নাছির উদ্দিন শোয়েব
আলোচিত মামলার সাক্ষীদেরও কি গুম করা হয়েছে? ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওইসব ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! ৭০ লাখ টাকা কেলেঙ্কারির ঘটনায় সমালোচিত আওয়ামী লীগ নেতা ও দফতরবিহীনমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িচালক আলী আজম ৩ মাস ১২ দিন হলো নিখোঁজ। এদিকে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের পর থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না তার গাড়িচালক আনসার আলীকে। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বনানী থানার এএসআই মাহবুবেরও হদিস নেই। অপরদিকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির বাসার দারোয়ান হুমায়ুন কবিরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আলোচিত মামলাগুলোর তদন্তে সাক্ষী হিসেবে এই ব্যক্তিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রত্যেকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন হলো এসব ব্যক্তি ফেরার। তাদের খুঁজ বের করার চেষ্টা চলছে না। এমনকি মামলার তদন্তের প্রয়োজনেও তাদের হাজির করা হচ্ছে না। নিখোঁজ এসব ব্যক্তির পরিবার দুশ্চিন্তায় রয়েছে। তাদের ভাগ্যে কী জুটেছে কেউ জানে না। তারা গুম বা গুপ্তহত্যার শিকার কিনা তা নিয়ে অজানা আতঙ্কে দিন কাটছে পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজনদের।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে না। তারা পুলিশ ও প্রভাবশালীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। সুরঞ্জিত সেনের এপিএস ফারুক তালুকদারের গাড়িচালক আলী আজম ও ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসার আলীকে খুঁজে বের করার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাদের পরিবার। আলী আজমের বাবার দাবি, শুধু তার ছেলে একাই নিখোঁজ নয়। ছেলের স্ত্রী ও মেয়ে কারোরই কোনো খোঁজ নেই। তারা বিভিন্ন স্থানে খুঁজেছেন। কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসার আলীর পরিবারের দিন কাটছে চরম কষ্টে। যাদের কাছে সাহায্যের জন্য যাবেন সেই ইলিয়াস আলীই তো গুম! এ অবস্থায় আনসার আলীর দরিদ্র পরিবার গ্রামের বাড়িতে ছেলে-সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে জানা যায়।
সাংবাদিক-দম্পতি সাগর-রুনির বাসার দারোয়ানের কোনো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া ইলিয়াস আলীকে গাড়ি থেকে তুলে নেয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষকারী বনানী দুই নম্বর রোডের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যাদের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তারাও নিখোঁজ। এর মধ্যে কয়েকজনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আলী আজমকে ফিরে পেতে চায় মা-বাবা : ‘প্রতিদিনই আমরা দিন গুনছি। দিন গুনতে গুনতে ৩ মাস পার হলো আমাগো ছেলে আলী আজমকে আমাগো বুকে ফেরত পাইলাম না। আমরা আলী আজমকে দেখতে চাই। হেয় কোনো অন্যায় করলে সাজা ভোগ করবো, আমাগো হেতে কোনো মানা নাই। আমাগো জানতে হইব সে বাইচ্চা আছে কিনা’। এ কথাগুলো বললেন দফতরবিহীনমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িচালক আলী আজমের বাবা দুদ মিয়া (৭২) ও মা মাজেদা বেগম (৬০)। ছেলের কথা বলার সময় তারা কেঁদেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা আলী আজমকে নিয়ে অজানা আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের মনে ভর করেছে নানা শঙ্কা। একই সঙ্গে তারা এ আতঙ্কেও আছেন, আলী আজম আটক বা গুম আছে কিনা, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে?
গত ৯ এপ্রিল রাতে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে আটক হওয়ার পর থেকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আলী আজমের। সেদিন রাতেই সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার, রেলওয়ের জিএম ইউসুফ মৃধা, কমান্ড্যান্ট এনামুল হক ও চালক আলী আজম আটক হয়। পরদিন অন্যরা ছাড়া পেলেও আলী আজম রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ রয়েছে। আজমের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদী উত্তর ইউনিয়নের নওগাঁ গ্রামে। বাবা দুদ মিয়া ও মা মাজেদা বেগম। আলী আজমের ভাই শাহআলম খান, কাইউম খান, কামাল খান, সোহেল খান ও বোন নাজমা বেগম, সালমা বেগম। লেখা পড়ায় আলী আজম অষ্টম শ্রেণী পাস। ড্রাইভারি শিখে ঢাকায় চাকরি করলেও কখন যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িচালক হয়েছে জানতো না তার বাড়ির কেউ। বিষয়টি তারা টেলিভিশনের খবর ও পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারে। দুদ মিয়া বলেন, আলী আজমের স্ত্রী স্বপ্না ও মেয়ে রিয়াকে নিয়ে ঢাকায় থাকত। আলী আজমের বাবা দুদ মিয়া বলেন, আমার ছেলে আটক, গুম, খুন কোনোটি জানতে চাই না। ছেলেকে ফেরত চাই। ভাই কাইয়ুম খান বলেন, আমরা হতাশ, কিছুই বলার নেই আমাদের। মা সন্তানের খোঁজে এ বাড়ি ও বাড়ি ছুটে বেড়ান। বেশকিছু দিন আগে ২ জন লোক এসেছিল। পরিচয় গোপন রেখেছে। তবে ঢাকা যেতে বলেছিল।
মানবেতর দিন কাটছে আনসার আলীর পরিবারে : ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক নিখোঁজ আনসার আলীর স্ত্রী মুক্তা বেগম বলেন, ঘটনার দিন রাত ১১টার দিকে স্বামীর সঙ্গে তার শেষবারের মতো কথা হয়। এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। তার কোনো শত্রু নেই বলেও দাবি করেন মুক্তা বেগম। তিনি বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তার দুই বছরের শিশু সারাদিন বাবাকে খুঁজছে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর বৃদ্ধ মা সন্তান হারানোর শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর গাড়িরচালক আনসার আলীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে। বাংলাদেশ মোটরচালক দল এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। আয়োজক সংগঠনের আহ্বায়ক সেলিম রেজা বাবু বলেন, ফারুক তালুকদারের গাড়িচালক ও ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক দুই পরিবারের দুটি মানুষ নিখোঁজ। পরিবার দুটির উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আর কেউ নেই। এভাবে পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি যদি নিখোঁজ হয়ে যান, এই পরিবার দুটির সদস্যদের জীবন জীবিকায় যেমন নেমে আসবে বিপর্যয় তেমনি স্তব্ধ হয়ে যাবে সামনে চলার গতি। তাই অবিলম্বে তাদের জনসম্মুখে হাজির করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে জোর দাবি জানাচ্ছি।
প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্য কোথায়? বনানী ২ নম্বও রোডে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের কাছ থেকে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীকে আটক করে নেয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তা এএসআই মাহবুব এখন কোথায়? ঘটনার পর তড়িঘড়ি করে তাকে দুই সপ্তাহের ছুটিতে পাঠানো হলেও তিনি আর বনানী থানায় যোগ দেননি। তিনি কোথায় আছেন তাও স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। গত ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে ইলিয়াস আলীর গাড়িটিকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে দু’জনকে নামিয়ে নেয়ার পর তিনিই প্রথম ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। এ ঘটনায় তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বনানী থানার ওই ঘটনার কয়েকদিন পরই এএসআই ছুটিতে চলে যান। এর আগে তিনি থানায় অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে মহাখালী কলেরা হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে সেখান থেকেই তিনি ছুটিতে যান।
জানা যায়, ইলিয়াস আলীকে আটক করে নেয়ার সময় ওই পুলিশ কর্মকর্তা টহল ডিউটিতে ছিলেন। লোকজনের চিত্কার শুনে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরে তিনি রাস্তার মাঝ থেকে গাড়িটি ঠেলে সাউথ পয়েন্ট গেটের কাছে নিয়ে রাখেন। সূত্র জানায়, ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তিনি প্রথমে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘটনার বর্ণনা দিলেও পরে আর মুখ খুলতে রাজি হননি। সূত্র জানায়, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশেই তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে বনানী থানার ওসি ভূঁইয়া মাহবুব হোসেন বলেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছু স্পষ্ট করে বলতে পারবেন না। তিনি থানায় যোগ দেয়ার আগে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ছুটিতে গেছেন। তবে তিনি শুনেছেন, দুই সপ্তাহের ছুটির পর এএসআই মাহবুবকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু রাজারবাগ পুলিশ লাইনে খোঁজ নিয়েও ওই পুলিশ কর্মকর্তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
দারোয়ন হুমায়ুন নিখোঁজ : গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ৫৮/এ/২ ইন্দিরা রোডে পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি। এ ঘটনার এখনও পর্যন্ত কিনার করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার পরই ওই ভবনের দুই সিকিউরিটি গার্ড ও কেয়ারটেকারকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের গোয়েন্দা কার্যালয়ে আটক রেখে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে গোয়েন্দারা গত ২৬ ফেব্রয়ারি সাংবাদিকদের জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া ওই ভবনের দারোয়ান হুমায়ুন কবীর, পলাশ রুদ্র পাল এবং ম্যানেজার আবু তাহেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জানা যায়, এই তিনজনকে ছেড়ে দেয়ার পরও কয়েক দফা ডেকে নিয়ে গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু এরপর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন হুমায়ুন কবির। তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হলেও ওই বাসায় পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার তদন্তভার র্যাবের হাতে আসার পর র্যাব সদস্যরাও হুমায়ুনকে খুঁজে পাচ্ছে না বলে জানা যায়। তবে গত ১৫ জুলাই নিখোঁজ গার্ডের মোবাইল ফোন সেট গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার সোলায়মানের ভাই মোসলেম উদ্দীনের কাছ থেকে সেটটি উদ্ধার করে র্যাব। মোসলেমকে আটক করে র্যাব জিজ্ঞাসাবাদও করেছে । মামলার বর্তমান তদন্তকারী সংস্থা র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, দারোয়ান হুমায়ুন কবিরকে খুঁজতে গিয়ে তার মোবাইল সেটের সন্ধান পান তারা।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে না। তারা পুলিশ ও প্রভাবশালীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। সুরঞ্জিত সেনের এপিএস ফারুক তালুকদারের গাড়িচালক আলী আজম ও ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসার আলীকে খুঁজে বের করার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাদের পরিবার। আলী আজমের বাবার দাবি, শুধু তার ছেলে একাই নিখোঁজ নয়। ছেলের স্ত্রী ও মেয়ে কারোরই কোনো খোঁজ নেই। তারা বিভিন্ন স্থানে খুঁজেছেন। কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসার আলীর পরিবারের দিন কাটছে চরম কষ্টে। যাদের কাছে সাহায্যের জন্য যাবেন সেই ইলিয়াস আলীই তো গুম! এ অবস্থায় আনসার আলীর দরিদ্র পরিবার গ্রামের বাড়িতে ছেলে-সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে জানা যায়।
সাংবাদিক-দম্পতি সাগর-রুনির বাসার দারোয়ানের কোনো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া ইলিয়াস আলীকে গাড়ি থেকে তুলে নেয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষকারী বনানী দুই নম্বর রোডের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যাদের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তারাও নিখোঁজ। এর মধ্যে কয়েকজনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আলী আজমকে ফিরে পেতে চায় মা-বাবা : ‘প্রতিদিনই আমরা দিন গুনছি। দিন গুনতে গুনতে ৩ মাস পার হলো আমাগো ছেলে আলী আজমকে আমাগো বুকে ফেরত পাইলাম না। আমরা আলী আজমকে দেখতে চাই। হেয় কোনো অন্যায় করলে সাজা ভোগ করবো, আমাগো হেতে কোনো মানা নাই। আমাগো জানতে হইব সে বাইচ্চা আছে কিনা’। এ কথাগুলো বললেন দফতরবিহীনমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িচালক আলী আজমের বাবা দুদ মিয়া (৭২) ও মা মাজেদা বেগম (৬০)। ছেলের কথা বলার সময় তারা কেঁদেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা আলী আজমকে নিয়ে অজানা আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের মনে ভর করেছে নানা শঙ্কা। একই সঙ্গে তারা এ আতঙ্কেও আছেন, আলী আজম আটক বা গুম আছে কিনা, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে?
গত ৯ এপ্রিল রাতে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে আটক হওয়ার পর থেকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আলী আজমের। সেদিন রাতেই সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার, রেলওয়ের জিএম ইউসুফ মৃধা, কমান্ড্যান্ট এনামুল হক ও চালক আলী আজম আটক হয়। পরদিন অন্যরা ছাড়া পেলেও আলী আজম রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ রয়েছে। আজমের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদী উত্তর ইউনিয়নের নওগাঁ গ্রামে। বাবা দুদ মিয়া ও মা মাজেদা বেগম। আলী আজমের ভাই শাহআলম খান, কাইউম খান, কামাল খান, সোহেল খান ও বোন নাজমা বেগম, সালমা বেগম। লেখা পড়ায় আলী আজম অষ্টম শ্রেণী পাস। ড্রাইভারি শিখে ঢাকায় চাকরি করলেও কখন যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িচালক হয়েছে জানতো না তার বাড়ির কেউ। বিষয়টি তারা টেলিভিশনের খবর ও পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারে। দুদ মিয়া বলেন, আলী আজমের স্ত্রী স্বপ্না ও মেয়ে রিয়াকে নিয়ে ঢাকায় থাকত। আলী আজমের বাবা দুদ মিয়া বলেন, আমার ছেলে আটক, গুম, খুন কোনোটি জানতে চাই না। ছেলেকে ফেরত চাই। ভাই কাইয়ুম খান বলেন, আমরা হতাশ, কিছুই বলার নেই আমাদের। মা সন্তানের খোঁজে এ বাড়ি ও বাড়ি ছুটে বেড়ান। বেশকিছু দিন আগে ২ জন লোক এসেছিল। পরিচয় গোপন রেখেছে। তবে ঢাকা যেতে বলেছিল।
মানবেতর দিন কাটছে আনসার আলীর পরিবারে : ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক নিখোঁজ আনসার আলীর স্ত্রী মুক্তা বেগম বলেন, ঘটনার দিন রাত ১১টার দিকে স্বামীর সঙ্গে তার শেষবারের মতো কথা হয়। এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। তার কোনো শত্রু নেই বলেও দাবি করেন মুক্তা বেগম। তিনি বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তার দুই বছরের শিশু সারাদিন বাবাকে খুঁজছে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর বৃদ্ধ মা সন্তান হারানোর শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর গাড়িরচালক আনসার আলীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে। বাংলাদেশ মোটরচালক দল এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। আয়োজক সংগঠনের আহ্বায়ক সেলিম রেজা বাবু বলেন, ফারুক তালুকদারের গাড়িচালক ও ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক দুই পরিবারের দুটি মানুষ নিখোঁজ। পরিবার দুটির উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আর কেউ নেই। এভাবে পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি যদি নিখোঁজ হয়ে যান, এই পরিবার দুটির সদস্যদের জীবন জীবিকায় যেমন নেমে আসবে বিপর্যয় তেমনি স্তব্ধ হয়ে যাবে সামনে চলার গতি। তাই অবিলম্বে তাদের জনসম্মুখে হাজির করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে জোর দাবি জানাচ্ছি।
প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্য কোথায়? বনানী ২ নম্বও রোডে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের কাছ থেকে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীকে আটক করে নেয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তা এএসআই মাহবুব এখন কোথায়? ঘটনার পর তড়িঘড়ি করে তাকে দুই সপ্তাহের ছুটিতে পাঠানো হলেও তিনি আর বনানী থানায় যোগ দেননি। তিনি কোথায় আছেন তাও স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। গত ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে ইলিয়াস আলীর গাড়িটিকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে দু’জনকে নামিয়ে নেয়ার পর তিনিই প্রথম ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। এ ঘটনায় তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বনানী থানার ওই ঘটনার কয়েকদিন পরই এএসআই ছুটিতে চলে যান। এর আগে তিনি থানায় অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে মহাখালী কলেরা হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে সেখান থেকেই তিনি ছুটিতে যান।
জানা যায়, ইলিয়াস আলীকে আটক করে নেয়ার সময় ওই পুলিশ কর্মকর্তা টহল ডিউটিতে ছিলেন। লোকজনের চিত্কার শুনে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরে তিনি রাস্তার মাঝ থেকে গাড়িটি ঠেলে সাউথ পয়েন্ট গেটের কাছে নিয়ে রাখেন। সূত্র জানায়, ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তিনি প্রথমে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘটনার বর্ণনা দিলেও পরে আর মুখ খুলতে রাজি হননি। সূত্র জানায়, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশেই তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে বনানী থানার ওসি ভূঁইয়া মাহবুব হোসেন বলেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছু স্পষ্ট করে বলতে পারবেন না। তিনি থানায় যোগ দেয়ার আগে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ছুটিতে গেছেন। তবে তিনি শুনেছেন, দুই সপ্তাহের ছুটির পর এএসআই মাহবুবকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু রাজারবাগ পুলিশ লাইনে খোঁজ নিয়েও ওই পুলিশ কর্মকর্তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
দারোয়ন হুমায়ুন নিখোঁজ : গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ৫৮/এ/২ ইন্দিরা রোডে পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি। এ ঘটনার এখনও পর্যন্ত কিনার করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার পরই ওই ভবনের দুই সিকিউরিটি গার্ড ও কেয়ারটেকারকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের গোয়েন্দা কার্যালয়ে আটক রেখে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে গোয়েন্দারা গত ২৬ ফেব্রয়ারি সাংবাদিকদের জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া ওই ভবনের দারোয়ান হুমায়ুন কবীর, পলাশ রুদ্র পাল এবং ম্যানেজার আবু তাহেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জানা যায়, এই তিনজনকে ছেড়ে দেয়ার পরও কয়েক দফা ডেকে নিয়ে গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু এরপর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন হুমায়ুন কবির। তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হলেও ওই বাসায় পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার তদন্তভার র্যাবের হাতে আসার পর র্যাব সদস্যরাও হুমায়ুনকে খুঁজে পাচ্ছে না বলে জানা যায়। তবে গত ১৫ জুলাই নিখোঁজ গার্ডের মোবাইল ফোন সেট গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার সোলায়মানের ভাই মোসলেম উদ্দীনের কাছ থেকে সেটটি উদ্ধার করে র্যাব। মোসলেমকে আটক করে র্যাব জিজ্ঞাসাবাদও করেছে । মামলার বর্তমান তদন্তকারী সংস্থা র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, দারোয়ান হুমায়ুন কবিরকে খুঁজতে গিয়ে তার মোবাইল সেটের সন্ধান পান তারা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন