বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সুবচন নির্বাসনে চলে যাচ্ছে


ওপরতলার মানুষদের মুখে আর সুবচন হয়তো কোনো দিন শুনতে পাবো না। এভাবে সুবচন নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে কেন? অপর দিকে সত্যনিষ্ঠ হয়ে লেখালেখির দিনও যেন ফুরিয়ে আসছে। এখন আর নিরাপদ মৃত্যুর প্রত্যাশা করা এবং কান্তিগুলো ক্ষমা করার আকুতি জানানোকে ক্ষমতাবানেরা ভালোভাবে নেন না। তারা প্রতিপক্ষকে যে ভাষায় সমালোচনা ও নিন্দাবাদ করেন, তার কিয়দংশও তারা শুনতে চান না। নিজেদেরকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখতে, নিন্দা ও অভিযোগমুক্ত থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এক দিকে অনুগত বা গৃহপালিত বিরোধী দল, অন্য দিকে দলান্ধ মিডিয়া ও উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবীদের তথাস্তুপ্রীতি। একপক্ষে অসহিষ্ণু ক্ষমতাচর্চাকারী, অন্য দিকে বসন্তের কোকিলেরা। তার ওপর চার পাশে মোসাহেব, চাটার দল, পো ধরা তোষামোদকারীদের রমরমা আসর। এমনি একটা পরিস্থিতিতে শাসকেরা প্রতিবাদী শক্তিকে আমলে নেবে, গঠনমূলক সমালোচনাকে প্রয়োজনীয় ভাববে, নিন্দাকে ভাববে পথ চলার পাথেয়, তবেই না গণনন্দিত শাসনের একটা মাত্রা লক্ষ করা যাবে। জবাবদিহিতার একটা আবহ সৃষ্টি হবে। কার্যকর ও রীতিসিদ্ধ বিরোধী দলের অভাব কিঞ্চিৎ পূরণ হবে।

আমরা যারা কোনো দলের প্রতিনিধি নই, জাতীয় অঙ্গীকার ও পেশাদারিত্বকে মর্যাদা দিয়ে পেশায় টিকে আছি। নিজেরা লিখছি, অন্যদের লেখা ছাপছি, তারা আছি এখন উভয় সঙ্কটে। প্রতিনিয়ত বিব্রত হওয়ার মতো অস্বস্তিকর কিছু প্রশ্ন তাড়া করে ফিরছে। অমুকের লেখা কেন ছাপছি। তমুকের লেখায় এত নিন্দাবাদ ও সমালোচনা কেন, ইত্যাকার প্রশ্ন প্রতিনিয়ত আমাদেরকে বিব্রত করে, একধরনের অদৃশ্য চাপও সৃষ্টি করছে। বিস্মিতও করে হররোজ। বিব্রত করে এ জন্য যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আর কাঁহাতক সম্পাদনার কলম চালাবো। সম্পাদনার কাঁচিরও তো একটা মাত্রা আছে। আরো বেশি বিস্মিত করে এ জন্য যে, মোটেও বুঝতে পারছি না আমরা কোন সভ্যতার ভেতর কোন গণতন্ত্রের ছায়াতলে বসবাস করছি। আর কত সেল্ফ সেন্সরশিপের কারণে ক্ষতবিক্ষত হবো। প্রাণ ও হাত খুলে লিখতে না পারার কষ্টটা একধরনের না দেখা রক্তক্ষরণের মতো।

এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রেক্ষাপটটা অনেক পূরনো হলেও বাড়াবাড়িটা শুরু হয়েছিল চূয়াত্তর-পঁচাত্তরের দিকে। সেই গ্রহণকালটা শেষ পর্যন্ত কেটেছিল। এর পরও খবরদারি ছিল, কিন্তু সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছিল এক-এগারোর প্রেক্ষাপটে। সত্যি কথা বলতে কী, এক-এগারোর পর অনেক জাঁদরেল কলমযোদ্ধা থমকে গিয়েছিলেন। কেউ সেজেছিলেন বোবা শয়তান। সত্যটা বলতেন না, শুনতেন না, লিখতেন না। এক-এগারোর নায়কদের স্তাবকে পরিণত হয়েছিলেন। রাজনীতি কতটা বিষাক্ত, দুই নেত্রী কত মন্দ তাই লিখে নিজেকে জাহির করতেন। প্রথম কাতারের কয়েকটি জাতীয় দৈনিক সেই সময়টাকে আশীর্বাদ হিসেবে নিয়েছিল। বলেছিল এক-এগারো তাদের অর্জন। সেই সময়টাতে রাজনীতি ও দুই নেত্রীর গোষ্ঠী উদ্ধারের জন্য কেউ কেউ নিজেদের এক রকম ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। রাজনীতি, গণতন্ত্র, সংবিধান, মানবাধিকার ও দুই নেত্রীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন মূলত হাতেগোনা কজন লেখক-কলামিস্ট। সিরাজুর রহমান, ফরহাদ মজহার, মাহমুদুর রহমান, আসাফউদ্দৌলা, নুরুল কবির, ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আসিফ নজরুলসহ আমরা কজন সাদাকে সাদা বলার চেষ্টা করেছি। ফলে বারবার অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। তখন গোয়েন্দারা প্রায় শাসাতেন। আবদারকরতেন কার কার লেখা ছাপানো যাবে, কারটা ছাপানো যাবে না। অনেক তুখোড় রাজনীতিবিদও ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিয়ে জানিয়েছেন, সময় বিবেচনা করে সংযম দেখানো ভালো। আরো পরামর্শ দিয়েছেন, এত সাহসএখন নয়। রাজনীতিবিদেরা তখন খামোশ হয়েছিলেন। বলা চলে তাদের খামোশ হয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও অ্যাডভোকেট ছানাউল্লাহ মিয়া আইনের ছত্রছায়ায় কিছু সাহসী কথা বলার চেষ্টা করতেন। তাদের সাথে যোগ দিতেন আরো কজন। তারপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টেছে। কিন্তু রাজনীতির ভাগ্য পাল্টেনি।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগ পর্যন্ত অনেক কলামিস্ট ও লেখকই তাদের লেখায় ও মন্তব্যে সত্যনিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, সংবিধান এবং প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির স্বপক্ষে সোচ্চারও থেকেছেন। অনেক লেখক নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারণ করারও চেষ্টা করেছেন। অথচ তাদের কেউ কেউ নির্বাচনের পর ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়া এবং ক্ষমতার পক্ষে কী নির্লজ্জ প্রচারণাই না শুরু করলেন! বাংলাদেশে কার্যত কলাম লেখেন হাতেগোনা কয়েকজন। সব লেখক কলামিস্ট হতে পারেন না। অথচ এখন শত শত কলামিস্ট। কলামের ভাষা তো দূরের কথা, সাধারণ গদ্যও যাদের ঠিক নেই, তারাও কলামিস্ট সেজে গেছেন। কলামিস্ট ঋজু ভাষায় লেখেন কিন্তু কখনো চরম মন্তব্য করেন না। তিনি শব্দের মারপ্যাঁচে, বাক্যের প্রাচুর্যে, উপস্থাপনার মুনশিয়ানা ও উপমার মাধ্যমে গল্প সাজিয়ে, তার বলার কথা বলে দেন। অশ্লীল শব্দ, কটুবাক্য, প্রতিহিংসার ভাষা এবং আক্রোশের স্থান কলামে নেই। কলামিস্ট শিক্ষকও নন, পরামর্শদাতাও নন। নীতিবাগীশও হতে চান না। অথচ পাঠক গঠনমূলক সমালোচনা পায়, নিটোল ভাষায় নির্দেশনাও খুঁজে পায়, নিজের সিদ্ধান্ত নিতে যুক্তি ও তথ্য উপাত্ত খুঁজে পেতেও সক্ষম হয়।

এখন এক-এগারোর সরকার নেই। মনে হয় তারই ফলোআপ চলছে। পক্ষ দুটো। দুই নেত্রী দুই পক্ষে। তাতেও হররোজ আমাদের বিব্রত করার লোকের অভাব নেই। চেয়ারে বসেই গালমন্দ কিংবা প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে প্রস্তুত থাকি। দিন কয়েক আগের কথা, একজনের জিজ্ঞাসা (পরিচয়টা গোপন থাক) বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর লেখা কেন ছাপতে হবে? সাহা পরিবারের মেয়ে মিনা ফারাহর লেখায় সভ্রমবোধনেই কেন? বিগড়ে যাওয়া গোলাম মাওলা রনির লেখা না ছাপলেই কি নয়! সিরাজুর রহমান এত বেশি নিন্দুককেন? মিনার রশীদ এত টিপ্পনি কাটেন কেন? বৃদ্ধ বয়সে এবনে গোলাম সামাদের এত দেশপ্রেমিকসাজার দরকার কী? শফিক রেহমানের জন্য আর কপৃষ্ঠা বরাদ্দ করলে আমরা খুশি হবো। সাদেক খান এত ঘুরিয়ে বলেন কেন? ফরহাদ মজহারের কি মৃত্যুভয়নেই? রেজোয়ান সিদ্দিকীর বিএনপি বন্ধনাকবে শেষ হবে? ইত্যাদি। বুঝানোর চেষ্টা করলাম- লেখকের কলমের স্বাধীনতা রক্ষা করা একটা সহনীয়পর্যায় পর্যন্ত আমাদের সম্পাদকীয় নীতি। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সংবিধানের মর্যাদা, গণতন্ত্রের মূল্যবোধ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা, দেশের স্বার্থানুকূল পররাষ্ট্রনীতির প্রতি সমীহ ভাব প্রদর্শন, বিচার ও বিচারপতির এখতিয়ারে হস্তক্ষেপ না করা, সমালোচনা করার সময়ও শব্দচয়নে পরিশীলিত থাকা, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে সাহায্য করা, এর ব্যত্যয় ঘটলে সমালোচনা করে পরামর্শ দেয়া, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মানসম্মান ও সুনামকে পরিকল্পিতভাবে বা অসৎ উদ্দেশ্যে লেখার বিষয় না বানানো, রাষ্ট্রের গোপনীয়তা যা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আপসহীন থাকা আমাদের বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও হেফাজত করার মতো বিষয়গুলো আমরা সম্পাদনার মাধ্যমে কখনো লেখক-কলামিস্টদের জানিয়ে, কখনো না জানিয়ে সংশোধন করার চেষ্টা করি। এ ব্যাপারে কাউকে কখনো সজ্ঞানে ছাড় দেয়া হয় না।

আরো বুঝাতে চেষ্টা করলাম, হাল আমলে ক্ষমতা যেমন উপভোগ্য, তেমনি জনগণের আমানত বিবেচনায় সমালোচনার তীর্যকবানে জর্জরিত হওয়ার মতো বিষয়ও। ক্ষমতা সব অর্থে আমানত, এটা নষ্ট করলে বা খেয়ানত করলে প্রকাশ করে দেয়া কর্তব্য। শপথ, প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদা শুধু রাষ্ট্রাচার নয়, জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণের অঙ্গীকার। যারা এখানে সীমা অতিক্রম করে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। সত্যনিষ্ঠ থাকা, সততা প্রদর্শন ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা ক্ষমতাবানদের জন্য অপরিহার্য এবং অবশ্য পালনীয় বিষয়। জনগণের পক্ষে মিডিয়া ও লেখক-কলামিস্টদের বাড়তি চোখ দিয়ে তা দেখতে হয়। সাহসের সাথে সেটা প্রকাশও করতে হয়। তবে স্মরণীয় যে, মায়ের গুণ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না, প্রিয়ার অবয়ব নিয়ে কাব্যও লেখা যায়। এটা যেকোনো লেখক-কলামিস্ট জানেন, মানেন। লেখায় সেই রুচির প্রতিফলনও ঘটান। সমস্যা হচ্ছে, যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, সমালোচনার তীরটা তাদের দিকে ছোড়া হয়। ভুলত্রুটি তাদেরই দেখা হয়। এটাই স্বাভাবিক। আমরা যারা দলনিরপেক্ষ হয়ে সরকারের সমালোচনা করি, তখন বিএনপির আমলে আওয়ামী হয়ে যাওয়ার অভিযোগ মাথায় নেই। আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি-জামায়াত হয়ে যাওয়ার খেতাব পাই। দেশের স্বার্থে বললে ভারতবিদ্বেষীর অভিযোগ ওঠে। সাথে যোগ হয় পাকিস্তানপ্রীতির দুর্নাম। আইনের শাসন, মানবাধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বললে পশ্চিমা দালালির অভিযোগ ওঠে। এটাই এখন আমাদের ললাটের লিখন।

লেখায় ও সম্পাদনার সময় আমরা কখনো ভুলে যাই না যে, আমরা সমাজের সুবিধাভোগী কোনো বিশেষ শ্রেণী নই। আইনের ঊর্ধ্বে আমাদের কোনো অবস্থানও নেই। হাতে অস্ত্র থাকলেই যেমন ছাত্র ক্যাডার ও দায়িত্বহীন পুলিশ প্রতিপক্ষের দিকে তাক করে, কার্যকর দায়িত্বশীলতা তা হতে দেয় না। কারণ পেশাদারিত্ব এবং নীতি-নৈতিকতা, পরিমিতি বোধ ও দায়িত্বশীলতা আমাদের প্রতিনিয়ত পাহারা দেয়। তাই সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলাই আমাদের পেশাদারিত্ব। আমাদের দায়বদ্ধতা জনগণ ও সমাজের কাছে। রাষ্ট্রের কাছে। আইনের কাছে। মানবাধিকার রক্ষার দায়বোধের সাথে সভ্যতা ও চিরায়ত মূল্যবোধের কাছেও। ধর্ম ও নিজস্ব সংস্কৃতির কাছে তো বটেই। সর্বোপরি আমাদের জনগণের প্রত্যাশার কাছেও। আমরা জানি যুক্তি ফুরিয়ে গেলে মানুষ শক্তি প্রয়োগ করে। শক্তি আড়ষ্ট হয়ে গেলে অরুচিকর শব্দ উগড়ে দিয়ে প্রতিপক্ষকে গালমন্দ করে। এটা একধরনের বিকার। এতে সুবচন নির্বাসনে যায়। সুকৃতির বিলুপ্তি ঘটে। অসহিষ্ণুতা বাড়ে। দূরত্ব আরো বেড়ে যায়।

ক্ষমতার অহম, শক্তি ও চৌহদ্দি আমাদের জানা। তার পরও মানুষের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানুষ ইচ্ছা করলেই আকাশ ফুড়ে ঊর্ধ্বে চলে যেতে পারে না। মাটি ভেদ করে পাতালেও আশ্রয় নিতে পারে না। মৃত্যুকে জয় করা কোনো দুর্বিনীত শাসকেরও সাধ্য নেই। কোনো মানুষ এতটা অপরিহার্য নয় যে, তিনি বা সে না হলে পৃথিবী উচ্ছন্নে যাবে। তবে প্রত্যেক মানুষ যার যার অবস্থানে, যার যার জীবনকালে অপরিহার্য না হলেও গুরুত্বপূর্ণ বটে। তা ছাড়া আমরা কোনো শাসককে দেবতা কিংবা শয়তানও ভাবি না, ফেরেশতাও মনে করি না। আমাদের দণ্ডমুণ্ডের মালিক মোকতারও ভাবি না। শাসকদের নেকড়ের মতো হিংস্র, শিয়ালের মতো ধূর্ত কিংবা ধর্মাবতার ভেবে আমরা কাপুরুষ সেজে বসে থাকতে পারি না। আমরা সত্যের শক্তি, মিথ্যার ভঙ্গুরতা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। ক্ষমতার কালো হাত সম্পর্কেও জ্ঞাত। তার পরও আমরা প্রতিনিয়ত বিশ্বাসের পাথারে সাঁতার কাটি। তথ্যের সাম্রাজ্যে বিচরণ করি। কিন্তু নিজের সক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা ও অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জমুক্ত ও একচ্ছত্র ভাবি না। ভাবি বিনয় ও বিনম্রতা সত্যের মতোই শক্তিমান ও অক্ষয়। পেশাদারিত্ব তার চেয়ে গৌণ কিছু নয়।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads