শা কি ল ও য়া হে দ
গেল সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর জন্য আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। মোট ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় সাপেক্ষে নির্মিতব্য পদ্মা সেতুতে একা বিশ্বব্যাংকই প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থের সমপরিমাণ ১২০ কোটি মার্কিন ডলার জোগান দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কনসোর্টিয়ামের আরেক দাতা সংস্থা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এডিবির দেবার কথা ছিল ৬১.৫০ কোটি ডলার, জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা জাইকার দেবার কথা ছিল ৪০.৫০ কোটি ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক আইডিবির দেবার কথা ছিল ১৪ কোটি মার্কিন ডলার। বাকি ৫৪ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ জোগান দেবার কথা ছিল সরকারের অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে। বিশ্বব্যাংকের পথ অনুসরণ করে প্রকল্পের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থ জোগানদাতা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এডিবিও তার প্রতিশ্রুত অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। কনসোর্টিয়ামের বড় দুই অর্থায়নকারীর মতো ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করে জাইকা খানিকটা সময় নিচ্ছে এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক আইডিবিও জাইকার পথই অনুসরণ করছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক সরে যাবার পর কনসোর্টিয়ামের বাকি সদস্যরাও যে একে একে সরে যাবে প্রকল্প থেকে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ বিশ্বব্যাংক আর এডিবি মিলে প্রকল্পের যে সিংহভাগ ৬০ শতাংশ অর্থায়নের কথা ছিল, তা প্রত্যাহার হয়ে যাবার পর শুধু জাইকা এবং আইডিবির ২০ শতাংশ অর্থায়ন দিয়ে যে প্রকল্পটি আর এগিয়ে নেয়া যাবে না, তা এককথায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
টানাপোড়েন তো চলছিল অনেকদিন ধরেই। দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল স্বয়ং বিশ্বব্যাংক। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা আগেকার মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম ধরে কোনো রাখঢাক না করে পদ্মাসেতু প্রকল্পে প্রত্যক্ষ দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে। প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের তরফ থেকে কাজ পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে সহায়তার বিনিময়ে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের কাছ থেকে মন্ত্রী, সচিব ও প্রকল্প পরিচালক ১০ শতাংশ ঘুষ দাবি করেছিলেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হয়েছিল সরকারের কাছে। একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, পদ্মাসেতু প্রকল্পে তারা ঋণচুক্তি স্থগিত করছে, কারণ এই প্রকল্পের উচ্চপর্যায়ে বড় আকারের দুর্নীতির আভাস পাওয়া গেছে। তারা তাদের হাতে থাকা তথ্য-প্রমাণাদি সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেয় সুষ্ঠু তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। কিন্তু সরকার কোনো এক অজানা কারণে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীকে রক্ষা করতে দৃষ্টিকটু রকমের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। পক্ষান্তরে বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে অনবরত চাপ দিয়ে যেতে থাকে। বিষয়টি নিয়ে সরকার এবং বিশ্বব্যাংক যেন মুখোমুখি অনড় অবস্থানে দাঁড়ায়। বিশ্বপুঁজির নিয়ন্ত্রক বিশ্বব্যাংকের অব্যাহত চাপে সরকার একপ্রকার বাধ্য হয়েই অভিযুক্ত মন্ত্রীকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেয়। অভিযুক্ত সচিবকে বদলি করা হয় অন্য মন্ত্রণালয়ে। আর অভিযুক্ত প্রকল্প পরিচালকের মেয়াদ শেষ হবার পর তার নিয়োগের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো কার্যকর তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়নি অভিযুক্ত মন্ত্রী ও অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। বরং আজ্ঞাবহ দুদককে দিয়ে অভিযুক্ত মন্ত্রীর জন্য ফরমায়েশি একখানা পরিচ্ছন্নতা সনদের ব্যবস্থা করা হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি বলে যেনতেন রকমের একটা ঘোষণা দিয়ে দেয় দুদক, যা সংশ্লিষ্ট মহলে ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতেও ব্যর্থ হয়।
অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটনস্থ সদর দফতরে বৈঠকের জন্য গেলে তার কাছেই প্রাথমিক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সংস্থাটির ইন্টেগ্রিটি সংক্রান্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট দুই দফায় বাংলাদেশ সফর করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি বিষয়ে তাদের আপসহীন অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়ে যান সরকারকে। সরকার গা করেনি বিষয়টাতে, কিংবা হয়তো বলা যায়, অজ্ঞাত কারণে অভিযুক্ত মন্ত্রীর বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে কথা চালাচালি চলতে থাকে রীতিমত অশোভন পর্যায়ে। সরকারের ছোট-বড় মন্ত্রীরা তো বটেই, বয়োজ্যেষ্ঠ অর্থমন্ত্রীও বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগকে রাবিশ জাতীয় বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকেন। আরেক কাঠি এগিয়ে গিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হাস্যকরভাবে পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেন, পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ যদি তারা প্রমাণ করতে না পারে, তবে তিনি বিশ্বব্যাংক থেকে এই প্রকল্পে কোনো অর্থই নেবেন না। কানাডার পুলিশ তাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান আইন ভঙ্গ করে কোনো দুর্নীতিতে জড়িয়েছে কিনা সেটা তদন্ত শুরু করে। তারা এসএনসি লাভালিনের অফিসে হানা দেয়, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে কিছু তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে, প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে লাভালিনের প্রধান নির্বাহী পদত্যাগ করেন এবং সর্বশেষ দু’জন বাঙালি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হয়। কানাডীয় পুলিশ বাংলাদেশে উড়ে এসে দুদকের কাছে তাদের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণাদি হস্তান্তর করে যায়। এসএনসি লাভালিন নামক প্রতিষ্ঠানটি ও এর কর্মকর্তারা যখন কানাডায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে কাজ পাওয়ার চেষ্টার অভিযোগে আনুষ্ঠানিক বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন, তখন বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র। অভিযুক্তদের রক্ষায় সরকারের প্রাণান্তকর চেষ্টা এবং তথাকথিত স্বাধীন দুদকের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজদের সাফাই গাওয়ার নিরন্তর অপপ্রয়াস জনমনে ব্যাপক কৌতূহল উদ্রেক করে চলেছে এবং নানারকম প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কেন এমন হলো?
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকারবদ্ধ হলে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে সরকার তো প্রথম থেকেই স্বচ্ছতার নীতি বেছে নিতে পারত। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত সব তথ্য-প্রমাণাদি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিতে পারত জনমনে বিদ্যমান বিভ্রান্তি দূর করার জন্য। একটা সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারত সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে এবং প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে তদন্তের জন্য সহযোগিতাও নিতে পারত। তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে যথাযথ তদন্ত করে অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে পারত। সেক্ষেত্রে জনগণ সরকারের নৈতিক মনোবলের পরিচয় পেত এবং দীর্ঘদিন ধরে ভাবমূর্তি সঙ্কটে ভোগা দুদকেরও এক ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি হবার সুযোগ ছিল। বিশ্বব্যাংক সেক্ষেত্রে খুশি থাকত এই ভেবে যে, সরকার তাদের উত্থাপিত দুর্নীতির বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করছে। লক্ষণীয় যে, অদ্যাবধি সরকার কিংবা দুদকের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকসহ কানাডীয় পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণাদি জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হয়নি। ফলে গুজব ডানা মেলছে বিভিন্ন রূপে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে নানারকম সরল ও জটিল বিশ্লেষণ। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বড় আকারের দুর্নীতি যে হয়েছে, সে বিষয়ে জনমনে নিশ্চিত প্রতীতি জন্মেছে এরই মধ্যে। উপরন্তু অভিযুক্ত মন্ত্রীকে সরানোর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অবিচল অনীহা দেখে দুর্নীতিতে আরো উচ্চপর্যায়ের জড়িত থাকার ব্যাপারেও সন্দেহ দানা বেঁধেছে। গত সপ্তাহে ফেনীতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা তো বলেই ফেললেন, পদ্মাসেতু প্রকল্পের দুর্নীতিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার জড়িত। সরকার দলের কেউ কেউ অবশ্য ড. ইউনূস তত্ত্বও প্রচার করছেন। তিনিই পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত বিশ্বব্যাংক মারফত এই জটিলতা সৃষ্টি করিয়েছেন বলে তাদের অনেকেই ধারণা পোষণ করেন। কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে মিথ্যা, তা বুঝতে চেষ্টা করে বেচারা আমজনতার ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে প্রচারিত বল্গাহীন মিথ্যা আর বাগাড়ম্বরের নিচে চাপা পড়েছে প্রকৃত সত্য। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু না হওয়ার হতাশা। বিশেষ করে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় এখন সর্বত্র, যারা পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন।
দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অর্থমন্ত্রী যে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, তা ছিল এককথায় অভূতপূর্ব। অনেক কথার মাঝে তিনি হুট করে বলে বসলেন, এই সিদ্ধান্ত নাকি বিশ্বব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত। নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিলে নাকি সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা হতে পারে। কিন্তু নতুন প্রেসিডেন্ট কোরীয় বংশোদ্ভূত জিম ইয়ং কিম তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই জানিয়ে দিলেন, বিদায়ী প্রেসিডেন্টের ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি সম্পূর্ণ একমত। তিনি এও জানিয়ে দেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মঙ্গলের ব্যাপারে সজাগ হলেও দুর্নীতিকে কখনও প্রশ্রয় দেবে না। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এই যে, এরপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাংকের উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগকে আমলে নেয়া তো দূরের কথা উল্টো বিশ্বব্যাংককেই দুর্নীতিবাজ বলে অভিহিত করলেন। নিজেদের পয়সায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করে ফেলবেন বলে অর্থহীন বাগাড়ম্বরও করলেন। চেলাচামুণ্ডা নেতা-মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর সুরে সুুর মিলিয়ে বিশ্বব্যাংককে কষে গালমন্দ করলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করে বাজার মাত করলেন। রেল দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ও বর্তমানে দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গভীর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শোনালেন, সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী তার স্বভাবসুলভ মারমুখো ভঙ্গিতে একবেলা বাজার না করে সেই পয়সায় পদ্মাসেতু করবার তত্ত্ব দিলেন এবং বর্তমান বাক্যবাগীশ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিকল্প উত্স থেকে আরও কম খরচে পদ্মা সেতু অর্থায়নের কল্পকাহিনী তুলে ধরলেন। মালয়েশিয়া থেকে অর্থায়ন হবে, কাতার থেকেও অর্থায়ন হতে পারে, মুখ থুবড়ে পড়া শেয়ারবাজার থেকে হতে পারে, নাকি ইনস্যুরেন্স সমিতির দাবি মোতাবেক প্রিমিয়াম তহবিল থেকে অর্থায়ন হবে, তা নিয়ে বালখিল্য পর্যায়ের হাস্যকর সব আলাপ-প্রলাপ চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর তার অকিঞ্চিত্কর বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি থেকে আধা বিলিয়ন ডলার সরকারকে পদ্মা সেতু অর্থায়নে দিয়ে দেবার প্রস্তাব করেছেন। বাস্তবতার নিরিখে এই বিকল্পগুলোর কোনোটাই যে কোনো প্রকার গুরুত্ব বহন করে না এবং অপরিণামদর্শী বোলচাল মাত্র, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না কারোরই। এই সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদে পদ্মা সেতু প্রকল্প যে শুরু করা যাচ্ছে না, তা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে সবার কাছে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু ছাড়াও আরও ৩৩টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ৪৬০ কোটি ডলারের অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সরকারের অপিরণামদর্শী হাঁকডাকের কারণে এখন সেইসব প্রকল্পেও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। অভিযুক্ত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বর্তমান মন্ত্রণালয় তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি প্রকল্পে এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করেছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে অবস্থা যে খুবই সঙ্গিন হয়ে পড়েছে, তা বলাই বাহুল্য। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থাও যে ক্রমাবনতিশীল, গত মাসে বাজেট নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত আলোচনা-সমালোচনা থেকেই তা স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকেই অব্যাহত নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি, লেনদেন ভারসাম্যসহ বিশাল ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাক্কলিত বৈদেশিক অনুদান ও সাহায্য না পেলে বিদ্যমান পরিস্থিতি যে আরও নাজুক হয়ে পড়বে, সে বিষয়ে কারোর কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়ন বাজেট অর্থায়ন তো দূরের কথা, ঘোষিত রাজস্ব বাজেট অর্থায়নের ক্ষেত্রেই সরকার বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। এখন প্রশ্ন হলো, পদ্মাসেতু না হয় বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ না পেলে নাই বা করা হলো, তাতেই কি সব ঝামেলা মিটে যাবে? উত্তর হলো সোজা—না, মিটবে না। পদ্মা সেতু হোক বা না হোক বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান দশায় বিদেশি সূত্র থেকে বড় কোনো অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থসংস্থান করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। রফতানি ও রেমিট্যান্স খাতে বিরাজমান দুর্দশার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি এমনিতেই রয়েছে বিপর্যস্ত অবস্থায়। সেক্ষেত্রে বড় আকারের কিছু বৈদেশিক অনুদান বা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছাড়া আমাদের ক্রমহ্রাসমান লেনদেন ভারসাম্য অনুকূলে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। পরপর তিন অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্য পরিস্থিতি কেবল খারাপ থেকে খারাপই হয়েছে। সরকারের বাজেট দলিল থেকে নেয়া তথ্যমতে, লেনদেন ভারসাম্য ২০০৯-১০ অর্থবছরে থাকা জিডিপির ৩.৭ শতাংশ থেকে ২০১০-১১ অর্থবছরে জিডিপির ০.৯ শতাংশে এবং সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত হিসেবে তা উদ্বিগ্ন হবার মতো পর্যায় ০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এমতাবস্থায় বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে সামনের দিনগুলোতে সরকারকে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যারপরনাই রকমের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হবে। পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি না থাকার কারণে দায়-দেনা মেটাতে ব্যর্থ হলে দেউলিয়াত্ব বরণ করার মতো পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতে পারে।
এরপরও কি বলা যাবে যে, টনক নড়েছে সরকারের? একের পর এক কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তির সঙ্কট ক্রমশ আরো ঘনীভূত হচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিসমূহ পূরণ না হওয়ায় এবং অন্য সব অনাচারের প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে আজ ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। গণ-অসন্তোষের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। জনমনে প্রশ্ন এখন একটাই—নৌকাডুবির প্রহর কি অত্যাসন্ন?
লেখক : সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বিএনপি
টানাপোড়েন তো চলছিল অনেকদিন ধরেই। দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল স্বয়ং বিশ্বব্যাংক। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা আগেকার মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম ধরে কোনো রাখঢাক না করে পদ্মাসেতু প্রকল্পে প্রত্যক্ষ দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে। প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের তরফ থেকে কাজ পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে সহায়তার বিনিময়ে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের কাছ থেকে মন্ত্রী, সচিব ও প্রকল্প পরিচালক ১০ শতাংশ ঘুষ দাবি করেছিলেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হয়েছিল সরকারের কাছে। একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, পদ্মাসেতু প্রকল্পে তারা ঋণচুক্তি স্থগিত করছে, কারণ এই প্রকল্পের উচ্চপর্যায়ে বড় আকারের দুর্নীতির আভাস পাওয়া গেছে। তারা তাদের হাতে থাকা তথ্য-প্রমাণাদি সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেয় সুষ্ঠু তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। কিন্তু সরকার কোনো এক অজানা কারণে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীকে রক্ষা করতে দৃষ্টিকটু রকমের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। পক্ষান্তরে বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে অনবরত চাপ দিয়ে যেতে থাকে। বিষয়টি নিয়ে সরকার এবং বিশ্বব্যাংক যেন মুখোমুখি অনড় অবস্থানে দাঁড়ায়। বিশ্বপুঁজির নিয়ন্ত্রক বিশ্বব্যাংকের অব্যাহত চাপে সরকার একপ্রকার বাধ্য হয়েই অভিযুক্ত মন্ত্রীকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেয়। অভিযুক্ত সচিবকে বদলি করা হয় অন্য মন্ত্রণালয়ে। আর অভিযুক্ত প্রকল্প পরিচালকের মেয়াদ শেষ হবার পর তার নিয়োগের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো কার্যকর তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়নি অভিযুক্ত মন্ত্রী ও অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। বরং আজ্ঞাবহ দুদককে দিয়ে অভিযুক্ত মন্ত্রীর জন্য ফরমায়েশি একখানা পরিচ্ছন্নতা সনদের ব্যবস্থা করা হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি বলে যেনতেন রকমের একটা ঘোষণা দিয়ে দেয় দুদক, যা সংশ্লিষ্ট মহলে ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতেও ব্যর্থ হয়।
অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটনস্থ সদর দফতরে বৈঠকের জন্য গেলে তার কাছেই প্রাথমিক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সংস্থাটির ইন্টেগ্রিটি সংক্রান্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট দুই দফায় বাংলাদেশ সফর করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি বিষয়ে তাদের আপসহীন অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়ে যান সরকারকে। সরকার গা করেনি বিষয়টাতে, কিংবা হয়তো বলা যায়, অজ্ঞাত কারণে অভিযুক্ত মন্ত্রীর বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে কথা চালাচালি চলতে থাকে রীতিমত অশোভন পর্যায়ে। সরকারের ছোট-বড় মন্ত্রীরা তো বটেই, বয়োজ্যেষ্ঠ অর্থমন্ত্রীও বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগকে রাবিশ জাতীয় বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকেন। আরেক কাঠি এগিয়ে গিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হাস্যকরভাবে পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেন, পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ যদি তারা প্রমাণ করতে না পারে, তবে তিনি বিশ্বব্যাংক থেকে এই প্রকল্পে কোনো অর্থই নেবেন না। কানাডার পুলিশ তাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান আইন ভঙ্গ করে কোনো দুর্নীতিতে জড়িয়েছে কিনা সেটা তদন্ত শুরু করে। তারা এসএনসি লাভালিনের অফিসে হানা দেয়, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে কিছু তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে, প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে লাভালিনের প্রধান নির্বাহী পদত্যাগ করেন এবং সর্বশেষ দু’জন বাঙালি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হয়। কানাডীয় পুলিশ বাংলাদেশে উড়ে এসে দুদকের কাছে তাদের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণাদি হস্তান্তর করে যায়। এসএনসি লাভালিন নামক প্রতিষ্ঠানটি ও এর কর্মকর্তারা যখন কানাডায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে কাজ পাওয়ার চেষ্টার অভিযোগে আনুষ্ঠানিক বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন, তখন বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র। অভিযুক্তদের রক্ষায় সরকারের প্রাণান্তকর চেষ্টা এবং তথাকথিত স্বাধীন দুদকের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজদের সাফাই গাওয়ার নিরন্তর অপপ্রয়াস জনমনে ব্যাপক কৌতূহল উদ্রেক করে চলেছে এবং নানারকম প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কেন এমন হলো?
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকারবদ্ধ হলে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে সরকার তো প্রথম থেকেই স্বচ্ছতার নীতি বেছে নিতে পারত। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত সব তথ্য-প্রমাণাদি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিতে পারত জনমনে বিদ্যমান বিভ্রান্তি দূর করার জন্য। একটা সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারত সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে এবং প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে তদন্তের জন্য সহযোগিতাও নিতে পারত। তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে যথাযথ তদন্ত করে অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে পারত। সেক্ষেত্রে জনগণ সরকারের নৈতিক মনোবলের পরিচয় পেত এবং দীর্ঘদিন ধরে ভাবমূর্তি সঙ্কটে ভোগা দুদকেরও এক ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি হবার সুযোগ ছিল। বিশ্বব্যাংক সেক্ষেত্রে খুশি থাকত এই ভেবে যে, সরকার তাদের উত্থাপিত দুর্নীতির বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করছে। লক্ষণীয় যে, অদ্যাবধি সরকার কিংবা দুদকের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকসহ কানাডীয় পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণাদি জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হয়নি। ফলে গুজব ডানা মেলছে বিভিন্ন রূপে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে নানারকম সরল ও জটিল বিশ্লেষণ। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বড় আকারের দুর্নীতি যে হয়েছে, সে বিষয়ে জনমনে নিশ্চিত প্রতীতি জন্মেছে এরই মধ্যে। উপরন্তু অভিযুক্ত মন্ত্রীকে সরানোর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অবিচল অনীহা দেখে দুর্নীতিতে আরো উচ্চপর্যায়ের জড়িত থাকার ব্যাপারেও সন্দেহ দানা বেঁধেছে। গত সপ্তাহে ফেনীতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা তো বলেই ফেললেন, পদ্মাসেতু প্রকল্পের দুর্নীতিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার জড়িত। সরকার দলের কেউ কেউ অবশ্য ড. ইউনূস তত্ত্বও প্রচার করছেন। তিনিই পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত বিশ্বব্যাংক মারফত এই জটিলতা সৃষ্টি করিয়েছেন বলে তাদের অনেকেই ধারণা পোষণ করেন। কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে মিথ্যা, তা বুঝতে চেষ্টা করে বেচারা আমজনতার ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে প্রচারিত বল্গাহীন মিথ্যা আর বাগাড়ম্বরের নিচে চাপা পড়েছে প্রকৃত সত্য। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু না হওয়ার হতাশা। বিশেষ করে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় এখন সর্বত্র, যারা পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন।
দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অর্থমন্ত্রী যে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, তা ছিল এককথায় অভূতপূর্ব। অনেক কথার মাঝে তিনি হুট করে বলে বসলেন, এই সিদ্ধান্ত নাকি বিশ্বব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত। নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিলে নাকি সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা হতে পারে। কিন্তু নতুন প্রেসিডেন্ট কোরীয় বংশোদ্ভূত জিম ইয়ং কিম তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই জানিয়ে দিলেন, বিদায়ী প্রেসিডেন্টের ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি সম্পূর্ণ একমত। তিনি এও জানিয়ে দেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মঙ্গলের ব্যাপারে সজাগ হলেও দুর্নীতিকে কখনও প্রশ্রয় দেবে না। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এই যে, এরপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাংকের উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগকে আমলে নেয়া তো দূরের কথা উল্টো বিশ্বব্যাংককেই দুর্নীতিবাজ বলে অভিহিত করলেন। নিজেদের পয়সায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করে ফেলবেন বলে অর্থহীন বাগাড়ম্বরও করলেন। চেলাচামুণ্ডা নেতা-মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর সুরে সুুর মিলিয়ে বিশ্বব্যাংককে কষে গালমন্দ করলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করে বাজার মাত করলেন। রেল দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ও বর্তমানে দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গভীর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শোনালেন, সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী তার স্বভাবসুলভ মারমুখো ভঙ্গিতে একবেলা বাজার না করে সেই পয়সায় পদ্মাসেতু করবার তত্ত্ব দিলেন এবং বর্তমান বাক্যবাগীশ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিকল্প উত্স থেকে আরও কম খরচে পদ্মা সেতু অর্থায়নের কল্পকাহিনী তুলে ধরলেন। মালয়েশিয়া থেকে অর্থায়ন হবে, কাতার থেকেও অর্থায়ন হতে পারে, মুখ থুবড়ে পড়া শেয়ারবাজার থেকে হতে পারে, নাকি ইনস্যুরেন্স সমিতির দাবি মোতাবেক প্রিমিয়াম তহবিল থেকে অর্থায়ন হবে, তা নিয়ে বালখিল্য পর্যায়ের হাস্যকর সব আলাপ-প্রলাপ চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর তার অকিঞ্চিত্কর বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি থেকে আধা বিলিয়ন ডলার সরকারকে পদ্মা সেতু অর্থায়নে দিয়ে দেবার প্রস্তাব করেছেন। বাস্তবতার নিরিখে এই বিকল্পগুলোর কোনোটাই যে কোনো প্রকার গুরুত্ব বহন করে না এবং অপরিণামদর্শী বোলচাল মাত্র, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না কারোরই। এই সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদে পদ্মা সেতু প্রকল্প যে শুরু করা যাচ্ছে না, তা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে সবার কাছে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু ছাড়াও আরও ৩৩টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ৪৬০ কোটি ডলারের অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সরকারের অপিরণামদর্শী হাঁকডাকের কারণে এখন সেইসব প্রকল্পেও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। অভিযুক্ত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বর্তমান মন্ত্রণালয় তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি প্রকল্পে এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করেছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে অবস্থা যে খুবই সঙ্গিন হয়ে পড়েছে, তা বলাই বাহুল্য। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থাও যে ক্রমাবনতিশীল, গত মাসে বাজেট নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত আলোচনা-সমালোচনা থেকেই তা স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকেই অব্যাহত নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি, লেনদেন ভারসাম্যসহ বিশাল ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাক্কলিত বৈদেশিক অনুদান ও সাহায্য না পেলে বিদ্যমান পরিস্থিতি যে আরও নাজুক হয়ে পড়বে, সে বিষয়ে কারোর কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়ন বাজেট অর্থায়ন তো দূরের কথা, ঘোষিত রাজস্ব বাজেট অর্থায়নের ক্ষেত্রেই সরকার বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। এখন প্রশ্ন হলো, পদ্মাসেতু না হয় বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ না পেলে নাই বা করা হলো, তাতেই কি সব ঝামেলা মিটে যাবে? উত্তর হলো সোজা—না, মিটবে না। পদ্মা সেতু হোক বা না হোক বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান দশায় বিদেশি সূত্র থেকে বড় কোনো অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থসংস্থান করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। রফতানি ও রেমিট্যান্স খাতে বিরাজমান দুর্দশার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি এমনিতেই রয়েছে বিপর্যস্ত অবস্থায়। সেক্ষেত্রে বড় আকারের কিছু বৈদেশিক অনুদান বা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছাড়া আমাদের ক্রমহ্রাসমান লেনদেন ভারসাম্য অনুকূলে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। পরপর তিন অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্য পরিস্থিতি কেবল খারাপ থেকে খারাপই হয়েছে। সরকারের বাজেট দলিল থেকে নেয়া তথ্যমতে, লেনদেন ভারসাম্য ২০০৯-১০ অর্থবছরে থাকা জিডিপির ৩.৭ শতাংশ থেকে ২০১০-১১ অর্থবছরে জিডিপির ০.৯ শতাংশে এবং সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত হিসেবে তা উদ্বিগ্ন হবার মতো পর্যায় ০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এমতাবস্থায় বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে সামনের দিনগুলোতে সরকারকে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যারপরনাই রকমের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হবে। পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি না থাকার কারণে দায়-দেনা মেটাতে ব্যর্থ হলে দেউলিয়াত্ব বরণ করার মতো পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতে পারে।
এরপরও কি বলা যাবে যে, টনক নড়েছে সরকারের? একের পর এক কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তির সঙ্কট ক্রমশ আরো ঘনীভূত হচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিসমূহ পূরণ না হওয়ায় এবং অন্য সব অনাচারের প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে আজ ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। গণ-অসন্তোষের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। জনমনে প্রশ্ন এখন একটাই—নৌকাডুবির প্রহর কি অত্যাসন্ন?
লেখক : সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বিএনপি
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন