শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

দেশ জুড়ে আতঙ্ক - জানুয়ারিতে ক্রস ফায়ারে ২০জন নিহত


দেশবাসী আশা করেছিলেন যে, দেশের মানুষ এই নির্বাচন মেনে নিক আর নাই নিক, সরকার একতরফা নির্বাচন করে একতরফা জয়লাভ করে কিছুটা উদার হবে। এটিই সাধারণত হয়। কোন সরকার অন্যায়ভাবে বা কারচুপি করে নির্বাচনী বৈতরনি পার হলে পরবর্তীতে ঐ সরকার জনগণের মন জয় করার চেষ্টা করে। কারণ জনগণকে তুষ্ট করতে না পারলে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। ভেবেছিলাম, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারও সেই উদার নীতি অনুসরণ করবে। কিন্তু এখন দেখছি সরকার শুধু কঠোর হয়নি, রীতিমত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। যখন বলা হয় যে সরকার  কঠোর হয়েছে, তখন সেই কঠোরতা সবসময় নেতিবাচক অর্থে গ্রহণ করা হয় না। কঠোরতার অনেক ইতিবাচক দিকও থাকে। যেমন আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বিশেষ করে দেশে ক্রিমিনাল অফেন্স অর্থাৎ ফৌজদারী অপরাধ বেড়ে গেলে সরকারকে কঠোর হতে হয়। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধ বেড়ে গেলে সরকার কঠোর হয়। অপরাধীদেরকে যদি সরকার পাকড়াও করে এবং কঠিন শাস্তি দেয় তাহলে অপরাধ কমে যায় এবং জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এবং তার নবগঠিত সরকার উল্টা পথে হাঁটছেন। গত শুক্রবার ইংরেজি ‘ডেইলি স্টারের’ খবরে প্রকাশ, শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসে আইন-শৃংখলা বাহিনীর ক্রস ফায়ারে ২০ ব্যক্তি মারা গেছেন। ডেইলি ষ্টারের ঐ রিপোর্টে বলা হয়, গতকাল অর্থাৎ বৃহস্পতিবার নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ এবং ফেনীতে আইন-শৃংখলা বাহিনী এবং বিএনপি নেতা এবং তার সমর্থকদের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধে ৩ ব্যক্তি নিহত হয়। এই ৩ জনসহ গত ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিচারবর্হিভূত হত্যাকা-ের সংখ্যা দাঁড়ালো ২০ জন। এদের মধ্যে অন্তত ৯ জন পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছেন। এব্যাপারে পুলিশ যে বিবৃতি দিয়েছে সেটি অতীতের অনেক ক্রস ফায়ারজনিত মৃত্যুর পর ইস্যুকৃত বিবৃতির অনুলিপি মাত্র। সাম্প্রতিককালে বিচারবর্হিভূত হত্যাকা-ের সংখ্যা আতঙ্কজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা অবিলম্বে এসব হত্যাকান্ডের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে। গত বুধবার সোনাইমুড়ী উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম ঐ উপজেলার মেদিপুর গ্রামে তার সমর্থকবৃন্দ এবং পুলিশের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। নোয়াখালীর এসপি আনিছুর রহমান বলেন যে, অস্ত্র উদ্ধারের জন্য তারা তৌহিদকে ভোর ৪টার সময় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। তারা সেখান থেকে ফেরার পথে তৌহিদের সমর্থকরা পুলিশের ওপর গুলীবর্ষণ করে। পুলিশও বাধ্য হয়ে পাল্টা গুলীবর্ষণ করে। পুলিশ এখানে ৪০ রাউন্ড গুলীবর্ষণ করে। এই গুলীবর্ষণের ফলে তৌহিদ নিহত হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তৌহিদকে ঢাকায় গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ প্রশাসন তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলামকে পুলিশ সুপার (এসপি) আনিছুর রহমানের নেতৃত্বে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে দলটির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এ অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় নোয়াখালীর পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানকে দায়ী করে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, এটা ক্রসফায়ার নয়, পরিকল্পিত হত্যা। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এ সময় তিনি তৌহিদুল হত্যাকান্ডসহ সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিষয়ে জাতিসংঘসহ দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
খোকন অভিযোগ করে বলেন, ২৮ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে বের হওয়ার সময় বিএনপির নেতা তৌহিদুল ইসলাম ও সোনাইমুড়ী উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ফয়সাল হোসেনকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ আটক করে  রাতে পল্টন থানায় সোপর্দ করে। ২৯ জানুয়ারি তাদের নোয়াখালীর পুলিশ সুপারের নির্দেশে নোয়াখালী পুলিশ লাইনে নেয়া হয়। তিনি বলেন, তাদের দুজনকে ক্রসফায়ারে না দেয়ার জন্য পুলিশ সুপারকে আইনজীবীসহ বিভিন্নজন অনুরোধ করেন। ২৯ জানুয়ারি (বুধবার) দিবাগত রাত তিনটার দিকে পুলিশ লাইন থেকে বের করে তাদের সুধারাম থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তৌহিদকে চোখ বেঁধে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিএনপির এই নেতা আরো অভিযোগ করেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য সরকারের নির্দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এসব হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। তৌহিদকে ক্রসফায়ারে হত্যার জন্য সোনাইমুড়ি ও চাটখিলের কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ইন্ধন দিয়েছেন। এ ঘটনায় এসপি আনিসুর রহমানকে দায়ী করে অবিলম্বে তাকে বরখাস্তের দাবি করেন তিনি।
বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে তিনি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার তদন্ত দাবি করেন। একই সাথে বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থাকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আহ্বান জানিয়ে মাহবুব বলেন, আপনারা সরকারের লেজুড়বৃত্তি না করে এর প্রতিবাদ করুন। প্রসঙ্গত, পুলিশের হাতে গ্রেফতারের দুই দিন পর বৃহস্পতিবার নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলামের গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
দুই
অপর একটি খবরে প্রকাশ, যৌথবাহিনীর গুলীতে নিহত হয়েছেন ফেনীর যুবদল নেতা গোলাম সরোয়ার (৩০)। গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনা ঘটে। ফেনী সংবাদদাতা জানান, ফেনীতে র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গোলাম সরোয়ার (৩০) নামে এক যুবদল নেতা নিহত হয়েছেন। তিনি ইউনিয়ন যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সদর উপজেলা যুবদলের সদস্য বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। ফেনী সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নে লস্করতালুক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, এনকাউন্টার-ক্রসফায়ারের নামে বিরোধী নেতা-কর্মী হত্যাকান্ডের জন্য এই সরকারকে একদিন জবাবদিহি করতে হবে। গত মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাব কনফারেন্স লাউঞ্জে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৭৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ভূমিহীন দল আয়োজিত “সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা : চলমান রাজনৈতিক সংকট” শীর্ষক এক আলোচনা সভার প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
তিনি বলেন, শিবির বলে যাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে তারা বাংলাদেশী, পাকিস্তানী নয়। ১৯৭১ সালে তাদের অধিকাংশেরই জন্ম হয়নি। পাখির মতো গুলী করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, কোন সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না। সারা দেশে যেভাবে ছাত্রদল-ছাত্র শিবির ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে ক্রসফায়ারের নামে প্রকাশ্যে হত্যা করা হচ্ছে, এর দায় প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হবে। এজন্য তাকে একদিন আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মানুষ মারা বন্ধ করুন।
প্রধামমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করে তিনি বলেন, আপনি (হাসিনা) খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানে যেতে বলেছেন বার বার। মুক্তিযুদ্ধে আপনারতো কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। বরং আপনি দেশের বাইরে থেকে এসেছেন। আপনার মন্ত্রীসভায় স্বাধীনতা বিরোধীরা এবং শেখ মুজিবের গায়ের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানো ব্যক্তিরাও রয়েছেন।
তিন
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ (এইচআরডব্লিউ)। একই সঙ্গে এসব ঘটনা স্বাধীনভাবে তদন্ত করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গুলোকে তাদের হেফাজতে নিয়ে প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়ার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গত সোমবার সংগঠনটির এশিয়া অঞ্চলের প্রধান ব্র্যাড অ্যাডামস এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান।
অ্যাডামস বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সন্দেহ ভাজনদের হত্যার ঘটনা ঘটছে। ক্ষমতাসীন আ’লীগ বিরোধী দলে থাকাকালীন একে ক্রস ফায়ারে হত্যা বলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতায় থেকে তারা এ বিষয়ে কথা বলছে না। এই হত্যার নিন্দা জানিয়ে এখন প্রধানমন্ত্রীর উচিত, প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয়া এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বিরোধী দলীয় সমর্থকদের গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে। গ্রেফতারকৃতদের অনেকের বিরুদ্ধেই গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সহিংস আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনী বলছে, গ্রেফতারের পর যে হত্যার ঘটনা ঘটছে সেগুলো ক্রস ফায়ারের ঘটনা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আগেই ক্রস ফায়ারকে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর একটি প্রচলিত পুরনো ধ্যান ধারণা বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু বাস্তবে এসব ভয়াবহ ঘটনাবলিকে হত্যাকা- বলেই গণ্য করতে হবে।
গত ২৯ জানুয়ারি ডেইলি স্টার প্রধান সম্পাদকীয়তে বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছে। বলা হয়েছে যে, বিগত ৩ সপ্তাহে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা আতঙ্কজনকভাবে বেড়ে গেছে। পত্রিকাটির মতে এসব রিপোর্ট পড়লে আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে নিচের দিকে একটি ঠান্ডা ¯্রােত বয়ে যায়। এ ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে সেটা গৎবাঁধা অতি পুরাতন ব্যাখ্যা। দেখা যাচ্ছে যে, ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে যাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্র শিবিরের লোক। আর কিছু কিছু বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদলের লোক। পত্রিকাটি বলেছে যে, যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদের অপরাধ থাকুক আর নাই থাকুক, অন্ততপক্ষে তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি। এই রকম বেপরোয়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- আইনের শাসনের মূল স্তম্ভকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। যারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তাদেরকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা উচিত এবং তাদেরকে উপযুক্ত আইনানুগ শাস্তি দেয়া উচিত বলে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads