শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিদেশে নিন্দার ঝড়


পাঠকদের অনেকেও সম্ভবত টেলিভিশনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সে প্রতিক্রিয়া দেখে থাকবেন। এটা ১১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। রাতের খবরে দেখা গেলো, প্রচ- ক্ষোভ ঝাড়ছেন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে। কারণও জানিয়েছেন তিনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের দল অওয়ামী লীগকে জনগণ নাকি আগামী পাঁচ বছরের জন্য ম্যান্ডেট দিয়েছে এবং তারা পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবেন বলে জানিয়ে সৈয়দ আশরাফ বলছিলেন, এতো পরিষ্কার একটি ‘মীমাংসিত বিষয়’ নিয়েও এসব কূটনীতিকের. কথার কোনো শেষ হচ্ছে না। শুনতে শুনতে তারা নাকি ‘টায়ার্ড’ হয়ে গেছেন কিন্তু এই কূটনীতিরা এখনো ‘টায়ার্ড’ হওয়ার নাম করছেন না। তারা বলেই চলেছেন। তাদের কথায় যে কোনো কাজ হবে না, সে কথাটাও যথেষ্ট জোরের সঙ্গে এবং ব্যঙ্গাত্মকভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন সৈয়দ আশরাফ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং খুবই প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ কেন এতটা উত্তেজিত হয়েছেন তার কারণ জানানোর আগে অন্য দুজন মন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কেও জেনে নেয়া যাক। দুজনের একজন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং অন্যজন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ১২ ফেব্রুয়ারি দুজনের মুখেই শোনা গেলো হতাশা ও উদ্বেগের কথা। তারা বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিএসপি সুবিধা না পাওয়ার ব্যাপারে। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ১৫টি শর্তের মধ্যে ১২টি এরই মধ্যে পূরণ করা হয়েছে জানিয়ে দুজনই বলছিলেন, এরপরও যুক্তরাষ্ট্র যদি জিএসপি বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করে তাহলে ইউরোপের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করতে পারে। আর ইউরোপের দেশগুলো সত্যিই জিএসপি সুবিধা বাতিল করলে বাংলাদেশকে মারাত্মক বিপদে পড়তে হবে। দেশের রফতানি আয়ে ঘটবে মহাবিপর্যয়।
পাঠকরা লক্ষ্য করবেন, একই সরকারের তিনজন মন্ত্রীর কথায় কিন্তু দুই রকম প্রতিক্রিয়া বা মনোভাবের  প্রকাশ ঘটেছে। তোফায়েল আহমেদ ও আবুল মাল আবদুল মুহিত যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টার কথা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সৈয়দ আশরাফ সেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে একহাত নিয়ে ছেড়েছেন। এসব দেশ নাকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো একটি ‘মীমাংসিত বিষয়’ নিয়েও এখনো শোরগোল করছে বলে ব্যঙ্গ পর্যন্ত করেছেন তিনি। সৈয়দ আশরাফের এই প্রতিক্রিয়ার আসল কারণ কিন্তু কেবলই কূটনীতিকদের তৎপরতা নয়। এর পেছনে রয়েছে অতি সাম্প্রতিক দুটি পৃথক বিষয়ও। একটি র‌্যাবের প্রশিক্ষণ সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তা বাতিলের সিদ্ধান্ত, অন্যটি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন সিনেটের শুনানি। এ দুটির কোনোটির মধ্যেই সৈয়দ আশরাফদের তথা সরকারের জন্য উল্লসিত হওয়ার কোনো উপাদান নেই। বরং রয়েছে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত হওয়ার কারণÑ যে জন্য তোফায়েল আহমেদ ও আবুল মাল আবদুল মুহিতকে খুবই ব্যস্ত দেখা গেছে।
প্রথমে র‌্যাব প্রসঙ্গ। ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন বেআইনি কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাব-এর সদস্যদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়ার ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সম্প্রতি এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্র বলেছেন, মার্কিন অর্থে পরিচালিত কোনো প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে বাংলাদেশ সরকার যেন র‌্যাব-এর কোনো সদস্যকে মনোনয়ন না দেয়। চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, র‌্যাব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের
কর্মকা- বন্ধ করেছে এবং বাংলাদেশ সরকার র‌্যাব-এর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সদস্যদের বিরুদ্ধে সংশোধন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেÑ এই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই যুক্তরাষ্ট্র এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবে। সংগ্রামসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশেরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংস্থার জরিপ ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব-এর ব্যাপারে এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অভিযোগ করেছে, সরকার বেছে বেছে এবং তালিকা করে দলের নেতাকর্মীদের গুম ও খুন করছে। এভাবে দলের অন্তত তিনশ’ নেতাকর্মীকে সম্প্রতি হত্যা করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, নতুন বছর ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৪১ দিনেই কম পক্ষে ৪৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। এসবের অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিক হত্যাকা-। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রিপোর্টেও ২৫ দিনে ৩৯টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের তথ্য-পরিসংখ্যান রয়েছে। প্রতিটি হত্যাকা-েই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে র‌্যাব-এর সদস্যরা। যে যৌথবাহিনীর নামে এসব হত্যাকা-ের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হচ্ছে, সে বাহিনীতেও র‌্যাব-এরই প্রাধান্য রয়েছে। এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব-এর প্রশিক্ষণে অর্থ সহায়তা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রকাশিত সব রিপোর্টেই জানা গেছে, ইন্টারনাল ইনকোয়ারি সেল বা আইসিসিতে মনোনীত হওয়ার এবং কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষভাবে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সে প্রশিক্ষণেই যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। বিদেশী নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন সরকারকে দেশটির ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আ্যক্ট অব ১৯৬১ মেনে চলতে হয়। অ্যাক্টটিতে এমন কোনো বিদেশী বাহিনীকে সহায়তা দেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যে বাহিনীর সদ্যসরা নিজ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মূলত ওই অ্যাক্টের নির্দেশনা পালনের উদ্দেশ্যেই যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবকে সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে কথার মারপ্যাঁচে নানা ব্যাখ্যা দেয়া হলেও বাস্তবে গুম ও গুপ্তহত্যা তথা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিষয়টি কতো ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তারই একটি বড় প্রমাণ। বস্তুত এ শুধু বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ নয়, আসলেও দেশের এমন কোনো এলাকার কথা বলা যাবে না যেখানে বিএনপি-জামায়াত এবং দল দুটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা গুপ্তহত্যার শিকার না হচ্ছেন। প্রতিটি হত্যাকা-ের পরই সরকারের পক্ষ থেকে একই ভাষায় জানানো হচ্ছে, আসামী ধরতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল বলেই র‌্যাব ও পুলিশ  নাকি ‘বাধ্য হয়ে’ গুলী ছুঁড়েছে এবং এতেই নাকি মৃত্যু ঘটেছে ওই নেতাকর্মীদের! কারও কারও বেলায় আবার গল্প বানাতে গিয়ে বলা হচ্ছে, দলের অন্য বোমাবাজ-সন্ত্রাসীদের আস্তানা দেখিয়ে দেয়ার জন্য বন্দি নেতাকে নিয়ে বিশেষ এলাকায় গেলে র‌্যাব ও পুলিশ প্রতিরোধের মুখে পড়ে। উভয়পক্ষের গোলাগুলীতেই নাকি প্রাণ হারিয়েছেন ওই নেতা! বলা বাহুল্য, কাহিনী চমৎকার হলেও সাধারণ মানুষকে কিন্তু মোটেও বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। জনগণের সচেতন অংশের বরং মুজিব আমলের রাজনৈতিক হত্যাকা-ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসন আমলে বিরোধী দলের প্রায় ৪০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
বলা দরকার, ১৯৭৫ পর্যন্ত যেমন বর্তমান সময়েও তেমনি জনগণ গল্পে বিশ্বাস করছে না। জনগণ বরং বিরোধী দলের এই অভিযোগকেই অনস্বীকার্য মনে করছে যে, মুজিব আমলের মতো এবারও দেশের ছাত্র-যুবকদের নির্মূল করে ফেলার ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। বাস্তব ঘটনাপ্রবাহেও সেটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথমে র‌্যাব, পুলিশ বা সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা বেছে বেছে নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর দু-একদিন পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এবং সবশেষে তাদের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে নদী বা খালের পাশে এবং ফসলের ক্ষেতে। কখনও ঝোপঝাড়ে, কখনও আবার মহাসড়কের পাশে। সব ক্ষেত্রেই এসব গুম ও হত্যাকা-ের জন্য পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম জড়িয়ে পড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে, রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের জন্য ঢালাও গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি গুম ও হত্যার ব্যাপারেও সরকার সমান তালে এগিয়ে চলেছে। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই আমরা আগেও বলেছি, সরকারের জন্য দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ, প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ ও র‌্যাবের অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। সামনে পুলিশ ও র‌্যাবকে রাখা হলেও পেছনে আসলে রয়েছে সরকার। এ যে কেবলই আমাদের কথা বা অভিযোগ নয় তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায়। আপত্তির কারণ হলো, র‌্যাব পরিকল্পিত হয়েছিল একটি এলিট ফোর্স হিসেবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার র‌্যাবকে দলীয় ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীতে পরিণত করেছে। বলা দরকার, সদিচ্ছা থাকলে এখনো র‌্যাবকে তার মূল অবস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সেটা দরকারও। এজন্যই সরকারের উচিত দলীয় ঘাতক বাহিনী হিসেবে নিন্দিত করার পরিবর্তে র‌্যাব-এর হারানো ভাবমর্যাদা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেই বেশি সচেষ্ট হওয়া।
এবার মার্কিন সিনেটের শুনানি প্রসঙ্গ। গত ১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এই শুনানিতে বাংলাদেশে স্বল্প সময়ের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি। দশম নামের সংসদ নির্বাচন এবং সহিংসতা ও রাজনৈতিক হত্যাকা-সহ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কিত শুনানিতে অংশ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল বলেছেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো অংশ না নেয়ায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। ভোটাররাও এতে ভোট দিতে যাননি। তারও আগে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এমপিরা। এসব কারণে নির্বাচনটি ছিল অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। গত বছরের নভেম্বরে নিজের বাংলাদেশ সফর এবং সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বর্ণনা দিতে গিয়ে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দুই নেত্রীকেই তিনি সংলাপের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পন্থা উদ্ভাবনের এবং সে অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার সে আহ্বান অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজিত হয়নি। নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের নেয়া সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানিয়েছিল উল্লেখ করে মার্কিন মন্ত্রী বলেছেন, সে উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে। সব মিলিয়েই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরপরই মার্কিন সরকার খুব দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য তাগিদ দিয়েছে, যাতে জনগণ তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়।
শুনানিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কেও জানিয়েছেন নিশা দেশাই বিসওয়াল। বলেছেন, গণতন্ত্রে সহিংসতা কাম্য নয়। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর রবার্ট মেনেন্দেজ এবং প্যানেলের অন্য সদস্যরা। প্রত্যেকেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে স্বল্পসময়ের মধ্যে নতুন করে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন। এদিকে ঢাকায়ও একই মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে একই আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। মঙ্গলবার ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএইড) নতুন মিশন প্রধান জ্যানিনা জ্যারুজেলস্কিকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক বৈঠক শেষে রাষ্ট্রদূত মজিনা বলেছেন, সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলেছেন সেটি একটি খুবই ভালো ধারণা। সরকারের উচিত মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
গার্মেন্ট শিল্পসহ বাংলাদেশ সংক্রান্ত আরো কিছু বিষয়ে আলোচনা হলেও মার্কিন সিনেটের শুনানিতে প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালও তার পুরো বক্তৃতায় নির্বাচন নিয়েই বলেছেন। এতে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জন এবং ভোটারদের অনুপস্থিতি তথা অংশ না নেয়ার দিকটি। অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে সংবিধান এবং বিরোধী দলের নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কিত দাবির মতো বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত বলা থেকে বিরত থাকলেও মার্কিন মন্ত্রী কিন্তু কিছুটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সব তথ্যই তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে নিজের সফরকালীন অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি নিশ্চয়ই দুই নেত্রীর অবস্থান ও বক্তব্য সম্পর্কে সিনেটকে অবহিত করেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়েও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনটি নিয়ে মার্কিন সরকার মোটেই সন্তুষ্ট নয়। স্বল্পসময়ের মধ্যে নতুন আরও একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেয়ার ফলেও মার্কিন সরকারের একই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। তারা শুধু এটুকু বলতেই বাকি রেখেছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার কোনো বৈধ সরকার নয়। কথাটা মুখে না বললেও নতুন সরকারের সঙ্গে অতি শীতল ব্যবহার এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা কমানোর মতো এমন বেশ বিছু লক্ষণ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যেগুলো প্রমাণ করে, দ্বিতীয় মেয়াদে আগত সরকারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। র‌্যাব-এর প্রশিক্ষণের জন্য অর্থিক সহায়তা নিষিদ্ধ করার মতো তথ্যগুলোও স্মরণ করা যেতে পারে। সব মিলিয়েই মার্কিন সিনেটের শুনানিতে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য স্পষ্ট এবং কঠোর বার্তাই এসেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্ষমতাসীনদের উচিত এই বার্তার মূলকথা অনুধাবন করা এবং আবারও সংবিধানের দোহাই দেয়ার ও পাঁচ বছরের মেয়াদপূর্ণ করার চিন্তা পরিত্যাগ করে যতো দ্রুত সম্ভব নতুন সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, একমাত্র ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশের কাছেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাতেই প্রতিক্রিয়া Ÿ্যক্ত করেছে। ব্রিটেনতো অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য-সহায়তা স্থগিত ও বন্ধ করার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়েছে। অন্য আরও কিছু দেশও পর্যায়ক্রমে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মূলত অমন আশঙ্কার ভিত্তিতেই অর্থমন্ত্রী মুহিত এবং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারেননি। পরিস্থিতি সত্যিই তেমন হয়ে গেলে ভারত একা এই সরকারকে রক্ষা করতে পারবে না। সুতরাং বিপদ বেড়ে যাওয়ার আগেই ক্ষমতাসীনদের উচিত মার্কিন সিনেটের আহ্বানে সাড়া দেয়া এবং বিশেষ করে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন করে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। বলা দরকার, এজন্য শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিলে চলবে না, একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধানও সংবিধানে যুক্ত করতে হবে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দমন-নির্যাতনতো বন্ধ করতেই হবে, একই সঙ্গে বন্ধ করতে হবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ও। এখন দেখার বিষয়, সরকার মার্কিন সিনেটের শুনানির ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে যায় কি না। অনিশ্চয়তার কারণ হলো, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সৈয়দ আশরাফের মতো ভারতীয় সেবাদাসদের সংখ্যাও অনেক নানা কথার মারপ্যাঁচে সর্বতোভাবে যারা কেবল উস্কানি দিয়ে থাকেন। যেমনটি সর্বশেষ উপলক্ষে দিয়েছেন সৈয়দ আশরাফ নিজেও।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads