শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১২

সুরঞ্জিত কেলেঙ্কারিতে সরকারে ঝড়



সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নিয়োগবাণিজ্যের ঘুষ কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সরকারি দল আওয়ামী লীগে। জনপ্রিয়তার পড়ন্তবেলায় এই কেলেঙ্কারি সরকারি দলকে নানামুখী বৈরিতার সম্মুখীন করছে বলে মনে করছেন অনেক প্রভাবশালী নেতা। কেউ কেউ মুখও খুলেছেন এ ব্যাপারে। আর রাতারাতি নায়ক থেকে ভিলেনে পরিণত হলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন যেন এখন আওয়ামী লীগের আপাদমস্তক বোঝা। ‘তাকে যত তাড়াতাড়ি বিদায় দেয়া যায় ততই মঙ্গল। যত তাকে আঁকড়ে ধরা হবে কিংবা ইনিয়ে-বিনিয়ে তার পক্ষ নেয়া হবে সরকার ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনিতেই যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন শুধু কৈফিয়তের পথ খোলা রাখা।’ বস্তাভর্তি ঘুষের টাকা কেলেঙ্কারির পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন আপাতত এমনটাই।
তাদের মন্তব্য হচ্ছে, ‘এই লোকটি দল ও সরকারের চরম ক্ষতি করল। নিজেও ডুবল দলকেও ডুবাল। কয়েক দিন ধরে সহকর্মীদের কাছে এমন শত শত মন্তব্য করছেন দলের তৃণমূল নেতা থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতা পর্যন্ত। আলাপচারিতায় নিজেরা এমন মন্তব্য করলেও মিডিয়ার কাছে এ ব্যাপারে কোনো নেতা মুখ খুলতে রাজি নন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম লীর সদস্য রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার যতটুকু সোচ্চার, সুরঞ্জিতের ঘটনার পর সরকার আর ততটুকু সোচ্চার থাকতে পারবে কি না তা নিয়েও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা চলছে। তারা এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় কী তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। রেলগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে মন্ত্রী ও সরকারের ভেতরকার প্রভাবশালীদের অনেকেই আবার আতঙ্কে আছেন। কারণ গত সাড়ে তিন বছরে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটলেও তা প্রকাশ্যে আসেনি। এখন এমন এক সময়ে সুরঞ্জিত বাবুর ঘটনা সামনে চলে এলো যেখান থেকে বের হয়ে আসার কোনো উপায় পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘটনার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ওপর চরম ুব্ধ। তিনি যে এলাকায় বসবাস করেন, সেই ধানমন্ডি ঝিগাতলার বাসিন্দা কর্মী ও সমর্থকেরাও চরম বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। যদিও এটা তার সংসদীয় এলাকা নয়, তারপরও ঝিগাতলার বাড়িতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বসবাস করায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে তার বিশেষ একটি সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে ধরা পড়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তার বাসার সামনে গিয়ে উচ্চস্বরে গালিগালাজ করছেন। সেখানে একজন নেতা বলেন, ‘ওকে (সুরঞ্জিত) বাসা থেকে টেনে বের করে এনে সাজা দেয়া উচিত’। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন্ আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিপদের সময় এসব নেতা সারাক্ষণ তার পাশে থাকলেও মন্ত্রী হওয়ার পর তাদের দূরে সরিয়ে দেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এপিএস ফারুকের ওপর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অতি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। মন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই এপিএস ফারুক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের মন্ত্রীর কাছে ভিড়তে দিতেন না।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, মন্ত্রীর এপিএস টাকা নিয়ে ধরা পড়ার বিষয়টি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, যেকোনো দল, সংগঠন এমনকি ব্যক্তির জন্যও বিব্রতকর। এ ঘটনা সরকার ও দলের ইমেজ নষ্ট করেছে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, রেল মন্ত্রণালয়ের এ ঘটনা তুরস্কে সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি এতে ুব্ধ মনোভাব পোষণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আজ শনিবার সকালে দেশে ফিরবেন। দেশে ফিরে সুরঞ্জিতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন বলেও জানায় সূত্রটি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরেই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা জোরালোভাবে বলে আসছেন। তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন, ‘আমার সরকারে কোনো দুর্নীতিবাজ নেই। আমি এমন কাউকে প্রশয় দিইনি।’ সুরঞ্জিত বাবুর এই কীর্তির পর সরকারের এ ধরনের বক্তব্যের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ল।
সরকারপ্রধান একই সাথে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও বেগম খালেদা জিয়ার পরিবার নিয়ে নানা তির্যক মন্তব্য করেন। একই ধরনের অভিযোগ ওঠায় এর আগে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ওই মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেন। সংসদ উপনেতার সাবেক এক ব্যক্তিগত সহকারীর রাজকীয় বিয়ে নিয়েও সম্প্রতি ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। সেই রেশ এখনো কাটেনি। এরই মধ্যে আবার দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলো রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এমন ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দলের সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, রেল মন্ত্রণালয়কে আরেকটি হাওয়া ভবন হতে দেয়া যায় না। সে জন্য তিনি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ব্যাখ্যা প্রদানেরও আহ্বান জানান।
চালক আলী আজম কোথায়? : রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের ব্যক্তিগত গাড়িচালক আলী আজম ঘুষের টাকা ধরিয়ে দেয়ার পর থেকেই লাপাত্তা রয়েছেন। তিনি এখনো বিজিবির হেফাজতে রয়েছেন নাকি মন্ত্রীর হেফাজতে রয়েছেনÑ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকেই এমনও বলছেন, চালক কি জীবিত? শুধু গাড়িচালক নন, ঘটনার রাত থেকেই বিজিবির হেফাজত থেকে মুক্ত হওয়া এপিএস, রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ে ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্ট এনামুল হকও গা ঢাকা দিয়েছেন। সর্বশেষ তারা গত মঙ্গলবার কয়েকটি মিডিয়ার সাথে টেলিফোনে কথা বললেও এর পর থেকেই তাদের আর কাউকে মোবাইল ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার রেলভবন সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেছেন, তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও এ নিয়ে অনেক সমস্যা রয়েছে। এপিএস ও চালকের বিষয়টি মন্ত্রীর একান্ত সচিব আখতার উজ-জামান তদন্ত করবেন। আর রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) ও ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্টের বিষয়টি তদন্ত করবেন রেলওয়ের মহাপরিচালক মো: আবু তাহেরের নেতৃত্বে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটির অপর সদস্য হচ্ছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শশী কুমার সিংহ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, ঘটনাটি ঘটেছে রেলওয়ে এলাকার বাইরে। এ ক্ষেত্রে এই তদন্ত কমিটি কতটুকু স্বচ্ছভাবে কাজ করতে পারবে তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন। ইতোমধ্যে কমিটির পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার গাড়িভর্তি ঘুষের টাকাসহ পিলখানা গেটে বিজিবির হাতে আটক হওয়া রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারকে আগামীকাল রোববার সকাল ১০টায় রেলভবনে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেয়ার জন্য তার মোহাম্মদপুরের বাসায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। একইভাবে রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) ও রেলওয়ের ঢাকা জেলার কমান্ড্যান্ট এনামুল হককেও ওই দিন বেলা ১১টায় রেলভবনে গঠিত তদন্ত কমিটির সামনে হাজির থাকতে চিঠি দেয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্ত্রীর এপিএসের ব্যক্তিগত গাড়িচালক আলী আজম পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। কিন্তু গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত আলী আজমের কোনো সন্ধান জানতে তার পরিবারের কেউ যোগাযোগ করেননি। একইভাবে রেলওয়েতে লুটপাট সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা হিসেবে পরিচিত ওমর ফারুক তালুকদারও ঘটনার পরদিন থেকে তার মোহাম্মদপুরের বাসভবনে থাকছেন না। অন্য দিকে রেলওয়ে ঢাকা বিভাগের নিরাপত্তা বিভাগের কমান্ডার (আরএনবি) এনামুল হকও তার রেলওয়ের সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের বাসভবনে নেই। তাদের সবার মোবাইল ফোনও বন্ধ।
এদের ব্যাপারে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে প্রশ্ন করা হলে তিনি স্পষ্ট বলে দেন, এপিএস ফারুককে অফিসে আসতে তিনি নিষেধ করেছেন। আর তার চালক বিজিবির হাতে আটক হয়েছেন। বিজিবিই এখন বলবে গাড়িচালক তাদের হেফাজতে রয়েছে নাকি অন্য কোথাও রয়েছেন। আলী আজমের অবস্থান সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।
গতকাল শুক্রবার কমলাপুর রেলস্টেশনে খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, কমান্ডার এনামুল হকের অফিসের গেট তালাবদ্ধ। তবে একই ভবনের পাশে রেলওয়ে ট্রেনস অফিসের দায়িত্বশীল দুই ব্যক্তির সাথে কথা বলতে গেলে তারা প্রথমে বলেন, কমান্ডার এনামুলকে আমরা চিনি না। তিনি কোথায় অফিস করেন তা-ও তাদের জানা নেই। পাশাপাশি অফিসে থাকার পরও এনামুল হককে চেনেন নাÑ এমন প্রশ্নের উত্তর তারা এড়িয়ে বলেন, আপনি সামনের অফিসে গিয়ে খোঁজ নেন। পরে তাদের সাথে আবার কথা বললে তারা বলেন, এত দিন এনামুল সাহেবকে আমরা তেমন একটা চিনতাম না। তবে ঘুষের টাকা কেলেঙ্কারিতে তিনি ধরা পড়ার পর পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি আমাদের পাশের অফিসের নিরাপত্তা কমান্ডারই হচ্ছেন সেই এনামুল। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মন্ত্রী বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, রেলওয়ের পারফরম্যান্সে তিনি সন্তুষ্ট। কিন্তু বাস্তব চিত্র কী তা আমরা ভালো করে জানি। ট্রেনের শিডিউল তো একেবারে ল ভ । এক ট্রেনের বগি আরেক ট্রেনে লাগিয়ে কোনো মতে এখন ট্রেনের শিডিউল ঠিক রাখা হচ্ছে। মূলত রেলের কোনো উন্নতি হয়েছে এমন কথা মন্ত্রী কিভাবে বলেন তা আমরা বুঝতে পারছি না। তাদের মতে, রেল যেমন ছিল এখন তেমনই আছে। তবে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে শুধু মন্ত্রী, এপিএস ও রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। যাদের সামনে আমরা কখনো দাঁড়াতে পারব না।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা গতকাল এ প্রতিবেদকের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে অভিযুক্ত রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ে ঢাকার কমান্ডার এনামুল হককে চিঠি দেয়া হয়েছে। এখন তারা রোববার গঠিত তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হন কি না তা আগে দেখার বিষয়। যদি সেই দিন তারা উপস্থিত না হন তাহলে ধরে নিতে হবে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। একই সাথে তারা এ-ও বলছেন, এপিএসের গাড়িচালক আলী আজম যদি বিজিবির হেফাজতে এখন না থাকেন তাহলে ধরে নিতে হবে ওই চালক প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়ে রয়েছেন, যে কারণে তার নিখোঁজের ব্যাপারে তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ এখনো তোলা হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, গত ৯ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস তার ব্যক্তিগত মাইক্রো বাসে মন্ত্রীর বাসভবনে যাওয়ার উদ্দেশ্য ধানমন্ডি থেকে রওনা দেন। পিলখানার সামনে যাওয়ার পরপরই গাড়িচালক আলী আজম গাড়ি নিয়ে একপর্যায়ে বিজিবি সদর দফতরে ঢুকে পড়েন। এ সময় গাড়ির ভেতর ছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ের ঢাকা বিভাগের কমান্ডার এনামুল হক। এ সময় চালক আলী আজম বিজিবি সদস্যদের বলতে থাকেন, ‘স্যার আমাকে বাঁচান’। গাড়ির ভেতর বস্তাভর্তি টাকা। এরপরই বিজিবি সদস্যরা গাড়ির ভেতর থেকে দু’টি বস্তায় থাকা বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার করেন। এরপরই তাদের টাকার উৎসের ব্যাপারে জানতে চাইলে তখন মন্ত্রীর এপিএস ফারুক বিজিবির সদস্যদের ধমকের সুরে বলার চেষ্টা করেন, আমি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনের এপিএস ফারুক। পরিচয় দেয়ার পরও যখন তাদের আটকে রাখা হয় তখন এপিএস গাড়িসহ আটক হওয়ার কথা প্রথম সংবাদ জানান মন্ত্রীর বাড়িতে থাকা আরেক এপিএস ‘মোশাররফকে’। ঘটনাটি তখনো কেউ জানতে পারেননি। পরে ওই মোশাররফ বিষয়টি রাতেই সুরঞ্জিতের নির্বাচনী এলাকা দিরাইয়ের জনৈক ব্যক্তিকে টেলিফোনে জানান। তখন সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সুরঞ্জিতের এপিএস ফারুক ৭০ লাখ টাকা ও মদসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়েছেন। দিরাই থেকে রাতেই ঢাকাসহ দেশ-বিদেশে খবরটি ছড়িয়ে দেয়া হয়। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বিজিবির হাত থেকে যদি গাড়িচালক আলী আজম মুক্তি পেয়েই থাকেন, তাহলে তিনি এখন কোথায়? অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, তিনি কি আসলেই জীবিত আছেন? গতকাল রেল মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত দু’টি তদন্ত কমিটির একটির প্রধান রেলওয়ের মহাপরিচালক মো: আবু তাহেরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন ধরেননি।
রেলমন্ত্রীর সম্পৃক্ততার ব্যাপারে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়োগবাণিজ্যের হোতা পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধাকে অপসারণ করে রিমান্ডে নেয়া এবং এই নিয়োগবাণিজ্যের ঘটনা উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্তের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ। একই সাথে নিয়োগবাণিজ্যে রেলমন্ত্রী সম্পৃক্ত থাকলে তারও বিচার দাবি করেন সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। তাদের দাবি বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়োগবাণিজ্যে রেলমন্ত্রীর সম্পৃক্ততার অভিযোগের ব্যাপারে গত ফেব্র“য়ারি মাসেই মন্ত্রীকে সতর্ক করেছিলেন তারা। রেল কর্তৃপ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তাদের বক্তব্য আমলে নিলে সব রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ললাটে এমন লজ্জাকর কলঙ্ক তিলক পরার দৃশ্য দেশবাসীকে অবলোকন করতে হতো না। পরিষদ নেতৃবৃন্দ নিয়োগবাণিজ্যের কারণে বিতর্কিত বর্তমান নিয়োগ কমিটি পুনর্গঠন করে বাকি নিয়োগ দ্রুত সম্পন্ন করারও দাবি জানান। বর্তমান নিয়োগকে কেন্দ্র করে পদবি ভেদে দুই থেকে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে বলে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের দাবি। মন্ত্রীকে দিতে হবে এমন কথা বলে জিএম পদবি ভেদে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে নিয়েছেন বলে শ্রমিক নেতৃবৃন্দ জানান।
গতকাল সকালে চট্টগ্রাম প্রেস কাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় রেলওয়ের বর্তমান নিয়োগে যোগ্যতার মাপকাঠি টাকা।
সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের নেতা মো: হারুনুর রশিদ লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এ সময় বলা হয়, রেলমন্ত্রীর এপিএস ও রেলওয়ের জিএমের (পূর্ব) বিরুদ্ধে ৭০ লাখ টাকা ঘুষ প্রদানের অসৎ উদ্দেশ্যের বিষয়টি সর্বত্র জানাজানি হলে দেশবাসীর সাথে রেল শ্রমিক-কর্মচারীরাও মর্মাহত এবং উদ্বিগ্ন। ঘুষ কেলেঙ্কারি তথা রেলওয়ের নিয়োগবাণিজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিষদের প থেকে গত ছয় মাস আগে থেকেই কর্তৃপ তথা সরকারের উচ্চপর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন হওয়ার পর রেল ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপরে নিয়োগবাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ততার কথা সব রেলওয়েতে ব্যাপক প্রচারিত হলে গত ফেব্র“য়ারি মাসের শুরুতেই মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সতর্ক এবং এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়। সর্বশেষ গত ২৮ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের ১৪ জন প্রতিনিধি রেল ভবনের সম্মেলন কে রেলমন্ত্রীর সাথে সাাৎ করে রেলওয়ের নিয়োগে দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে মন্ত্রীর হস্তপে চাওয়া হয়। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের এসব বক্তব্যকে কর্ণপাত করা হয়নি এবং এর প্রতিবাদে গত ৪ এপ্রিল সিআরবি ও পাহাড়তলীতে বিােভ করা হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
নিয়োগবাণিজ্যে মন্ত্রী জড়িত কি নাÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ রেলওয়ে সংগ্রাম পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মোখলেসুর রহমান জানান, সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তবে জিএম নিজেই আমাদের বলেছেন মন্ত্রীকে টাকা দিতে হবে, সে জন্য পদবি ভেদে টাকার পরিমাণও বাড়াতে হবে। এভাবে কত টাকার বাণিজ্য হয়েছেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে মোখলেসুর রহমান জানান, তা ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে যেসব নিয়োগ হয়েছে পদবি ভেদে দুই থেকে পাঁচ-ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি হয়েছে বলে তিনি জানান।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, লিখিত পরীার নামে একটি আইওয়াশ হয়েছে। এসব খাতা কাটানো হয়েছে পেনসিল দিয়ে মার্কিং করে। এখানে যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি ছিল টাকা এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে পাসকে ফেল, ফেলকে পাস করানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে পরিষদের সমন্বয়কারী এস কে বারী খোকন, কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবদুস সবুর, মোহাম্মদ আলী, রফিক চৌধুরী, কাজী আনোয়ারুল হক, গোলাম মোস্তফা, রেজওয়ানুর রহমান খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads