বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের চুক্তি প্রসঙ্গে


দেশে-বিদেশে যখন ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও একতরফা নির্বাচন নিয়ে প্রবল নিন্দা-সমালোচনার ঝড় চলছে এবং সরকার নিজেও যখন স্বীকৃতির মারাত্মক সংকটে রয়েছে, বেছে বেছে ঠিক তেমন এক সময়েই বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করার কর্তৃত্ব আদায় করেছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন (ওএনজিসি)। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গোপসাগরের ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পূর্ণ অধিকার দিয়ে ভারতের এ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পেট্রোবাংলা। চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এবং ভারতের হাই কমিশনারসহ উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সমগ্র আয়োজন আসলে আওয়ামী লীগ সরকারই করেছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ভারতীয় কোম্পানিটি ১৪ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় কূপ খনন করবে এবং ২০ বছর ধরে গ্যাস ও ২৫ বছর ধরে তেল উত্তোলন করতে ও বিক্রি করতে পারবে। বিক্রির ব্যাপারেও ওএনজিসি পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কথাটার মধ্যে সুকৌশলে ফাঁক রেখে বলা হয়েছে, পেট্রোবাংলা যদি কিনতে রাজি না হয় তাহলে ওএনজিসি অন্য যে কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে তেল-গ্যাস বিক্রি করতে পারবে। অর্থাৎ আয়োজন এমনভাবেই করা হবে, যাতে পেট্রোবাংলা ভারতীয় কোম্পানির কাছ থেকে তেল-গ্যাস না কেনে এবং এই সুযোগে কোম্পানিটি যাতে বিক্রির আড়ালে বাংলাদেশের তেল-গ্যাস ভারতে বা অন্য কোনো দেশে বিক্রি বা পাচার করতে পারে। পাচারের এই কার্যক্রমকে আইনসম্মত করার জন্যই চুক্তিতে ধারাটি যুক্ত করা হয়েছে। চুক্তির অন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, বাংলাদেশ সরকারকে কোনো রয়্যালটি না দিয়েই ওএনজিসি সম্পূর্ণ লভ্যাংশ নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবে। যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রেও তাদের কোনো শুল্ক দিতে হবে না। আমদানিকৃত সব যন্ত্রপাতিই বাংলাদেশে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ব্যবহার করা হবে নাকি ব্যবহারের নামে বিনাশুল্কে আমদানি করা অনেক যন্ত্রপাতি ভারতে পাচার হয়ে যাবেÑ এ বিষয়ে কোনো শর্ত রাখা হয়নি। চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য মাত্র ১০ শতাংশ শেয়ারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই শেয়ারের মালিকানা থাকবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বাপেক্স)-এর।
এভাবে বিভিন্ন ধারা-উপধারার মাধ্যমে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির আড়ালে প্রকৃতপক্ষে ভারতের কাছেই বাংলাদেশের তেল ও গ্যাস সম্পদের কর্তৃত্ব তুলে দিয়েছে সরকার। সে কারণে এই চুক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনেরা। তাদের অভিমতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আমরাও মনে করি, বঙ্গোপসাগরের তেল ও গ্যাস সম্পদ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন। সে সম্পদের কর্তৃত্ব ভারতের হাতে তুলে দেয়ার ফলে জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, জ্বালানির জন্য দেশকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। ভারতীয় কোম্পানিটি যেহেতু মুনাফার জন্য রফতানিসহ ব্যবসা করবে সেহেতু বাংলাদেশকে তার নিজের সম্পদই অনেক চড়া দামে তার কাছ থেকে কিনতে হবে। উল্লেখ্য, চুক্তিতে গ্যাসের ক্রয়মূল্য আগের তুলনায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি নির্ধারণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর অধিকারও থাকবে ভারতীয় কোম্পানিটির। বড় কথা হলো, তৃতীয় যে কোনো রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের কাছে যথেচ্ছ দামে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে ওএনজিসি। ফলে অবস্থা এমনও হতে পারে যখন এই দাম বাংলাদেশের নাগালের বাইরে চলে যাবে এবং জনগণের ওপর দামের বোঝা কেবল বাড়তেই থাকবে। অন্য একটি প্রসঙ্গও আলোচিত হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মহলে। সরকারের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান ও উত্তোলন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব থাকার যে যুক্তি দেখিয়ে ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে বাস্তবে সেটা একটি ঠুনকো অজুহাত মাত্র। কারণ, ভারতের ওএনজিসি যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ দেশের গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে অলস পড়ে আছে বহুদিন ধরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও বিক্রির কর্তৃত্ব ভারতের হাতেই তুলে দিয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, চুক্তিটির কারণে বাংলাদেশ বাস্তবে সবদিক থেকে তার নিজের সম্পদের ওপর অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। এর ফলে তেল ও গ্যাসের জন্য বাংলাদেশ শুধু ভারতের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়বে না, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও শিল্পায়নসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রের তলদেশে আরো অনেক প্রাকৃতিক সম্পদও রয়েছে, যেগুলো গোপনে পাচার হয়ে যাবে ভারতে, বাংলাদেশকে জানতেই দেয়া হবে না। একই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়বে জাতীয় নিরাপত্তাও। আমরা তাই জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিটি বাতিল করার দাবি জানাই। মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস এবং স্যান্টোসসহ বিদেশি অন্য কোনো কোম্পানির সঙ্গেও এ ধরনের চুক্তি করা চলবে না। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে থাকলে অবিলম্বে বাতিল করতে হব্।ে আমরা চাই, যেহেতু সমুদ্রে অনুসন্ধান চালানোর এবং তেল-গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করার মতো যথেষ্ট অর্থ অলস পড়ে আছে সেহেতু সরকারের উচিত ভারত বা অন্য কারো হাতে তুলে দেয়ার পরিবর্তে নিজেদের উদ্যোগে কাজ শুরু করা। এজন্য সময় বেশি লাগলেও জনগণ নিশ্চয়ই সানন্দেই অপেক্ষা করতে সম্মত হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads