মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

‘ক্রেস্ট নয়, ক্যাশ দিয়েন’

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 
বাংলাদেশ এখন ঘুষ, দুর্নীতি, চোর-ছ্যাচ্চর, বাটপারদের এক মহা-অরণ্যে পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালের ‘আঁতাতের’ নির্বাচনের পর রাষ্ট্রলুণ্ঠনে এক মহোৎসব শুরু করে আওয়ামী লীগ। সেই লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় যোগ দেন মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা, মাস্তান, সন্ত্রাসী। টে-ারবাজী, চাঁদাবাজী, দখলবাজী, ঘুষ, দুর্নীতির এক মহোৎসব শুরু হয়ে যায়। আর প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এইসব লুটেরাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাতে থাকেন। তারপর গুম, খুন, নরহত্যা এখন খুব স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এতে যোগ দেয় ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতা ও কর্মী। কিন্তু এই পাঁচ বছরে হাজার হাজার নরহত্যার একটিরও বিচার শেষ পর্যন্ত হয়নি। মুখে বড় বড় বুলি সরকারের মন্ত্রীরা অতীতে যেমন আওড়িয়েছেন, বর্তমানেও আওড়ে যাচ্ছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় ও প্রতিমন্ত্রী বহু ঘটনা সম্পর্কে এমন কথাও বলেছেন যে- ২৪ ঘণ্টা, ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অপরাধীদের ধরে ফেলা হবে। সে ছিলো শুধুই ফাঁকা বুলি। অপরাধ আওয়ামী রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
আমরা বাইরে থেকে যা দেখতে পাচ্ছি তার শতগুণ অপরাধ দৃষ্টির আড়ালেই থেকে গেছে। প্রধানমন্ত্রী এসবের দিকে কর্ণপাত করেননি। বরং লক্ষ্য করা গেছে যে, তিনি দুর্নীতিবাজকেই একেবারে কোলে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশে ত্রাসের অপর নাম ছাত্রলীগ। খুন, ধর্ষণসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করেনি বা করছে না। কিন্তু কখনও কখনও প্রধানমন্ত্রী শুধু তাদের ভালো হয়ে যেতে বলছেন। এর বাইরে কুটোটিও নড়েনি। ছাত্রলীগের তা-বে বহুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় এখনও প্রায় অচল হয়ে আছে। তারা প্রতিদিন কোথায়ও না কোথায়ও রক্তপাত, প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার কখনও হয়নি। আমরা বরং এও দেখেছি যে, পুলিশের সহায়ক বাহিনী হিসেবে ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে। পুলিশের সামনেই যুদ্ধক্ষেত্রের মতো অবিরাম গুলী বর্ষণ করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা গত কয়েক বছরে গৌণ হয়ে পড়েছে। তাদের ব্যস্ত রাখা হয়েছে বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের কাজে। র‌্যাব, যৌথবাহিনী যা কিছু করা হয়েছে তারা সবাই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ঠেঙাতে ব্যস্ত থেকেছে। এখনও আছে। এটা যে কী ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, কী সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অনাচার সৃষ্টি করতে পারে- সে সম্পর্কে বোধকরি সরকারের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
ফলে দেশজুড়ে এক অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ কোনো একটি ঘটনায় ৪/৫ জনের নাম উল্লেখ করে হাজার হাজার লোককে আসামী করেছে। তারপর গ্রেফতার বাণিজ্যের জন্য গভীর রাতে সাদা পোশাকে অভিযান চালিয়ে হাজতখানা ভরিয়ে তুলেছে। অর্থের লেনদেন শেষে সকালে সেখানে সামান্য কয়েকজনই থেকেছে- যাদের চালান দেয়া হয়েছে। এই গ্রেফতার বাণিজ্য এখন তুমুল। মানুষের দাঁড়াবার জায়গা নেই। পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ কোথায়ও যেনো আশ্রয় নেই। এমন এক ভায়াবহ পৈশাচিক পরিবেশে পড়েছে আড়াই হাজার বছরের সভ্যতার সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এই জনপদে মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস দীর্ঘ। সকল স্বৈরশাসক, ফ্যাসিবাদ, জুলুম, পীড়নের বিরুদ্ধে মানুষ লড়াই করে জয়ী হয়েছে। কখনও পরাভব মানেনি। এরকম স্বাধীনচেতা, সংগ্রামী জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের মাধ্যমে দাসানুদাসে পরিণত করার বদখেয়াল যারা করেন- তারা ইতিহাস-অচেতন এবং আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। কিন্তু বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এই জাতিকে সেরকম দাস বানানোর জন্যই তাদের যাবতীয় কর্মকা- পরিচালনা করছেন। পৃথিবীতে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এরকম কোনো সরকার জিততে পারেনি। জনআকাঙ্খার কাছে তাদের নতি স্বীকার করতেই হয়েছে।
পৃথিবী থেকে রাজতন্ত্রতো বলতে গেলে একেবারে উঠেই গেছে। দু’চারটি দেশ ছাড়া আর কোথায়ও শক্তিশালী রাজতন্ত্র নেই। রাজা আছেন বা রাণী আছেন। কিন্তু তাদের ক্ষমতাও খুবই সীমিত। কিংবা কোথায়ও কোথায়ও তাদের পদ একেবারেই আলঙ্কারিক। ফলে ঐসব দেশে শাসন নিয়ন্ত্রণ করে জনপ্রতিনিধিরাই। রাজা বা রাণীর স্বাক্ষরে যদি তা অনুমোদন হয়ও সেটিও আনুষ্ঠানিকতামাত্র। সৌদি আরবে রাজতন্ত্র আছে। এখানে বাদশার অনেক ক্ষমতা। কিন্তু তারপরও তাদেরকেও জনআকাঙ্খার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিধি-বিধান তৈরি করতে হয়েছে। জনগণকে বাদ দিয়ে কিংবা দমন করে অথবা উৎপীড়ন করে কোনো তন্ত্রই টিকতে পারে না। হোক তা রাজতন্ত্র, হোক তা হাসিনাতন্ত্র।
একথা ঠিক যে, সরকার দেশকে এক বৃহত্তর কারাগারে পরিণত করেছে। দাগী অপরাধীদের মুক্তি দিয়ে হত্যাকারীকে রাষ্ট্রপতি সাধারণ ক্ষমায় ছেড়ে দিয়ে এরা ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছে। জেলখানাগুলো ভরে তুলছে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে। এও এক ধরনের কৌশল। এই কৌশলের মাধ্যমে সামনে নির্বাচনগুলোতে বিরোধী দলের জেতার সম্ভাবনা ছিনতাই করে নেয়া হয়েছে। বিরোধী দলকে যেভাবে বাইরে রেখে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রহসন হলো এই প্রক্রিয়াও তাই। একদিকে প্রতিদিন শত শত নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অপরদিকে অজ্ঞাত আসামী ধরার নামে তাড়া করা হচ্ছে। তারপর গুম, ক্রসফায়ার তো আছেই। এ এক আতঙ্কের জনপদ।
এর মধ্য দিয়ে ঘটে গেছে দুর্নীতির মহোৎসব। এটি হয়তো প্রকাশিত হতো না। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে জনগণের জ্ঞাতার্থে তাদের হলফনামা প্রকাশ করা হয়। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে তখন হাই! হাই! রব ওঠে। চুরি করেছি কিন্তু সে চুরি ধরা পড়ে গেলো। এটি যেনো তারা মানতেই পারছিলো না। আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ওসব তথ্য ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলো। বশংবদ নির্বাচন কমিশন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঐ তথ্য তাদের ওয়েবসাইট থেকে নামিয়ে ফেললো। কিন্তু ততোদিনে যা হবার হয়ে গেছে। ওয়েবসাইট, ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে কোটি কোটি মানুষ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, নেতাদের দুর্নীতির মহোৎসব প্রত্যক্ষ করলেন। আর আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, এসব দুর্নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী টু শব্দটিও করলেন না। অর্থাৎ দুর্নীতি করলে করেছে, জনগণকে তা জানাতে হবে কেনো। মুছে দাও ওয়েবসাইট থেকে। সুজনের ড. বদিউল আলম মজুমদার লিখেছেন, নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত মারাত্মক অন্যায় ও গণবিরোধী হয়েছে। কারণ এসব তথ্য দেখে, জেনে, বুঝে জনগণ সিদ্ধান্ত নিতে পারতো কাকে তারা ভোট দেবে, কাকে তারা ভোট দেবে না। তাদের সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হলো। জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো হয়তো আরও বড় কোনো দুর্নীতবাজকে।
আমরা লক্ষ্য করলাম, আওয়ামী লীগের বিগত পাঁচ বছরে যারা যতো বেশি বাকোয়াজি করেছে তারাই ততো বড় দুর্নীতবাজ। শেখ হাসিনার দয়ার শরীর। তিনি দুর্নীতবাজদের বিশ্ব দেশপ্রেমিকের খেতাব দিলেন। কালো বিড়াল খ্যাত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে মন্ত্রিত্বে বহাল রাখলেন। অথচ পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশে এ ধরনের ঘটনার পর কেউ মন্ত্রী থাকতে পারতো না। সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন যে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবার আগেই শত শত কোটি টাকা দুর্নীতি করলেন, বিশ্বব্যাংক তার প্রমাণ সরকারের সামনে হাজির করে। তখন একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন শেখ হাসিনা। বললেন, আবুল হোসেন ভালো কাজ করছেন। তিনি একজন বিশ্বদেশপ্রেমিক। এমনি আরেকজন সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। রেলের মন্ত্রী ছিলেন। বস্তা ভর্তি ঘুষের টাকাসহ ধরা পড়ে তার এপিএস। তারা বলেছে, এ টাকা নিয়ে তারা যাচ্ছিলো সুরঞ্জিতেরই বাসায়। কালো বিড়াল খ্যাত সুরঞ্জিত এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে পদত্যাগ করেন। তার একদিন পরেই তিনি খামোখা উজির হিসেবে মন্ত্রিসভায় ফিরে আসলেন। এমনি আরেকজন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামছুল হক টুকু প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে অবৈধ উপায়ে বা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি দুই’শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ। বিপুল অঙ্কের টাকার মালিক হয়েছেন তার দুই ছেলে, স্ত্রী ও পুত্রবধূ। এই মন্ত্রী, এমপিরা বিগত পাঁচ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক’শগুণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এরকম মন্ত্রী, এমপি, নেতা, কর্মী ঝাঁকে ঝাঁকে।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে, ৫ জানুয়ারির প্রহসনের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে যে সরকার এখন ক্ষমতায় বসেছে শেখ হাসিনা সে সরকারকে ‘ক্লিন ইমেজ’ দেয়ার জন্য এবারের মন্ত্রিসভা থেকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের বাদ দিয়েছেন। কিন্তু এখনও দেখছি গোড়ায় গলদ। এই মন্ত্রিসভায় যিনি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন সেই শাহরিয়ার আলম শত শত স্কুল শিশুকে তার সংবর্ধনার জন্য না খাইয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। শত শত তোরণে সয়লাব হয়েছে এলাকা। তারপর মঞ্চে উঠে নিয়েছেন সোনার নৌকা আর কোটপিন। হ্যাঁ, শুরু হয়ে গেছে ভানুমতির খেল। আগের দফায় যারা টাকা বানিয়েছে, তারা তো বানিয়েছেই। এ দফায় একেকজন বউনির কাজ শুরু করে দিয়েছেন। শুধু শাহরিয়ার আলমই নয়, জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আসম ফিরোজ যেনো আরও এক কাঠি সরেশ। তিনি প্রকাশ্য জনসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, তিনি আর ক্রেস্ট নেবেন না। ক্যাশ নেবেন। ‘যদি কেউ উপঢৌকন দেবার ইচ্ছা থাকে, তবে... ক্যাশ চাই ক্যাশ-টাকায়। কথাটা বোঝেন নাই? নির্বাচন করতে গেলে অনেক লাগে। কাজেই ক্যাশ দিয়েন..., খুব ভালো হবে। এগুলোর দরকার কি? অর্থাৎ মাইকে ঘোষণা দিয়ে শুরু হয়ে গেলো চীফ হুইপের চাঁদাবাজি। এই জন্য পরদিন তিনি সকাল নয়টা থেকে তিনটা পর্যন্ত দলীয় কার্যালয়ে থাকবেন বলে মাইকে ঘোষণা দেন। তিনদিন হয়ে গেলো সংসদ নেত্রী এ সম্পর্কে কিছুই বলেননি। পরে আরও এক চমকপ্রদ তথ্য জানা গেলো। তা হলো, এই আসম ফিরোজ ঋণ খেলাপী। কেনো তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হলো না। বা কি করে তার প্রার্থিতা বহাল থাকলো-জানতে চেয়েছেন আদালত। এমন এক অন্তহীন গোঁজামিলের ভেতর দিয়ে অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে দেশ। জানি না কোথায় গিয়ে শেষ হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads