্রন্থকে ১৯৫৮ সালে একবার, ১৯৬৫ সালে আরেকবার মোট দু’বার বাজেয়াপ্ত করেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। জনগণকে এ বই তারা পড়তে দেবে না। জানতে দেবে না মওলানা ভাসানীকে।
১৯৫৪ সালের মার্চ মাসের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে চিরকালের জন্য কবরে শায়িত করে, এদেশের জনগণ তথা যুক্তফ্রন্টকে যারা বিজয়ের মুকুট পরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই তিন নেতার অন্যতম ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আমাদের জাতীয় রাজনীতির গণমুখী ধারার অগ্রনায়ক, আমাদের জাতীয় রাজনীতির শেষ প্রমিথিউস। অন্য দুই নেতা ছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
পূর্ব বাংলায় শেরেবাংলার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পর, একই বছর ২৭ মে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য মওলানা ভাসানী ইউরোপ গমন করলেন। মওলানার ইউরোপে যাত্রার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে, ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বাতিল করে জারি করেন ৯২(ক) ধারা। চালু হয় কেন্দ্রীয় শাসন। ভদ্রলোক মানুষ হিসেবে পরিচিত চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে সরিয়ে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন তত্কালীন প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইসকান্দার মির্জাকে। নতুন গভর্নর ঢাকায় পৌঁছেই উর্দি ও বর্দি পরে হাত দিয়ে মিলিটারি ব্যাটন ঘোরাতে ঘোরাতে সদম্ভে ঘোষণা করলেন, ‘ভাসানী হলেন ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর। ভাসানী রাষ্ট্রদ্রোহী। রাষ্ট্রদ্রোহী ভাসানীকে দেশে প্রত্যাবর্তনমাত্র গুলি করে হত্যা করা হবে।’
ইসকান্দার মির্জার এই অসভ্য দম্ভোক্তির প্রায় ৫৩ বছর পর এক সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে পাকিস্তান সফরে যাই আমি। সফরকালে করাচি, ইসলামাবাদ ও লাহোরের বহু বিদগ্ধজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় আমার। দ্বিপাক্ষিক এবং অমীমাংসিত অনেক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় হয় আমাদের। তারা সবাই এক বাক্যে বলেছেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন আফ্রো-এশীয় ল্যাটিন আমেরিকার শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের মহান নেতা।
উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামে তিনি যে ভূমিকা রেখে গেছেন; তার সঙ্গে তুলনা করার মতো নাম আজও বিশ্বে খুব বেশি নেই। আর ইসকান্দার মির্জা? পাকিস্তানের রক্ত-মাংস খুবলে খুবলে খাওয়ার জন্য যে ক’টি হিংস্র লোভী স্বার্থপর ক্ষুধার্ত প্রাণী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ক্ষমতার ওপর, তাদেরই অন্যতম ছিল এই মির্জা। বংশধারার দিক থেকে সে যেমন ছিল আপনাদের মীর জাফরের অধস্তন বংশধর, তেমনি চরিত্রও ছিল একই রকম। ফলে তার মতো নিকৃষ্ট, জঘন্য ষড়যন্ত্রকারীর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল এক মহান নেতা সম্পর্কে ওরকম কথা বলা।
আমাকে অনেক পাকিস্তানি বলেছেন, দেখুন সেই সময়কার পাকিস্তানে মাত্র দু’জন সর্বপাকিস্তানীয় নেতা ছিলেন—একজন সোহরাওয়ার্দী, আরেকজন মওলানা ভাসানী। পূর্ব এবং পশ্চিমে যে দিকেই তাকান না কেন, আর সবাই ছিলেন আঞ্চলিক নেতা। তারপর তার ন্যাপও ছিল একমাত্র সর্বপাকিস্তানীয় দল। পাকিস্তানের যেখানেই যান না কেন, এখনও ভাসানী অনুসারীদের পাবেন আপনি। মাহমুদ আলী কাসুরী, মাহমুদুল হক ওসমানী, সিআর আসলাম, মিয়া ইফতেখার, আরিফ ইফতেখার কিংবা কানিজ ফাতিমার অনুসারীরা এখনও পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে মওলানা ভাসানীর নাম উচ্চারণ করেন। আর উল্টোদিকে ইসকান্দার মির্জাকে ‘মানুষ’ মনে করে এমন একজন লোকও আপনি সারা পাকিস্তানে খুঁজে পাবেন না। বরং লোকেরা বলবে, ও ছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক গগনের শনি। ষড়যন্ত্র আর সামরিক শাসনের মধ্যে পাকিস্তানকে নিক্ষেপ করে বারোটা বাজিয়ে গেছে গণতন্ত্রের। ধ্বংস করে দিয়ে গেছে পাকিস্তানের সংহতি। তো আবর্জনার স্থান তো ভাগাড়েই হয়। শেষ পর্যন্ত ওর স্থানও হয়েছে ইতিহাসের ডাস্টবিনে। পাকিস্তানের কুকুরগুলো পর্যন্ত বলে, ও ছিল কুকুর কুলের মধ্যেও নিকৃষ্ট।

দুই.
আওয়ামী লীগের ‘জাতির পিতা’ শেখ মুজিব যার পায়ের তলায় বসে রাজনীতি শিখেছেন, আজকের আওয়ামী লীগের জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বাপ্নিক, অত্যাচারী শাসক ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক, বাংলাদেশের অমিততেজা জাতিসত্তার অপরাজেয় স্পন্দন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা সংগ্রামের প্রধানতম চেতনা, মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি—তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশ ও মওলানা ভাসানী যেমন একই অস্তিত্বের ভিন্ন নাম, তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মওলানা ভাসানী পরস্পরের পরিপূরক। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশেরও প্রধান নির্মাতাদের একজন তিনি। সেই মওলানা ভাসানীর ওপর সরকার এবার লেলিয়ে দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে। অর্থাত্ স্বাধীনতার ঘোষক বীর মুক্তিযোদ্ধা, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বাংলাদেশের গর্ব ও অহঙ্কার একমাত্র নোবেলজয়ী বাংলাদেশী ড. ইউনূসের পর বর্তমান সরকার এবার টার্গেট করেছে মওলানা ভাসানীকে। বিএনপির কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম ঠিকই বলেছেন, ‘জাতি গঠনে অন্য ক্ষণজন্মা নেতাদের অবদান অস্বীকার করে একদল-একনেতার দেশে বাংলাদেশকে পরিণত করার আওয়ামী সরকারের উদ্যম ও উদ্যোগের শেষ নেই।’
‘নিজেরে করিতে গৌরবদান, নিজেরে কেবলি করি অপমান’ বলে কবিরা যতই বলুক, আওয়ামী কুলরবিরা তাতে গা করেন না। অজানা আশঙ্কায় সব সময় কম্পমান থাকে তারা, এই বুঝি ‘বঙ্গবন্ধু’ ক্রেডিট শেষ হয়ে গেল। এই বুঝি তাদের বিকৃত তথ্যের ঝোলের জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল। এই বুঝি প্রকৃত সত্য বেরিয়ে পড়ে। এই কারণেই তারা ১৯৭১-৭৫ এর মতো ‘এক নেতা এক দেশ/বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে গোঁয়ারের মতো নতুন করে আরেকটি ফ্যাসিবাদ কায়েমের সর্বনাশা পথে পা বাড়িয়েছে। নতুন বাকশালের দাঁত ঘষটানির শব্দ এখন সর্বত্র। যার অর্থ বাংলাদেশে শেখ মুজিব ছাড়া আর কোনো নেতা থাকবে না। আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দল থাকবে না। আওয়ামী লীগার ছাড়া আর কোনো মানুষ থাকতে পারবে না।
ইউনূসের বেলায় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও তাদের গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী এবং গণমাধ্যমের চাপাকে ঢালাও ব্যবহার করেছে সরকার। জিয়াউর রহমানের বেলায় বেছে নিয়েছিল সব রকম অস্ত্র। মঞ্চ, সংবাদপত্র, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, পাতিমন্ত্রীদের চাপায় যতদূর কূলায় তার চেয়েও অধিক বর্বর ভাষায় নিকাশ করা হয়েছে এই নেতাকে। তারপর জিয়ার নামাঙ্কিত যেখানে যত স্থাপনা আছে সেগুলোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তারপরও ভয় যায়নি প্রধানমন্ত্রী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের। তারা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) ব্যবহার করেছে দলীয় প্রচার সেলের মতো। পাঠ্যপুস্তকে যেখানে যেভাবে দরকার সেভাবেই জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে সঞ্চার করেছে কুত্সা। মুছে দিয়েছে তার নাম।
এবার তাদের টার্গেট বাংলাদেশের অন্যতম স্থপতি মওলানা ভাসানী। একই এনসিটিবির মাধ্যমে তারা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক থেকেই ঝেড়ে-মুছে বাদ দিয়েছে এই মহান নেতার জীবনী। অর্থাত্ বাংলাদেশের যা কিছু মহত্, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সত্য, যা কিছু বড় হওয়ার প্রেরণা জোগাবে—তার ছিটেফোঁটাও যেন পাঠ্যপুস্তকে না থাকে। ছেলেমেয়েরা অষ্টপ্রহর শুধু জপবে ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের তসবিহ। এরপর যদি কারও নাম নিতেই হয়, তিনি তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কে হবেন!
এই ফর্মুলা মোতাবেক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের নাম মুছে দেয়া হয়েছে। যেমন উধাও হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক প্রকৃত বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানীর সব চিহ্ন। এখনকার পাঠ্যপুস্তকে আর হাজী মহসিনের কাহিনী থাকে না। বাংলা ভাষাকে প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিদাতা ন্যায়পরায়ণ শাসক গিয়াসউদ্দিন আজম শাহও এখন অচ্ছুত্। তিতুমীর, ঈশা খাঁ, শরীয়তুল্লাহ, টিপু পাগল, শমসের গাজীর চাইতে অনেক বড় ‘বীর’ হিসেবে ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটেছে ফারুক খান, শাজাহান খান, আবুল মাল, আবুল হোসেন, মসিউর, মোদাচ্ছের, গওহর রিজভীদের। আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে আছেন শাহজাদা ‘জয়’।
পাঠ্যপুস্তক থেকে মওলানা ভাসানীর নাম বাদ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বেছে নিলেন কাকে? নুরুল ইসলাম নাহিদকে। যেমন ভাসানী নভোথিয়েটার থেকে ‘ভাসানী’ বিতাড়নে ভূমিকা রেখেছিলেন ইয়াফেস ওসমান। ইনু, মেনন, দিলীপ বড়ুয়ার যত দোষই থাক, শেখের চামড়া দিয়ে এরা যত ডুগডুগিই বাজাক, কিন্তু শেখের সত্যিকার ক্ষতি যারা করেছিল তারা এই নাহিদ সাহেবরা। এরাও শেখের চামড়া দিয়ে জুতা বানানোর স্বপ্ন দেখত। তারপর শেখের লাথি ঝাঁটা খেতে খেতে যখন প্রাণ যায়, তখন এরা বেছে নিয়েছিল ভিন্ন পথ। বন্ধুর বেশে, হিতাকাঙ্ক্ষীর বেশে এরা সওয়ার হয়েছিল শেখের ঘাড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ শাসক শেখ মুজিব তার মস্তিষ্ক দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে এদের কুবুদ্ধিকে সুবুদ্ধি মনে করেছিলেন। ফট করে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন সব রাজনৈতিক দল, সব সংবাদপত্র। তারপর গঠন করেছিলেন ‘বাকশাল’। যা পরে তার জন্য ডেকে আনে ভয়ঙ্কর পরিণতি।
সেই একই শক্তি, সেই একই ব্যক্তিরা এখন শেখ হাসিনার চারপাশে। সত্যিকারের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন ব্রাত্য। ফলে এই পরগাছা শ্রেণীর দাপট এখন আকাশচুম্বী। সেই দাপট দিয়ে শেখ হাসিনাকে ধনেমানে ডোবানোর জন্যই এরা এনসিটিবিকে দিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিয়েছে মওলানা ভাসানীর নাম। নাকি প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ বুদ্ধিতেই হচ্ছে সব? যদি তাই হয়, তাহলে তো তার সামনে ঘোর বিপদ।

তিন.
মওলানা ভাসানীর ওপর যারাই অপবাদ দেয়ার চেষ্টা করেছে, চাপিয়ে দিয়েছে অন্যায়, কর্তন করতে চেয়েছে তার নাম, ইতিহাস সাক্ষী তাদের প্রত্যেকেরই পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ।
মওলানা ভাসানী যে শুধু জনমননন্দিত জননেতা ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন অনেক বড় মাপের আধ্যাত্মিক নেতা। তাছাড়া স্বভাবগতভাবে বাংলাদেশের মানুষও এমন যে, তারা মওলানার ওপর কোনো জুলুমই কখনও মেনে নেয়নি। দেরিতে হলেও তারা অপরাধীর কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে চরম কাফফারা।
পূর্ব বাংলার অত্যাচারী জমিদাররা মওলানার বিরুদ্ধে লাগল। মওলানার অপরাধ তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেন গরিব চাষীদের। ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় মওলানাকে করা হলো ‘কুইট বেঙ্গল’। বাংলা ছাড়ার আগে সন্তোষের অত্যাচারী জমিদারের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, মানুষ এবং ইতিহাস আমার পক্ষে। আমি বিজয়ীর বেশে ফিরে আসব। তোমাদের উদ্ধত শির সেদিন লুটাবে ধুলায়। আর গরিব চাষীর রক্তের বিনিময়ে গড়ে ওঠা এসব সুরম্য বালাখানায় আমি গড়ে তুলব শিক্ষাঙ্গন।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে উত্সারিত ব্রিটিশদের এসব ‘অবৈধ সন্তান’দের সত্যি চিরকালের জন্য উত্খাত করে গেছেন ভাসানী। আর সন্তোষের রাজবাড়ী আজ মানুষ গড়ার কারখানা।
ইসকান্দার মির্জাকে কান ধরে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছিলেন তারই শিষ্য আইয়ুব খান। তাকে এক বস্ত্রে ত্যাগ করতে হয়েছিল পাকিস্তান। বাকি জীবন লন্ডনে ভাতের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে।
১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার সামান্য পরই, মওলানা যখন ভারতীয় লুণ্ঠন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করলেন, সোভিয়েত ষড়যন্ত্রের কথা বলা শুরু করলেন, শুনে গা জ্বলে উঠলো আজকের নুরুল ইসলাম নাহিদদের নির্মাতা কমরেড মণি সিংয়ের। তিনি সরকারি ছত্রছায়ায় বসে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করে ঘোষণা করলেন, রুশ ও ভারতের বিরুদ্ধে আর যদি একটি কথাও মওলানা বলেন তাহলে তাকে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলা হবে। বাংলাদেশের মাটিতে রুশ-ভারতের বিরোধিতাকারীদের ঠাঁই নেই। মওলানা ভাসানী তার স্বভাবজাত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, মণি সিং তুমি হলে ‘অভিশপ্ত’। বাংলাদেশ কোনো অভিশপ্ত লোকের জন্য নয়। কোনো দালালদের জন্যও নয়। এটা তোমাদের পৈতৃক জমিদারি নয়। এ দেশের মালিক এ দেশের জনগণ। সেই জনগণের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে আমি কথা বলেই যাব। আর তোমাদের মতো দালালদের জন্য অপেক্ষা করছে ধ্বংস।
কমরেড মণি সিংয়ের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো বিরাগ নেই। কিন্তু কে না জানে, বাকি জীবন তাকে কাটাতে হয়েছে শয্যায়। কেন তিনি অচল হয়ে পড়েছিলেন তা আল্লাহই ভালো জানেন।
শেখ মুজিবকে শেখ মুজিব বানানোর ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা ছিল অনন্য। দু’জনের সম্পর্কও ছিল পিতা-পুত্রের মতো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় মওলানাই গড়ে তোলেন তুমুল গণআন্দোলন। মওলানা আওয়াজ তোলেন—‘জেলের তালা ভাঙবো/ শেখ মুজিবকে আনবো।’ এ পথেই গড়ে ওঠে ’৬৯-এর গণআন্দোলন। ‘বীরের’ মতো জেল থেকে বেরিয়ে আসেন শেখ মুজিব। ’৭০-এর নির্বাচনের পর শেখ মুজিবকে বাংলার ভাবী সিরাজ বলে অভিনন্দিত করেন মওলানা ভাসানী। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তাজউদ্দিন সরকারকে তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন দেন।
সেই শেখ মুজিব ১৯৭২-এ দেশে ফিরে রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী দিয়ে দেশজুড়ে কায়েম করেন এক ত্রাসের রাজত্ব। ঘোষণা করেন নকশাল দেখা মাত্র গুলি কর। এটা ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য ঢালাও নির্দেশ। সে সময় শেখের মাধ্যমে লক্ষাধিক বামপন্থীকে হত্যা করার নীলনকশাও চূড়ান্ত হয় (হক কথা, ১ম বর্ষ, ত্রয়োদশ সংখ্যা, ২৬ মে ১৯৭২)।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গু রাখতে রুশ-ভারত মেতে ওঠে নানা ষড়যন্ত্রে। পাকিস্তানে আটকে পড়া বেঙ্গল রেজিমেন্ট ফিরে আসুক, সেটাও চাইছিল না তারা।
৩০ মে কিশোরগঞ্জের এক সভায় মওলানা ঘোষণা করলেন, লাল বাহিনী দিয়ে কৃষক সমিতি দমন করলে মুজিবের দশা হবে চিয়াং কাইশেকের মতো।
এ সময় রিলিফ লুণ্ঠন, অবাধ চোরাচালান ও আওয়ামী লীগের দখল বাণিজ্য নিয়েও সোচ্চার হয়ে পড়েন বৃদ্ধ নেতা।
এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবকে সামনে নিয়ে ভাসানীকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে একই চক্র (হক কথা, ১৬ জুন ১৯৭২)। এ কাজে অধিক সক্রিয় ছিল শেখ মুজিবের লাল বাহিনী।
মওলানা ভাসানীর হক কথা সে সময় হত্যা, লুণ্ঠন, গুম, চুরি এবং নানামুখী চক্রান্তের বিরুদ্ধে পালন করতে থাকে সাহসী ভূমিকা। ক্রুদ্ধ শেখ মুজিব গ্রেফতার করলেন হক কথা সম্পাদক ইরফানুল বারীকে। সে সময় শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকারও হরণ করে মুজিব সরকার। মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশকে ঠেলে দেয় সর্বনাশের মধ্যে। ভারতীয়রা বাংলাদেশকে পরিণত করে তাদের কেরদানী ফলানোর রঙ্গমঞ্চে। সাংবাদিকদের বিরাট অংশ পরিণত হয় শেখ মুজিবের দাবার ঘুঁটিতে। দেশে দেখা দিতে থাকে দুর্ভিক্ষ। যা ’৭৪-এ বীভত্স আকার ধারণ করে। হক কথা লিখলো, শেখ মুজিবের ‘আমি ভাতে মারবো, পানিতে মারবো’ নির্মম পরিহাস নিয়ে সত্য হলো। ভাসানী ডাক দিলেন ভুখা মিছিলের। নিপীড়িত ভাগ্যহত অনশনবন্দী জাগো। এরই মধ্যে চালনা বন্দর দেয়া হলো আমেরিকাকে। কিসিঞ্জারের গোপন সফর নিয়ে রিপোর্ট করলো হক কথা। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সেই গোপন ৭টি চুক্তি ফলাও করে ছাপা হলো হক কথায়। বরিশালের জনসভায় মওলানা বললেন, মুজিব তোমার লুটেরাদের বিচার করো। মানুষ হত্যা বন্ধ করো। জনগণকে বললেন, বাংলাদেশের মাটিতে ভারত ও রাশিয়ার কবর রচনা করো।
ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ শেখ মুজিব নিষিদ্ধ করে দিলেন হক কথার প্রকাশনা।
বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ গৃহবন্দী করলেন তার ‘রাজনৈতিক পিতা’ মওলানা ভাসানীকে। যে শেখ মুজিবকে জেল থেকে বের করার জন্য তুমুল আন্দোলন করেছিলেন ভাসানী, স্বাধীন বাংলাদেশে তার হাতেই বন্দী হলেন ভাসানী!
তার পরের ইতিহাস বাকশাল গঠনের ইতিহাস। তার পরের কাহিনী বেদনাদায়ক কাহিনী।

চার.
হাতি-ঘোড়া গেল তল, ভেকে বলে কত জল। শেখ হাসিনার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে নুরুল ইসলাম নাহিদরা শীতার্ত ইঁদুর থেকে এখন ‘বাঘে’ পরিণত হয়েছেন। কিন্তু এই সব বাঘ যে নিতান্তই কাগুজে তা বলাই বাহুল্য। কারণ এখন যদি শেখ হাসিনা এদের বের করে দেন, তাহলে এই ‘এতিমদের’ দাঁড়াবার জায়গাটুকুও থাকবে না।
তো নাহিদ সাহেব এতটাই অথর্ব যে, এমসি কলেজের ভস্মীভূত হোস্টেল দেখে তিনি ভেউ ভেউ কাঁদেন। প্রতিকার করার মুরোদ তার নেই। তার হাত দিয়ে দেশের সবক’টি শিক্ষাঙ্গন এখন রণক্ষেত্র। তার পেটোয়া ছাত্রলীগাররা এখন এসিড ছুড়ে মারছে শিক্ষকদের ওপর। মেয়েদের হোস্টেলে ঢুকে করছে শ্লীলতাহানি। তার মন্ত্রণালয়ে ঘুষ আর অনিয়মের ছড়াছড়ি। শহীদ মিনারকে পরিণত করা হয়েছে শিক্ষক পেটানোর ময়দানে।
সেই কীর্তিমান নাহিদ সাহেব তার কুিসত এবং অথর্ব হাত দিয়ে আঘাত করেছেন মওলানা ভাসানীর ওপর। তার পবিত্র নামের ওপর। এ কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন এনসিটিবির দায়িত্বজ্ঞানহীন সুবিধাকাঙ্গাল একদল কর্মকর্তাকে। তাদের সঙ্গে হুক্কাহুয়া দিয়েছেন দু’চারজন বুদ্ধিজীবী। তারা সম্মিলিতভাবে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিয়েছে এদেশের মহানায়কের জীবনী। জাতির জন্য হাসিনা সরকারের এ হলো সর্বশেষ অবদান! যার মাসুল তাকে দিতে হবে।
মওলানা ভাসানীর নাম পাঠ্যপুস্তকে থাকলো কী থাকলো না তাতে তার বিদেহী আত্মার কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমরা যারা জনগণ, তাদের অনেক যায় আসে। কারণ আমরা তো চাই আমাদের ছেলেমেয়েরা সঠিক ইতিহাস পড়ুক। যথার্থ অর্থে ‘মানুষ’ হোক। বড় হওয়ার শিক্ষা পাক। মহত্ প্রাণের মানুষ হোক। সবকিছুর ঊর্ধ্বে মূল্য দিতে শিখুক দেশ ও জনগণকে। সেই আমাদের ছেলেদের সম্মুখ থেকে মানুষকে ভালোবাসার ‘মডেল’কে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় আইকনকে মুছে দেয়া হয়েছে। এটা মোটেই ছোটখাটো বিষয় নয়। এর পেছনে আছে সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত। বাংলাদেশের মানুষকে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করার এ হলো এক একটি ধাপ। শিক্ষার্থীদের হীনম্মন্য করে গড়ে তোলার জন্য, তাদেরকে নিজের ইতিহাসকে অশ্রদ্ধা শেখানোর এ হলো একটা পদক্ষেপ। এর শেষ গন্তব্য ব্যর্থ ও অকার্যকর বাংলাদেশ।
এ পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? দেশপ্রেমিক জনগণের করণীয় কী? রাজনৈতিক দলগুলোরই বা করণীয় কী? রাজনীতিবিদরা আন্দোলন গড়ে তুলবেন কী তুলবেন না, আমি জানি না। কিন্তু যারা আমজনতা, যাদের দল নেই, আছে দেশ। আছে দেশপ্রেম। তাদের এখন একটাই কাজ, তা হলো কারা কারা এই জাতীয় অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা করে রাখা। পরে যাতে এরা বর্ণ পরিবর্তনের সুযোগ না পায়। তারপর
‘আসিলে সময়
বিশ্বময়
তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিণ্ডে
পদাঘাত হানি
নিয়ে যাব জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে টানি।’
a_hyesikder@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads