বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

‘ক্রসফায়ার’ ও সরকার


সম্প্রতি ক্রসফায়ারশব্দটি বহুল ব্যবহৃত। এ শব্দ সাধারণত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বর্তমানে শব্দটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রচলিত হচ্ছে বলে জনমনে বিশ্বাস দৃঢ়তর হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারশব্দটি প্রয়োগ করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, বেশির ভাগকেই গ্রেফতারের পর হত্যা করা হয়েছে। আর কিছু নিহত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকালে। এসব হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিতে ক্রসফায়ারগল্পের অবতারণা করা হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল উল্লেখ করেছে। তাদের মতে, প্রথমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে আটক করে। পরে অস্ত্র অনুসন্ধানের অজুহাতে গভীর রাতে তাদের নিয়ে যায় নির্জন এলাকায়। সেখানেই কথিত ক্রসফায়ারঘটনা ঘটে। বিস্ময়ের ব্যাপার, এতে শুধু আটক ব্যক্তিই নিহত হন আর সবাই অক্ষত থাকেন। তবে প্রচারণায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দু-একজন সদস্য আহত হওয়ার কথা উল্লেখ থাকে। বিস্ময়ের ব্যাপার, তাদের দাবি মতে, সব ক্ষেত্রে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছলে আটক ব্যক্তির সহযোগী সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর আক্রমণ করে। এতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে তাদেরই পক্ষভুক্ত আটক ব্যক্তি নিহত হয়ে থাকেন! তবে এ দাবি যে হাস্যকর ও অবাস্তব তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ প্রশিক্ষিত দক্ষ আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদের হেফাজতে আটক ব্যক্তিকে কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা গ্রুপের পক্ষে হত্যা করা যে সহজ নয়, তা লোকজন সহজেই উপলব্ধি করে। সম্প্রতি পত্রপত্রিকার খবরে জানানো হয়েছে, কোনো কোনো সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সরকারি দলের লোকজনও ছিল। এ ছাড়া স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন জাগে, সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কি চুপ করে বসে থাকে? যারা সরকারবিরোধী মিছিল-সমাবেশে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করতে পারে, তারা আক্রমণকারী সন্ত্রাসীদের হত্যা করতে পারে না কেন? কথিত ক্রসফায়ারসংঘটনস্থল থেকে কোনো সন্ত্রাসীকে তারা আটক করতে পারে না কেন? অধিকন্তু নিজেদের হেফাজতে থাকা আটক ব্যক্তি প্রতিটি ক্ষেত্রে নিহত হন কিভাবে? এ রকম আরো অনেক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, যার কোনো জবাব মেলেনি। 

প্রচলিত আইনানুসারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি পুলিশের হেফাজতে থাকবেন এবং গ্রেফতারের অনূর্ধ্ব ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে নিকটস্থ আদালতে হাজির করতে হবে। পরে আদালতের অনুমতিক্রমে প্রয়োজনে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। অথচ কথিত ক্রসফায়ারঘটনায় দেখা যায়, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কয়েক দিন অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়ে থাকে। তার পর আদালতে হাজির না করেই কিংবা বিচারের সুযোগ না দিয়েই তার মৃত্যুর পথ সুগম করা হয়। অধিকন্তু ক্রসফায়ারের অজুহাতে হত্যার দায় নিহত ব্যক্তির স্বজন-সহকর্মীদের ওপর পড়ে! এ অবস্থায় দেশের মানুষ উৎকণ্ঠিত ও সন্ত্রস্ত। 

প্রকৃতপক্ষে ক্রসফায়ারবিচারবহির্ভূত পরিকল্পিত হত্যা। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ভাষায় হুবহু একই ছকে বিবরণ দিচ্ছে, তা জনগণ বিশ্বাস করতে পারছে না। সরকার এসব হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ক্রসফায়ারে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সরকার অনুগত মানবাধিকার কমিশন এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর আমাদের দেশের দলীয় বুদ্ধিজীবীরা এ বিষয়ে মুখ খোলেন না। তারা সত্য কথা বলে বিরাগভাজন হতে চান না। ক্ষমতার আশীর্বাদ লাভের সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চান না। এসব কারণে তারা গণতান্ত্রিক অধিকার হরতালের বিরোধিতা করলেও ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে পারেন না। কথিত ক্রসফায়ারে নিহত নেতাকর্মীদের আত্মীয়স্বজনের বুকফাটা কান্না ও করুণ আহাজারিতে বাতাস ভারী হলেও তাদের কানে পৌঁছে না। ৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ক্রসফায়ারের হত্যাকাণ্ড অস্বীকার করেছেন। তিনি বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসীও ক্রসফায়ারে নিহত হয়নি বলে দাবি করেছেন! তবে আওয়ামী লীগের একান্ত সমর্থক প্রবাসী লেখিকা মাসুদা ভাট্টি সরকার নির্দেশিত কথিত ক্রসফায়ারঘটনার তীব্র সমালোচনা করে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে লিখেছেন, ‘...অবিলম্বে এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে এবং আইনের শাসনকে তার নিজস্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। বিক্ষুব্ধ দেশবাসীও এ দাবি ও প্রত্যাশা করে।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads