বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১২

গুজব জল্পনা শঙ্কা সর্বত্র


গুজব জল্পনা শঙ্কা সর্বত্র


বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী কি বেঁচে আছেন, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে? হত্যা করা হলে কারা তাকে তুলে নিয়েছিল, কোথায় গোপন করা হয়েছে তার লাশ। বাংলাদেশে কি কোনো সঙ্ঘবদ্ধ চক্র এই গুম-খুনের পেছনে কাজ করছে? সেই দিন ইলিয়াসকে তুলে নেয়ার সময় কি কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা কাউকে চিনতে পেরেছিলেন? সেই ব্যক্তি কি কোনো সংস্থার হয়ে সেখানে গিয়েছিলেন ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে নানা জল্পনা, গুজব ও শঙ্কা রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র। 
হঠাৎই যেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত ও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ইলিয়াস আলীকে গুম করা নিয়ে। বিরোধী দল বর্তমান সরকারের শাসনামলে এই প্রথমবারের মতো টানা তিন দিন হরতাল পালন করল দেশব্যাপী। শনিবারের মধ্যে ইলিয়াসকে মুক্ত করা না হলে আরো দুই দিন হরতাল আসতে পারে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যে কখনো মনে হয় ইলিয়াস আলী জীবিত আছেন আবার কোনো কোনো সময় মনে হয় তাকে ফিরে পাওয়ার কোনো আশা নেই। 
ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে র‌্যাব পুলিশের অভিযান নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। ইলিয়াসের পরিবারের কাছে খবর আসে পূবাইলে ইলিয়াস আলীকে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু র‌্যাবের অভিযানের পর সেখানে কিছুই পাওয়া যায়নি। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় অভিযানের খবর এসেছে ইলিয়াস ও ড্রাইভারকে হত্যা করার পর অ্যাসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার খবর পাওয়ার পর। কিন্তু সেখানে কিছুই পাওয়া যায়নি। সিলেটের কয়েকটি স্থানেও অভিযান চালানো হয়েছে। সব অভিযানই নিষ্ফল। এসব নিষ্ফল অভিযান নিয়ে বড় রকমের প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে একটি চাঞ্চল্যকর খবর বের হওয়ার পর। দৈনিকটিতে বলা হয়, ইলিয়াসকে সেই দিন তুলে নেয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানে কর্তব্যরত একজন সাব ইন্সপেক্টর। তিনি ভিকটিমকে উদ্ধার করতে চাইলে তাকে একটি বিশেষ অ্যাজেন্সি এই অভিযান চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। এমনও বলা হচ্ছে, তিনি গুম অভিযানের একজনকে চিনতেও পেরেছেন। তিনি একটি বিশেষ অ্যাজেন্সিতে কর্মরত মধ্যমপর্যায়ের কর্মকর্তা। 
পত্রিকটির প্রতিবেদনে অপহরণের ঘটনা পাশের এক বাড়ি থেকে মোবাইলে ভিডিও করার কথাও বলা হয়েছে। সেই ভিডিওকারী ব্যক্তিকে এরপর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। 
পত্রিকার বর্ণনা অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তা ছিনতাইকারী ভেবে অপহরণকারীদেরই একজনকে পেছন দিক থেকে কলার চেপে ধরেন এবং কৌশলগতভাবে হুমকিও দেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলে ওঠেন, ‘কেউ নড়বে না, গুলি করে দেবো কিন্তু’। এ সময় ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত একজন মাইক্রো বাসের সাইডে এগিয়ে এসে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে নিজেদের একটি বিশেষ বাহিনীর পরিচয় দিয়ে বলেন, আমরা অভিযান চালাচ্ছি। বাধার সৃষ্টি করবেন না, সরে দাঁড়ান। এ সময় মাইক্রো বাসের ভেতরে ওই বাহিনীর কিছু নমুনা প্রমাণ হিসেবে দেখতে পেয়ে কথিত অভিযান পরিচালনাকারীর শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে তিনি দুই পা পিছিয়ে যান। কিন্তু মাইক্রো বাসের লোকটি আবার পেছন দিকে এসে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে আবার ধমক দিয়ে বলেন, ‘সরে যেতে বললাম না, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলে যান।’
এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাটি আর এক মুহূর্তও ঘটনাস্থলে অবস্থান করা নিরাপদ ভাবেননি, তাই তিনি জোর কদমে হেঁটে গলি রাস্তাটির দণি পাশের জলখাবার হোটেলের সামনে চলে যান। সেখানে ওই পুলিশ কর্মকর্তার মোটরসাইকেলটি রাখা ছিল। সেখান থেকে তিনি গুলশান জোনেরই তার কর্মস্থল থানায় পৌঁছে অফিসার ইনচার্জ ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে পুরো বিষয়টির বর্ণনাও দিয়েছেন। কিন্তু অফিসার ইনচার্জ বিভিন্ন স্থানে টেলিফোনে আলাপ করে ওই সাব ইন্সপেক্টরকে এ বিষয়ে আর মুখ খুলতে নিষেধ করে দেন। পাশাপাশি তাকে সাবধানে চলাফেরারও পরামর্শ দেন। এ ঘটনার পর রাতেই পুলিশ কর্মকর্তাটি ঘটনাস্থলে ইলিয়াস আলীকেই অপহরণ করা হয়েছে বলে জানতে পারেন। তিনি ঘটনাস্থলেও যান।
জাতীয় দৈনিকটিতে এ খবরটি প্রকাশ হওয়ার দু-এক দিন আগ থেকে সংবাদকর্মীদের মধ্যে এ ঘটনার বিক্ষিপ্ত তথ্য নিয়ে আলোচনা হতে দেখা যায়। কিন্তু স্পর্শকাতর এ ঘটনার ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চিত না হয়ে কেউ রিপোর্ট করতে চাননি। 
ঢাকার পত্রপত্রিকায় এ ধরনের খবরাখবর যখন প্রকাশ হচ্ছিল, তখন দেশের বাইরের পত্রপত্রিকায় ও ইন্টারনেটে এ ঘটনা নিয়ে অনেক তথ্য প্রকাশ হয়। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কান গার্ডিয়ান পত্রিকায় ঢাকায় প্রতিবেশী একটি দেশের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ১০০ জনের একটি কিলিং মিশন বাংলাদেশে কাজ করছে বলেও উল্লেখ করা হয়। সেই আলোচিত রিপোর্টে গুম তালিকায় কারা কারা আছেন, তাদের নামও ছাপা হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আলোচিত সৌদি কূটনীতিকসহ অনেক গুম হওয়া ব্যক্তি এই গ্রুপের শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে। শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ানের এই প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় থাকায় এটির বিস্তারিত বিবরণ ঢাকার কোনো কাগজে দেখা যায়নি। অথচ ইন্টারনেট জগতে আলোড়ন তোলে এটি।
ইন্টারনেটে হত্যা-গুম প্রভৃতি কাজের সাথে জড়িত হিসেবে আরেকটি গ্রুপের কথা বলা হচ্ছে, যার নাম উল্লেখ করা হয় স্পেশাল মিশন গ্রুপ। উল্লেখ করা তথ্যানুযায়ী বর্তমান সাবেক সামরিক বেসামরিক কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে এ বিশেষ গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। বিশেষ পরিকল্পনাকে সামনে রেখে তারাই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয় তাতে। 
গত কয়েক মাসের আলোচিত হত্যা-গুমের ঘটনায় শুধু দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তাই নয়; এর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কর্মরত বিদেশী মিশনের জনবলকে সন্ধ্যার পর বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ঢাকার বেশির ভাগ দেশের কূটনৈতিক মিশনের পক্ষ থেকে লিখিত বা মৌখিকভাবে এ পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অল্প কিছু দিন আগেও বাংলাদেশের কোনো বিষয় তেমন একটা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেত না। এখন উল্লেখযোগ্য বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই আলোচিত খবরের বিষয় হয় গুম-হত্যা অথবা রাজনৈতিক অস্থিরতা অথবা যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু। 
ঢাকা সিভিল সোসাইটির সদস্য যারা দেশের পরিস্থিতির ওপর গভীরভাবে নজর রাখেন, তারা বর্তমান অবস্থাকে আতঙ্কজনক বলেই বর্ণনা করছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads