বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১২


কোটি টাকা ভাগ হয় এপিএস-এর বাসায়
বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল ২০১২
নূরুজ্জামান: আটক টাকা নিয়োগ বাণিজ্যের। টাকার অঙ্ক ছিল কোটি ছাড়িয়ে। ওই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিবের বাসায়। সেই ভাগের এক অংশের মূল্যমান ৭০ লাখ টাকার গন্তব্য ছিল রেলমন্ত্রীর বাসভবন। মধ্যরাতে  একান্ত সচিবের গাড়িচালকের গোঁয়ার্তুমির কারণে নিয়োগ-বাণিজ্য ও ভাগ-বাটোয়ারার পুরো বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়ে। গতকাল কমলাপুর রেলস্টেশন, সচিবালয় সংলগ্ন রেলভবন, বিজিবি সদর দপ্তর, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর থেকেই মন্ত্রীর একান্ত সচিবের গাড়িচালক আলী আজমকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আটক হওয়া কর্মকর্তারা মন্ত্রীর বাসায় যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও টাকার কথা স্বীকার করেননি। রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ৬৫ ক্যাটিগরিতে ৭১৪০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে ১৩৩৮ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। বাকি জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে অগ্রগতি হচ্ছে। আর এ নিয়োগের পুরো বিষয়টির মূল তদারকের দায়িত্ব পালন করছেন রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের দুই জেনারেল ম্যানেজার। এদের একজন ইউসুফ আলী মৃধা। নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির খবর ওপেন সিক্রেট। সূত্র জানায়, ইউসুফ আলী মৃধার নিয়োগ সিন্ডিকেটের শক্তিশালী সদস্য হিসেবে খুব কম সময়ের ব্যবধানে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একান্ত সচিব ওমর ফারুক তালুকদার ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (ঢাকা বিভাগ) কমান্ড্যান্ট এনামুল হক। তারা দু’জনেই অধঃস্তন নিয়োগ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন জেলার লোকজনের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সর্বশেষ ধাপের নিয়োগ-বাণিজ্যের প্রায় দুই কোটি টাকা তারা তিনজনে ভাগ-বাটোয়ারা করেন। এ জন্য নিরাপদ জায়গা হিসেবে বেছে নেন একান্ত সচিব ওমর ফারুক তালুকদারের ধানমন্ডি-৩ নম্বরের বাড়ি। এ ভাগে অংশ নিতে চট্টগ্রাম থেকে ঘটনার আগেই ঢাকায় এসেছিলেন ইউসুফ আলী মৃধা। ঢাকায় এসে তিনি তার ব্যক্তিগত গাড়িতে তুলে নেন রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে। সরাসরি যান একান্ত সচিব ওমর ফারুকের ধানমন্ডির বাসায়। সেখানে  প্রত্যেকে ৩০ লাখ টাকা করে বুঝে নেন। পরে ৭০ লাখ টাকার আলাদা একটি ভাগ ব্যাগে ভরে ওমর ফারুক তার গাড়িতে তোলেন। নিজের গাড়ি ছেড়ে ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হক ওঠেন ওমর ফারুকের গাড়িতে। এরপর রওনা দেন মন্ত্রীর বাসার উদ্দেশ্যে। পুরো বিষয়টি চালক আলী আজমের নজরাধীনেই হয়েছে। তিনিও টাকার একাংশ দাবি করেছিলেন। তার দাবি মেটানো হয়নি। পরে এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায়। কমান্ড্যান্ট এনামুল হক সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ওই রাতে আমরা তিনজনই মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলাম। পথে চালক হঠাৎ করেই বিজিবি সদর দপ্তরের ভেতর ঢুকে পড়ে। তবে সে সময় গেটে দায়িত্ব পালনকারী বিজিবি’র সদস্যরা বাধা দেননি। একরকম বিনা বাধায়  বেশ খানিক দূরে যাওয়ার পর চালক গাড়ি থামিয়ে দেয়। কোন বিষয় নিয়ে ওমর ফারুকের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। প্রায় ঘণ্টাখানেক আপস-মীমাংসার চেষ্টা চলে। এরই মধ্যে বিজিবি’র সদস্যরা আমাদের দর্শনার্থীর কক্ষে বসিয়ে রাখে। তিনি দাবি  করেন, সে সময় আমাদের কাছে কোন টাকা ছিল না। ওমর ফারুকের কাছে ছিল কিনা তা-ও জানি না। তবে আমরা তিনজনই মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলাম। বিজিবি’র সূত্র জানায়, তাদের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। বিষয়টি পুলিশকে ফোন করে জানানো হয়েছিল। এরপরই তা ফাঁস হয়ে যায়। এনামুল আরও বলেন, জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা ঘটনার রাতে আমাকে বলেন, চলো মন্ত্রীর বাসায় যাই। তার কথামতো তার গাড়িতে উঠে ধানমন্ডি তিন নম্বরে যাই। সেখান থেকে গাড়ি বদল করে মন্ত্রীর একান্ত সচিবের গাড়িতে উঠি। চালক চিৎকার করে অবৈধ টাকার কথা বললেও আমি ওই টাকা দেখিনি। এদিকে গতকাল দুপুর ২টায় শাহজাহানপুর রেলওয়ে অফিসার্স স্টাফ কোয়ার্টারের ডি টাইপের ১/এ নম্বর ইউসুফ আলী মৃধার  ফ্ল্যাটে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। দরজায় নক করলে গৃহকর্মী পরিচয়ে একজন কাজের মেয়ে বের হয়। সে বলে, বাসায় কেউ নাই। এর আগে সকাল ১১টার দিকে রেলভবনে মন্ত্রীর একান্ত সচিব ওমর ফারুক তালুকদারের কক্ষ খোলা পাওয়া গেলেও তার চেয়ার ছিল ফাঁকা। তিনি অফিস করেননি। মন্ত্রীও ছিলেন না। ওমর ফারুকের কক্ষে দু’জন ব্যক্তি বসে থাকলেও তারা তাদের পরিচয় দেননি। বলেন, আমরা মন্ত্রীর লোক। এদের একজনের নাম খুরশিদ। তিনি বলেন, বিজিবি’র সদর দপ্তরে যে গাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার ও এপিএসসহ তিন কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছিল সেই গাড়ি কিংবা চালক রেল বিভাগের নয়। একান্ত সচিবের ব্যক্তিগত গাড়ি তার ব্যক্তিগত চালক চালাচ্ছিলেন। এর সঙ্গে মন্ত্রী কিংবা রেল বিভাগ জড়িত নয়। রেল ভবনের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানান, মন্ত্রীর একান্ত সচিব টাকাসহ আটক হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর গতকাল সকাল থেকে অন্তত ২০ জন লোক ঘুরে গেছে। তারা তার বর্তমান অবস্থান জানতে চেয়েছে। রেলসূত্র জানায়, রেল বিভাগের ৬৫ ক্যাটিগরিতে ৭২৭৫ জন  নিয়োগ অনুমোদন দেয়ার পর ৭১৪০ জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৩৮ জনের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। পরে অনুমোদন পাওয়া গেছে আরও ৫৩৬ জনের। এর বিপরীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৪৩৮ কর্মচারী। সব মিলে ১৭৭৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। বাকি নিয়োগের ছাড়পত্রের মেয়াদ ১১/২/২০১২ তারিখে উত্তীর্ণ হওয়ায় এবং মামলা থাকায় নিয়োগ সম্ভব হয়নি। ছাড়পত্রের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ওই মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাখ্যা জানাতে বলা হয়েছে। জেনারেল ম্যানেজার পূর্ব এবং পশ্চিমের কাছে বর্ধিত মেয়াদ ১১/২/২০১২-এর মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যার জন্য গত ১৪/৩/২০১২ তারিখে চিঠি দেয়া হয়েছে। গত ৯ই এপ্রিল এ বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আরও একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। সূত্র আরও জানায় ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে রেল বিভাগের এত সংখ্যক জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর তখন থেকেই রেল বিভাগের দুই জেনারেল ম্যানেজার (পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল)-এর অধীনে কমকর্তা ও কর্মচারীদের বিভিন্ন সিন্ডিকেট নিয়োগ ও তদ্বির বাণিজ্য শুরু করে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির জনবলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রেলের গার্ড ৭৬, স্টেশন মাস্টার ৯১, বুকিং সহকারী ২০০, ওয়েম্যান ২৭১১, খালাসি ১৪৪১ ও ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে ৪০০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এদের মধ্যে প্রত্যেক পদের বিপরীতে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা করে নিয়োগ সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে। তবে অবৈধ টাকা রাখার বিষয়টি স্বীকার করেননি মন্ত্রীর একান্ত সচিব ওমর ফারুক তালুকদার। ঘটনার পরপরই তিনি সাংবাদিকদের কাছে জানান, তার কাছে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা ছিল। এ টাকা লন্ডনপ্রবাসী তার শ্যালকের।     
চালক আলী আজম কোথায়: এদিকে বিজিবি’র সদর দপ্তরে টাকাসহ আটক তিন কর্মকর্তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও গাড়িচালক আলী আজমকে ছাড়া হয়নি। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, আলী আজম বর্তমানে বিজিবি’র হেফাজতে রয়েছেন। তিনি বাইরে বেরিয়ে এলে নিয়োগ-বণিজ্যের পুরো সিন্ডিকেটের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়বে। এ আতঙ্ক থেকেই প্রভাবশালী মহল তাকে অজ্ঞাত স্থানে আটক করে রেখেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবি’র জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মোহসীন রেজা বলেন, আমি কিছুই জানি না। তাকে আটক রাখা হয়েছে নাকি ছেড়ে দেয়া হয়েছে- কোন বিষয়েই মন্তব্য করতে পারবো না। তিনি আরও বলেন, বিজিবি সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী। কার টাকা কারা কিভাবে নিয়ে গেল সেটি দেখার দায়িত্ব পুলিশের, বিজিবি’র নয়। তবে প্রয়োজন হলে গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিকভাবে ডেকে পুরো বিষয়টির ব্যাখ্যা দেয়া হবে। সূত্র জানায়, রেল মন্ত্রীর একান্ত সচিব ওমর ফারুক তালুকদারের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন চালক আলী আজম। তাদের বাড়ি একই এলাকায়। ওমর ফারুক চালক হিসেবে চাকরি করলেও দু’জন ছিলেন বন্ধু। আলী আজমের নিয়োগ তদ্বির ও নিয়োগ-বাণিজ্যের টাকা পয়সা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দু’জনের দ্বন্দ্ব চলছিল। এ দ্বন্দের সূত্র ধরেই গত সোমবার দিবাগত রাতে তিনি ইচ্ছা করে গাড়ি বিজিবি সদর দপ্তরে ঢুকিয়েছিলেন। সেখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক আপস-মীমাংসার চেষ্টা চালিয়ে পরে বিজিবি’র ৩ নম্বর গেটে দায়িত্ব পালনকারী বিজিবি’র সদস্যদের কাছে অবৈধ টাকার বিষয়টি ফাঁস করে দেন।
টাকার উৎস খুঁজবে দুদক: গতকাল বিকালে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছেন, অবশ্যই এ টাকার উৎস অনুসন্ধান করা হবে। তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়লে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।    
তদন্ত শুরু হয়নি: রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দু’টি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিলেও গতকাল পর্যন্ত ওই দু’টি কমিটি কাজ শুরু করেনি। এমনকি আনুষ্ঠানিক কোন কমিটিও গঠন করা হয়নি। রেল ভবনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও ট্রাফিক বিভাগের পরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, এখন পর্যন্ত তদন্ত কমিটি গঠন সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক কোন কাগজপত্র কিংবা চিঠিপত্র পাইনি। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেছিলেন বিষয়টি তদন্তের জন্য দু’টি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads