সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও ‘সংখ্যালঘু’


সংখ্যালঘুইস্যুটি নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বর্তমান শাসক দল ও তার অঙ্গসংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট কিছু মহল দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি করার সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল, যা এখনো বিদ্যমান। বর্তমান সরকার দশম সংসদে ১৫৩ আসন ফাও পেয়ে, অর্থাৎ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে জয়ী হয়ে বাকি ১৪৭ আসনে ভোটারবিহীন নির্বাচনে নিজ দলের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, দেশ-বিদেশের সভ্য সমাজ তাকে লজ্জাজনক বলে অভিহিত করেছে।
পত্রিকায় উঠেছে সংখ্যালঘুর জন্য যারা আজ মায়াকান্না করছেন, সংখ্যালঘুরাও বহু ভোটকেন্দ্রে তাদের ডাকে ভোট দিতে যাননি। তারা বলেছেন, ‘আমরা ভোট দিলে বা না দিলে কী আসে-যায়, নির্বাচন হচ্ছে প্রধান বিরোধী দলবিহীন। জয়-পরাজয় আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে।সরকার এ মর্মে নাটক সাজিয়েছেÑ ‘সংখ্যালঘুদের ভোট দিতে দেয়নি জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ক্যাডাররা।৫ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারির পত্রিকায় এসেছে, সরকারদলীয় কিছু এলাকাভিত্তিক অস্ত্রধারী হুমকি-ধমকি দিয়েছে ভোট দিতে না যাওয়ার কারণে। নির্বাচন একতরফা হওয়ায় সংখ্যালঘুরাও ভোটদানে বিরত থাকেন। ৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস কাবে আলোচনা সভায় বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ৩০০ আসনের ১৫৩ আসনে বিয়ে ছাড়া সন্তান জন্ম দেয়ার মতো; আর বাকি ১৪৭ আসনে হয়েছে অ্যাবরশন, যা ভূমিষ্ঠ হতে পারেনি। তার মতে, সংখ্যালঘুরাও যদি ভোটকেন্দ্রে যেতেন তাহলে শেখ হাসিনার লজ্জা নিবারণ হতো; কিন্তু তারা ভোটকেন্দ্রে যাননি বলেই তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। আর বিগত তিন মাস (নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে) সহিংস কর্মকাণ্ড হয়েছে। এতে শুধু সংখ্যালঘু নয়, বহু মুসলমানও বাড়িতে থাকতে পারেননি। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নিহত ও আহতের সংখ্যা বিবেচনায় মুসলমানদের সংখ্যা অনেক বেশি। মুসলিম সম্প্রদায়ের নিহতের সংখ্যা ছয় শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। আহত কয়েক হাজার। মামলা হয়েছে ৬৫ হাজার দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ৪২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কষ্টের, কলঙ্কের ও কান্নার বছর ছিল ২০১৩ সাল। কোন দলের আমলে এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটল, সেটাও কালো অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে ইতিহাসের পাতায়। কারণ সরকারের ব্যর্থতাই এ জন্য দায়ী। দায়বদ্ধতা থেকে প্রশাসন রেহাই পাবে না। ইতিহাসের ধারায় আজকের ক্ষমতাসীনদের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। পাপ বাপকেও রেহাই দেয় না। অপরাধের শাস্তি শুধু পরকালেই নয়, ইহকালেও ভোগ করতে হয়।
উপমহাদেশের ২০০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের ইন্ধনে হিন্দু-মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাধানো হতো, যাতে মানুষ মারা যায়। ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এখনো নানা উসকানিতে অব্যাহত রয়েছে। বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে গোটা ভারতে নিরীহ বহু মুসলমান নিহত হয়েছিলেন; আহতের সংখ্যাও কম নয়। মুখ্যমন্ত্রী মোদির গুজরাট রাজ্যে বহু মুসলমান নিহত হয়েছিলেন। ৮০-এর দশকে আসামের দাঙ্গায় মুসলমানদের নিহত হওয়ার বিপুল সংখ্যা বিশ্ববিবেককে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। উপমহাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রশক্তি এবং রাজনৈতিক দল ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তাদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক ট্রাম্পকার্ডটি যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ, যারা রাজনীতির সাথে মোটেও সম্পৃক্ত নন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুটি রাজনৈতিক অঙ্গনে অগ্রগণ্যতা লাভ করেছে। কেউ বলছেন, সংখ্যালঘুর বাড়িঘর দখল করার জন্য এসব করা হচ্ছে। আবার কেউ বলছেন, সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীুুুগ সমর্থক তাই তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে। তবে অনেকেই বলছেন, ওরা কেন ভোট দিতে গেল না সে জন্য সরকারদলীয় সমর্থকেরা এ কাণ্ড ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু তা রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তায় প্রধানত সরকারের ওপর। যারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বেশি বলেন, তারা কিন্তু গোড়ায় পানি না ঢেলে গাছের আগায় পানি ঢালছেন। তাদের উচিত শাসক দলকে (যখন যে দল ক্ষমতায় যায়) এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা কড়া ভাষায় কিভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে ঘটছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে রহস্য রয়েছে। পত্রিকায় উঠেছে, দুষ্কৃতকারীদের ওরা ধরছে আবার কিছুক্ষণের মধ্যে ছেড়ে দিচ্ছে। টাকার বিনিময়ে এমন কর্মকাণ্ড চলতে দেখা যায়। আবার দেখা গেছে, নিরপরাধ ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গেছে, পরে তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ক্রসফায়ারের নামে ডাইরেক্ট ফায়ারে খুন করা হয়েছে, এমন নেতাকর্মীর সংখ্যা প্রায় ৩০০। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে গুম আর খুনের এ ধরনের একটি হিসাব তুলে ধরেন। পত্রপত্রিকায়ও এমন খবর প্রতিদিন বের হচ্ছে। নিজের ভুলভ্রান্তি বা দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ক্ষণিকের জন্য তৃপ্তির ঢেঁকুর দেয়া যায়। সরকারের উচিত আত্মসমালোচনা করা। নিজ দলের ছেলেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ ফেব্রুয়ারি পিস্তল হাতে নিয়ে যেভাবে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে, সে দায় থেকে সরকার কিভাবে নিস্তার পাবে? পত্রিকায় উঠেছে, ছয় অস্ত্রধারীর পাঁচজনই ছাত্রলীগ নেতা। যত দোষ নন্দ ঘোষ এই প্রবাদ বাক্যে যদি সরকার স্থির থাকে, তাহলে ভুল করবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে হলফনামায় অনেকের শত কোটি টাকা লুটপাটের যে হিসাব নির্বাচন কমিশন থেকে ওয়েবসাইটে বেরিয়েছিল, সেটা আলাদিনের চেরাগকেও হার মানায়। নির্বাহী প্রধানের উচিত ছিল নিজ দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আত্মশুদ্ধি না করে অপরের সমালোচনা করা যায় না। বিরোধী দলের সমালোচনা করার আগে নিজের দলের সমালোচনা করুন। গণতন্ত্রের শিক্ষাও এটি। মহানবী সা: নিজে মিষ্টি পছন্দ করতেন, তাই অন্যকে প্রথমে না খাওয়ার উপদেশ দেননি। যখন নিজে এ অভ্যাস থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত হলেন তখনই তা পরিত্যাগের উপদেশ দিলেন। রাজনীতিকদের জন্য এটি একটি চমৎকার উদাহরণ। শাসক দলের লোকজন চুরি করবে আর মামলা থেকেও তারা অব্যাহতি পাবে, অন্য দিকে একই দোষে শুধু বিরোধী দলকে হাজতে ঢুকাবে এটা ন্যায়নীতি বিরোধী। সন্ত্রাস ও সংখ্যালঘু পীড়ন বন্ধ করতে, জঙ্গিবাদ বন্ধ করতে গাছের গোড়ায় প্রথম পানি ঢালতে হবে, অর্থাৎ সরকারি দলকেই প্রথমে প্রশ্নবিদ্ধ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতি চলছে। বাংলাদেশকে কখনোই সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু জাতি-গোষ্ঠীর মানদণ্ডে বিচার করা উচিত নয়। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই রাষ্ট্রে যারা নাগরিকত্ব নিয়ে বাস করছেন তারা যে ধর্মের বা বর্ণের বা ভাষারই হোন না কেন, তাদের পরিচয় হলো বাংলাদেশী। সংখ্যালঘু পরিচয় দিলে একজন মানুষ স্বদেশে বাস করেও ভাবতে পারেন এ দেশ আসলে তার নয়। এ ধরনের চিন্তা থেকে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারেন। বাংলাদেশী মানুষকে বিভক্ত করার জন্য সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর প্রশ্নটি আনা হয়েছে। এটাও রাজনৈতিক কূটকৌশল। ভোটব্যাংক হিসেবে সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করার জন্য কেউ কেউ আবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার নামে হাজির হচ্ছেন। গৃহশত্রু বা ঘরের শত্রু বিভীষণ। এদের সম্পর্কে সাবধান থাকুন।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads