বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১২

মহাজোট মন্ত্রিসভা প্রাইভেট লিঃ-১৮জনগণের নিরাপত্তা চেয়ে জেনারেল ডায়েরি



আ মী ন কা দী র
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মতো তাদেরই একজন হিসেবে এই মুহূর্তে আমি ও এই দেশের জনগণ স্মরণকালের ভয়ঙ্করতম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। জীবনের নিরাপত্তা নেই আমাদের। ঘর থেকে বেরুবার পর সপ্রাণ বাড়িতে আবার ফিরতে পারব কি-না তার কোনো আশ্বাস নেই। নিশ্চয়তা নেই। এমনকি আমাদের লাশও ঘরে পৌঁছাবে কি-না, এই রাষ্ট্র, এই সরকার, এই প্রশাসন তার গ্যারান্টি দিতে পারছে না। এমনই ভয়াল নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি আমরা। আমি এবং আমরা যে কোনো সময় গুম হতে পারি। শিকার হতে পারি গুপ্তহত্যার। অদ্ভুত এক বিপন্নতা, বিস্ময়কর এক আতঙ্ক আমাদের ঘিরে। আমরা বেঁচে আছি কি-না; আমরা খুন হয়েছি কি-না তাও আমাদের পরিবার-পরিজন কখনও জানবে না। আমাদের অন্তিম ঠিকানা হতে পারে অজানা অচিন এক অন্ধকূপ। আমাদের দেহ পৌঁছে যেতে পারে এমন এক সংগোপন মৃত্যু উপত্যকায়, যার ঠিকানা কেউ জানে না। এই সরকার ও প্রশাসন সেই ঠিকানা জানতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য হলেও তারাও ভয়ঙ্কর অন্ধ। বরং তারা নিরাপত্তাহীনতার এই অদ্ভুত আঁধারে হাস্যরস করে মজা লুটছে। ভড়ং-ভণ্ডামি-শঠতা করছে নির্বিকার চিত্তে। এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়? সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে নিরাপত্তা প্রতিবিধানে। আমরা এখন কোথায় যাব? কার কাছে যাব! কে আমাদের রক্ষা করবে গুম-গুপ্তহত্যার ভয়াল আতঙ্ক থেকে!
যে জেনারেল ডায়েরিটি এই মুহূর্তে লিখছি—৫৬ হাজার বর্গমাইলের সব থানায় এটি একযোগে দাখিল করে যেতে চাই। আমরা নিশ্চিত নই—কোথাও এটি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় নেয়া হবে কি-না! যদি না-ই হয় তবে মহাকালের অক্ষয় পাতায় এটি দায়ের করে গেলাম।
আমরা এই সময়ে এতটাই অনিরাপদ—খোদ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ২৩ এপ্রিল ২০১২ সালে নিরাপত্তা চেয়ে একটি জেনারেল ডায়েরি দাখিল করা হয়েছে। সদাশয় শাহবাগ থানা কর্তৃপক্ষ সেটি গুরুত্বের সঙ্গে রুজুও করেছে। কোনোরকম অবহেলা, শিথিলতা দেখায়নি পুলিশ। প্রধানমন্ত্রীর এই যে নিরাপত্তার অভাব বোধ করলেন তারই কোনো গুণগ্রাহী—গভীরভাবে প্রত্যাশা করি—প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই প্রতিবিধান পাবেন। নিশ্চয়ই তিনি থানা পুলিশের সুরক্ষা পাবেন।
এখানে সবিনয়ে প্রশ্নটা না করে পারছি না—যেখানে একান্ত ভক্তরা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি পাচ্ছেন না, সেখানে আমাদের মতো আম-জনতার কি অবস্থা তা সহজেই অনুমানযোগ্য। তদুপরি পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা সঙ্কটকে কোনোভাবেই আমলেও নিচ্ছে না। আমরা থানায় গেলে মামলা নেয় না তারা। আমাদের ভাই সাগর, বোন রুনি দিব্যি খুন হলো—মাসের পর মাস যেতে চলেছে আমরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। সারাদেশের প্রায় দু’শ মানুষ গুম হলো—তারা বেঁচে আছে নাকি লাশ হলো সে কথাও বলতে পারছে না পুলিশ। বরং মানুষগুলো গুম হয়েছে কি না—এই রাষ্ট্র ও সরকার তারই প্রমাণ চাইছে শোকার্ত রোরুদ্যমান স্বজনদের কাছে। সত্যিই আমরা এখন বেশ আছি। মরে গিয়ে কিংবা গুম হয়ে আমাদেরই এখন প্রমাণ করতে হবে—আমরা মরিয়াছি। আমাদের লাশ হয়েও দিব্যি হেঁটে হেঁটে থানায় এসে হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে মৃত্যুর সত্যতা। এমনই এক পরাবাস্তব বাংলাদেশে বাস করছি আমরা। দেশ এখন উদ্ভট উটের পিঠেই কেবল সওয়ার নয়—বাংলাদেশের বাস্তবতা এখন কবির কল্পনাকেও হার মানাচ্ছে।
পত্রিকান্তরে কিছু কল্পনাতীত খবরাখবর জেনেও ভয়ে জবুথবু হয়ে আছি। ২৩ এপ্রিল ২০১২ জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম সংক্রান্ত রিপোর্টে বলছে—“গোয়েন্দা সূত্র মতে, এটি সাধারণ কোনো পেশাদার চক্রের কাজ নয়। এই নিখোঁজ রহস্যের সঙ্গে এমন কোনো চক্র জড়িত, যারা অনেক বেশি সতর্ক, সাবধানী, দক্ষ এবং বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। হতে পারে তারা রাষ্ট্রের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার চেইন অব কমান্ড বা ট্রেইল ভাঙা গ্রুপ। এদের সঙ্গে সরাসরি নেপথ্যে থেকে কিংবা মদত দিয়ে বাইরের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার লোকও থাকতে পারে। এর আগে পাওয়া বিভিন্ন ক্লুর সঙ্গে এই বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।” একই দিন দৈনিক সমকাল ‘১০ শর্ত মানলে মুক্তি ইলিয়াস আলীর’ শীর্ষক রিপোর্টে বলছে—“নিখোঁজ ইলিয়াসের সন্ধানে প্রভাবশালী দুটি দেশের সহযোগিতা নিতে দলের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।... একটি সূত্র জানায়, একটি দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইলিয়াস আলী যদি জীবিত থাকেন তাহলে তাকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন তারা।”
শীর্ষ এই দুই জাতীয় পত্রিকার বিস্ফোরক খবর পড়ার পর মেরুদণ্ডের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শীতল অনুভূতি সারা শরীরকে জড়বত্ করে ফেলল। মনে হলো কোন দেশে আছি আমি। পরদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১০ শর্তের ব্যাপারটি ভুয়া বলা হলেও কালের কণ্ঠের খবর নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করা হয়নি।
তার মানে দাঁড়ায়—খবরটি মিথ্যা নয়। এমনটি ঘটছে। আমার স্বদেশের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে দিব্যি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যখন তখন যে কাউকে গুম-খুন-গায়েব করতে পারছে বিদেশি শক্তি। তার সরল অর্থ দাঁড়ায়—একবার গুম-গায়েব হয়ে গেলে আমাদের লাশ স্বদেশের মাটিতে ঠাঁই পাবে—তারও গ্যারান্টি নেই।
২.
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য জেনারেল ডায়েরি করার লোক আছে। শাহবাগ থানার জিডির কথাই ধরি। এটি যিনি করেছেন তিনি আওয়ামী লীগ বা গণনেত্রী পরিষদ জাতীয় শুভাকাঙ্ক্ষী সংগঠনের নেতা। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা তার কোনো অফিসিয়াল স্টাফ কিংবা তার কোনো পরিবার সদস্যকে থানায় যেতে হয়নি। জিডির কপি হাতে ধর্ণা দিতে হয়নি পুলিশের কাছে। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন—এমন লোক জিডি করলেও দুরন্ত ও দ্রুত কাজ হচ্ছে। থানা পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে যাচ্ছে। মামলা হচ্ছে। আদালতও দেরি করছে না। রাষ্ট্রের শীর্ষ নির্বাহীর জন্য সবাই দৌড়ঝাঁপ করছেন। দ্রুত বিচার আদালতের চেয়েও দ্রুতগতিতে নিষ্পত্তি হচ্ছে এসব জিডি ও মামলার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উদ্ভট শিক্ষক ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনা করে স্ট্যাটাস দিয়েছিল। খুব দ্রুত সফল অ্যাকশন হয়েছে। লোকটিকে আদালতে তলব করা হয়েছে। অবশেষে আদালতে গরহাজির তথা তলব অমান্য করার অপরাধে তার ছয় মাসের জেল-জরিমানা হয়েছে। শিক্ষক নামধারী লোকটি এখন অস্ট্রেলিয়ায়। দিব্যি সেখানে বহাল-তবিয়তে বাস করছেন। জেল খাটতে তিনি দেশে আসবেন নাকি দেশে গেলে তাকে জেল খাটতে হবে—ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে বিড়ম্বনায় তিনি নিজ দেশে রাজনৈতিক হয়রানির শিকার—এই ভুয়া অজুহাত খাড়া করে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় আবার রাজনৈতিক তকমার স্ট্যাটাস পেয়ে বসেন কি-না সেটাও দেখার বিষয়। এমনিতে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার তদবিরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডাহা ব্যর্থ। সেখানে ফেসবুক অপরাধীদের কেমন করে দেশে এনে তারা শাস্তি বিধান করে—সমুদ্রজয়ী দীপু মনির দিকে সাগ্রহে তাই তাকিয়ে অনেকে। ২৩ এপ্রিল যে লোকটির বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় জিডি হয়েছে—অবাক ব্যাপার হলো এই লোকটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তরুণ, বয়স সামান্য। বুয়েটের প্রভাষক। অভিযোগ মতে, এ লোকও হত্যার হুমকি দিয়েছে ফেসবুকে। দিয়ে যাবে কোথায়! ঠিকই গণনেত্রী পরিষদের নেতার নিবিড় জালে ধরা পড়ে গেছে। রেহাই নেই। আশা করা যায়—এ লোকও উপযুক্ত শাস্তি পাবে। থানা-পুলিশ-আদালত অতি দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করবে। তবে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জাবি শিক্ষকের মতো এই শিক্ষকও দেশে না বিদেশে অবস্থান করছেন—এ নিয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি।
ক্ষুদ্র জ্ঞানে আইনজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি—ফেসবুকে হত্যার হুমকি, মৃত্যু কামনা ইত্যাদি গুরুতর অপরাধের সমুচিত শাস্তির ব্যাপারটি বাংলাদেশ তথা অন্যান্য দেশের আইনে ধূম্রজালে ভরা। কোনো ব্যক্তি যদি আদালতে গিয়ে ঘোষণা দেন, কথিত ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি তার নয়। ফেইক অ্যাকাউন্ট। তাহলে সে ঘোষণাকে মিথ্যা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য বৈকি। কেননা, মিথ্যা অ্যাকাউন্ট অনেকের নামেই তৈরি করা হচ্ছে। বিশেষ করে সেলিব্রেটি রাজনৈতিক নেতাদের নামে তৈরি করা ফেইক অ্যাকাউন্ট রয়েছে ভূরি ভূরি। এক সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নামে করা মিথ্যা অ্যাকাউন্ট মিডিয়াতে বেশ আলোচনার খোরাক যুগিয়েছিল।
আর তাই হত্যার হুমকিদানকারী এই কথিত দোষীদের শাস্তি প্রদান কতটা সম্ভব তা এখনও পরিষ্কার নয়। জাবির যে শিক্ষকের ৬ মাস জেল-জরিমানা হয়েছে—তা প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনার কথিত ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য নয়—হয়েছে আদালতের হাজিরার আদেশ অমান্য করার জন্য।
অভিবাসন আইন বিশেষজ্ঞদের মতে—এ ধরনের মামলাগুলো অপরাধীর জন্য শাপে বর হওয়ার আশঙ্কা বহন করে। কেননা, মামলার শিকার কথিত ইন্টারনেট দুর্বৃত্তরা উন্নত বিশ্বের কোনো দেশের শরণাপন্ন হয়ে এই আর্জি তুলতে পারে যে, স্বদেশে তারা রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক রাজনৈতিক বৈরিতাপ্রসূত অন্যায় হয়রানির শিকার। তারা সরকারের জুলুমবাজির শিকার। এই ফরিয়াদের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের অসারতা তুলে ধরলে তারা ওই দেশের বিশেষ আনুকূল্যও পেতে পারেন। অভিবাসন আইনজ্ঞদের আশঙ্কা—রাষ্ট্রকে বোকা বানিয়ে এমনটা ঘটে থাকলে তা আবারও দেশের ভাবমূর্তিকে বিদেশে ভূলুণ্ঠিত করবে বলাই বাহুল্য।
আইনজ্ঞদের আশঙ্কা যাই হোক; আমরা কায়মনোবাক্যে প্রত্যাশা করি—এসব জিডির উপযুক্ত বিহিত হোক। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হোক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ‘মৃত্যুকামনাকারী, হত্যার হুমকিদানকারী’দের বদদোয়া থেকে সহি-সালামতে সুস্থ সুদীর্ঘজীবী থাকবেন। কেননা, রাষ্ট্রের যিনি শীর্ষ নির্বাহী তার নিরাপত্তা সবার আগে। তার নিরাপত্তার প্রতিবিধান যদি সুনিশ্চিত করা যায়, তখন আমরা যারা এই গরিব প্রজাতন্ত্রের নগণ্য অসহায় অবহেলিত নাগরিক—তাদের নিরাপত্তার জিডিটির যথাবিহিত হবে। থানা পুলিশ যদি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জিডি নিয়ে শক্ত অ্যাকশন করে—তবে আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি—২/১ শতাব্দীর মধ্যে তারা আমাদের নিরাপত্তা দিতে সক্রিয় হবে।
আবার একথাও তো ঠিক, ২/১ শতাব্দী পরে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে—এই স্বপ্ন নিয়ে তো বসে থাকলে চলছে না। কেননা আমাদের গড় আয়ু ৬০/৬৫-এর বেশি নয়। সমকালের নিরাপত্তার কী অবস্থা।
আতঙ্কিত মানুষের সাহস নাকি একপর্যায়ে বেড়ে যায়। সেই সাহসে ভর করে সবিনয়ে জানতে চাই, প্রধানমন্ত্রী—যার নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রীয় সুদক্ষ প্রশিক্ষিত বাহিনী রয়েছে, কিছু গর্দভ মূর্খ ধান্ধাবাজ ফেসবুকে মৃত্যু কামনার স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের ধান্ধা হাসিল করছে—আমরা আইনগতভাবে দেখতে পাচ্ছি, তাদের প্রতিবিধান হচ্ছে দ্রুত। কিন্তু আমরা যারা সাগর-রুনির মতো বেঘোরে মারা যাচ্ছি, বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হয়েও রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে সৌদি কূটনীতিক খালাফ মারা গেছেন, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর মতো গুম হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, ১৪৪ ঘণ্টাতে খোঁজ মেলেনি ইলিয়াসের—এই নিবন্ধটি লেখার সময়কাল পর্যন্ত। আবার শতাধিক গুম ব্যক্তি আজীবনের জন্য চলে গেছেন অজানার ঠিকানায়—এদের ক্ষেত্রে প্রতিবিধান কোথায়।
এসব গুমের রহস্য জানা যাচ্ছে না কেন? ফেসবুক তন্ন তন্ন করে খুঁজে বদদোয়া দানকারী অপরাধীর সন্ধান মিলছে। কিন্তু যারা হত্যাকারী, গুমকারী—তাদের সন্ধান লাভে রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ। তবে কি ডিজিটাল বাংলাদেশে রাষ্ট্র ডিজিটাল ক্রিমিনালদেরই পাকড়াও করবে, শাস্তি দেবে, কিন্তু এনালগ ক্রিমিনালরা খুন, গুম করেও দিব্যি হেসে-খেলে দেশে-বিদেশে ঘুরে-ফিরে বেড়াবে—কোনো বিচার হবে না। ডিজিটাল ইন্টারনেট অপরাধী শনাক্ত, ধৃত ও দণ্ডিত হবে। আর এনালগ খুনি মুক্ত—আশ্চর্য ডিজিটাল বাংলাদেশ কী আসলে বাস্তব অস্তিত্ববিহীন ভার্চুয়াল দেশে পরিণত হচ্ছে। আমরা কী তবে এখন কোনো ইউটোপিয়ান ভার্চুয়াল বাংলাদেশের নাগরিক!
আর এই রাষ্ট্রে যারা সবচেয়ে সুরক্ষিত—সর্বোচ্চ সুপ্রিম পাওয়ার, নিরাপত্তার ঘেরাটোপে যারা নিরাপদ, তারা তৃণমূল থানায় গেলে দ্রুত সেবা পাচ্ছেন; আমরা যারা তৃণমূলে থানার ফুটপাতে, রাস্তায়, পাড়ায়-মহল্লায় গিঞ্জি পরিবেশে বাস করি আমাদের কেউ নিরাপত্তা দেবে না।
ওহে রাষ্ট্র, ওহে সরকার, ওহে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ—সাড়ে চৌদ্দ কোটি সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা নিয়ে এমন নিষ্ঠুর তামাশা তুমি কেন করছ! কে দিয়েছে তোমায় এই অধিকার! ওহে সরকার, তুমি কি আমার নও! ওহে রাষ্ট্র তুমি কি তবে আমাদের নও! ওহে প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, তুমি কি তবে ষোল কোটি বাঙালির নও? তুমি কি প্রজাতন্ত্রের প্রজাদের অভিভাবকত্বের দায় অস্বীকার করছো। ওহে মাতৃভূমি বাংলাদেশ—তুমি কি তবে আমাদের মাতৃত্বের মমতা প্রত্যাখ্যান করছ!
৩.
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র স্টেশনে আমার এই জেনারেল ডায়েরি-জিডিটি দাখিল করছি। এবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফরিয়াদ, সংশয় ও আশঙ্কার কথা বলছি।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার যখন ক্ষমতায় তখন একটি প্রবল-প্রচণ্ড মিডিয়া-গোষ্ঠীর তরফ থেকে বিরামহীন তোপধ্বনির মতো গরম আওয়াজ উঠেছিল—বাংলাদেশ অকার্যকর রাষ্ট্র হয়ে পড়ছে কিংবা হতে চলেছে। তখন নানাভাবে প্রমাণ ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল। অকার্যকর রাষ্ট্র মানে ভয়ঙ্কর কথা। ভয়াল উচ্চারণ। তারা তখন অকার্যকর সরকার বলেনি, বরং কার্যকারিতা হারানোর অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল রাষ্ট্রের প্রতি। অকার্যকর মানে ক্রমেই মৃত রাষ্ট্র।
আমি এবং আমরা— এই দেশের ১৬ কোটি নাগরিক রাষ্ট্রবিরোধী নই। রাষ্ট্রদ্রোহী নই। এ আমার সোনার বাংলা। আমরা মাতৃভূমি বাংলাকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি। এ আমার প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ। প্রথম বাংলাদেশ যেমন অস্তিত্বের উত্থান—এই মাতৃভূমিই তেমনি আমাদের অন্তিম ঠিকানা। এই মাটি, এই সবুজ—এই হাজার নদীর দেশ—পলি ধূসরিত অববাহিকা—এই সাত নদীর মোহনা—কুয়াকাটা, হরিণঘাটা, কক্সবাজার, সন্দ্বীপ, মহেশখালী, সেন্টমার্টিন, আশার চর, সোনার চর, রুপার চর, মনপুরা, নিঝুম দ্বীপ—এই শত সাগর সৈকত বিধৌত অপূর্ব বাংলাদেশ কোথাও পাব না আমরা। এই মাটিতে ডালিম গাছের তলে হবে আমাদের ছায়া সুনিবিড় শেষ আশ্রয়—এই মাটি ছেড়ে আমরা কোথায় যাব—কেন যাব!
আমার মাতৃভূমিকে আমরা অকার্যকর, মৃত রাষ্ট্র হতে দেব না। আমার রাষ্ট্র ও দেশ মৃত্যুঞ্জয়ী। এক সাগর রক্ত দিয়ে পেয়েছি এই স্বাধীন স্বদেশ। এই রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার যে কোনো চেষ্টাকে আমরা—‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি—বুঝে নিক দুর্বৃত্ত’র দৃপ্ত শপথে মোকাবিলা করব।’
আর তাই অকার্যকর রাষ্ট্র তো দূরের কথা, আমরা চাই না আমাদের সরকারও অকার্যকর হোক। গণতন্ত্র মরে যাক। দেশটা ভয়াল মৃত্যুপুরী হোক।
দেশপ্রেমিক জনগণ আমরা কখনোই ওই রাষ্ট্রের মর্যাদা—আবরুকে প্রশ্নের মুখোমুখি করিনি। কিন্তু সরকার যখন অকার্যকর-মরণাপন্ন হয়ে পড়েছে, কী চারদলীয় জোট আমল—কী মহাজোট আমল—আমরা সরকারের সেই অকার্যকারিতাকে বিবেকের কাঠগড়ায়—জনতার আদালতে তুলে কার্যকর ও সাহসী হওয়ার অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা জোগাতে চেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ—কবিঠাকুর বলেছেন—আধমরাকে ঘা মেরে তুই বাঁচা।
এই সরকার, এই প্রশাসন যখন আধমরা হয়ে পড়েছে—আইসিইউতে শায়িত হতে চলেছে, তখন তার চিকিত্সা দরকার। আর রাবিন্দ্রিক চিকিত্সা হলো, ঘা মেরে উজ্জীবনের পথে উদ্দীপ্ত করা।
আজ রাষ্ট্রের কয়েকশ’ ব্যক্তি গুম হলো—তারা হারিয়ে গেল অজানা-অচিন দেশে, তুমি তাদের কী নিরাপত্তা বিধান করেছ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার! তুমি কি তাদের কবরের চির শান্তির দেশে অন্তিম নির্বাসন দিয়েছ!
এর জবাব অবশ্যই তোমাকে দিতে হবে! কোথায় সেই গুম ব্যক্তিরা? তাদের ঠিকানা জানাতে তুমি বাধ্য হে কথামালার বজ্রবাঁশি সরকার। তোমার প্রধানমন্ত্রী, তোমার স্বরাষ্ট্রন্ত্রী, তোমার পুলিশ, সিআইডি, র্যাব—কোনোভাবেই গুমের দায় এড়াতে পারে না। তাদের হাতে সোপর্দ করা হয়েছিল সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের সবার নিরাপত্তা। তারা নিরাপত্তা বিধান ও সুরক্ষার সাংবিধানিক শপথ নিয়েছে। এখন তারা কোনোভাবেই বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে পারবো না বলে দায়িত্ব এড়াতে পারবে না।
গাজীপুরের পদত্যাগী সংসদ সদস্য তানজিম আহমেদ সোহেল তাজকে জানাই লাল সালাম। তাকে গাজীপুরের ভোটাররা নির্বাচনে জিতিয়ে এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি একজন কার্যকর মন্ত্রী হিসেবে কাজের সুযোগ পাননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ জনগণের সুরক্ষা—বেডরুম, ড্রইংরুমে পুলিশ পাহারা না বসিয়েও জনগণকে নিরাপত্তা দেয়া যে সম্ভব সেটা নিশ্চিত করা। তাকে নামকাওয়াস্তে মন্ত্রিত্ব উপঢৌকন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জনগণের নিরাপত্তার কার্যকর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। তাকে ডামি-পুতুল মন্ত্রী বানানো হয়েছিল। প্রতিবাদ করেছে সুযোগ্য তরুণটি। তার দায়িত্ববোধ আছে। আত্মশ্লাঘা আছে। আত্মমর্যাদাবোধ আছে। রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের পঙ্কিল পথে সে মন্ত্রিত্ব আঁকড়ে থাকতে চায়নি। মন্ত্রিত্বকে রাজতন্ত্রের মতো বংশগত অধিকার মনে করেনি। তাই পদত্যাগ করেছিল অকার্যকর মন্ত্রিত্ব থেকে। কোনো দ্বিধা করেনি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে শ্রম-ঘাম দিয়ে খেটেখাওয়া তরুণ। দেশের অকার্যকর রাজতন্ত্রে সে বিলাসব্যাসন ভোগ—চাটুকারিতার মহার্ঘ্য মাখন-ঘি চেটেপুটে খেতে চায়নি, তাকে টুপি খুলে অভিবাদন জানানো দরকার।
লুটপাট, দুর্নীতি, অকার্যকারিতা আর যত্রতত্র মাইক্রোফোন পেলেই বিরামহীন গালি—দোষারোপের সার্কাস, মূর্খ-অকর্মণ্য, অথর্ব আত্মতৃপ্তির এই অকার্যকর সরকার ব্যবস্থার সে হিস্যা হতে চায়নি। তাকে প্রলোভন দেয়া হয়েছিল। উেকাচ দিয়েছে সরকার। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেয়ার পরও বছরের পর বছর তাকে জোর করে উজিরে খামোখা করে রাখা হয়। ঘাড়ে ধরে নষ্ট-জর্জরিত সরকারের দায় গেলানোর জন্য জবরদস্তিভাবে তাকে মন্ত্রিত্বের বেতন পর্যন্ত দেয়া হচ্ছিল। প্রবল ঘৃণাভরে সে এই অসদুপায়কে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারপরও তার একাউন্টে ঢোকানো হচ্ছিল টাকা। এই নষ্ট ব্যবস্থার প্রতি ঐতিহাসিক প্রতিবাদ জানাতে তিনি শেষ পর্যন্ত সংসদ সদস্যপদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। দুঃখ প্রকাশ করেছেন গাজীপুরবাসীর কাছে—ইচ্ছা ছিল, ভালোবাসা ছিল, অদম্য দায়িত্ববোধ ছিল, তারপরও এই চলমান ব্যবস্থা তাকে কাজ করতে দেয়নি।
বঙ্গতাজের সুযোগ্য ছেলের মতো কাজ করেছে তরুণটি। সালাম—শত সালাম। ওই তরুণ তাজ যে কাজ পারল—এই আধমরা সরকারের অন্য অকর্মন্য জীবনমৃতদের কেন সেই উপলব্ধি হয় না।
মানুষের জন্য কাজ করতে পারেনি—এই আত্ম্যোপলব্ধিতে সে সরে দাঁড়ালো, আর তোমরা যে সরকারকে কার্যকর সক্রিয় রাখতে পারছ না—কেউ মারা গেলে তার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে টিটকিরি তামাশা করছো—এমনই নির্লজ্জ! এক সদ্য তরুণের যে দায়িত্ব কর্তব্যবোধ তার ছিটেফোঁটাও নেই তোমাদের মধ্যে। তদুপরি অবিরাম ঠাট্টা করে চলেছ।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কান্নায় বুক ভাসাচ্ছে। স্ত্রী সন্ধান চাইছে স্বামীর। পুত্র-কন্যা সন্ধান চাইছে পিতার। এরকম গুমের শিকার শত পরিবার আজ কাঁদছে। তা নিয়েও ঠাট্টা তোমরা থামাচ্ছ না। তোমাদের টিটকিরি-কৌতুকের ভাণ্ডার অফুরন্ত। কেউ অপহৃত হলে, গুম হলে কার কাছে প্রতিকার চাইবে তার পরিবার! তারা কী রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে ফরিয়াদ জানাতে পারবে না! প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তা চাইতে পারবে না! প্রতিটি নাগরিকের জন্ম-মৃত্যুর খতিয়ান জানতে, জানাতে সরকার বাধ্য। কেউ যখন তার গুম সন্তানটির কথা অশ্রুভরা চোখে জানতে চায় তখন কি-না তোমরা বিষয়টি ঠাট্টার লহরি ছুটিয়ে দিয়েছ! গুম ব্যক্তিরা নিজেরা গুম হয়ে আছে কি-না, লুকিয়ে আছে কি-না সেই কথা বলে বিমল আনন্দে হেসে চলেছ! কোনো নেত্রী লুকিয়ে রেখেছে কি-না সেরকম উক্তি করে হাসিতে, খুনসুটিতে তোমরা লুটোপুটি।
আমরা কি হাসির রাজার তাসের দেশে বাস করছি! আমরা কি তবে ঠাট্টা-তামাশা সার্কাসের সরকারকে ভোটে জিতিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছি। তোমরা কি তবে ঠাট্টা মশকরার ভার্চুয়াল সরকার! আমরা গুম হবো—তোমরা হাসবে। আমরা গুম হবো, আমাদের মা-বোন-স্ত্রী-সন্তান কাঁদবে—তোমরা হাসতে হাসতে বলবে—কিরে গুম হয়ে আছিস না-কি ব্যাটা।
পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই—বর্তমান সরকার ব্যবস্থা যদি কার্যকর কর্মক্ষম সরকার হয় তবে হাসি-ঠাট্টা ভাঁড়ামো তার কাজ নয়। তার কাজ হলো গুম ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা। তার স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নিশ্চিত করা। কেউ যদি খুন হয় তবে খুনিদের কঠিন বিচার সুনিশ্চিত করা। আর এসবের মাধ্যমে জননিরাপত্তাকে সুদৃঢ় করা। এ কাজে যদি তারা ব্যর্থ হয় তবে তারা অকার্যকর সরকার। আর এ ধরনের অকার্যকর সরকার ক্ষমতায় বসে ভাঁড়ামো-ভণ্ডামিতে লিপ্ত থাকলে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম কার্যকর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়—তা বলাই বাহুল্য।
লেখক : কপি সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ, ব্লগার

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads