মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

অস্ত্রচুক্তি অপ্র্রয়োজনীয় দায় সৃষ্টি করবে

প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফর পাল্টে দিচ্ছে পররাষ্ট্র কৌশল?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিন দিনের রাশিয়া সফরে গতকাল ১০০ কোটি ডলারের (আট হাজার ২৫০ কোটি টাকা) অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ বিভিন্ন েেত্র সহযোগিতামূলক তিনটি চুক্তি এবং ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অস্ত্রচুক্তির আওতায় রাশিয়ার কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সরবরাহ ঋণে সেনাবাহিনীর জন্য সাত ধরনের এবং বিমানবাহিনীর জন্য চার ধরনের সমরাস্ত্র কেনা হবে। সেনাবাহিনীর সমরাস্ত্রের তালিকায় রয়েছে ট্যাংকবিধ্বংসী মিসাইল, সাঁজোয়া যান, স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড লঞ্চার, নৌপথে সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক পারাপারের পন্টুন, বিমানবাহিনীর প্রশিণ জঙ্গিবিমান, সামরিক পণ্য পরিবহন হেলিকপ্টার, গামা রাডার ইত্যাদি। চুক্তি অনুযায়ী এই কেনাকাটার জন্য অগ্রিম হিসেবে রাশিয়াকে ৮০০ কোটি টাকা দিতে হবে। ঋণের সুদ হবে ৫ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১৭ সালের মধ্যে কেনাকাটার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। স্বাধীনতার এত বছর পরও কোনো প্রতিরা নীতি না থাকায় সমরকৌশলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারগুলো সশস্ত্র বাহিনীর জন্য অস্ত্র কিনতে পারেনি। এ কারণে কোন প্রক্রিয়ায়, কিভাবে এবং কতটুকু যৌক্তিক প্রয়োজনে এসব কেনাকাটা হয়; তা নিয়ে সব সময়ই আলোচনা-সমালোচনা হয়ে আসছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিমান বাহিনীর জন্য রাশিয়া থেকে আটটি মিগ-২৯ বিমান কেনা হয়েছিল। মোট ১২ কোটি ৪০ লাখ ডলার (এক হাজার কোটি টাকা) দিয়ে ওই জঙ্গিবিমানগুলো কেনা নিয়ে পরবর্তী সময়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এখন এই মিগের দু’টি মাত্র আকাশে উড়তে পারে। আর দু’টি ছোটখাটো মেরামত করে ওড়ার মতো অবস্থায় আছে। এসব বিষয় বিবেচনায় তখনই বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের মিগ কেনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। ২০০১ সালে বিএনপি  নেতৃত্বাধীন জোট সরকার মিগের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে সঙ্কটে পড়ে এবং এগুলোর উচ্চ রক্ষণাবেক্ষণ খরচের জন্য ওই মিগগুলো বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু মামলার কারণে শেষ পর্যন্ত মিগগুলো বিক্রির প্রক্রিয়া থেমে যায়।

সরকারের ক্ষমতার মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এসে আগের বারের আট গুণ বেশি দামের অস্ত্র কেন কিনতে হচ্ছে তার কোনো স্পষ্ট জবাব নেই। বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য এ মুহূর্তে কোনো সামরিক শত্রু দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় উন্নয়ন ও সেবামূলক খাতগুলোতে মনোযোগ দেয়া যেখানে ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি না করে আট সহস্রাধিক কোটি টাকার অস্ত্র কেনা দেশের মানুষের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করবে। ৫ শতাংশের কাছাকাছি সুদসহ পাঁচ বছরে এসব অস্ত্রশস্ত্রের দায় শোধ করতে হলে প্রতি বছর বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে শোধ করতে হবে। রেয়াতি বৈদেশিক সাহায্য যেখানে কমে যাচ্ছে সেখানে এ বিপুল দায় রাষ্ট্রকে খেলাপি হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছাবে কি না, এসব ভাবা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কৌশলের বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো স্বল্পোন্নত দেশ তার সীমিত প্রতিরক্ষা সামর্থ্যকে সামনে রেখে এ কৌশল বিন্যাস করে। এ কারণে ব্যয়বহুল প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার দিকে এ ধরনের দেশগুলো যায় না। গত ৪০ বছরে মিগ ও ফ্রিগেড কেনা ছাড়া এর তেমন একটা ব্যত্যয় ঘটেনি। রাশিয়া থেকে যেসব যুদ্ধাস্ত্র কেনার চুক্তি করা হচ্ছে তার মান নিয়ে বড় কোনো প্রশ্ন উঠবে না, কিন্তু যেসব সূত্র থেকে এর আগে এসব অস্ত্র বাংলাদেশ সংগ্রহ করেছে তার তুলনায় এখানে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি দাম দিতে হচ্ছে। আর এসবের রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বেশি। ব্যয়বহুল ও উচ্চাভিলাষী ধরনের যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহে বাজেটের বড় অংশ ব্যয়ের আরেকটি বিপদ হলো এর অর্থসংস্থান করতে গিয়ে দৈনন্দিন প্রতিরক্ষা সামর্থ্যরে জন্য যে অস্ত্র-গোলাবারুদ কিনতে হয় তাতে টান পড়ে যায়। আর শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিরক্ষা কেনাকাটাতে পুরো স্বচ্ছতা না থাকায় এ ধরনের কেনাকাটার সাথে বিভিন্ন দেশে বিদায়ী সরকারের নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের একটি সম্পর্ক আবিষ্কারেরও চেষ্টা করা হয়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য এবার ৫০ কোটি ডলারের চুক্তি হচ্ছে। বাংলাদেশের অবশ্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন এবং পারমাণবিক বিদ্যুতে প্রাথমিকভাবে অধিক বিনিয়োগ হলেও তুলনামূলক স্বল্পদামে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। চেরনোবিলের দুর্ঘটনার পরও এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সামর্থ্যরে ব্যাপারে বড় কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির দেশে এ ধরনের প্রকল্পের নিরাপত্তার দিকটাও ভাবা দরকার । বিশ্বে বিভিন্ন দেশ যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে সেখানে কেন আমরা সেদিকে এগোচ্ছি, এ ব্যাপারে আরো স্পষ্ট বক্তব্য প্রয়োজন। জাপানের মতো দেশ পারমাণবিক চুল্লির বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আমরা কিভাবে পারব? এসব বিষয় ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।
প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে কৌশলগত মিত্র বাছাইয়ে নতুন চিন্তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরতার বাস্তব বিষয় না ভেবে ১৯৭১ সালের আবেগ দিয়ে পররাষ্ট্র সম্পর্কে নীতি পরিবর্তনের বিপদ যে হতে পারে সেটি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। এখনো বাংলাদেশের ২২ শতাংশ পণ্য রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ৪৫ শতাংশের মতো পণ্য যায় ইউরোপে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো  রেয়াতি ঋণ দেয়ার প্রতিষ্ঠান প্রধানত নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউর দেশগুলো। দুই-তৃতীয়াংশ রেমিট্যান্স আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এসব বিষয় না ভেবে পশ্চিমের বিকল্প শক্তির সাথে বিশেষ সম্পর্কের পদক্ষেপ সরকার ও দেশের জন্য আত্মঘাতীও হতে পারে।
আমরা মনে করি, সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ হওয়া উচিত রাষ্ট্র ও দেশের জনগণের কথা ভেবে। আবেগ জাতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু বাস্তবতাবর্জিত আবেগ হবে বিপর্যয়কর। সরকারের শেষ সময়ে এখনই প্রয়োজন নেই এমন ধরনের বিরাট দায় সৃষ্টি করে কেনাকাটা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। এ দায় নিঃসন্দেহে পরবর্তী সরকারকে বিরাট অর্থনৈতিক চাপে ফেলবে। অনুৎপাদনশীল খাতে বিপুল দায় সৃষ্টির পরিবর্তে অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিা ও সামাজিক খাতে আরো মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। সুযোগ থাকলে অস্ত্র কেনার চুক্তি পর্যালোচনা করা দরকার এবং এ ব্যাপারে জাতিকে অন্ধকারে রাখা কোনোভাবেই ঠিক হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads