বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

ঋণচুক্তি বাতিলের বেইজ্জতি

ঋণচুক্তি বাতিলের বেইজ্জতি


॥ সাদেক খান ॥

সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের শেষ দিনে বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ ঘটিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশকদের অনলাইনে ও বিবিসি রেডিও টেলিভিশনে ৩০ জুন ভোরে বহুভাষিক বিশ্বসংবাদে দুনিয়াকে জানান দেয়া হয়েছে : বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক যে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চেয়েছিল, দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে দীর্ঘ বাদানুবাদের পর শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সেই ঋণ দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সদর দফতর ওয়াশিংটন থেকে জারি করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে : এই সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের েেত্র বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় ওই ঋণচুক্তি বাতিল করা হয়েছে। সেতু নির্মাণের েেত্র বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা, কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ব্যক্তিদের মধ্যে যোগসাজশে বিভিন্ন সূত্র থেকে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের হাতে এসেছে। এসব তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দেয়া হয়েছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ও ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে এসব তথ্য-প্রমাণ দেয়া হয়। দুর্নীতির এই অভিযোগ পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক ভেবেছিল বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে। বাস্তবে সেটি হয়নি। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির যে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে সে সম্পর্কে কিছু পদপে নেয়ার দাবি করেছিল। বিশ্বব্যাংকের দাবি ছিল যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সরিয়ে দেয়া এবং অভিযোগ তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্তদল নিয়োগ করা। বিশ্বব্যাংকের এই অবস্থান ব্যাখ্যা করা ও বাংলাদেশ সরকারের জবাব জানার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের দল ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া বা জবাব সন্তোষজনক ছিল না। তাই বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে ঋণচুক্তিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক একটি প্রকল্পে তখনই অর্থায়ন করতে পারে যখন তারা সেই প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও কার্যক্রমের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। কারণ বিশ্বব্যাংকের তহবিলে দাতা দেশগুলোর কাছে বিশ্বব্যাংক নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ।
এই বজ্রাঘাত যে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো হঠাৎ করে আসেনি, বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে সে কথাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। মেঘ জমছিল অনেক দিন ধরে। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের ওই বিজ্ঞপ্তির মাত্র দিন দশেক আগে বাংলাদেশেরই পত্রপত্রিকায় খবর ছিল : পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৭০ লাখ ডলার। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কাছে ১০ শতাংশ অর্থ কমিশন চেয়েছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ তিনজন। অর্থের অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া এসএনসি-লাভালিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে দুহাইমের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে কানাডার পুলিশ। আর বিশ্বব্যাংকের তরফে এই তথ্য পাঠানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক)। এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়ে নতুন করে আবার তদন্ত শুরু করে দুদক। এর আগে বিশ্বব্যাংক সরকারের কাছে বারবার চিঠি দিয়ে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করার আহ্বান জানায়। সরকার নতুন কোনো কমিটি গঠন না করে দুদককে নতুন করে তদন্ত করার অনুমতি দেয়। 
১৪ জুন দুদক কাউকে কাউকে নামমাত্র জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বিশ্বব্যাংকের তরফে অভিযোগ পাঠানোর প্রথম দফায় গত ফেব্রুয়ারিতে দুদক স্রেফ সাফাই গেয়েছিল, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর আরো কিছু তথ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংকের প থেকে একটি প্রতিবেদন দেয়া হয় সরকারকে। দুদক সূত্রেই সংবাদপত্রে খবর আসে যে ‘এসএনসি-লাভালিনের কাছে ঘুষ চাওয়ার প্রমাণ পেয়েছে কানাডীয় তদন্তদল।’
ওই খবরে উচ্চপদস্থ মন্ত্রী ও কর্মকর্তা যাদের নামোল্লেখ প্রতিবেদক করেছিলেন, তাদের কয়েকজন বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। দুদকও ২১ জুন সুর পাল্টে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে : বিভিন্ন সংবাদপত্রে কোনো কোনো প্রতিবেদনে দুদকের বরাত দিয়ে অনেক েেত্র খণ্ডিত আকারে সংবাদ প্রকাশের কারণে আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও প্রচারিত হয়েছে। এতে বিভ্রান্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি দাতা সংস্থার অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক অর্থছাড় স্থগিত রেখেছে। পরামর্শক নির্বাচনের েেত্র দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত কিছু তথ্য বিশ্বব্যাংক দুদককে দিয়েছে। এতে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে। পরামর্শক সংস্থার কাছ থেকে তারা ঘুষ দাবি করেছেনÑ প্রাপ্ত তথ্য থেকে এই উপসংহারে আসা সঠিক হবে না, আইন ও বিধিসম্মতও হবে না। অধিকন্তু এ পর্যায়ে নাম প্রকাশ করা হলে তাদের প্রতি সুবিচার হবে না।
যেখানে দুদকসহ বাংলাদেশের যেকোনো তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা মওকা পেলেই তদন্তের সম্ভাব্য সূত্রের দোহাই দিয়ে ঢালাওভাবে সন্দেহভাজন বলে অনুমাননির্ভর তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে নানা চাঞ্চল্যকর খবর ফাঁস করে আত্মপ্রচারের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন, চমক দিতে নিরীহ ব্যক্তিদের চরিত্রহননেও পিছপা হন না, সেখানে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশে এই লুকোচুরি রাখঢাক কেন? যেখানে গুরুতর অপরাধী সন্দেহে তদন্তাধীন ব্যক্তিদের দ্বারা তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে, অপরাধের সাীরা বিগড়ে যেতে পারে এই অজুহাতে তদন্তাধীনদের শুধু সরকারি দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি নয়, জেলহাজতেও দীর্ঘ দিন বিচারের অপোয় আটক রাখতে বর্তমান সরকার উৎসাহের আতিশয্য দেখাচ্ছে, সে েেত্র পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তাধীন ব্যক্তিদের শুধু নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি নয়, সরকারি উচ্চপদেও বহাল রাখা হয়েছে কোন বিবেচনায়? এই সরকার কি তাহলে দুর্নীতিকে গুরুতর অপরাধ বলে মনে করে না?
দুদকের ওই মৃদু সাফাইয়ের ওপর একধাপ মাত্রা যোগ করে চড়া গলায় ২৩ জুন খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বললেন : পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে আমি কোনো বক্তব্য রাখতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে পারি, অপ্রমাণিত বিষয় নিয়ে কথা উঠছে। আমি একসময় বিচারিক হাকিমের দায়িত্ব পালন করেছি। তাই জানি যে প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী বলা যায় না। প্রমাণ ছাড়া কারো নাম প্রকাশ করা নির্বুদ্ধিতা। দুর্নীতি দমন কমিশনের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারি না। কিছু এলে ওখানেই পাঠিয়ে দিই। তবে আমি এ কথা বলব যে, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন নিয়ে একটি অভিযোগও আসেনি। ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) চুক্তিই অনুমোদন করে রেখেছে। কিন্তু কাজ বন্ধ। যেহেতু সবার একসাথে কাজ করার কথা।
‘শেয়ারবাজার নিয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কমিটির প্রতিবেদনেও কিছু নাম এসেছিল। কিন্তু সাী নেই। একই জিনিস হয়েছে পদ্মার বেলায়। কিছু নাম এসেছে। প্রমাণের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু সেই প্রমাণ আমার কাছে নাথিং (কিছুই না)।’ এখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর এই ঋণচুক্তি বাতিলের পর সহ-অর্থায়নকারী জাপান, এডিবি ও আইডিবিও তাদের ঋণচুক্তি বাতিল কিংবা স্থগিত করেছে। খুব সহজে এক বাক্যে ‘নাথিং’ বলার পদ্মা সেতুর জন্য কোনো সহায়তা নয়, এই জবাব পেলেন অর্থমন্ত্রী। অবশ্য চড়া সুদে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বাণিজ্যিক ঋণের বোঝা চাপিয়ে মালয়েশিয়ার মাধ্যমে ‘অপ্রদর্শিত’ বা গোপন সূত্রের অর্থ নিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প এই অর্থবছরেই শুরু করার যে অনড় সঙ্কল্প সরকার ঘোষণা করেছে, সেটা অর্থমন্ত্রী ঘোষিত বাজেটের কালোটাকাপ্রীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কোনো সহায়তা নয়, তবে বাজেটের মতোই কতটা বাস্তবায়নযোগ্য বা তার বোঝা কত ভারী হবে, তা নিয়ে ওয়াকিবহাল মহল একাধারে সন্দিহান ও উদ্বিগ্ন। 
বিশ্বব্যাংক এখন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩৪টি উন্নয়ন প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্র“ত সাহায্যের পরিমাণ ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলারÑ যা বাংলাদেশের গত বছরে পাওয়া মোট বৈদেশিক সাহায্যের এক-চতুর্থাংশের মতো। বিশ্বব্যাংক আগামী বছরগুলোতে প্রতি বছর ১০০ কোটি মার্কিন ডলার করে সহায়তা বাড়ানোর কথা বলেছিল। সেটা নিয়েও এখন একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের আশঙ্কা, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহারের কারণে দাতাদের সাথে সরকারের স্নায়ুচাপ কিছুটা হলেও বাড়বে। অন্য যেসব প্রতিশ্র“তি থাকে বা আছে তার ছাড়ও বিলম্বিত হবে। ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আরো শ্লথ গতি দেখা দেবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ব্যাপারে মন্তব্য করার েেত্র সরকারের অবশ্যই সংযত হওয়া উচিত। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, আমাদের এমনিতেই প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতা আছেÑ যার কারণে আমরা দাতাদের অনেক টাকাই ব্যবহার করতে পারি না। তার ওপর এ ধরনের সুনাম ুণœ হলে অন্য দাতারাও অনেক কঠিনভাবে মনিটরিং করবে। তাদের মনেও সন্দেহের সৃষ্টি হবে বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের কারণে। বিশ্বব্যাংক যেসব প্রস্তাব দিয়েছিল সরকারের উচিত ছিল তা গুরুত্বের সাথে নেয়া। 
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব হোসেনের মতে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয়াটা আমাদের জন্য ভালো হলো না। প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে আমরা প্রতিশ্র“ত অর্থের ব্যবহার করতে পারি না। আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে অবশ্যই বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন মতা বাড়াতে হবে। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে এলো, এতে করে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমর্যাদা খুবই তিগ্রস্ত হলো।
অথচ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে এমন প্রহসনের খলনায়ক সেজে বাংলাদেশের তামাশাপ্রিয় অর্থমন্ত্রী এখনো তামাশা করেই চলেছেন। সারা জুন মাস ধরে বাজেটের নামে একটা মনগড়া বেহিসেবি সরকারি রাজস্ব আদায় আর ঋণসন্ধানের অনিশ্চিত অঙ্কের বিপরীতে ব্যাংক বৃদ্ধির আকাশকুসুম রচনা করে তিনি জাতীয় সংসদকে বিভ্রান্তির ঘোরে মগ্ন রেখেছেন। আর মাশুল গুনতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। বাজেট প্রস্তাব পেশের দিন যে দ্রব্যমূল্য আবার বাড়তে শুরু করেছে, সেই বাড় আর থামার লণ নেই। বাজেট আলোচনা করতে গিয়ে শেয়ারবাজারে দরপতনের কোনো প্রভাব অর্থনীতিতে বর্তায় না বলে তিনি যে ফতোয়া দিলেন, তার ফলে সারা মাস ধরে শেয়ারবাজারের অধঃপতন আর থামল না। এরপর আধমরা শেয়ারবাজারকে ঘা মেরে বাঁচাতে ওষুধ আসছে বলে তিনি ধৈর্য ধরার উপদেশ দিলেন।
এখন পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের পর তিনি ক’দিন ধরে সকালে এক কথা বিকেলে এক কথা আজ এক রায় কাল আরেক রায় দিয়ে চলেছেন, যার মূল কথা তার কিংবা বাংলাদেশ সরকারের কোনো দোষ নেই। সব দোষ বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রধান কর্মকর্তা জোয়েলিক সাহেবের। প্রথমেই তিনি বললেন, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি ‘সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য’। বিশ্বব্যাংকের কায়দাকানুন রীতিনীতি বা ভেতরের খবর তার নখদর্পণে এমন একটা ভঙ্গি নিয়ে তিনি বললেন, ‘(বিশ্বব্যাংকের) বিবৃতিতে যে ভাষা এবং ভাব ব্যক্ত করা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক সে রকম বিবৃতি তাদের কোনো সদস্যদেশ সম্পর্কে দিতে পারে কি না, সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার মনে হয়, এটি বিশ্বব্যাংকের মন্তব্য নয়। এটি বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী সভাপতি রবার্ট জোয়েলিকের ব্যক্তিগত মন্তব্য।’ পরদিন কিছুটা স্বর খাটো করে ‘পদ্মা সেতু বিষয়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশে সরকারের বক্তব্য’ পেশ করতে গিয়ে তিনি বললেন : বিশ্বব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা করে যে, তারা পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশের সাথে যে ঋণচুক্তি দস্তখত করেছিল, সেটি বাতিল করা হয়েছে। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে একটি অভিযোগ করা হয়েছে, একটি দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে বাংলাদেশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এতে বিশ্বব্যাংক দাবি করেছে, তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি চেয়েও তারা পায়নি।
“শনিবার আমি এক সংপ্তি বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রদানের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছি এবং সে জন্য তাদের বিজ্ঞপ্তিটি অগ্রহণযোগ্য মনে করেছি। আমি আরো বলেছি, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা তুলে ধরেছে এবং সে সম্বন্ধে আমরা কোনো পদপে নিইনি’Ñ এ কথাটিও সঠিক নয়।” তারপর পদ্মা সেতু নিয়ে অর্থায়ন বিশ্বব্যাংক বিগত বিএনপি সরকারের দুর্নীতির কারণেই বন্ধ রেখেছিল এই দাবি করে তারই প্রচেষ্টায় কী করে ঋণচুক্তি সম্পাদিত হলো সেই কৃতিত্বের বিশদ বিবরণ দিয়ে তিনি মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের কাছে বার্তা দিলেন : ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল অনাকাক্সিত ও রহস্যজনক। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি জারি করাটা অসম্মানজনক। বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আমরা তাদের পুনর্বিবেচনার জন্য অপো করব।’ পর দিন জাতীয় সংসদে বিবৃতি দিয়ে আবারো বিশ্বব্যাংকের ওপর দোষারোপ করে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন : ‘আমি জোর গলায় বলতে পারি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোথাও কোনো অপচয় বা দুর্নীতি হয়নি। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, এই অর্থবছরেই আমরা পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করব।’ 
‘বিশ্বব্যাংক অসমর্থিত বা অসম্পূর্ণ অভিযোগের ভিত্তিতে একটি দেশকে এভাবে অপবাদ দিতে পারে না বা সে দেশের জনগণের মর্যাদাহানি করতে পারে না।’ টেলিভিশনে তার ওই সংসদীয় নাটক দেখে দর্শক মন্তব্য ছিল : পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়!
অর্থমন্ত্রীর কর্তৃত্বাধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে সাংবাদিকদের বেনামি ব্রিফিং দেয়া হলো : ‘সংস্থাটির বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিককে বোঝানো না গেলেও অন্তত তাকে বোঝানো যাবেÑ এ ভাবনা মাথায় রেখে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে সরকার। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে।’
কিন্তু সেই আশারও বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে বিশ্বব্যাংকের নয়া প্রধান জিম ইয়ং কিম ৩ জুলাই সরাসরি বলে দিয়েছেন : ‘পদ্মা সেতু বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের মঙ্গলের বিষয়ে আমরা সজাগ। কিন্তু বিশ্বব্যাংক কখনো দুর্নীতি সহ্য করে না। সেটাও দেখতে হবে।’
অনলাইনে পাঠক মন্তব্য : ‘‘পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে তথ্য-উপাত্ত আর সরকার সেসব ভুল প্রমাণ করতে চালাচ্ছে চাপাবাজি আর গলাবাজি। সরকারের লোকজন তারস্বরে ‘আমরা চোর না’ বলে ঢোল পেটাচ্ছে, আর সারা দুনিয়ায় বেইজ্জত হচ্ছে বাংলাদেশ।” 
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads