শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

প্রহসনের নির্বাচন, সংসদ, সংসদের প্রথম অধিবেশন ইত্যাদি


আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হরিণ মার্কার মিজানুল হক বলেন, ১৯৮৬-এর মতো এবার ভোট ডাকাতি হয়েছে। আমার পোলিং এজেন্ট মৃত্যুভয়ে কেন্দ্রে যায়নি।’ শুধু তার কেন্দ্রে নয়, করিমগঞ্জের ৭৮টি এবং তাড়াইলের ৪২টি কেন্দ্রে মুজিবুল হকের লোকজন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা-কর্মীদের নিয়ে ভোট ডাকাতি করেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মুজিবুল হক দৈনিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাড়ির কেন্দ্রে প্রতি নির্বাচনে ভোটাররা উৎসাহ নিয়ে সকালবেলায় ভোট দিয়ে কাজে চলে যায়। এবারের নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিগত ’৯১ ও ৯৬-এ আমি পরাজিত হলেও এ দুটি কেন্দ্রে ৮০ ভাগ ভোট আমিই পেয়েছি।’ (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ৬ জানুয়ারী ২০১৪)
 ১৯৯১ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল ৫ জানুয়ারি থেকে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত দুই যুগের মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ছাড়াই একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সরকারি আর বিরোধী দল মিলেমিশে একাকার এই সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী ১৪৬ জন এমপি হয়েছেন কম ভোটের  রেকর্ড গড়ে।
২০১৩ সালের স্থানীয় নির্বাচনসমূহ ও দেশি-বিদেশি সব জরিপ অনুযায়ী দশম নির্বাচনে বিরাট ব্যবধানে বিজয়ী হওয়ার কথা ছিল বিএনপির। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিএনপির অনুপস্থিতির মধ্যেও সরকার, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন যে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা রেখেছে, তাতে নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে বিএনপির আশঙ্কা প্রমাণিত হয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতাও তাতে ফুটে উঠেছে।
ভোট বর্জন করা বিরোধী জোট শুরু হওয়া সংসদকে আখ্যায়িত করেছে সাংবিধানিক গোঁজামিলের সংসদ হিসেবে। ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দশম সংসদ অধিবেশনকে ‘সাংবিধানিক গোঁজামিলে’র সংসদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়ে গেল তাতে ১৫৩ জন কুশীলব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭ আসনের এমপিরা মাত্র ৫ শতাংশ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। গণতন্ত্রকে হত্যা করে, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে যে সংসদ গঠিত হয়েছে তার কোন কর্তৃত্ব নেই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মাত্র যে ৫ ভাগ ভোটে নির্বাচিত হয়েছে তাতে শুধু আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যায়। এতে কোন কর্তৃত্ব নেই। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। মির্জা আলমগীর বলেন, আবারও প্রমাণ হয়েছে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাদেরকে আজ অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচনা করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, সম্প্রতি সারাদেশে যে পরিমাণ ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এখন যেখানে-সেখানে বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যাচ্ছে। ২৮ জানুয়ারিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পল্লবীতে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বিরোধী দলকে নির্মূল করতেই এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চালানো হচ্ছে। গুম, খুনের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মির্জা আলমগীর বলেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা আমাদের সঙ্গে  যোগাযোগ করেছে।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের সমালোচনা করে মির্জা আলমগীর বলেন, ইনু সাহেব যে ভাষায় কথা বলছেন তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। এটা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বহির্ভূত। তিনি অতীত ভুলে গেছেন। অতীতে হত্যা, সন্ত্রাস ও মানুষ খুনসহ সহিংস ঘটনার সংস্কৃতি ইনু সাহেবই শুরু করেছিলেন। এসব ঘটনার কারণে তার নাম ইতিহাসে চিরদিন লেখা থাকবে। কারণ, তিনি গণবাহিনী  তৈরি করেছিলেন এবং আজকে যাদের সঙ্গে ক্ষমতায় আছেন তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। তথ্যমন্ত্রীকে তার অতীতের কথা স্মরণ করে বিএনপি চেয়ারপারসন সম্পর্কে কথা বলার আহ্বান জানান মির্জা আলমগীর।
এই সংসদ যেভাবে সরকার গঠিত হয়েছে, তাতে বলা যায় বর্তমান সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। সংসদের প্রধান কাজ সরকারের কাছ থেকে জবাবদিহি আদায় করা। কিন্তু বিরোধী দল না থাকায় এই সংসদে জবাবদিহির কোনো সুযোগ থাকছে না, যে কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সংসদ কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর প্রতি সংসদেই সরকার কিংবা বিরোধী দলের আসনে ছিল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। একানব্বইয়ের পর ষষ্ঠ সংসদ ছাড়া প্রতিটি সংসদেই প্রতিনিধিত্ব ছিল দেশের তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল জামায়াতের। কিন্তু ৫ জানুয়ারির প্রহসনের একতরফা নির্বাচন বর্জন করায় এবার এই দুই রাজনৈতিক দল ছাড়াই কার্যত একদলীয় সংসদ যাত্রা শুরু হলো। খোদ শাসক দলেই এই সংসদের আয়ু নিয়ে রয়েছে সংশয়।
‘এটা কোনো সংসদ নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন দেশের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। অন্যদিকে এটা একটি অসুস্থ সরকার বলে আখ্যা দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। ৯ জানুয়ারি ২০১৪ বেসরকারি টেলিভিশন বাংলা ভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব মন্তব্য করেন এ দুই সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, যেভাবে নির্বাচন হবার কথা এটা সেভাবে হয়নি। নির্বাচনের নামে সিলেকশন করা হয়েছে। সংবিধানের দিকে ভালোভাবে তাকালে এটাকে সংসদ বলা যাবে না। এটা কোনো সংসদ না। এটি সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। কারণ, দেশে ৯ কোটি ১৯ লাখ ভোটারের মধ্যে এক কোটি কিংবা তার চেয়ে একটু বেশিসংখ্যক ভোটার তাদের ভোট দিতে পেরেছেন। অন্যদিকে বেশিরভাগ লোক তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads