শনিবার, ১৪ জুলাই, ২০১২

চিনি শিল্প ধ্বংসে শিল্পমন্ত্রীর মিশন


 দারুণ কৃতিত্ব দেখালেন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। সাম্যবাদী এ নেতা দেশের আখ চাষি আর চিনি শিল্পের কবর খুঁড়ছেন। চাষিরা এবার আখের বদলে ভুট্টা চাষ করেছেন। যেসব চাষি আখ চাষ করেছিলেন আখ উপড়ে ফেলে তারা ভুট্টা, শাকসবজির আবাদ করছেন। রমজান সামনে রেখে আমদানিকারকরা ৫ লাখ টন চিনি মজুত করে রেখেছেন। শিল্পমন্ত্রী বাজার মূল্য অপেক্ষা ১১ টাকা বেশি মূল্যে করপোরেশনের চিনি বিক্রি করে আমদানিকারকদের দাম বাড়ানোর সুযোগ এবং তাদের মর্জির ওপর চিনির বাজার ছেড়ে দিয়েছেন। আমদানিকারক সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা করতেই করপোরেশনের চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে। করপোরেশনের মজুত ১ লাখ ৮৬ হাজার টনের মধ্যে বিক্রি হয়েছে ১৫ টন। বর্ধিত মূল্যে ডিলাররা ১ টন চিনিও উত্তোলন করেননি।
এ অভিযোগ করপোরেশনের শীর্ষস্থানীয় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, ডিলার ও আখ চাষি সমিতির নেতাদের। আখ চাষিরা ৬ মাসেও গত মওসুমের আখের দাম না পাওয়ায় এবং আগামীতে দাম পাওয়ার অনিশ্চয়তায় আখ চাষে অন্যুসাহী হয়ে পড়েছেন। মিল এলাকার ২ লাখ একর জমিতে আখ চাষ হয়। এবারে তা ১ লাখ একরে নেমে আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মিলগুলো প্রয়োজনের অর্ধেক আখও পায় কিনা সে সংশয় দেখা দিয়েছে। অপরদিকে আমদানি করা চিনির প্রায় ৮ হাজার টন বন্যায় বিনষ্ট হয়েছে। চিনির দাম খোলাবাজারের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় ডিলাররা চিনি নিচ্ছেন না। এদিকে অর্থাভাবে ১৫টি মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দু’মাস ধরে বন্ধ। সুগার ও ফুড করপোরেশনের হেড অফিসের কর্মচারী-কর্মকর্তারা জুন মাসের বেতন এখনও পাননি। এ অবস্থায় করপোরেশন ও দেশের চিনি শিল্প চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি।
সুগার অ্যান্ড ফুড করপোরেশনের কর্মকর্তা, ডিলার সমিতি ও আখ চাষি সমিতি নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করছেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের গোষ্ঠীস্বার্থবাদী সিদ্ধান্তের কারণে চিনি শিল্প ধ্বংস হতে বসেছে। আখ চাষি সমিতির নেতা মুসলেম উদ্দিন বলেন, নাটোর সুগার মিলের চাষিরা মিলে আখ দিয়েছেন গত ডিসেম্বরে। এর পর পরই পুরো মূল্য পরিশোধ করার কথা। মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে গত জুনে। ৬ মাস দাম না পেয়ে চাষিরা খেতের আখ উঠিয়ে ভুট্টা চাষ করেছে। একই অবস্থা অপর ৮-৯ সুগার মিলে। ১৫টি চিনি কলের আখ চাষভুক্ত এলাকার সকল চাষিই আখ চাষ ও মিলে আখ দেয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহী হয়ে পড়েছে। গত বছর চিনিকলগুলোতে ৭০ হাজার টন চিনি উৎপাদন হয়েছে।
করপোরেশন গত বছরের সেপ্টেম্বরে চিনির দাম বাড়িয়ে কেজি প্রতি ৫৬ টাকা করে। বাজার নিম্নমুখী হওয়ায় নভেম্বরে দাম ১ টাকা কমিয়ে ৫৫ টাকা করা হয়। তখনও খোলাবাজারে চিনির দাম ছিল ৫৩ টাকা। বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দাম হওয়ায় করপোরেশনের ৫ হাজার ডিলার করপোরেশন থেকে চিনি উত্তোলন গত সেপ্টেম্বর থেকেই বন্ধ করে দেয়। অপরদিকে ডিলার পর্যায়ে টিসিবির চিনির দাম প্রতি কেজিতে ৪৭ টাকা। ব্যবসায়ীরা খোলাবাজারে এ চিনি বিক্রি করছেন ৪৯ থেকে ৫০ টাকায়। টিসিবি ও খোলা বাজারে ব্যবসায়ীদের দামের চেয়ে করপোরেশনের চিনির দাম বেশি হওয়ায় ডিলারদের পক্ষে এই চিনি বাজারে বিক্রি করা সম্ভব নয় বলেই তারা গুদাম থেকে চিনি তুলছেন না। একজন ডিলার মাসে ৩ টন করে চিনি বরাদ্দ পান। করপোরেশনের দামে চিনি কিনে এবং বর্তমান বাজারদরে বিক্রি করে একজন ডিলারকে ৩ টনে ২০ হাজার টাকা লোকসান গুণতে হবে। এ অবস্থায় করপোরেশনের উৎপাদিত ৭০ হাজার টন তিনি গুদামেই পড়ে আছে। গত অর্থবছরে শিল্প মন্ত্রণালয় ৫০ হাজার টন চিনি আমদানি করেছিল রমজানের জন্য। এর মধ্যে বিক্রি হয় ১৮ হাজার টন। অবশিষ্ট ৩২ হাজার টন চট্টগ্রামের একটি গুদামে গত এগার মাস ধরে পড়ে আছে। গুদাম ভাড়া বাবদ করপোরেশনকে মাসে ২৫ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে। চিনি আমদানির জন্য সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয় ১৫৮ কোটি টাকা। ব্যাংককে সুদ দিতে হচ্ছে প্রতি মাসে ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা করে। এবারের বন্যায় গুদামের দুই স্তরে রাখা ৮ হাজার টন চিনি গলে গেছে। এ চিনি ব্যবহারের যে মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে তাতে আগামী মাসে এ ৩২ হাজার টন চিনি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যাবে।
এবারের রমজান উপলক্ষে ৭৫ হাজার টন চিনি আমদানি করা হয়। গত মে মাস থেকে এ চিনি গুদামে পড়ে আছে। গুদাম ভাড়া দিতে হচ্ছে মাসে ৬০ লাখ টাকা করে। এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদ যাচ্ছে মাসে আড়াই কোটি টাকার বেশি। আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি থেকে কেনা ১০ হাজার টন চিনিও পড়ে আছে।
ডিলাররা লোকসানে চিনি বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয় নিজেই খোলাবাজারে চিনি বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। শিল্পমন্ত্রী এ বিক্রয় কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। কিন্তু ক্রেতা নেই। চারটি গাড়িতে করে করপোরেশন এ পর্যন্ত ১৫ টন চিনি বিক্রি করতে পেরেছে। ৬০ টাকা কেজিতে ভোক্তারা এ চিনি নিতে আগ্রহী নন। করপোরেশনের বিক্রি এখন প্রায় বন্ধ।
করপোরেশনের চিনি উত্তোলন না করা সম্পর্কে ডিলার সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল বলেন, লোকসান এড়ানোর জন্য সেপ্টেম্বর থেকে আমরা দাম কমানোর জন্য বলে আসছি। করপোরেশনের কাছে ডিলারদের জামানত বাবদ ৫০ লাখ টাকা এফডিআর করা আছে। করপোরেশন আর্থিক এ সুবিধা নেয়ার পরও বরাদ্দ অনুযায়ী মাল না ওঠাতে পারায় প্রতি টনে ২০০ টাকা করে জামানত থেকে কেটে রাখা হচ্ছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ নিস্পেষনমূলক আচরণ এবং ভ্রান্ত ও গোষ্ঠী স্বার্থবাদী নীতির কারণে চিনি শিল্পের অপমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে।
বেসরকারি খাতে আমদানিকারকরা রমজান সামনে রেখে ৫ লাখ টনেরও বেশি চিনি আমদানি করেছেন। এ চিনি বেশি দামে বিক্রির সুযোগ করে দেয়ার জন্যই করপোরেশন হঠাৎ করে চিনির দাম বাড়িয়েছে বলে করপোরেশনেরই অনেক কর্মকর্তা মনে করেন। তাদের আশঙ্কা এর ফলে বেসরকারি আমদানিকারক, বিক্রেতারা রমজানে চিনির দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
কি কারণে রমজানের আগে বাজার মূল্য অপেক্ষা অনেক বেশি হারে করপোরেশনের চিনির দাম বাড়ানো হলো, এতে কার স্বার্থ রক্ষা করা হলো প্রশ্ন করা হলে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া কথা বলতে রাজি হননি। আখ চাষি ও চিনি শিল্পের করুণ অবস্থা সম্পর্কেও তিনি কথা বলতে রাজি নন। মানবজমিনকে বলেন, এ নিয়ে অনেক কথা বলেছি, আর নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads