সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১২

ক্ষুব্ধ সোহেল তাজ এমপি পদ থেকেও পদত্যাগ করলেন : আরও বহু সত্য বলতে পারছি না




প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করে দলীয় সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন সরকারদলীয় এমপি তানজিম আহমেদ (সোহেল তাজ)। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার পরও তা গৃহীত না হওয়ায় ক্ষোভে-দুঃখে ও প্রতিবাদে সোহেল সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিকে পদত্যাগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সোহেল তাজ এক খোলা চিঠিতে বলেছেন, সবকিছু খুলে বলতে পারছি না। বাস্তবতা বিচার করে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। সম্মান রক্ষার্থে আমার সামনে এছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। এর আগে ২০০৯ সালের ৩১ মে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেও গত তিন বছরে ওই পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করে গেজেট নোটিফিকেশন না করার পাশাপাশি তার অ্যাকাউন্টে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মাসিক পারিতোষিক ও ভাতা পাঠানোর কারণ জানতে চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দিয়ে তার জবাব না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। এরপর গত ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেশন সেন্টারের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোহেল তাজকে দফতরবিহীন প্রতিমন্ত্রী উল্লেখ করার প্রেক্ষাপটে ক্ষুব্ধ হয়ে গতকাল সংসদ সদস্যের পদ থেকেও পদত্যাগ করলেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সোহেল তাজের পক্ষে গতকাল সকালে তার ব্যক্তিগত সহকারী আবু কাওসার স্পিকারের পিএ মোহাম্মদ শামীমের কাছে পদত্যাগ পত্রটি পৌঁছে দেন। আবু কাওসার পদত্যাগ পত্রের কপি রিসিভ করিয়েও নেন। এ সময়ে স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট সংসদে ছিলেন না। তিনি একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাগেরহাট গেছেন। ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী পদত্যাপ পত্র পাওয়ার কথাটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও পদত্যাগের ঘটনাকে দুঃখজনক উল্লেখ করে বলেন, স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট তার পদত্যাগপত্র হাতে পাওয়ার পর কার্যকর হবে। তবে, সংসদ সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মাহফুজুর রহমান পদত্যাগপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, বিষযটি স্পিকারকে অবহিত করা হয়েছে।
গতকাল ২৩ এপ্রিলের তারিখ উল্লেখ করে তানজিম আহমেদ তার সংসদ সদস্যের প্যাডে কম্পিউটার কম্পোজ করা পক্ষে দুই লাইনের চিঠিতে নিজ স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে পদত্যাগ করেন। স্পিকারকে সম্বোধন করে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমার নির্বাচনী এলাকা ১৯৭ গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া)। আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৭(২) ধারা মোতাবেক আপনার নিকট আমার পদত্যাগ পত্র পেশ করলাম।’ উল্লেখ্য, সংসদ পদ থেকে পদত্যাগ প্রসঙ্গে সংবিধানের ৬৭ (২)। ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্য স্পিকারের নিকট স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন; এবং স্পিকার কিংবা স্পিকারের পদ শূন্য থাকিলে বা অন্য কোনো কারণে স্পিকার স্বীয় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ডেপুটি স্পিকার যখন উক্ত পত্র প্রাপ্ত হন, তখন হইতে উক্ত সদস্যের আসন শূন্য হইবে।’
এদিকে পদত্যাগের বিষয়ে সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৭৭নং বিধিতে বলা হয়েছে, ‘(১) সংসদের আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক কোনো সদস্য এই মর্মে স্পিকারকে সম্বোধন করিয়া স্বহস্তে লিখিতভাবে জ্ঞাপন করিবেন যে, তিনি তাহার আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক, এবং তিনি পদত্যাগের জন্য কোনো কারণ দর্শাইবেন না।’
তবে শর্ত থাকে যে, কোনো সদস্য যদি কোনো কারণ জ্ঞাপন করেন, অথবা অপ্রাসঙ্গিক কোনো বিষয়ের অবতারণা করেন, তাহা হইলে স্পিকার স্বীয় বিবেচনামতে অনুরূপ শব্দ বা বাক্যাংশকে বাদ দিতে পারিবেন এবং উহা সংসদে পাঠ করিয়া শোনান হইবে না।
(২) স্পিকার অথবা যদি স্পিকারের পদ শূন্য থাকে, অথবা যদি তিনি কোনো কারণে তাহার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন, তাহা হইলে ডেপুটি স্পিকার কর্তৃক উক্ত পত্র প্রাপ্তির সময় হইতে সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে পদত্যাগ কার্যকর হইবে এবং সদস্যের আসন শূন্য হইবে।’
এদিকে স্বহস্তে লিখিত পত্রত্যাগ পত্র জমা না দিয়ে স্বাক্ষরযুক্ত পদত্যাগ পত্র জমা দেয়ায় এটি গৃহীত হওয়া না হওয়া নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেও সংবিধান অনুসারে এটি গ্রহণ না হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের ইংরেজি ভার্ষণ ও সংসদ কার্যপ্রণালী বিধি অনুসারে সংসদ সদস্যের পদত্যাগে স্বহস্তে লিখিত পত্রের কথা বলা হলেও সংবিধানের বাংলা ভার্ষণে বলা হয়েছে ‘স্বাক্ষরযুক্ত পত্র’-এর কথা। আর সংবিধানের ১৫৩(৩) (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলা ও ইংরেজি পাঠের বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে’। এ হিসেবে স্বাক্ষরযুক্ত পদত্যাগ পত্র অবশ্যই গৃহীত হবে।
সংবিধানের এই বিধানের বিষয়টি উল্লেখ করে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক গতকাল আমার দেশ-কে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সংশ্লিষ্ট সদস্য নিজের স্বাক্ষরযুক্ত পদত্যাগ পত্র জমা দিলেই পদত্যাগ হয়ে যাবে। পদত্যাপ পত্রটি স্বহস্তে লেখার বাধ্যবাধকতা নেই। এই আইনজীবী আরও বলেন, সংসদ সদস্যের পদত্যাগে স্পিকারের পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করা না করার কোনো সুযোগ নেই। স্পিকারের কাছে পদত্যাগ পত্র পেশ করলেই পদত্যাগ হয়ে যাবে। এর আগে ২০০৪ সালের ১০ মার্চ তত্কালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ও মাহী বি চৌধুরী সংসদ সদস্যদের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এদিকে পঞ্চম জাতীয় সংসদকালে ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর তত্কালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করলেও কোনো গ্রাউন্ড না থাকায় ওই সময়কার স্পিকার রাজ্জাক আলী তা গ্রহণ করেননি। পরে অবশ্য ৯০ কার্য দিবসের বাধ্যবাধকতার কারণে ১৯৯৫ সালের ১৯ জুন একযোগে ১৪৫ জন সদস্যের সদস্য পদ শূন্য হয়।
ডেপুটি স্পিকারের মন্তব্য : তানজিম আহমদ সোহেল পদত্যাগ প্রসঙ্গে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী গতকাল দুপুরে সংসদ ভবনের বাসায় উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, সোহেল তাজের চলে যাওয়া দুঃখজনক। এটা আমাদের রাজনীতির জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এটা হওয়ার কথা ছিল না কিন্তু হয়ে গেছে। এ ধরনের পদত্যাগকে এখন আওয়ামী রাজনীতিবিদদেরই ওভারকাম করতে হবে। তিনি বলেন, সোহেল তাজ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে। তিনি ইয়ংম্যান। আমাদের রাজনীতিতে তার দরকার ছিল। তিনি বলেন, তার পদত্যাগের খবর আমি শুনেছি। কিন্তু এখনও আমার কাছে পদত্যাগ পত্র এসে পৌঁছেনি। স্পিকার ঢাকায় নেই। তার কাছে পদত্যাগ পত্রটি পৌঁছলে সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্য পদটি শূন্য হয়ে যাবে। শূন্য হওয়ার বিষয়টি স্পিকার নির্বাচন কমিশনকে জানাবেন।
তিনি বলেন, তার মা (সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন) আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবনের সহকর্মী। তার মতো উদীয়মান নেতার পদত্যাগ আমাকে ব্যথিত করেছে। গণতান্ত্রিক রীতিতে পদত্যাগ তিনি করতেই পারেন। ডেপুটি স্পিকার বলেন, এর আগেও আমরা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বা সংসদ সদস্য হিসেবে তাকে সংসদে পাইনি। শুনেছি মাঝে মাঝে তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেতেন। আজ সংসদ পদ থেকেও পদত্যাগ করলেন, আমার পক্ষে এটাকে দুঃখজনক ছাড়া আর কিছু বলার নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মনে করি না শূন্যতায় ফেলবে। তবে এটা হওয়া উচিত নয়। পদত্যাগের ক্ষেত্রে কী কারণ থাকতে পারে? জানতে চাইলে ডেপুটি স্পিকার বলেন, দীর্ঘদিন তিনি সংসদে অনুপস্থিত। তাকে সংসদে যেমন পাওয়া যায় না; তেমনি তার এলাকার লোকজনও তাকে পায় না। এ চিন্তা থেকেও তিনি পদত্যাগ করতে পারেন।
সোহেল তাজের ব্যক্তিগত সহকারীর বক্তব্য : পদত্যাগ প্রসঙ্গে সোহেল তাজের ব্যক্তিগত সহকারী আবু কাওসার সাংবাদিকদের জানান, সংসদ ভবনে স্পিকারের কার্যালয় কর্মরত মোহাম্মদ শামীমের হাতে তিনি (আবু কাওসার) নিজে গিয়ে পদত্যাগ পত্রটি জমা দিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, পদত্যাগের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেননি সোহেল তাজ। সংবিধানের ৬৭ (২) ধারায় সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ করার যে সুযোগ রয়েছে তার ভিত্তিতেই তিনি পদত্যাগ করেছেন।
চলতি সংসদে সোহেল তাজ : চলতি নবম সংসদের সদস্য হওয়ার পর তানজিম আহমেদ এ পর্যন্ত চলা ২৮৮ কার্যদিবসের মধ্যে ৮৩ কার্যদিবস সংসদে যোগ দিয়েছেন। সর্বশেষ নবম অধিবেশনে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের দিন অনেকটা বাধ্যবাধকতার কারণে সংসদে যোগ দেন। এর পর তিনি আর সংসদে যাননি। গত ২৯ মার্চ শেষ হওয়া দ্বাদশ অধিবেশন পর্যন্ত তিনি ৫৪ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন গাজীপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের একমাত্র ছেলে সোহেল তাজ। দায়িত্ব পান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। বঙ্গবন্ধু পরিবারের এক প্রভাবশালী সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০০৯ সালের ৩১ মে যমুনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগপত্র জমা দেন। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। ফলে পরে ১ জুন তার একান্ত সচিবের মাধ্যমে পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেন। এ সময় পদত্যাগ করা না করার বিষয়ে নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান তিনি। এর মাস দেড়েক পরে ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের ঘটনা প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেন। পদত্যাগের বিষয়টি স্বীকার করার কিছুদিন পর দেশে ফেরেন সোহেল তাজ। কিন্তু তিনি বিমানবন্দরে প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও প্রতিমন্ত্রীর প্রটোকল গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। কয়েক দিন পর নিজ নির্বাচনী এলাকা কাপাসিয়ায় গিয়ে তার পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করেন সেখানকার মানুষের কাছে। কাপাসিয়ার মানুষ তার এ সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করে তাকে সমর্থন জানায়। এরপর বেশ কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসা করেছেন। অনেকটা স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করলেও মূলত তার মা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, প্রবীণ নেত্রী জোহরা তাজউদ্দিনের অসুস্থতার কারণেই তাকে ছুটে আসতে হয়েছে। এ সময় তিনি বাধ্য হয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সরকারের দেয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন।
এদিকে দীর্ঘদিনেও পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে উল্টো তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রতিমন্ত্রীর বেতন-ভাতা দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে গত ১৬ এপ্রিল সোহেল তাজ মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দেন। তিনি লেখেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে একসঙ্গে পাঠানো প্রতিমন্ত্রীর মাসিক পারিতোষিক ও ভাতাদির চেক (আগস্ট ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১১) কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বা কাম্য নয়, যা পরেও পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তিনি জানান, ২০০৯ সালের মে মাসে তিনি মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পরবর্তীকালে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কোথাও কোনো (পারিতোষিক ও ভাতাদি) স্বাক্ষর করেননি। চিঠিতে তিনি তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে আর টাকা না পাঠানোসহ জমা হওয়া অর্থ ফেরত নেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন।
পরের দিন মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে তিনি আরও একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। ওই চিঠিতে সোহেল তাজ লেখেন, ‘আমি ৩১ মে ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৮ (ক) ধারা মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর হাতে আমার পদত্যাগপত্র প্রদান করি এবং ১ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পদত্যাগপত্র প্রেরণ করি। কিন্ত অদ্যাবধি আমার পদত্যাগ গেজেট নোটিফিকেশন হয়নি। ফলে পদত্যাগ নোটিফিকেশন না করায় বর্তমানে সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও আমার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় কেন আমার প্রেরণ করা পদত্যাগ গেজেট নোটিফিকেশন না করে আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে প্রতিমন্ত্রীর পারিতোষিক ও ভাতাদি জমা করা হলো সেই মর্মে আমাকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
সোহেল তাজের খোলা চিঠি
অনেক কষ্ট করে গড়ে তোলা সুন্দর একটি জীবন ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। কৈশোর বয়স থেকে নিজে দিন-রাত কাজ করে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি। বাবা-মায়ের দেয়া শিক্ষা, দেশপ্রেম থেকেই দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে সবকিছু ছেড়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলাম। প্রথমে সামাজিকভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। আর্সেনিক নিয়ে সচেতনতার কাজও অনেক করেছি। গ্রাম-গঞ্জে ঘুরেছি দিনের পর দিন। বাবা ও মায়ের রাজনৈতিক সহকর্মীদের পরামর্শ এবং কাপাসিয়ার মানুষের অনুরোধেই আমার সক্রিয় রাজনীতিতে আসা। তারা আমাকে বুঝিয়েছিলেন রাজনৈতিক প্লাটফরম থেকে আরও ভালো করে দেশের মানুষের জন্য কাজ করা সম্ভব। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও শরীরে বয়ে চলা বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের রক্তই আমাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করেছে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দিতে এবং দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে। ক্ষমতা, অর্থসম্পদ, খ্যাতি ও প্রতিপত্তির জন্য আমি রাজনীতিতে যোগ দিইনি। যদি উদ্দেশ্য তাই হতো, তাহলে সবকিছু মেনে নিয়ে এখনও এমপি ও মন্ত্রিত্বের পদ আঁকড়ে থাকতাম। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাকে বাকি জীবন এই লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে রাখেন।
নিজের দলীয় ও তত্কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সৃষ্টি করা শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ২০০১ সালের নির্বাচনে কাপাসিয়ার মানুষের ভালোবাসায় প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলাম। দুর্ভাগ্য, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। আমার কাপাসিয়ার মানুষের ওপর বিএনপি-জামায়াত জোটের চলতে থাকে একের পর এক হামলা, মামলা ও নির্যাতন। প্রতিবাদে কাপাসিয়ার সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলি। বিএনপি-জামায়াতের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন আমার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী যুবলীগ সভাপতি জালাল উদ্দীন সরকার। পুলিশ নির্মমভাবে হত্যা করেছে জামাল ফকিরকে। এসবের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ অনশন করতে গিয়ে বারবার পুলিশের নির্মম হামলার শিকার হয়েছি। বস্তুত বিএনপি-জামায়াতের ৫টি বছর হামলা, মামলা ঠেকাতে আমাকে বেশিরভাগ সময় রাজপথ ও আদালত প্রাঙ্গণে সময় কাটাতে হয়েছে। কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেকে জড়াইনি। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে যা আয় হতো, তাই দিয়েই চলত আমার রাজনীতি। এমনকি পৈতৃক সম্পত্তিও বিক্রি করেছি রাজনীতির জন্য। খুব সাদামাটা সাধারণ জীবনযাপন করেছি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের কর্মকাণ্ড আমাকে হতাশ করলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের যুগোপযোগী নির্বাচনী ইশতেহার আমাকে রাজনীতিতে আরও বেশি উত্সাহিত করে। যে ইশতেহারটি ছিল প্রগতিশীল ও দিনবদলের একটি ঐতিহাসিক অঙ্গীকার। আশাবাদী হই একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির, যে সংস্কৃতির মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণ পাবে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার। যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চার নেতা, উদীচী, ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ড, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া ও আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড এবং ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। বাংলাদেশে হবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আর তাই যে মন্ত্রণালয় কেউ নিতে চায়নি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসে সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এই দায়িত্বটি ছিল শুধু মন্ত্রিত্ব নয়, একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব অপরিসীম। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বের অনেকটাই ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আমার সবসময়ই চেষ্টা ছিল পুলিশ বাহিনীকে একটি সৃশৃঙ্খল পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে জনগণের বন্ধু করে তোলা। মন্ত্রিত্বের শেষ দিন পর্যন্ত আমার সেই চেষ্টা অব্যাহত ছিল। কতটুকু পেরেছি বা কেন পারিনি সে কথায় না গিয়ে শুধু এইটুকু বলতে চাই, আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শিখেছি সবসময় অনিয়ম ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে সেটা যেই করুক না কেন। যতটুকু সম্ভব আমি আমার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে চেষ্টাও করেছিলাম। সেই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াও শুরু করতে সহযোগিতা করেছিলাম।
কথার পেছনে অনেক কথা থাকে। অনেক লুকায়িত সত্য থাকে, যা দেশ, জনগণ ও দলের বৃহত্তর স্বার্থে জনসম্মুখে বলা উচিত নয়। আর তা সম্ভবও নয়। শুধু এইটুকু বলি, আমি ‘সঙ্গত’ কারণেই এমপি ও মন্ত্রিত্বের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। যে ক’দিন দায়িত্ব ছিলাম মন্ত্রিত্বের শপথ থেকে বিচ্যুত হইনি। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যস্থাপনার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সোচ্চার ছিলাম। যখন মনে করেছি আমার সীমিত ক্ষমতায় জনগণের প্রতি দেয়া কমিটমেন্ট আর রক্ষা করা সম্ভব নয়, তখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি। কারণ পদ বা ক্ষমতার লোভে আমি রাজনীতিতে আসিনি। যদি তাই হতো, তাহলে মন্ত্রিত্বের লোভনীয় সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে প্রবাসে চাকরির জীবন বেছে নিতাম না। অর্থসম্পদ বা ক্ষমতার বিন্দুমাত্র মোহ আমার নেই।
আমার কাপাসিয়াবাসীর উদ্দেশে বলতে চাই, সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত নিতে আমার অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা, ভালোবাসা, স্নেহ, আমার জন্য এলাকার মানুষের ত্যাগ স্বীকার, আবেগ এইসব কিছু চিন্তা করার পরও বাস্তবতা বিচার করে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। কাপাসিয়ার মানুষের সম্মান রক্ষার্থে আমার সামনে এছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। কারণ কাপাসিয়ার মানুষের মর্যাদা ও সম্মান আমার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি জানি, আমার এই সিদ্ধান্তে আপনারা ক্ষুব্ধ ও অভিমানী হবেন, প্রতিবাদ করবেন। কারণ যে ভালোবাসা ও সম্মান আপনারা আমাকে দিয়েছেন এই সম্মানের ওপর কোনো কালিমা পড়ুক তা আমি চাই না। সঙ্গত কারণেই সবকিছু খুলে বলতে পারছি না। এই কাপাসিয়ার মাটি ও মানুষের সঙ্গে আমার নাড়ির সম্পর্ক। এই কাপাসিয়ার মাঠে-ঘাটেই বেড়ে উঠেছেন আমার বাবা বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। সেই মাটির গন্ধ আমার গায়েও। তার আদর্শ নিয়েই আমার পথচলা। কাপাসিয়ার মানুষের জন্য অনেক কিছু করার স্বপ্ন নিয়েই আমি প্রবাস জীবনের ইতি টেনেছিলাম। আপনাদের অকুণ্ঠ সমর্থন, ভালোবাসা ও দোয়া পেয়েছি। এর প্রতিদান হয়তো ততটুকু দিতে পারিনি। তবে সেই চেষ্টা আমার সবসময় ছিল। আমি এইটুকু বলতে চাই সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলেও আপনাদের পাশে থাকব সবসময়। হয়তো অন্য কোনোভাবে, অন্য কোনো পথে। এই প্রতিজ্ঞা করছি।
সক্রিয় রাজনীতিতে আবার আসার সম্ভাবনা না থাকলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদের আদর্শে গড়া আওয়ামী লীগই আমার শেষ ঠিকানা। কারণ এই দলটির সঙ্গে আমার বাবার রক্ত মিশে আছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েছেন। কোনো ষড়যন্ত্রের কাছে মাথা নত করেননি। জীবন দিয়েও তা প্রমাণ করে গেছেন।
কাপাসিয়ায় আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী যারা আমার জন্য ত্যাগ স্বীকার, জেল-জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করেছেন তাদের উদ্দেশে বলব আমি সবসময় যেটা আপনাদের বলে এসেছি তা হচ্ছে ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি পরিহার করতে হবে। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির রাজনীতি বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মতো নীতি-আদর্শের রাজনীতি করতে হবে। ঐতিহ্যবাহী কাপাসিয়ার নেতৃত্ব যেন ভালো মানুষের দ্বারা পরিচালিত হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। কাপাসিয়ার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আপনারা সেই পথে এগিয়ে যান। আপনাদের সবার মতো আমিও তাকিয়ে আছি ভবিষ্যতের দিকে। হয়তো একদিন সুস্থ একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ হবে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী একটি দেশ।
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া : দলীয় সংসদ সদস্য সোহেল তাজের পদত্যাগ প্রসঙ্গে এ মুহূর্তে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গতকাল এক মতবিনিময় সভা শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুনেছি সোহেল পদত্যাগ করেছেন। স্পিকার এ বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেন তা জানার পর মন্তব্য করবো।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads