রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

‘গণ’বিহীন গণতন্ত্র


বিশ্বে নানা ধরনের শাসনব্যবস্থার কথা আমরা রাজনীতি বিজ্ঞানে দেখতে পাই। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই গণতন্ত্রনামের শাসনব্যবস্থাই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে চর্চিত ও স্বীকৃত শাসনব্যবস্থা। এই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কার্যকর করার লক্ষ্য নিয়ে একটি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি-প্রক্রিয়া ও তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রমনা সচেতন মানুষ ও রাজনীতিবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রের বেশ কিছু মৌলনীতি চিহ্নিত করেছেন। গণতন্ত্রের এসব মৌলনীতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নাগরিক সাধারণের অংশগ্রহণ, বৈষম্যহীনতা, রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, নিয়মিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, মানবাধিকার নিশ্চিত করা, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, বহুদলীয় ব্যবস্থা ও আইনের শাসন। এর বাইরে রয়েছে গণতন্ত্রের সেই বহুল উচ্চারিত সংজ্ঞা অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল; যার মধ্যে নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের অনন্য মৌলনীতি। এসব মৌলনীতি বিবেচনায় আনলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোনপর্যায়ে আছে।
নাগরিকসাধারণ তথা জনগণের অংশগ্রহণের মৌলনীতিটির দাবি হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে সরকারটি গঠন হবে সেখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। আর প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে নাগরিকদেরসরকারের অংশগ্রহণের অপরিহার্যতা পূরণ হতে পারে? সব দলের অংশগ্রহণ ও সবার জন্য সমসুযোগ নিশ্চিত করেই এই অপরিহার্যতা পূরণ হতে পারে। সে ধরনের নিশ্চয়তা পেলেই জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবে। আর ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবে। এরাই হবেন প্রকৃত জনপ্রতিনিধি, যারা গঠন করবেন একটি সরকার। সে সরকার আখ্যায়িত হবে গণতান্ত্রিক সরকার নামে। আর এ সরকারের কর্মকাণ্ডে নিশ্চিতভাবেই থাকবে জনমতের প্রতিফলন। যদি প্রশ্ন করা হয় আমরা কি নাগরিক সাধারণের অংশগ্রহণের মৌলনীতিটির বাস্তবায়ন আমাদের দেশে দেখছি? এর বিতর্কহীন জবাব না। কারণ, আমরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে পেয়েছি। এই নির্বাচনের আগে এবং পরেও দেশে-বিদেশের বিভিন্ন মহল একবাক্যে বলছেÑ এ নির্বাচন ভোটারবিহীন ও প্রার্থীবিহীন একতরফা প্রহসনের নির্বাচন, তামাশার নির্বাচন। কারণ এ নির্বাচনে জনগণ তার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বঞ্চিত হয়েছে তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচনে। এ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থী পাস করেছেন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বাকি ১৪৩ আসনে নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর নেতৃত্বাধীন জোটবদ্ধ দলগুলোর প্রার্থীদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল সরাসরি এ নির্বাচন বর্জন করে। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে জোর করে নামানো এবং নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা দেয়া এবং একই সাথে এ দলকে সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে নানা হাস্যকর নাটকও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করে। তা ছাড়া বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষণার মধ্যে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির ১৪৩ আসনের নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। নির্বাচন কমিশন থেকে এ নির্বাচনে ৪০ শতাংশের মতো ভোটারের অংশগ্রহণের কথা বলা হলেও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, কোনো মতেই ভোটার টার্নআউট ২০ শতাংশের বেশি নয়। সব কিছু ছাপিয়ে জোরালো জনধারণা হচ্ছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল একতরফা এবং বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলবিহীন ও জনগণের অংশগ্রহণবিহীন তথা ভোটারবিহীন। অতএব এই নির্বাচনোত্তর সময়ে দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে এখনো বারবার তাগিদ আসছে দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা; কিন্তু নির্বাচনের পর বর্তমান সরকার বলছে, এ নির্বাচন গণতন্ত্র রক্ষার নির্বাচন। নির্বাচন গণতন্ত্র রক্ষা করেছে। এ সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে। এর আগে সংলাপ ও নির্বাচন কোনোটাই নয়। গণশব্দ বাদ দিয়ে যেমন গণতন্ত্রশব্দ লেখা যায় না, তেমনি গণেরতথা জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ীদের দিয়ে গঠিত সরকার দিয়ে আর যাই হোক গণতন্ত্রপ্রতিষ্ঠা করা যায় না। এর প্রমাণ এরই মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে সরকার দমনপীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার জোরালো প্রয়াসের মধ্য দিয়ে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এর মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের নেতাকর্মীদের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তুলেছে। মামলা-হামলার মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিকভাবে হয়রানির অভিযোগ তুলেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকেও একই ধরনের অভিযোগের সুর শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি লন্ডনের বিখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারত সরকারের লক্ষ্য অভিন্ন। সে লক্ষ্যে নিজ দেশের বিরোধী দলগুলোকে কোণঠাসা করতে যা যা প্রয়োজন, তার সবই করছেন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য যা অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। আদালত, রাজপথ ও সংসদে কোণঠাসা বিরোধী দল। তবে বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান, বর্তমান শান্ত অবস্থা হয়তো সামান্য সময়ের জন্যই বিরাজমান থাকবে।
গণতন্ত্রের আরেকটি মৌলনীতি হচ্ছে বৈষম্যহীনতা। বিশ্বের প্রতিটি উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে আমরা দেখি এমন একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের বা কোনো সংগঠনের প্রত্যেক নাগরিকেরই নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। সমসুযোগ ব্যবহার করে প্রার্থীরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের  অধিকার লাভ করে। গণতন্ত্রে নির্বাচনী খেলার মাঠ সবার জন্য সমান থাকে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সবার অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকে। সেই সূত্রে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে সমান সুযোগ ও বৈষম্যহীনতার নীতিতে; কিন্তু আমরা এমন এক অদ্ভুত নিয়ম করেছি যেখানে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এমপি-মন্ত্রী থেকে, অপরজন সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে। অতএব সমসুযোগ নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক নীতি এখানে হবে ভূলুণ্ঠিত। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে অনুপস্থিত। এর ওপর আছে দলবাজির ভিত্তিতে সাজানো প্রশাসন, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সে জন্যই বলা হচ্ছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে সমসুযোগের ভিত্তিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অন্তত এই সময়ে আমাদের দেশে সম্ভব নয়। তাই দেশের বেশির ভাগ মানুষের চাওয়া ছিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের চাওয়া-পাওয়া তথা গণতন্ত্রের মৌলনীতি উপেক্ষা করে দলীয় সরকারের অধীনেই এমন একটি নির্বাচন গত ৫ জানুয়ারি সম্পন্ন করল, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। যে কারণে দেশ-বিদেশে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
গণতন্ত্রের আরেকটি সর্বসম্মত নীতি হচ্ছে, রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা তথা পলিটিক্যাল টলারেন্স। গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে এমন একটি সমাজকেই বুঝি, যে সমাজ রাজনৈতিকভাবে সহিষ্ণু, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এর অর্থ সেখানে শাসন চলবে সংখ্যাগরিষ্ঠের, তবে সেখানে সব কিছুতেই সংখ্যালঘিষ্ঠের অধিকার সুরক্ষা পাবে নিশ্চিতভাবে। যারা ক্ষমতায় থাকবে না, তাদেরকে অবাধে সংগঠিত হওয়ার ও কথা বলার অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে, হতে পারে তাদের এই বক্তব্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যায়। ব্যক্তিপর্যায়েও প্রত্যেক নাগরিককে হতে হবে পরমতসহিষ্ণু। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস থাকতে পারে; থাকতে পারে সরকারের সাথে ভিন্নমত, ক্ষোভ। এরাও সেই ভিন্নমত ও ক্ষোভ প্রকাশের অধিকারী। এখানে কোনো পক্ষেরই অসহিষ্ণু হওয়ার সুযোগ গণতন্ত্র একেবারেই দেয় না। সরকারকে তো দেয় না অবশ্যম্ভাবীভাবেই। কিন্তু আমাদের দেশে এমন সরকার আমরা পেয়েছি, যেখানে বিরোধী দলের প্রতি সরকার চরম অসহিষ্ণু। এখানে বিরোধী দলগুলোর মতপ্রকাশ ও ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ সরকারবিরোধীদের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ। মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশের অধিকার হরণ করা হয় নানা ঠুনকো অজুহাতে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলে দেবে ওই সমাবেশে নাশকতা হবে এমন খবর তাদের কাছে আছে। অতএব এ সমাবেশের অনুমতি দেয়া যাবে না। যেখানেই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা যাবে, সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহের গন্ধ খোঁজা হবে, দায়ের করা হবে রাষ্ট্রদোহ মামলা। আসামি করা হবে বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের, সাথে কয়েক শকিংবা কয়েক হাজার অজ্ঞাতনানা আসামির কথা উল্লেখ তো থাকছেই। বহুল আলোচিত অভিযোগ সেই অজ্ঞাতনামারাই হয় পুলিশের গ্রেফতারবাণিজ্যসহ নানাধর্মী বাণিজ্যের শিকার। এই হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার নমুনা; কিন্তু এ ধরনের অসহিষ্ণুতাই আমাদের গণতন্ত্রের ভিতকে আজ নড়বড়ে করে তুলেছে।
শুনেছি গুণীজনেরা বলেন, গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হয় বৈচিত্রায়নের মাধ্যমে। গণতন্ত্র তত বেশি শক্তিশালী হবে, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ যত বেশি অবারিত হবে। এই ভিন্ন মতেই হয়তো নিহিত রয়েছে কোনো সমস্যার সত্যিকারের সমাধান। সে জন্যই হয়তো বলা হয়, শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র অচল; কিন্তু যেখানে সরকারি দলের লক্ষ্যই হয় বিরোধী দলকে অস্তিত্বহীন করা, সেখানে শক্তিশালী বিরোধী দলের কথা কী করে ভাবা যায়। যারা গণতন্ত্রের কথা বলে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে বিরোধী দলকে ধ্বংস করে দিতে চায়, তারাই কার্যত গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে। সেই সাথে নিজেদেরকেও নিয়ে যায় ধ্বংসের দিকে। কারণ গণতন্ত্রের মূলকথা হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান সর্বোত্তম অভিমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া, যে অভিমত দেশের বেশির ভাগ মানুষ ধারণ করে, তা অর্জনের জন্য প্রয়োজন পরমতসহিষ্ণু হওয়া ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। যদি দেশের সব নাগরিক মতপ্রকাশের সুযোগ পায়, সরকারপক্ষ সর্বোত্তম মতভিত্তিক সিদ্ধান্তটি নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে, তবে বিরোধীরাও সে সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়। সে জন্য গণতন্ত্রে আলোচনা-সমালোচনা ও তর্ক-বিতর্ককে ইতিবাচক বিবেচনা করা হয়। এখানেই রাজনৈতিক সহিষ্ণুতানীতির গুরুত্ব; কিন্তু বাস্তবে আমরা রাজনৈতিকভাবে এতটাই অসহিষ্ণু যে, প্রতিপক্ষের নেতানেত্রীদের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ না করলে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যই যেন পূর্ণতা পেতে চায় না। এ ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ যখন শীর্ষপর্যায়ের নেতানেত্রীদের কাছ থেকে আসে এবং তা চলে মাত্রাহীন অশ্লীলভাবে, তবে সাধারণ মানুষও তাতে লজ্জাবোধ করেন। দেশে সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এ অসহিষ্ণুতার বলয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
নিয়মিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের অনন্য এক মৌলনীতি। এই নীতি মেনে চলা অপরিহার্য। সব দলের অংশগ্রহণে নিয়মিতভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যখনই বাধাগ্রস্ত হয়, তখনই গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়। কিন্তু ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনকেই বলা হচ্ছে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন। আর এ নির্বাচন সূত্রে বর্তমান সরকারের লোকজনের চলছে রীতিমতো লম্ফঝম্ফ। বলা হচ্ছে বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনী ট্রেন ফেল করেছে, আর সরকারি দল আওয়ামী লীগ সেই ট্রেনে চড়ে বিজয়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। অতএব বিএনপির সাথে কোনো সংলাপেরও দরকার নেই, পাঁচ বছরের আগে কোনো নির্বাচন দেয়া হবে না; কিন্তু এরা একটিবারও ভেবে দেখছেন না কিংবা স্বীকার করছেন না, এ নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন নেই। এ নির্বাচনের নানা অপকৌশলের মধ্য দিয়ে যে বিরোধী দল গঠন করা হয়েছে, তা সত্যিকারের বিরোধী দল নয়। এরা গৃহপালিত বিরোধী দল যারা সরকারেও আছে, আবার বিরোধী দলেও আছে; যাদের প্রতি দেশের জনগোষ্ঠীর ুদ্রাতিুদ্র একটি অংশের মাত্র সমর্থন আছে। আর আজ সংসদে যারা ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে অটো এমপি হয়েছেন কিংবা সমঝোতার ভিত্তিতে পাতানো নির্বাচনে এমপি হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এমপি হওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। তাই এদের সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিও বলা যাবে না। আর এদের দিয়ে গঠিত সরকার কিংবা বিরোধী দলকে জনপ্রতিনিধিত্বশীল ভাবাও ভুল। এ ধরনের সরকার যত বেশি সময় ক্ষমতায় থাকবে, এ সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা যত বাড়বে; ততই বাড়বে দেশের গণতন্ত্রহীনতার মাত্রা। দেশের বিবেকবান মানুষ চায়, সরকার এ সত্য উপলব্ধি করুক, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার বিলাসিতা থেকে বেরিয়ে এসে জনতার কাতারে দাঁড়ানোর পথ বের করুক; কিন্তু সরকার সে পথে পা বাড়াবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশের কারণ বিদ্যমান। কারণ শোনা যাচ্ছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সূত্রে গঠিত সরকার নাকি গণতন্ত্রের নতুন মডেল সৃষ্টি করেছে। অতএব এই মডেল গণতন্ত্র থেকে সরকার সহজে বেরিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। কী সেই অদ্ভুত মডেল? সে মডেল হচ্ছে যত সমালোচনাই থাকুক, কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিক বা না নিক, দলীয় সরকারের অধীনে র‌্যাব-বিজিবি-সেনাবাহিনী নামিয়ে যেনতেন নির্বাচন করা হবে। তবে সে নির্বাচনে বিরোধী দল করার মতো যদি কোনো দল না পাওয়া যায়, তবে কোনো দলকে জোর করে নির্বাচনে আনা হবে; সেই দলকে সরকারেও রাখা হবে এবং প্রধান বিরোধী দল করা হবে। এর পর যারা এ সরকারের বিরোধিতা করবে তাদেরকে দমন পীড়ন করে অস্তিত্বহীন করা হবে। এই যদি হয় গণতন্ত্রের নতুন মডেল, তবে মনে হয় গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও আগামী দিনে নতুন করে লিখতে হবে। আর তখন গণশব্দ বাদ দিয়ে আমাদেরকে গণতন্ত্রশব্দ লেখার প্রক্রিয়াও হয়তো তখন উদ্ভাবন করতে হবে। সে দিন গণতন্ত্রের মৌলনীতিই বা কী হবে তা ভেবে আজকের রাজনীতিবিজ্ঞানীদের কাছে হতবাক হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads