সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১২

পদ্মা সেতুর জন্য দান নেয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাংকের সাথে সুসম্পর্ক রাখার সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায়



পদ্মা সেতুর জন্য দান নেয়ার সিদ্ধান্ত



নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আগ্রহীদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহের জন্য দু’টি ব্যাংক হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হবে যাতে আগ্রহী বাংলাদেশীরা স্থানীয় মুদ্রায় ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের অর্থ দিতে পারেন। আর দ্বিতীয়টি খোলা হবে প্রবাসীদের জন্য যাতে তারা বিদেশী মুদ্রায় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সহায়তা দিতে পারেন। এ ব্যাপারে শিগগির একটি গাইডলাইন তৈরির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। 
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এক মাসের বেতন অনুদান হিসেবে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। জাতীয় সংসদ সদস্যরাও তাদের এক মাসের বেতন দেবেন বলে জানানো হয়েছে। মন্ত্রিসভায় বিশ্বব্যাংকের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্যও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। 
বৈঠক সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিসভাকে জানিয়েছেন, তিনি পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে ঋণের বিষয়টি রিভিউ করার উদ্যোগ নেবেন। 
বৈঠক সূত্র জানায়, অনুদান সংগ্রহের বিষয়টি স্বচ্ছ রাখতে জনগণকে সঠিকভাবে হিসাব জানাতে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। পদ্মা সেতুর জন্য অনুদান সংগ্রহের বিষয়ে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের জন্য এ উদ্যোগ নিয়েছে। ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার দেয়ার জন্য চুক্তি করলেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সম্প্রতি তা বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। পরে প্রধানমন্ত্রী গত ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের রূপরেখা তুলে ধরেন। ৭৫০ মিলিয়ন ডলারের বন্ড ছাড়ার পরিকল্পনার কথাও তিনি বলেন। এরপরই বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ এবং বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প থেকে এ প্রকল্পে সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয় বলে জানানো হয়।
মন্ত্রিসভায় জানানো হয়, বিদেশী ঋণসহায়তার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুই সব নয়। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর বাংলাদেশের অন্যান্য প্রকল্পে চলতি অর্থবছর বিনিয়োগ প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বেশির ভাগ অর্থায়নই বিশ্বব্যাংকের। সামাজিক, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে এ বিনিয়োগ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংকের মুখোমুখি অবস্থানে যাওয়া ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের সাথে ‘মধুর সম্পর্ক’ রক্ষার তাগিদ দেন মন্ত্রিসভা সদস্যরা। 
অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। হলে আমি সংবাদ সম্মেলন করে জানাব। বিশ্বব্যাংকের কাছে ধরনা দেবে না বলে সিদ্ধান্ত হলেও সংস্থাটি ‘ভুল’ বুঝে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে বলেও আশা করছেন তিনি।
দেশে পদ্মা সেতুর তহবিল সংগ্রহের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে মুহিত বলেন, তবে নিজস্ব অর্থে পদ্মা প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়ার পর সারা দেশে ব্যাপক সাড়া মেলায় অনুদান সংগ্রহে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে।
জনগণের ব্যাপক সাড়া পেয়ে আগ্রহীদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহের জন্য দু’টি ব্যাংক হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে হয়েছে। 
২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা প্রকল্পের ৬০ কোটি ডলার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দেয়ার কথা ছিল বলে জানান অর্থমন্ত্রী। অনুদানের অর্থ কোনোভাবেই অন্য খাতে ব্যয় হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা সাংবাদিকদের মন্ত্রিসভা বৈঠক প্রসঙ্গে জানান, অনুদান সংগ্রহে দু’টি ব্যাংক হিসাব কিভাবে পরিচালিত হবে তার পদ্ধতি ও নীতিমালা চূড়ান্ত করার জন্য অর্থ বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে । তিনি বলেন, যারা স্বেচ্ছায় পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বা নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চান, তাদের অর্থই এ হিসাব দু’টিতে নেয়া হবে। এ জন্য কাউকে চাপ দেয়া হবে না। যেকোনো শ্রেণী বা পেশার মানুষ এ হিসাবে অর্থ জমা দেয়ার সুযোগ পাবেন। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব বলেন, জনগণের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া যারা এ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় অর্থ দিয়েছেন বা আগ্রহ দেখিয়েছেন তাদের তিনি অভিনন্দন জানিয়েছেন।
পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের এ উদ্যোগকে সরকারের ‘নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা’ বলে বিরোধী দল যে অভিযোগ এনেছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ক্যাবিনেট সচিব বলেন, এ ধরনের কোনো আলোচনা মন্ত্রিসভার বৈঠকে হয়নি। তবে এ প্রকল্পের জন্য কারো কাছে থেকে জোর করে কিছু নেয়া হবে না।
দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়ার দাবি করে গত ২৯ জুন ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। এর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে দেশে আলোচনা চলছে। গত সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংকের সাথে জটিলতা শুরুর পর মালয়েশিয়ার সাথেও আলোচনা এগিয়ে নেয় সরকার। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করা হবে। গত ৮ জুলাই সংসদে দেয়া বক্তব্যে অর্থায়নের রূপরেখাও ঘোষণা করেন তিনি। দেশের বহু প্রতীতি পদ্মা সেতু প্রকল্পে এডিবির ৬১ কোটি, জাইকার ৪০ কোটি এবং আইডিবির ১৪ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল।
এদিকে বৈঠকে কমনওয়েলথের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য। তারা জানান, আগে কমনওয়েলথভুক্ত অনেক দেশ ভ্রমণে ভিসা গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল না। এখন অনেকটাই অকার্যকর এ সংস্থাটি। 
বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত ‘ওয়াকফ (সম্পত্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন) বিশেষ বিধান আইন, ২০১২’-এর খসড়া ভূমি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সাথে আরো আলোচনা ও সংশোধন এবং পরিমার্জন করতে ফেরত পাঠানো হয়। পরে এ খসড়া আবারো মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য বর্তমানে একটি আইন রয়েছে। কিন্তু এতে ভূমি হস্তান্তর ও উন্নয়নে তেমন কোনো স্বচ্ছ ব্যবস্থা নেই। তাই এসব সম্পত্তি কোনো কাজে লাগছে না। এ থেকে কোনো আয়ও হচ্ছে না। এ কারণে ধর্ম মন্ত্রণালয় এ আইনটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করেছে। এতে ভূমি হস্তান্তর, আয় ও উন্নয়নের বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, হস্তান্তর ও উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরো স্বচ্ছ করবে।
এ ছাড়া বৈঠকে ২৯ থেকে ৩০ মে দোহায় অনুষ্ঠিত ‘যুক্তরাষ্ট্র-ইসলামিক বিশ্ব ফোরাম’ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর এবং ১৬ এপ্রিল লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠক এবং ১ থেকে ৩ জুন সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ‘শাংরিলা সংলাপে’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অংশ নেয়ার বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অবহিত করা হয়।
আজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক : পদ্মা সেতু নির্মাণে নিজস্ব অর্থায়নের লক্ষ্যে আর্থিক সহায়তা সংগ্রহের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত অর্থ সংগ্রহ করা হবে বলে জানা গেছে। আজ মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের ডাকা হয়েছে। এ ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ সব দফতর, অধিদফতর, সংস্থা, শিক্ষা বোর্ডগুলোর প্রধানরাও এ বৈঠকে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আজ বেলা ৩টায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে। এ বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ সব দফতর, অধিদফতর, সংস্থা, শিক্ষা বোর্ডগুলোর প্রধানদের পদ্মা সেতুর অর্থ সংগ্রহের জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে এ ব্যাপারে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব তুলে ধরে বিশেষ সভা করে উদ্বুদ্ধ করতে বলা হবে। জানা গেছে, সংগৃহীত অর্থ পদ্মা সেতু তহবিলে জমা দেয়া হবে। 
এ ব্যাপারে গত রাতে শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের সাথে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এ ফলে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হবে এবং কে কত বেশি টাকা জমা দিতে পারেন তা নিয়ে কাড়াকাড়িও হতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষাবিদ বলেন, পদ্মা সেতুর বিষয়টি রাজনৈতিক হলেও এর সাথে আবেগ জড়িয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করা হবে। বাস্তবতা হচ্ছে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈদেশিক সহায়তা বা ঋণ গ্রহণ দোষের কিছু নয়। এর সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা কতটুকু সঠিক বা সমীচীন হবে তা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
পদ্মা সেতুর জন্য ফান্ড : এ দিকে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় ফান্ড থেকে ১০ লাখ টাকা অনুদান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সাথে দলের প্রত্যেক কেন্দ্রীয় নেতাকে ন্যূনতম এক লাখ টাকা করে দেয়ারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কার্যনির্বাহী কমিটির ওই বৈঠক থেকে। বৈঠকের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বৈঠকে আগামী ১৫ আগস্ট শোক দিবস উপলক্ষে মাসব্যাপী কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়। এ ছাড়া বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান কেন্দ্রীয় নেতারা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads