সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

নিন্দার বিষয়টি সরকারকে স্পর্শ করবে কী



জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, শিক্ষকরা জাতি গঠনের কারিগর। এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-কর্মচারীদের ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও পিপার স্প্রে বা তরল গ্যাস নিক্ষেপ করে নিন্দনীয় কাজ করেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। উল্লেখ্য যে, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা এখন এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। গত রোববার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন শেষে কমিশনের চেয়ারম্যানকে স্মারকলিপি দিতে গেলে ড. মিজানুর রহমান আরো বলেন, কিছু পুলিশ সদস্য অতি উৎসাহী হয়ে এসব কাজ করছেন, এটা কখনো জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এ ধরনের নিন্দনীয় কাজ যেন পুলিশ সদস্যরা আর না করেন সেজন্য তিনি আহবান জানান। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, মানবাধিকার কমিশনের সামনেও আন্দোলনরত শিক্ষকরা অবস্থান করতে পারেননি। পুলিশ তাদের অবস্থান ধর্মঘটে বাধা দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। এর আগে জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনশন করতে গেলে পিপার গ্যাস স্প্রে করে সেই কর্মসূচি পন্ড করে দেয় পুলিশ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আন্দোলনরত শিক্ষকরা এখন যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নিজেদের অধিকার ও দাবির বিষয় নিয়ে কর্মসূচি পালনের সুযোগ পাচ্ছেন না তারা আমাদের এই গণতান্ত্রিক দেশে। বর্তমান সময়ে দেশে একের পর এক যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, যেভাবে জুলুম-নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে তাতে জনগণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে বসবাস করছে এমনটি ভাবতে পারছে না। সরকারের মন্ত্রী বাহাদুর ও দলীয় নেতা-কর্মীরা উচ্চকণ্ঠে নিজেদের গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বর্ণনা করলেও পর্যবেক্ষকমহল স্পষ্টভাবেই এখন বলছেন যে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। এখন যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, সরকারের সুরে সুর না মেলালেই বিপদ ঘনীভূত হয়ে আসবে। এক্ষেত্রে জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষকরাও রেহাই পায় না। শিক্ষকদের ওপর এখন জুলুম-নিপীড়ন শুধু পুলিশই চালায় না, এক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আরো ভয়ংকর। তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলেই এখন তারা শিক্ষকদের শুধু প্রহারই করছে না, তাদের শরীরে নিক্ষেপ করছে এসিডও। ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলার ভয়ে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন ক্যাম্পাসে আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হোস্টেলে প্রবেশ করে ইন্টার্নী চিকিৎসক ও ছাত্রীদের মারধর ও কয়েকজনের শ্লীলতাহানিও করে। গণতান্ত্রিক সরকারের যুবশক্তির এ হলো আচরণ। এজন্য শুধু ছাত্রলীগকে দায়ী করে লাভ নেই। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উস্কানির বিষয়টিও উল্লেখ করতে হয়। মুখে গণতন্ত্রের কথা উচ্চারণ করে আচরণে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠলে সমাজের যে অবস্থা দাঁড়ায়, এখন আমরা সেটাই যেন প্রত্যক্ষ করছি। উন্নত জীবন এবং গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্যে দেশের জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল। এ লক্ষ্যেই গত ৪১ বছর ধরে দেশের জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দিয়ে এসেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, নির্বাচনী ইশতেহারে গণআকাঙক্ষার কথা চমৎকারভাবে লিপিবদ্ধ হলেও তার বাস্তবায়ন হয়েছে খুবই কম। ফলে দিন বদলের কথা বহুলভাবে উচ্চারিত হলেও জনগণের দিন বদল আর হয়নি। ট্রাজেডি হলো, জনগণের দিন বদল না হলেও সরকারি ঘরানার কর্তা ব্যক্তিদের দিন বদল হয়েছে ঠিকই। আমরা জানি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য প্রয়োজন হয় সুশাসনের এবং নীতি নিষ্ঠতার। কোন সমাজে সুশাসন না থাকলে এবং নীতিনিষ্ঠা না থাকলে সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি জনগণের দুঃখের মাত্রা বাড়ে। তখন সাধারণ জনগণ এবং বিভিন্ন পেশার লোকদের সাথে সরকারের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় নিজেদের ত্রুটি স্বীকার করে কর্তব্যকর্মে এগিয়ে গেলে জনতার ক্ষোভ হ্রাস পেয়ে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এমন সুমতি সরকারের হয় না। বরং ক্ষমতার উষ্ণতায়, দাপুটে মেজাজে সরকার তখন দমন-অবদমনের পথেই পা বাড়ায়। সরকারের এমন অবদমন থেকে রক্ষা পান না জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষকরাও। এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর তরল গ্যাস নিক্ষেপের ঘটনায় আমরা তেমন চিত্রই লক্ষ্য করেছি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এ ঘটনার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই নিন্দার বিষয়টি সরকারকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads