মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

উপজেলায়ও ৫ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তি


সরকার তার যাবতীয় কর্মকা-ের মধ্যদিয়ে আবারও ৫ জানুয়ারির পথেই হাঁটতে শুরু করেছে। ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে সরকার যে প্রহসনের আয়োজন করেছিল তা দেশের ভেতরে তো বটেই সারা দুনিয়ায়ও এখন পর্যন্ত ধিকৃত হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব ও উন্নয়ন সহযোগীরা এখনও সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বারবার বলছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই সরকারকে অবিলম্বে জনগণের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন পুনরায় দিতে হবে। যাতে তার মধ্যদিয়ে নির্বাচনে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে। ঐ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের অর্ধেকের বেশি আসন সরকারদলীয় প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে জনগণ তাদের প্রতিনিধি বেছে নেয়ার কোনো সুযোগই পায়নি। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণ বর্জনও করেছে। ৫ শতাংশ ভোটারও ভোট দিতে যাননি। এমনকি ৫০টি কেন্দ্রে একটিও ভোট পড়েনি। নির্বাচনে বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণও করেনি। শেখ হাসিনার বহুকালের সহযোগী স্বৈরাচারী এরশাদ এই নির্বাচন বর্জন করেছিলেন।
নির্বাচনকে একাধিক দলের অংশগ্রহণমূলক দেখানোর জন্য তার সে বর্জন গ্রহণ করা হয়নি। তিনি নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছিলেন যে, তার দলের লাঙল প্রতীক যেন কাউকে বরাদ্দ দেয়া না হয়। বশংবদ নির্বাচন কমিশন তাতে কোনোরূপ কর্ণপাত করেনি। যেখানে যাকে খুশি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বহাল রেখেছে। আর এরশাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সরকার তাকে জোর করে চিকিৎসার নামে ‘সিএমএইচ’-এ বন্দি করে রেখেছিল। তারপর আবার কি যে হলো এরশাদ ঠিকঠিক পেছনের দরজা দিয়ে সংসদ ভবনে এসে শপথ গ্রহণ করলেন। তার দল সরকারেও আছে। বিরোধী দলেও আছে। সরকারে আছে মন্ত্রী, উপদেষ্টা হয়ে। আর বিরোধী দলে আছে বিরোধীদলীয় আসন অলঙ্কৃত করে।
এরকম একটা জগাখিচুড়ির সরকার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক্ষেত্রে দারুণ দেখিয়েছে সরকারের বশংবদ নির্বাচন কমিশন। সরকার যা যা বলেছে, এই নির্বাচন কমিশন ঠিক তাই তাই করেছে। তা নিয়ে বগলও বেশ বাজিয়েছে। আর নির্বাচনে এত কম ভোট পড়ায় সেটিকে বেশি দেখানোর জন্য কমিশন তিনদিন ধরে নানা কারসাজি করেছে। তারপর কখনও বলেছে, ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। কখনও বলেছে, ৪১ শতাংশ। আমরা ভোট কেন্দ্রে পুলিশ, আনসার বাহিনীকে রোদ পোহাতে দেখেছি। আর দেখেছি, কুকুরের ঘুম। ভেতরের টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমাতে দেখেছি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের। যে নির্বাচনী কর্মকর্তারা তৎপর ছিলেন তারা নিজেরাই সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়েছেন। কিন্তু জন্মান্ধ নির্বাচন কমিশন সেদিকে মুখ ফিরিয়েই থেকেছে।
আর ঐ প্রহসনের নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ ঐ দলের সকল শীর্ষ নেতাকে কারাগারে পুরা হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে। অথবা তাড়া করা হয়েছে। গুম, খুন, ক্রসফায়ারের নামে গণহত্যার উৎসব চালিয়েছে সরকার। সে উৎসব এখনও চলছে।
এইসব কর্মকা-ের লক্ষ্য ছিল এমন একটা ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে বিরোধী দলের কেউ নির্বাচনের ধারে-কাছেও আসতে না পারে। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন গৃহবন্দি। জনগণের প্রতি তার আহ্বান ছিল একটাই এই প্রহসনের নির্বাচন বর্জন করুন। সেই আহ্বানে জনগণ সাড়া দিয়েছে। সাড়া যে দেবে তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। কারণ তার আগে সকল জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছিল যে, সরকারের জনসমর্থনে চূড়ান্ত ধস নেমেছে। ৯০ শতাংশেরও অধিক মানুষ চেয়েছিল নির্বাচন হোক একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই সুষ্ঠু হতে পারে না। সরকার সে কথা মানেনি বলে জনগণ ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যায়নি। এ থেকেও ফের প্রমাণিত হয় যে, এই সরকারের জনসমর্থন শূন্যের কোঠায়।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রহসন থেকে মানুষের দৃষ্টি সরানোর জন্য বিদেশী মদদে সরকার যে কতরকম চমক সৃষ্টির চেষ্টা করল আমরা তা দেখেছি। সরকার দলের গু-া-পা-ারা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে, মন্দির ভেঙে দিয়ে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করল যাতে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো যায়। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। খোদ সংখ্যালঘুরাই মিছিল করে, মানববন্ধন করে, সাংবাদিক সম্মেলন করে জানালেন যে, জামায়াত-শিবির বা বিএনপির লোকরা তাদের ওপর হামলা চালায়নি। বরং সরকারদলীয় লোকরাই তাদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে, লুটপাট করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে। ফলে সরকারের ঐ অপকৌশল কাজে লাগেনি। বিশ্ব জনমত প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করে অংশগ্রহণমূলক জনপ্রতিনিধিত্বশীল আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ অব্যাহত রেখেছে। সরকারের অপরিণামদর্শী মন্ত্রী, নেতারা এমনভাবে কথা বলছেন যে, তাদের ধমকে বিশ্ব জনমত একেবারেই উল্টে চলে যাবেÑ যেভাবে প্রশাসন যায়, যেভাবে নির্বাচন কমিশন যায়, যেভাবে পুলিশ যায় কিংবা যেভাবে যায় বিচার বিভাগ পর্যন্ত।
বাংলাদেশে মানবাধিকার এখন ভূলুণ্ঠিত। গণতন্ত্র নির্বাসিত। ন্যায়বিচার সুদূরপরাহত। এখন অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে দেশ। ৫ জানুয়ারির কলঙ্কিত নির্বাচনী প্রহসন থেকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য সরকার ও বশংবদ নির্বাচন কমিশনের যৌথ প্রযোজনায় এখন শুরু হলো মাসভর উপজেলা নির্বাচনের নাটক। উপজেলা নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয় না। এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বলে যে যার মতো করে এই নির্বাচনে অংশ নেন। আর উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানের পদগুলোকে সরকার একেবার ঠুঁটোজগন্নাথ করে রেখেছে। এই চেয়ারম্যানদের কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের পদগুলো আলঙ্কারিক। উপজেলার সকল ক্ষমতার মালিক ঐ এলাকার এমপি। টেলিভিশনে দেখলাম, এক উপজেলা চেয়ারম্যান এবার আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, আসলে জনগণের কল্যাণে কোনো কিছু করার ন্যূনতম ক্ষমতাও উপজেলা চেয়ারম্যানদের নেই। সে ক্ষমতা সবটাই সংসদ সদস্যের হাতে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে।
তবু মানুষ নির্বাচন চায় এবং দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না বলে বিএনপিসহ ১৯ দল সমর্থিত প্রার্থীরাও এতে অংশ নিচ্ছেন। সরকার এখন সেটাও চাইছে না। ফলে এই তফসিল ঘোষণার বেশ আগে থেকেই গ্রেফতার, খুন, গুম, মামলা, হামলা শুরু করেছে। মামলা হয়েছে হাজার হাজার। এসব মামলায় সুনির্দিষ্ট ৫-৭ জনের নাম লিখে হাজার হাজার অজ্ঞাত পরিচয়ের লোককে আসামী করা হয়েছে। অর্থাৎ যাকে খুশি তাকে, যখন খুশি তখন গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগের শেষ চার বছরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ৭ লাখ ৮ হাজার ১১৩টি। একে মগের মুল্লুক ছাড়া আর কোনো ভাষায় অভিহিত করা যায় বলে মনে হয় না। এখন বাংলাদেশ এমনই এক মগের মুল্লুক। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, তাদের বহুসংখ্যক উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে মামলা দিয়ে হয় গ্রেফতার করা হচ্ছে অথবা তাড়া করা হচ্ছে। একেকজনের নামে শত শত মামলা তো আছেই। যেখানে বিরোধী দল সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী নিজে গ্রেফতার হননি, যেখানে তার পক্ষে কাজ করবার, ভোট চাইবার মতো লোক নেই। মামলা, হামলা, গুম, মৃত্যু ভয়ে সবাই প্রায় পলাতক।
নাটকগুলো গতানুগতিক। কোনোটার নাম অস্ত্র উদ্ধার। কোনোটার নাম গাছ চুরি। কোনোটার নাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এইসব। সরকারের পেটোয়া র‌্যাব-পুলিশ বাহিনীর গুম, খুন এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এরা যখন যেখানে যাকে খুশি হত্যা করছে। বিচার-আচার কিছু নেই। কয়দিন আগে দিনে-দুপুরে যাত্রাবাড়ীতে দুই নিরীহ যুবককে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। তারপর ঘোষণা দিয়ে দেয় ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সেখানে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ক্রসফায়ারের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পুলিশ ঐ দুই নিরীহ যুবককে বিনা কারণে হত্যা করেছে। বাংলাদেশ এখন এমনই এক ভয়াল মৃত্যু উপত্যকা।
উপজেলা নির্বাচনও ৫ জানুয়ারির আদলে করার জন্য উপজেলায় উপজেলায় এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে আসতেই না পারেন। আওয়ামী গু-া, মাস্তান, র‌্যাব, পুলিশ এক্ষেত্রে একাকার হয়ে এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করছে। মারধর দিয়ে বাগে আনতে না পারলে র‌্যাব, পুলিশ দিয়ে মধ্য রাতে তুলে এনে ক্রসফায়ারের ব্যবস্থা তো থাকলই। এত রক্ত, এত হত্যা, এত গুম, এত মায়ের বুক খালি করা, এত বোনকে স্বামীহারা করা, এত শিশুকে পিতৃহারা করার মধ্যদিয়ে সরকার রক্তের যে হোলিখেলা শুরু করেছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা কোনোদিন জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকেনি। প্রকৃতি এবং মানুষ কেউই এত অবিচার, অত্যাচার শেষ পর্যন্ত সহ্য করে না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads