শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১২

দলীয় বিবেচনায় আবারো বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু : নতুন এজলাস হচ্ছে ৫টি



খোকন বড়–য়া
দলীয় বিবেচনায় আবারো হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একটি তালিকা প্রধান বিচারপতির কাছে পৌঁছেছে। এই তালিকায় ছয়জন সুপ্রিম কোর্টের আইন কর্মকর্তা, ছয়জন আইনজীবী ও দুইজন জুডিশিয়ারির কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্য থেকে পাঁচ থেকে সাতজন নিয়োগ দেয়া হবে বলে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি নতুন পাঁচটি এজলাস তৈরির কাজও চলছে। উচ্চ আদালতের রায়ে সড়ক ভবনে এজলাস তৈরির কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। এজলাস তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পর এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার তাদের আগামী পৌনে দুই বছর সময়ের মধ্যেই নিজেদের অনুগত ব্যক্তিদের বিচারক পদে নিয়োগ সম্পন্ন করতে চায়। 
সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগের জন্য কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি ও সরকারদলীয় সিনিয়র আইনজীবী ইতোমধ্যেই তদবির সম্পন্ন করেছেন। তারা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের পছন্দের ও অনুগত আত্মীয় কয়েকজন আইজীবীকে নতুন বিচারক নিয়োগের নামের তালিকায় স্থান দিতে তদবির করেছেন। এবারের তালিকায় বিতর্কিত ব্যক্তির নামও রয়েছে। 
বিচারক নিয়োগে কোনোভাবেই দলীয় বিবেচনার উর্ধ্বে উঠতে পারছে না সরকার। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালতে একই অবস্থা বিরাজ করছে। সরকার গত তিন বছরে উচ্চ আদালতে ৫৩ জন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বর্তমানে শতাধিক বিচারপতি রয়েছেন।
অধিক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির কথা বলে রেকর্ডসংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেয়া হলেও মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত কোনো অগ্রগতি হয়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হলে উচ্চ আদালত এবং এর রায় নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দেবেই। পাশাপাশি বিচার বিভাগের মর্যাদা ুণœ হবে। জনগণের মধ্যে উচ্চ আদালতের প্রতি আস্থা কমে যাবে। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে মেধা ও যোগ্যতা বিবেচনা করেই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তাদের মতে দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা নির্ধারণে আইন করার কথা বলা হলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না । 
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচার নিয়োগে সংবিধানের দীর্ঘ ৪০ বছরেও কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় বার বার বিচারপতি নিয়োগে দেখা দিচ্ছে বিতর্ক। নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠছে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, শততা ও রাজনৈতিক দলীয় বিবেচনার প্রশ্ন। সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতি ও বিশিষ্ট আইনজীবী ও বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন মহল থেকে বার বার নীতিমালা তৈরির দাবি করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। ক্ষমতাসীন সরকার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা উপেক্ষা করে একের পর এক বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। এতে করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তথা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 
এ কারণে ‘বিচারক নিয়োগ’ নিয়ে রাজধানীতে একাধিক সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠিত এমন একটি সেমিনারে দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী, শিক্ষকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। সেমিনারে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, শুধু দলীয় বিবেচনায় নয়, বিচারক নিয়োগ হতে হবে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে দক্ষ ও যোগ্য বিচারক নিয়োগের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করার জোর দাবি জানান তিনি। 
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেছেন, আমেরিকায় নতুন রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় এসে তার পছন্দমতো বিচারক নিয়োগ দেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি যাদের নাম প্রস্তাব করেন, তা নিয়ে সিনেটে আলোচনা হয়। আমাদেরও বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকা দরকার। 
ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ইদানীংকালে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘৭২ সাল থেকেই বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে আইন করার কথা, কিন্তু তা হয়নি। বিচারপতি নিয়োগের কোনো বিধি থাকবে না, মাত্র দু-একজন ব্যক্তির ওপর এ নিয়োগ নির্ভর করবে, তা ঠিক নয়।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক এড়াতে এবং রাজনৈতিকভাবে সুপ্রিম কোর্টকে করায়ত্ত করার চেষ্টা বন্ধ করতে একটি আইন প্রণয়ন করে। ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অধ্যাদেশ ২০০৮’ নামের এ অধ্যাদেশটিতে প্রস্তাবিত ব্যক্তির শিাগত যোগ্যতা, পেশাগত দতা, জ্যেষ্ঠতা, সততা ও সুনামসহ কিছু বিষয় নির্ধারণ করে বিধান রাখা হয়। উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই করতে কমিশনের মৌখিক সাাৎকার গ্রহণ, এমনকি বাছাই প্রক্রিয়ায় কারো মতামত বা পরামর্শ প্রয়োজন হলে যেকোনো ব্যক্তিকে কমিশনের সভায় আমন্ত্রণ করার বিধান ছিল। স্থায়ী করার েেত্র হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে দতা, জ্যেষ্ঠতা, পেশাগত সততা ও সুনামসহ সার্বিক উপযুক্ততা বিশেষভাবে বিবেচনা করার মতা ছিল কমিশনের। হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগে নিয়োগের েেত্রও অভিন্ন বিধান অনুসরণ করার নির্দেশ রাখা হয়। কিন্তু এতে কিছু ত্রুটি থাকায় তা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ হয়। হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ অধ্যাদেশের একটি উপবিধি অকার্যকর হিসেবে বাতিল করে। মহাজোট সরকার মতা গ্রহণের পর এই অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করার সুযোগ থাকলেও সে পথে আর যায়নি। 
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমান হাইকোর্ট বিভাগে ১৭ জনকে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন। গত ১১ এপ্রিল এর মধ্য থেকে ১৫ জনের স্থায়ী নিয়োগের ব্যাপারে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর মধ্যে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস বাবু ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ খসরুজ্জামান। ওই সময় এই দুইজনের মধ্যে রুহুল কুদ্দুস বাবুর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ও মোহাম্মদ খসরুজ্জামানের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে ভাঙচুরের অভিযোগ থাকায় তাদের নিয়োগ ও শপথ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। সে সময় ওই নিয়োগের প্রতিবাদ জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন আইনজীবী সমিতি, যার কারণে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম এই দুইজনকে বিচারপতি হিসেবে শপথ পড়াননি। এ অবস্থায় প্রায় ছয় মাস কেটে যায়। পরে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর এ দুইজনকে শপথ পড়ান। সেই থেকেই তারা অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ দুইজনের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে এখনো দুই বছর পূর্ণ হয়নি। গত ১১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি ১৫জন অতিরিক্ত বিচারপতির দুই বছর পূর্ণ হওয়ায় তাদেরকে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads