বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১২

সমুদ্র জয়, সাংবাদিক জয় এবং অন্যান্য জয়



আ মী ন কা দী র
একের পর এক জয়ের নেশায় পেয়ে বসেছে মহাজোট সরকারকে। জয় তো নয়, একেকটা যেন মহাবিজয়। বাঙালি পুঙ্গব বিজয় সিংহ লঙ্কা বিজয় করেছিলেন সেই কত শ’ বছর আগে। তারপর বিদেশ বিজয়ে বাঙালির তেমন কোনো কীর্তিকাণ্ড নেই। অনেক অনেক সাধনার পরে আমরা পেলাম মহাজোট সরকার। বহুল আকাঙ্ক্ষিত সরকার। হাজার বছর সাধনার পর যেমন আমরা পেয়েছিলাম শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান বঙ্গবন্ধুকে। তিনিও বিদেশ বিজয়ের স্বাদ দিতে পারেননি। কিন্তু তার বীরকন্যার আমলে আমরা একের পর এক অপূর্ব বিজয়ের আস্বাদ পেয়ে চলেছি।
বিজয় সিংহ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জয় করেছিলেন লঙ্কা। আর মহাজোট জয় করেছে সমুদ্র। এরই মধ্যে সমুদ্র জয় মহান কাণ্ড হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমাদের সুযোগ্য আমলা রয়েছেন। একাধারে যিনি কবি ও রাজকর্মচারী। উনি দেরি করেননি। খুব দ্রুত ইতিহাসের পাতায় ঢুকিয়ে দিলেন জয়কাব্যকে। সারাদেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজগুলোর প্রধানকে তিনি ফরমান পাঠিয়েছেন। সমুদ্র জয় নিয়ে যেন স্পেশাল ক্লাস নেয়া হয়, কোনো গাফিলতি যেন না হয়। দেশের স্থল ও জলসীমা নিয়ে সহজ করে একখানা নোটও তৈরি করা হয়েছে। এতে ফ্যাদম, নটিক্যাল মাইল, মহীসোপান ইত্যাদি উচ্চমার্গীয় শব্দ শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে। এ তো আমাদের সমুদ্র জয়ের কেবল শুরু। এরপর কত কত সমুদ্র আমাদের জয় করতে হবে যে! আমরা যে সাগর-মহাসাগরজয়ী সিন্দাবাদ নাবিক হতে চলেছি। আগামীতে এ নিয়ে কত উপন্যাস-মহাকাব্য লেখা হবে। দি ভয়েজেস অব শেখ হাসিনা অ্যান্ড ডা. দীপু মনি। খণ্ডের পর খণ্ড। মিয়ানমারের সমুদ্রজয় করেছি। এরপর ভারতের সমুদ্র জয় করতে হবে। অবশ্য সেজন্য মহাজোট সরকার এরই মধ্যে জাতির কাছে আগাম উপঢৌকনও চেয়ে বসেছে। ভারতকে হারানো তো আর যেই-সেই কম্ম নয়, যার-তার পক্ষে সম্ভবও নয়। সেই কঠিন কাজটি করতে হলে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে আগামী বার নির্বাচনে জয়ী করে আনতে হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—সেই জন্মকাল থেকে আওয়ামী লীগের প্রতীক হলো নৌকা। আর নৌকা হলো নদীযাত্রার আবহমান প্রতীক। নদীর অভিযান শেষে সমুদ্রের দিকে জয়যাত্রা শুরু করেছে নৌকা। এক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই একচ্ছত্র অধিকার। নদীনালা পেরিয়ে সাত নদীর মোহনা দিয়ে সমুদ্র জয় অভিযান শুরু হয়েছে। একটু দেরিতে হলেও বিশ্বের সর্বোচ্চ পাহাড়শৃঙ্গ জয় করেছেন মুসা ইব্রাহীম। সেই এভারেস্ট বিজয়কে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল ডেইলি স্টার মিডিয়া গ্রুপ। আমাদের সরকারের আনন্দের আটখানা কাণ্ড সমুদ্র জয়—দি ভয়েজেস অব হাসিনা-দীপুমনি-কেও স্পনসর করেছে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গ্রুপ। তারাই প্রথম জাতিকে সুখবরটা জানিয়েছিল। সমুদ্র জয় শব্দগুচ্ছ তাদেরই আবিষ্কার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝেমধ্যেই প্রথম আলো-স্টারের বিরুদ্ধে গোস্বা করেন। আশা করা যায়, এই গোস্বা এখন কাটবে। কেননা প্রথম আলোর সাম্প্রতিক সার্ভিসগুলো অসাধারণ। সমুদ্র জয়কে স্পন্সর করেছে তারা। এমন অনন্য তকমা আওয়ামী লীগের অর্ধশিক্ষিত চাটুকারদের মাথায় আসত না কোনো ভাবেই। তারপর স্টার-প্রথম আলো বিএনপির আইএসআইয়ের টাকা খাওয়ার লা-জওয়াব রিপোর্টটি ছেপে কী ভয়ংকর মারণাস্ত্রটি তুলে দিয়েছিল হাসিনার করকমলে। কী অসাধারণ জিহ্বা-সুখ পেয়েছেন মহাজোট নেত্রী। এখনও সেই অপূর্ব স্বাদ কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তিনি। প্রধানমন্ত্রী পরিবারের ঘনিষ্ঠ শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়ার সুবাদে এক লাফে একুশে পুরস্কার পেয়েছেন লন্ডনের এক কোচিং সেন্টার পরিচালক। প্রধানমন্ত্রী সব সময় তার প্রিয়জনদের মূল্যায়ন করেন। নিশ্চয়ই আগামীবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ভুল করবেন না তিনি। শীর্ষতম জাতীয় পুরস্কার অবশ্যই ওই পত্রিকা গোষ্ঠীর প্রাপ্য। আমি আগাম নাম প্রস্তাব করে রাখলাম।
স্বাধীনতার ৪২ বছরের ইতিহাসের অনেক কিছুই এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে জয় করে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে একক মালিকানায় নিয়েছে। আমরা এটাকে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু-জয়। বঙ্গবন্ধু কেবলই আওয়ামী লীগের। কিছুতেই পিতাকে হাতছাড়া করেননি হাসিনা। শেরেবাংলা, মওলানা ভাসানী, জিয়া, ওসমানী কোনো দল বিশেষের নন। চাইলে যে কেউ তাদের মাজারে ফুল দিতে পারেন। কেউ মারবে না। কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু—তিনি তো কেবলই আওয়ামী লীগের সম্পত্তি। তার কবরে ফুল দিতে গেলে অবশ্যই মুজিব কোট কাঠফাটা রোদের মধ্যেও গায়ে চড়ানো চাই-ই চাই। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, স্বাধীনতার ঘোষণা—সবকিছু এখন তাদের দখলে। এসব জয় হাসিল করতে কত্ত কষ্ট করতে হয়েছে তাদের। আইন আদালত কোর্টকাচারি।
তাদের জয় অভিযান চলছেই।
সমুদ্র জয় সে তো হালকা-পাতলা কোনো ব্যাপার নয়। কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সাগরের সোয়া লাখ মাইল দখল করার অভিযান। কয়েকখানা বাংলাদেশের সমান। প্রথমত, এজন্য দক্ষ একজন অ্যাডভোকেট-মেরিন-জেনারেল তৈরি করতে হয়েছে। আর সেই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন একজন ডাক্তার। ডা. দীপু মনি। চাঁদপুরের নদী সিকস্তি এলাকায় তার বাড়ি। বাড়ির কাছেই বিশাল সমুদ্র-সমান দিগন্ত-ছোঁয়া নদী, যে নদীর কূল নেই, কিনার নেই। শিক্ষা সচিব কবি কামাল চৌধুরীকে তার সমুদ্রজয় কাব্য-ইতিহাস রচনায় আমরা সহায়তা করতে পারি। ধারণা করা যায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি যখন ছোট ছিলেন তখন বিশাল পদ্মা-মেঘনা নদীর দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতেন—বড় হয়ে একদিন সমুদ্র জয় করবেন। মেয়েমানুষ তাই এই মহত্ স্বপ্নের কথা কাউকে সাহস করে বলেননি। বললে যদি লোকে হাসে! তাই একান্ত সঙ্গোপনে মনের মধ্যে সেটি পুষেছেন। তার বাবা ছিলেন নৌকার রাজনৈতিক সওয়ারি। দীপু স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ছাত্রলীগ হয়ে নৌকায় চড়ে বসেন। প্রবল অনীহা সত্ত্বেও একখানা এমবিবিএস ডিগ্রি নেন। কিন্তু যার মাথায় আছে সমুদ্র জয়ের অপার স্বপ্ন, তিনি সামান্য ডাক্তারি নিয়ে পড়ে থাকতে পারেন না। তিনি প্রবলবেগে পড়াশোনা শুরু করে দিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কশাস্ত্র নিয়ে। লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। রাত নেই, দিন নেই, কেবল পড়া আর পড়া। হাউ টু উইন ওশেন। পাশাপাশি মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনদের নাজায়েজ জমানায় আসে সুবর্ণ সুযোগ। শেখ হাসিনা তখন মাইনাস টু নামক রাজনৈতিক খাঁচায় বন্দি। সুরঞ্জিত-ওবায়দুল-আমু-তোফায়েল-জলিল—আওয়ামী লীগের পলিটিকাল টাইগাররা কেউ নেত্রীর পাশে নেই। নেত্রী স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সাবন্দি। দীপু মনি কোমর বেঁধে স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেমে পড়লেন। সকাল-সন্ধ্যা স্কয়ারের সামনে রাস্তায় আছেনই। রাজনৈতিক ডিউটি করছেন। হাসিনা কেমন আছেন তা টাইম টু টাইম সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন। নানা স্কুপ খোঁজখবরও দিচ্ছেন। আস্তে আস্তে টপকে যেতে লাগলেন কঠিন সব হার্ডল।
সমুদ্রজয় কি এত সহজ কাজ! নৌকা নিয়ে মেঘনার কোনা দিয়ে নৌকা নামিয়ে বরিশালের দিকে বৈঠা মারা শুরু করলেন, অমনি জয় হাতের মুঠোয় এসে গেল! দিনের পর দিন কত ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন দীপু মনি। সেই ত্যাগের ফসল হিসেবে এক লাফে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে বসলেন। ফুল মিনিস্টার। তারপর মন্ত্রী হয়ে তিনি বসে থাকেননি। প্রতি মাসেই দু-একবার করে উড়োজাহাজে চড়ে বসেছেন। যেখানে পররাষ্ট্র দফতরের একজন জুনিয়র কর্মকর্তা গেলেও চলে, তিনি নিজে ছুটে গেছেন সেখানে। কূটনৈতিক রেওয়াজ-টেওয়াজের ধার ধারেননি। বিদেশ ট্যুরের সেঞ্চুরিখানা হাঁকিয়েছেন সেই কবে। নিন্দুকেরা কত কথাই না বলেছে! তার নাকি কূটনৈতিক হায়া-শরম নেই। বড় বড় দেশে যেমন গেছেন। যেসব দেশের নাম বিশ্বমানচিত্রে এখনও ঠিকমত ওঠেনি—সমুদ্র জয়ের নেশায় সেসব অখ্যাত-অজ্ঞাত দেশেও ছুটে গেছেন। সেমিনারের নামে, নামকা ওয়াস্তে দাওয়াত পেয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষায় হাজিরা দেয়ার নামে। কোনো বাছবিচার করেননি। অবিরাম উড়ে বেড়িয়েছেন কেবল অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। এমনকি শীর্ষ রাষ্ট্রাচার পর্যায়ের ভিভিআইপি পার্টিও মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে প্লেন ধরতে ছুটে গেছেন এয়ারপোর্টে। শোনা যায়—সরকারের হাইকমান্ড তার এই অতিরিক্ত নভ-অভিযান প্রীতিতে বিরক্ত-বিব্রত-বিস্মিতও হয়েছেন। সেসবকেও মোটেই পরোয়া করেননি। যদি পরোয়া করতেন, যদি পাছে লোকের কথায় কান দিয়ে তার সেমিনার-সিম্পোজিয়াম যাত্রা পণ্ড করতেন, তবে কি আমরা সমুদ্র জয় পেতাম!
অনেক সাধ্যসাধনা করে, অনেক সাধনার পরে আমরা এই সাগর জয় পেলাম। ডা. দীপু মনির যে এত বুদ্ধি, তা কি আমরা তখন বুঝেছি? ঢাকা থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে পশ্চিম আফ্রিকা-উত্তর আফ্রিকা-ইউরোপ-আমেরিকা-সাহারা-তানজানিয়া—কত জায়গায় তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন; একালের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক কলম্বাস—এ সবই তো সমুদ্র জয়ের দুর্নিবার লক্ষ্যে। আজ খুবই মনঃকষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে, সমুদ্রবিজয়ী এই মহত্ নারীর কীর্তিকাণ্ড তখন আমরা অনুধাবন করতে পারিনি। যদি পারতাম তবে আমরা নিশ্চয়ই নৌকাবাইচের দর্শকদের মতো ডা. দীপু মনির সাগরবাইচে দর্শক-কাতারে থেকে তাকে ‘শাবাশ শাবাশ’ বলে উত্সাহ দিতে পারতাম। তাতে তার লড়াই আরও মনোজ্ঞ-মনোরঞ্জনকর হতো। সেদিক থেকে তিনি আমাদের বঞ্চিত করেছেন বৈকি। যদ্দূর জেনেছি—দীপু মনি মাত্র একজন কো-অ্যাডমিরালকে সঙ্গে নিয়ে এই ভয়াল সমুদ্রবাইচে অংশ নিয়েছেন। আইপিএল-বিপিএল-সিসিএল-কেসিএলের এই রুদ্ধশ্বাস জমানায় গোপনে এইসব আন্তর্জাতিক বাইচে কেউ অংশ নেয়! জয়পরাজয়ের যে কোনো ইভেন্টে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ঢালছে স্পন্সররা। দীপু মনি যদি আগে আমাদের চ্যানেলগুলোকে একটু হিন্টস দিতেন—আহা! আমরা একটা বাজেটের সমান ডলার এই মেগা ইভেন্ট থেকেই তুলে নিতে পারতাম। এই মহাবিজয়ের মুহূর্তে অপ্রিয় হলেও আমি বলতে দ্বিধা করব না—দেশ ও জাতিকে সেদিক থেকে বঞ্চিত করেছেন তিনি। কেন তিনি এতবড় মহাকাণ্ড নিয়ে ঢাক গুড় গুড় করলেন! একটা চটকানা মেরে সমুদ্রসীমা থেকে হটিয়ে দিয়েছেন মিয়ানমারকে। মার্কিনিরা কত অস্ত্রবাজি খুন-খারাবি করে ইরাকিদের হারালো, সেখানে আমরা কোনো রকম খরচাপাতি না করে নাসাকাদের হারালাম—একজন মাত্র নারী মেরিন জেনারেল-, এমন অনন্য কীর্তি! ছিছি! সেই কৃতিত্বের কথা আমাদের জানতে হলো শেখ হাসিনার সদা টিটকিরি-ধন্য সুশীল-উচ্চমার্গীয় কাগজ প্রথম আলোর কাছ থেকে। খুবই লজ্জার কথা! পররাষ্ট্র দফতরের মিডিয়া উইং কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়? তাছাড়া সরকারের একটা প্রফেশনাল প্রোপাগান্ডা বিভাগ রয়েছে। তথ্য অধিদফতর; দৈনিক বাংলার মতো এই দফতরটিকেও কি মহাজোট সরকার অবলুপ্ত করে দিয়েছে নাকি! পুরনো কথা—তবুও বলি। যে যাই বলুক, দৈনিক বাংলা গোষ্ঠীকে কিন্তু উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিল ঐকমত্যের সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। কেননা দৈনিক বাংলা সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা হয়েও তলে তলে সেই বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে নীরব ঘাতক হিসেবে ক্ষতি করে গেছে আওয়ামী লীগের। বিচিত্রা-দৈনিক বাংলা গোপন চৈনিকদের আখড়া হিসেবে ক্রমাগত আক্রমণ করেছে বাকশাল ও উত্তর আওয়ামী লীগকে। সে হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হাসিনা উপযুক্ত শাস্তি বিধানই করেছিলেন।
যদিও ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস—সেই বিচিত্রার কিছু কর্ণধার আজ মহাজোট থিংক ট্যাঙ্কের ফাইভ স্টার মার্শাল।
এখানে একটা সুপারিশ রাখতে চাই—মহাজোট সরকারের সবচেয়ে ধুরন্ধর মহা কীর্তি সমুদ্র জয়কে জাতির সামনে সময়মত তুলে ধরতে না পারায় একটা প্রতীকী শাস্তি দেয়া দরকার তথ্য দফতরের অকর্মণ্যদের। একটা দৈনিক কাগজ যা পারল তারা তা পারল না কেন? অথচ কর্মঠ শিক্ষা-সচিবের তত্পরতা দেখুন। তিনি একরকম একক প্রয়াসে বিষয়টিকে ঐতিহাসিক মর্যাদা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। তাকে দেখে সবার শেখা উচিত।
বিএনপি সমুদ্র জয়ের জন্য প্রথমে সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েও পরে প্রত্যাহার করে নিয়েছে; ঠিক তেমনি ওপরের সুপারিশ করেও আবার প্রত্যাহার করে নেব কিনা ভাবছি। কেননা বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী থিংক ট্যাঙ্কের তরফ থেকে আপত্তি আসতেই— তারা বিষয়টিকে সমুদ্র জয় নয়, বরং সমুদ্র হার বলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-উপাত্ত হাজির করতেই ডা. দীপু মনি কেমন ভেজা বেড়ালের মতো চুপসে গেলেন। জাতীয় সংসদে খুব উচ্ছ্বসিত গলায় বলেছিলেন— আমরা সমুদ্র জয় করেছি। বলেছিলেন, আমরা যা চেয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি।
তখনই তার কথা শুনে কেমন কেমন লাগছিল! এ কী কথা বলছেন আমাদের সমুদ্রজয়ী নারী কলম্বাস। যা চেয়েছেন তার চেয়ে বেশি পাওয়া, সে কেমন পাওয়া। কী ভয়াল অ্যাডভেঞ্চারেই না তিনি নেমেছিলেন যে মিয়ানমার তার ভয়ে সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে গেল। নাকি তিনি আদৌ জানেনই না—কী তিনি চেয়েছিলেন, আর কী পেয়েছেন। আমাদের ঝানু ঝানু অনেক আমলা শুনেছি ইংরাজিতে বড় কাঁচা। মিনিস্টার অনেকে আছেন—ইংরেজির কথা শুনলেই মহা আতঙ্কে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যান জয়েন্ট প্রেস কনফারেন্স ফেলে; শুনেছি, ইংরেজিতে গণ্ডমূর্খ হওয়ায় দাবি-দাওয়া ঠিকমত বুঝিয়েও বলতে পারেন না। কিন্তু ডা. দীপু মনি অনেক ভারী ভারী মোটা বই পড়েছেন—ডাক্তারির বইও পড়েছেন ইংরেজিতে। তার তো অমন লেজে-গোবরে করে ফেলার কথা নয়। নিশ্চয়ই তার কথা শোনায় আমাদের ভুল হয়ে থাকবে। আমরা বরং তার কথাটাকে এইভাবে শুধরে নিতে পারি—তিনি অনেক অনেক চেয়েছিলেন এবং অনেক সারপ্রাইজিং ব্লক পেয়েছেন। তিনি আদৌ কতটা চেয়েছিলেন, আদতে তিনি জানেন না।
এত বড় বড় কিতাব পড়নেঅলা মিনিস্টার- কি চাইলেন কি পেলেন এর হিসাব ঠিকমত বুঝেননি; নিন্দুকেরা যে যাই বলুক- আমার ঠিক তা বিশ্বাস হতে চায় না। ইংরাজী ভাষা তার আয়াসসাধ্য নিশ্চয়ই। আর তাই যদি হয়- তবে কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়- জার্মানির ওই মেরিন ট্রাইব্যুনালে সৌজন্য সমঝোতামূলক ভাগ বাটোয়ারায় বাংলাদেশ এমনিতেই যা পেয়েছে- অর্থাত্ সেখানে সালিশের জন্য না গেলেও এমনিতেই যা পেত- বাস্তবে তারচেয়ে অনেক কম দাবি উপস্থাপন করেছিল ডা. দীপুমনির নেতৃত্বাধীন ক্যারিশম্যাটিক দূতিয়ালী গ্রুপ। আর তাই দীপুমনির সংসদে দেয়া রেকর্ডকৃত ভাষ্যে- যেমনটা জেনেছি- চাওয়ার চাইতে অনেক বেশি পেয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়া আমার কথায় কষ্ট পেতে পারেন- তবুও আমি সবিনয়ে বলবো- ওনার উচিত ছিলো ২/৪ জন জানাশোনাঅলা মেরিটাইম এক্সপার্ট ও সলিসিটর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। কেননা এ ধরনের আদালতের আর্গুমেন্ট মানে কিন্তু কোন সেমিনারে লিখিত বক্তব্য দেখে দেখে ইংরাজী বানান উচ্চারণ করে গড়গড়িয়ে বলে যাওয়া নয়। বাদানুবাদ-বক্তব্য পাল্টা বক্তব্যর বাচনশক্তিও পকেটে থাকা চাই।
ডা. দীপুমনি প্রজ্ঞামতী বিদূষী। উনার নিশ্চয়ই বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়- জাতিসংঘে বিশ্বসভায় প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তেজস্বী ভাষণ। সেই ভাষণ কিন্তু বিদেশীরা বাংলাতে অনুধাবন করেনি। বরং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ড. কামাল হোসেন, চোস্ত ইংরাজী জানেঅলা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মতো লোক ছিলেন। যারা বাংলা ভাষণটির খসড়া দেখে দেয়ার পাশাপাশি আগেভাগেই ইংরাজী অনুবাদটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছিলেন এবং সেটি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গেই পাঠ করে শুনিয়েছেন হুমায়ুন রশীদ। বিদেশীরা উনার পড়াটাই শুনেছেন।
বর্তমান মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের চাইতে ইংরাজী বঙ্গবন্ধু কম জানতেন না। ১০ই জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর লন্ডনে তিনি ইংরাজীতে প্রেস কনফারেন্সও করেছেন। ইউটিউবে সার্চ দিলে সেটির কপি দেখতে পাবেন যে কেউ। তারপরও বঙ্গবন্ধু অতি আত্মবিশ্বাস দেখাননি। জাতিসংঘে সঙ্গে করে কামাল-হুমায়ুনসহ একদল দক্ষ সিএসপিকে নিয়ে গেছেন। দীপুমনিও তেমনি সত্যিকারের এক্সপার্টদের নিয়ে গেলে আগেভাগেই ট্রাইব্যুনালের ক্লার্ক-মুহুরিদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা জেনে নিতে পারতাম- ওরা এমনিতেই কতটা বেশি দিতে চায়। তখন ঢাকায় তৈরি ইংরাজী পেপারখানায় তাত্ক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় রদবদল এনে আরও বেশি দাবি উপস্থাপন করে আরও বিশাল সমুদ্র জয় করতে পারতাম। এই যে আগেভাগে হাওয়া-বাতাস বোঝা- সেই অনুযায়ী প্রত্যুত্পন্নমতি অর্থাত্ তাত্ক্ষণিক শানিত বুদ্ধির পরিচয় রাখাই কিন্তু কূটনৈতিক দূতিয়ালী। কোথাও সেমিনারে পেপার পাঠের মত গড়গড়িয়ে কিছু বলাই কিন্তু কূটনীতিকের দক্ষতার পরিচয় নয়। আর তিনিই প্রকৃত পররাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি বুদ্ধিতে বিচক্ষণতায় তার টিমকে টেক্কা দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। ‘যা চেয়েছি- তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি-’ সংসদে দেয়া এই বিবৃতিই দীপুমনির কূটনৈতিক দক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ করে দিয়েছে আমাদেরকে।
সংসদে তিনি উচ্ছাসে আবেগ ভরা কণ্ঠে প্রবল বলেছিলেন- আমরা সমুদ্র জয় করেছি। তখন তাকে সত্যিই মনে হয়েছিল মহাসাগর বিজয়ী লেডি সিন্দাবাদ। দরিয়ার পর দরিয়া বিজয়ে যিনি নেমেছেন। কিন্তু অতি সম্প্রতি এই লেডি সিন্দাবাদ প্রচণ্ড হতাশ করেছেন আমাদেরকে। অতি সম্প্রতি জাতীয়তাবাদী থিংক ট্যাঙ্ক সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত রায় খতিয়ে দেখে যখন বললো সমুদ্র জয়ের দাবি অসার-অসত্য। অমনি দীপু তার সঙ্গে গলা মেলালেন কেন বুঝতে পারলাম না।
সরকারকে দেয়া ধন্যবাদ ফিরিয়ে নিয়ে সুশীল কারো কারো বিরাগভাজন হয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল। সুশীলরা বলছেন- ভুলকে শুধরে নিতে পারেন ফখরুল। কিন্তু ধন্যবাদ ফেরত নিতে পারেন না।
কিন্তু এখন দেখছি দীপুমনি সংসদে জাতির সামনে দেয়া বিজয় ঘোষণাই ফেরত নিলেন। ৮ এপ্রিল ২০১২ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক প্রেস কনফারেন্সে তিনি বললেন- আন্তর্জাতিক সমুদ্র মামলার রায়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দুই দেশেরই জয় হয়েছে। মামলায় বিবদমান দু’পক্ষ জয় পেয়েছে!
এ কেমন কথা। সমুদ্র জয়কে জাতির মহত্ অর্জন হিসেবে দেখিয়ে- এমনকি ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বড় বিজয় দাবি করে বিশাল বিশাল পোস্টার ফেস্টুন হলো- পত্রিকায় পূর্ণ পৃষ্ঠা ঢাউস বিজ্ঞাপন হলো- খোদ প্রধানমন্ত্রী আবেগঘন উষ্ণতার মধ্যে সমুদ্র বিজয়ী হিসেবে এফবিসিসিআই-এর বর্ণাঢ্য ঐতিহাসিক গণসংবর্ধনা নিলেন- এখন কিনা দীপুমনি বলছেন আধখানা জয় পেয়েছি। আমরাও জয়ী। প্রতিপক্ষও জয়ী। অর্থাত্ খেলা টাই।
না না, দীপুমনি এইভাবে প্রধানমন্ত্রীকে বেইজ্জত করতে পারেন না। সংসদে একরকম বলবেন, প্রধানমন্ত্রীকে একরকম বোঝাবেন- তাকে সংবর্ধনা নিতে উদ্বুদ্ধ করবেন- আর সবশেষে নিজের মন্ত্রণালয়ের ঘেরাটোপে ঢুকে বলবেন- মহাবিজয়টা বিতর্কিত ছিল। ওটা আসলে জয়টয়ের কোন ব্যাপারই ছিল না। নামকাওয়াস্তে একটা ভাগাভাগি ছিল।
না, এই অপরিণামদর্শীতা, বিএনপির প্রতি নীরব পক্ষাবলম্বন- সর্বোপরি বালিকাসুলভ চপলতা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। উনি দেশ পরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান- বিদেশ মন্ত্রকের গুরুভার দায়িত্বে রয়েছেন। এটা বৌচি কিংবা ইচিংবিচিং খেলা নয়- যে একবার জিতেছি বলে গলা ফাটালাম- আবার খানিকবাদে বললাম- থুক্কু আমরাই জিতিনি। সইলো তোরাও জিতেছিস!

২.
এ কথা এখন অস্বীকার করার উপায় নেই- ‘দি ভয়েজেস অব দীপুমনি’ মহাজোট মন্ত্রিসভার অন্যান্য মন্ত্রীকেও দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করছে। তারাও বিজয় রাজটীকা হাসিনাকে এনে দেয়ার জন্য নানাদিকে অভিযানের জোর প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন। আবুল হোসেন কেলেঙ্কারিতে ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনের আগেই পদ্মার অথৈ জলে ডুবে গিয়েছিল সোয়া ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বৃহত্তম সেতু প্রকল্পটি। লর্ড ক্লাইভ বিশ্বব্যাংক ও কথিত দুর্নীতিবাজ দেশীয় মীরজাফর কমিশনখোর চক্র ডুবিয়ে দেয়ার উপক্রম করেছিল এটিকে। এটার জন্য বাক্যবীর সেনাপতি ওবায়দুলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংককে না হয় খুইয়েছে আবুল- তাতে কি আসে যায়। ওবায়দুল ডুবন্ত সেতুকে বাস্তবায়ন করতে মালয়েশিয়া অভিযানে গেছেন। পদ্মা সেতু এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই হয় হয় আর কি। ওবায়দুল যেভাবে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে অর্থ সংগ্রহ অভিযানে নেমেছেন- দেখি এবার কে ঠেকায়। মালয়েশিয়া থেকে তিনি আস্ত একখানা সেতু নিয়ে নিশ্চয়ই ফিরবেন। তারপর সেটি পদ্মা নদীর ওপর ঠিকমত ফিটিং করা আর কয়দিনের কাজ। মহাজোটের চলতি মেয়াদেই ইনশাল্লাহ হয়ে যাবে। আর এটি হলে আমরা পদ্মা বিজয় নামে সংসদে, চীন মৈত্রী বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র ও পল্টনে যুগপত বিজয় উত্সব করবো।
তবে মহাজোটে যে কয়েকজন বাগড়া মন্ত্রী রয়েছেন- তাদের নিয়েই যতো গণ্ডগোল। ওবায়দুল কাদের এতো বড় গলা করে মালয়েশিয়া ট্রিপে গেলেন- ঠিক সেই মুহূর্তে অর্থমন্ত্রী বেফাঁস বলে বসলেন- মালয়েশিয়ার সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত হয়েছে- তাতে কিন্তু পদ্মা সেতু নেই। মাউ (মেমেরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং)টি হয়েছে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে। পদ্মা সেতু নিয়ে নয়।
পদ্মা সেতুর অর্থায়নের মাউ স্বাক্ষরের জন্য যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল স্বয়ং অর্থনৈতিক সম্পর্ক সচিব, সেতু সচিব- উপর্যুপরি পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালককে সঙ্গে নিয়ে মালয়েশিয়া ছুটে গেছেন। ১০ এপ্রিল মাউ স্বাক্ষরও করেছেন। তেমনটাই তারা জাতিকে জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রীর কথা যদি সত্য হয় তবে কি মুশকিল। বাঘা মন্ত্রী, বাঘা সচিবরা কি তবে মাউ-এর পেপারগুলো না পড়েই মালয়েশিয়ায় পদ্মা সেতু জয় করতে গেলেন। সমঝোতা স্মারকের ইংরাজী কপি পঠন পাঠনে অতি দক্ষ আমাদের অর্থমন্ত্রী। তার চুলমাত্র ভুল হওয়ার কথা নয়। ওবায়দুলও কি দেশে ফিরে দীপুমনির মতো সুর পাল্টে বলবেন মাউ নয়- আমরা পদ্মা সেতু দিয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে অনেক আলোচনা ও হাউকাউ করে এসেছি। তবে নবযুগের মন্ত্রী-আমলাদের অভিনব কর্মকাণ্ড অনুধাবনে অবশ্য ভুল করতে পারেন অর্থমন্ত্রী। অবকাঠামোর মাউ-এ পদ্মা সেতু পড়েই। কেননা পদ্মা সেতু অবকাঠামোর মধ্যেই পড়ে যে!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখছি- পদ্মা বিজয় ও বিদ্যুত্ বিজয় নিয়ে মস্ত গ্যাড়াকলে পড়েছেন। কুইক রেন্টাল করে বিদ্যুত্ সেক্টরে মহাবিজয়ের কথা তিনি সংসদে মহা আড়ম্বরে ফলাও করে বলেছিলেন। কেউ যাতে লোডশেডিং ভুলে না যায়- সেজন্য প্রতীকী লোডশেডিং দিয়ে মানুষকে অতীত-ইতিহাস সচেতন রাখার প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার সরকারের অলঙ্কার এবং বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভুইয়ার কণ্ঠে একি উদ্ভট কথা শুনলাম আমরা। ইনু-মেননের কণ্ঠেও কি শুনছি! ‘বিদ্যুত্ সঙ্কট ও জনস্বার্থ’ শীর্ষক ওয়ার্কার্স পার্টির গোলটেবিলে ৯ এপ্রিল ’১২ সুবিদ আলী বললেন, বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাত নিয়ে আমাদের সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দ্রুত বিদ্যুতের পরিকল্পনা ব্যর্থ প্রমাণ হয়েছে। বিদ্যুত্ সমাধান তো হয়নি- বরং অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হয়েছে।
এসব কথা সত্যি সুবিদ আলী বলেছেন তো! হঠাত্ মহাজোটের মহা বিদ্যুত্ বিজয়ের সুর পাল্টে তিনি ভরাডুবির কথা কেন বলছেন! কোথায় গেল প্রধানমন্ত্রীর প্রত্মতাত্ত্বিক লোডশেডিং।
ইনু-মেননও গলা ফাটিয়ে বললেন, দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ও ঘণ্টায় লোডশেডিং নাকি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ইনু বললেন, কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ চরম ভুল। লুটপাট হচ্ছে।
মেনন সাহেব বিএনপির পক্ষাবলম্বন করতেও পিছপা হননি- লাজশরমের মাথা খেয়ে বললেন, বিদ্যুত্ সঙ্কট বিএনপির আমলের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সরকার বিদ্যুত্ খাতে যা বলছে- বাস্তবতা তার বিপরীত।
সুবিদ আলী বললেন, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে বিদ্যুত্ দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। মহাজোট সরকার প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে কী অশ্রাব্য অকথ্য অপপ্রচার। প্রধানমন্ত্রী যা বলছেন- ঠিক তার আকাশ-পাতাল উল্টো বলা। ইনু-মেনন-সুবিদ এরা মহাজোটে আছেন তো। আমরা যারা প্রধানমন্ত্রীকে বিনা বাক্যব্যয়ে বিশ্বাস করি- তাদের কাছে এসব কথা অসহ্য লাগছে। কদিন আগে ইনু সাহেব স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার মতো উস্কানি দিয়ে বসলেন- বললেন- সরকারের ভুলত্রুটির জন্য আমাদের জুতা মারুন।
ইনু তো বলেই খালাস। তিনি কোন মন্ত্রণালয় পাননি। জনগণ যখন জুতা মারতে শুরু করবে- তখন একটাও তার গালে পড়বে না। তিনি উস্কানির স্লোগান দিয়ে দায় এড়ানোর তালে আছেন। মহাজোটের এইসব ঘরের শত্রু বিভীষণকে চিহ্নিত করা দরকার। বাক স্বাধীনতা মানে বিদ্যুতের অবিরাম জোয়ারকে অমাবশ্যার ভাটা বলার স্বাধীনতা নয়। নৌকায় চড়ে দিব্যি নির্বাচনের বৈতরণী জয় করলেন, এখন দুর্দিনে উথাল সমুদ্রে নৌকাকে রেখে ইমার্জেন্সি লাইফ বোটে চড়ে পালাবেন- এটা হতে দেয়া যায় না।

৩.
এবার সন্দেহাতীত নিরঙ্কুশ জয় দিয়ে আজকের কলামের ইতি টানতে চাই। বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিজয়ের মতো কিছুদিন আগে দিল্লীতে বাংলায় প্রেস কনফারেন্স করে ভারত সভা জয় করার চমত্কার চেষ্টা চালিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তার অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধু। তিনি সদা মুজিব অনুরাগী। তবে তার পরিকল্পনায় গলদ ছিল। তিনি সঙ্গে করে ড. কামাল-হুমায়ুন রশীদ মার্কা দক্ষ ইংরাজী জানাঅলা নিয়ে যাননি। তাই দিল্লীর সাংবাদিককুলের মন জয়ের বদলে হাসির পাত্রে পরিণত হন তিনি। তা নিয়ে দেশেও নিন্দুকেরা কম নিন্দাচর্চা করেনি। কেন তিনি দিল্লীর কূট-সাংবাদিকদের ফার্মগেটের মোড়ে হরতালের দিন অবস্থানরত মাঠ সাংবাদিক ভাবলেন- সে নিয়ে রসময় প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
তা নিয়ে যতো হাসাহাসি হোক- অবশেষে বহুত ছুপা রুস্তম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন তিনি। সাম্প্রতিককালে মহাজোট সরকার ও শেখ হাসিনাকে সবচেয়ে বড় বিজয়টি এনে দিয়েছেন তিনিই। রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বিচারে এটি সমুদ্র জয়ের চেয়েও বড় অর্জন।
কূটনীতিক খালাফ এবং সর্বোপরি সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে অসম্ভব পেরেশানিতে দিন যাচ্ছে শেখ হাসিনার। সাংবাদিক হত্যা ইস্যুতে দেশের সাংবাদিক সমাজ রাতারাতি ঐক্য গড়ে তুললো। সরকার সমর্থক সাংবাদিকরা বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অবস্থান ধর্না কলমবিরতি করলো। সর্বাত্মক কর্মসূচির হুমকিও দিল। এটা গ্লোবাল মিডিয়া যুগ। দেশ-বিদেশে সরকারের ইমেজ ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিল। মিয়ানমারের হাতে সেন্টমার্টিনের অবস্থান রেখা হাতছাড়া হয় হোক- ব্লক যাক। তাতে কিছু আসে যায় না। সাংবাদিকরা সাগর-রুনি ‘ফালতু ইস্যু’ নিয়ে সরকারের ইজ্জতহানি ঘটাতে চলছিল।
সেই বেয়ারা-বেয়াদব সাংবাদিকদের জয় করে দেখালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মাঠ রাজনীতির অসাধারণ ক্যারিশমায় তিনি সাংবাদিক নেতাদের তার মিন্টো রোডের বাসায় ডাকলেন। চা খাওয়ালেন। জাদুমন্ত্র করলেন। তারপর ঐন্দ্রজালিক ঘটলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্নেহের ছোয়ায় ভেজা বেড়াল হয়ে গেলেন সাংবাদিক নেতারা। মন্ত্রীর বাসার চায়ের কি অপূর্ব স্বাদ। তারা সব ধরনের কর্মসূচি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখলেন। যে সাংবাদিক নেতারা আট ঘাট কাছা কোমর বেধে বলেছিলেন- বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচ্যগ্র মেদেনী। তারা তাদের মস্ত মস্ত বজ্রকণ্ঠ বক্তৃতা-ওয়াদা- সব শপথ বন্ধক রেখে এলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চায়ের চুমুকে।
সমুদ্র জয়, বিদ্যুত্ জয় ইত্যাদি বিতর্কিত ভুয়া বিজয়ের ডামাডোলে একেবারেই লাইমলাইটে আসেনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সাংবাদিক নেতাদের বশীকরণ- বিজয় কাহিনী।
দেশে হত্যার হোলিখেলা চলে চলুক, ছিনতাই ডাকাতি চলুক- গুম গুপ্তহত্যা চলুক- কোন সমস্যা নেই। যে মন্ত্রী সাংবাদিক নেতাদের বিবেকের লাশের ওপর সাগর-রুনির খুনে ভেজা রক্তাক্ত দণ্ড ঠুকে দিয়ে পত পত করে ওড়াতে পারেন বিজয় পতাকা- তার তখত্ আগামী পৌনে ২ বছর সুরক্ষিত থাকবে ইনশাল্লাহ।
লেখক : কপি এডিটর, দৈনিক আমার দেশ, ব্লগার

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads