শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

রায় অমান্য করেছে কারা, সরকার না বিরোধী দল?


সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত ফুলবেঞ্চ ১০-৫-২০১১ তারিখে ৪-৩ বিভক্ত সংক্ষিপ্ত রায় দিয়েছিলেন। এটি অবশ্যপালনীয় বিবেচনায় সরকারি দল পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৬ মাস আগে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার ৫০ দিন পরে এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের ৩০ মাস আগেই গত ৩০-৬-২০১১ তারিখে বাজেট পাসের আড়ালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের ব্যবস্থা করে। এর মাধ্যমে বিএনপি সরকার কর্তৃক ২৫ মার্চ ১৯৯৬ সালে পাসকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে বর্তমান সঙ্কটের জন্ম দেয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত সেই সংক্ষিপ্ত রায়ে কী ছিল তা দেখা যাক।
রায়টি দুটি অনুচ্ছেদে বর্ণিত ছিল। প্রথম অনুচ্ছেদ : সাতজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুলবেঞ্চের চারজন বিচারপতি (সবাই আওয়ামী লীগ শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত) তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক নীতির সাথে সাংঘর্ষিক বলে ঘোষণা করেন। অপর তিনজন বিচারপতি (বিএনপি আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত) তা বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ : সাতজন বিচারপতি একমত যে, দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় এবং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হানাহানি ও সংঘর্ষ পরিহারের জন্য পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে যদি সংসদ সমীচীন মনে করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে না করে বিকল্প সম্মানিত যোগ্য কোনো ব্যক্তিকে করার ভারও সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
সচেতন ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, সেই রায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটি পরবর্তী দুটি নির্বাচন সংক্রান্ত হওয়ায় প্রথমে পালনীয়। তা সত্ত্বেও দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা না করে এবং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হানাহানি ও সংঘর্ষ পরিহারের ব্যবস্থা না করে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করার  লক্ষ্যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়। অথচ ওই সংশোধনী পাস করেছেন যারা, সেই ২৯২ জন এমপির মধ্যে পঞ্চম সংসদের ১৪৭ জন এমপি সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্তির দাবিতে ১৯৯৪ সালে সংসদে বিল পাস করতে ব্যর্থ হয়ে সংসদ থেকে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেছিলেন। তাদের পদত্যাগপত্র স্পিকার গ্রহণ না করায় তারা হাইকোর্টে রিট করে তা গ্রহণ করতে স্পিকারকে বাধ্য করেছিলেন। ফলে ১৯৯৫ সালে দেশের সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়। ১৯৯৪-৯৬ সালে এই দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল হয়েছে। ১৯৯৬ সালে মার্চ মাসজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলে। সর্বশেষ বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (তখন তিনি সচিব ছিলেন) নেতৃত্বে সরকারি কর্মচারীদের বিদ্রোহঘোষণা ও প্রেস কাবের সামনে জনতার মঞ্চস্থাপন করে দেশের প্রশাসন অচল করে দেয়া হয়। ফলে বিএনপি সরকার ২৫-৩-১৯৯৬ তারিখে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে পদত্যাগ করে। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সাহস দেখাতে ব্যর্থ হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৪ সালে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে এখনকার মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যসহ আওয়ামী লীগ, ও অন্যান্য দলের ১৪৭ জন এমপি ছিলেন। আবার ২০১১ সালে বাতিলের জন্য তারাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করে এবং  ভোট দিয়ে প্রস্তাব পাস করেছেন। জনগণ তাদের এই নীতিবিরুদ্ধ আচরণ মেনে নিতে পারেনি, যার প্রমাণ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের শোচনীয় পরাজয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের দাবিতে ১৯৯৬ সালে রিট করেছিলেন কে? আওয়ামী সমর্থক আইনজীবী সলিমুল্লাহ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার জন্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। ২০০৪ সালে রিটের শুনানি হলে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আবেদনটি খারিজ করে দেন। সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়েরের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আরেক আওয়ামী আইনজীবী আবেদন করে আপিলের পক্ষভুক্ত হলে ২০০৯ সালে তাকে হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয় বর্তমান সরকার। তারপর আরেক আওয়ামী আইনজীবী রিট আপিলে পক্ষভুক্ত হয়ে আপিলটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ মামলার আপিল পর্যায়ে তিনবার বাদি পরিবর্তনের অনুমতি পাওয়ার আর কোনো নজির আমাদের জানা নেই।
সুপ্রিম কোর্ট পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার ভার জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য, সর্বোচ্চ আদালত যে মহান দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ তার  অবমাননা করে নিজেদের নির্বাচনে জয় লাভের ব্যবস্থাই করেছেন। জনগণ বিবেচনা করে দেখুন, সর্বোচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে চলেছে কারা, এখনকার সরকারি দল না বিরোধী দল?
জনগণ আরো অবাক হয়েছে এটা দেখে যে, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার ১৭ মাস পরে সেপ্টেম্বর ২০১২-তে প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে এজলাসে ঘোষিত তার সংক্ষিপ্ত রায়কে পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী পরিবর্তন করে নির্বাচনকালে নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এটা তার শপথ ভঙ্গের শামিল বলে প্রখ্যাত আইনজীবীরা মনে করেন। এজলাসে প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত রায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অমান্য করে প্রথম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৬ মাস আগেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়েছে। সেহেতু পরে ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ের অজুহাত প্রদর্শনের সুযোগ নেই। সংক্ষিপ্ত রায় হয়েছে ১০-৫-২০১১ তারিখে, সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে ৩০-৬-২০১১ তারিখে এবং পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সংসদ সদস্যরা বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় শপথ নেন সংবিধান সংরক্ষণ ও সমুন্নত রাখার। অথচ তারাই তা সংশোধনের দাবিতে পদত্যাগ করেছিলেন। আবার সংবিধানের যে বিধান নিজেদের স্বার্থের প্রতিকূলে মনে করেন, সেই বিধান বাতিল করতেও দেরি করেননি। জনগণের কল্যাণের কথা তখন মনে ছিল না।
আশা করি, ১৭৩ দিন হরতাল, ৩০ দিন অবরোধ এবং সংসদ থেকে পদত্যাগের ফসল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আরো দুটি নির্বাচন পর্যন্ত বহাল রেখে জনগণকে শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে ২০০৬ সালে গোঁয়ার্তুমির ফল যেমন ২০০৮ সালে বিএনপি পেয়েছে, একই ধরনের ফলাফলের সম্মুখীন আওয়ামী লীগও হতে পারে।

আবদুর রহমান


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads