বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

আর কত লাশ দেখব


আগামীকাল একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা-শহীদ দিবস। একই সাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। এবার দিনটি ৫২ সালের মতো ফাল্গুন মাসের ৮ তারিখ হলো না। ৯ তারিখ হলো। এখন চলছে ১৪২০ সাল। ৬২ বছর আগে বাংলা সাল ছিল ১৩৫৮। এক সময় ৮ ফাল্গুনও পালিত হতো। মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়ার দিনটিতে ইংরেজি হিসাব অনেকেই করতে চাইতেন না। এখন আর সেই আবেগ নেই। অনুভূতির সেই গভীরতাও চোখে পড়ে না। একুশকে কেউ আর ইংরেজি সালের তারিখ ভেবে নেয় না, বা গ্রহণ করে না, নেয় আমাদের দেশজ পরিভাষার মতো করে। এটি দুভাবে দেখার সুযোগ আছে। প্রথমত, এটিকে আমাদের আত্মস্থ করার ক্ষমতা হিসেবে দেখা যায়। ঔদার্য এবং কূপমণ্ডূকতার ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়ার মতো বিষয় মনে করা যায়। অন্য দিকে নিজেদের দেউলেভাব কিংবা বাংলা সালের সাথে এক ধরনের উপহাস হিসেবেও ভাবার সুযোগ আছে। যে দিন ৫২ সালের ঘটনাটি ঘটেছিল সে দিন ছিল ৮ ফাল্গুন যা আগেই উল্লেখ করেছি।
জাতি হিসেবে আমরা এখন আগের তুলনায় আত্মস্থ করার অনেক বেশি যোগ্যতা অর্জন করেছি কি না জানি না, তবে এখন অনেক কিছুতেই আমরা উদার। হয়তো বা উদাসীনও। নিজস্ব সংস্কৃতির ব্যাপারেও আমরা এতটাই উদার যে, আমাদের লোকজ ঐতিহ্যগুলো জাদুঘরে ঠাঁই পাচ্ছে। হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি এসে উর্দুর স্থান দখল করেছে। পিন্ডির স্থলে দিল্লির দৌরাত্ম্য বেড়েছে। আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যগুলো, কৃষিজীবীদের জীবনযাপনের গ্লানিগুলো আমরা নগরে বসে উপভোগকরি। কেউ কেউ মনে করেন এটা এক ধরনের ভড়ং। মানতেই হবে এখন আর দরজা জানালা বন্ধ করে রাখার সুযোগ নেই। সব কটা জানালাখুলে গেছে। দেয়া-নেয়া বেড়েছে। আমাদের আত্মস্থ করার সক্ষমতাও হয়তো বেড়েছে। আবার আত্মবিসর্জনের ব্যাপারটাও একটা জায়গায় থেমে নেই। এটাকে যুগের চাহিদা বলা সম্ভব। আবার আত্মবিসর্জনের মতো বিষয় ভাবারও সুযোগ আছে। আমাদের ভাষা বিজ্ঞানীদেরকেই বলতে হবে আমরা ভাষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হচ্ছি, না নিজেদের হারিয়ে খুঁজছি। এ ধরনের প্রসঙ্গ উঠছে এই কারণে যে, বাসন্তী শাড়ি পরে আমাদের নারীরা বসন্তবরণ করে। তারুণ্যও যোগ দেয়। আবার ফাগুন এসেছে গো ফিরেবলে গানও গাই। কিন্তু ফাল্গুনের আগুন ঝরা ভাষা-আন্দোলন ততটা টানে বলে মনে হয় না।
কবিরা স্বপ্ন দেখায়। লেখকেরা আশা জাগায়, ভরসা জোগায়। এ কারণেই আল মাহমুদ বারবার বলছেন ঢাকা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাজধানী। এতটা ঋজু ভাষায় সাহসী উচ্চারণের আর কোনো লোক কি নেই! থাকলে তারা কি এখনো স্বার্থবাদের পূজার ধারা পরিবর্তন না করেই বাঙালি জাতিকে বালকের হাতে ললিপপ ধরিয়ে দেয়ার মতো মন ভোলাতে চান। এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া জরুরি।
ভাষা-সাহিত্য কোনো ঠুনকো বিষয় নয়। সব ভাষা পবিত্র। সব ভাষাই সৃষ্টি কর্তার অপার দয়ার ফসল। ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য মহান সৃষ্টিকর্তার অনুপম নিদর্শন। তাই কোনো ভাষা বিদ্বেষ কাক্সিক্ষত নয়। আবার নিজেকে হারিয়ে খোঁজার মতো কাজও নন্দিত নয়। মাতৃভাষাপ্রীতি প্রকৃতিসিদ্ধ। এই সহজাত মাতৃভাষাপ্রীতির একটা নন্দিত ভাব ও চেতনা আছে। আবার বর্জনের একটা খেসারত এবং দায়ও আছে। এখনো নতুন প্রজন্মকে প্রচুর ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়। ভাষা আন্দোলনকেও আমরা নির্মোহভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। যার যতটুকু নোংরা ও দলান্ধ রাজনীতি করা দরকার, তিনি ততটুকু করেই আমাদের সামনে একটা বিভ্রান্তির জাল বিস্তার করেছেন। সেই রাজনীতির জের আমরা টেনেছি, এখনো নতুন প্রজন্ম কেন টানবে?
২. যশ থাকতে কীর্তন থামাতে হয়। নয়তো শোনার লোক থাকে না। হিন্দু ধর্মে কীর্তন ধর্মীয় গান। আমাদের কাছে প্রবচনটা ধর্মীয় কিছু নয়। কদিন আগে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা যখন লিখলাম কুইনিন জ্বর সারাবে কিন্তু কুইনিন সারাবে কে’, তখন অনেকেই বিব্রতবোধ করলেন। তখন গরু ব্যবসায়ীর টাকা লুটের ঘটনায় চার র‌্যাব সদস্য চাকরিচ্যুত হয়েছিল। এর ভেতর শতাধিক র‌্যাব সদস্য নানা কারণে বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে। যারা র‌্যাবকে ফেরেশতাভেবেছেন তারা যেমন ভুল করেছেন, তেমনি যারা শুধু অমানুষ এবং খুনের হোতা ভেবেছেন, তারাও সঠিক চিন্তা করেননি। দোষে-গুণে মানুষ। কৃপ্রবৃত্তি মানুষকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে। র‌্যাব যখন জনগণের স্বস্তির কারণের সাথে শ্রদ্ধাকুড়াল, তখন অনেক মানুষের কাছে বিভীষিকা সৃষ্টিকারী হিসেবে ভীতিও কুড়িয়েছে। র‌্যাব কোনো ইস্যু নয়। কেউ এর অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেনি। যারা র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দিতে অর্থ জোগায়, তাদের হাল আমলের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে যাবো না। প্রতিদিন আমাদের সম্পাদকীয় দফতরে প্রচুর চিঠি জমা হয়। র‌্যাবের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করার জন্য জনগণের আবেদন যেমন আসে, তেমনি বিনা বিচারে হত্যার দায়’, ক্রসফায়ারের বৈধতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আপত্তি উত্থাপন করেও প্রচণ্ড ক্ষোভমাখা কিছু চিঠিও আসে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে ফরেন বডিবলে একটা কথা আছে। বেশি মাত্রায় ওষুধ নির্ভরতার জন্যই এটা বলা হয়ে থাকে। ওষুধের প্রতিরোধ ক্ষমতা হারানোর কথা অনেকের জানা। একটি অ্যান্টিবায়োটিক এক সময় কার্যকারিতা হারায়। এ জন্য চেতনা শক্তির নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা জরুরি হয়ে পড়ে। র‌্যাব নিয়ে অতি মাত্রায় আবেগপ্রবণ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে যথেষ্ট সময় পার হয়েছে। পানি ঘোলা হওয়ার কারণ ঘটেছে। বিশ্ববাজারে বিতর্ক চলছে। বাস্তবতা হচ্ছে আয়নায় আমরা মুখ দেখি। কিন্তু আসল চেহারা দেখতে চাই না। আমরা পাকিস্তানি বর্বরতা দেখেছি। রক্ষীবাহিনীর সীমালঙ্ঘনের মাত্রা প্রত্যক্ষ করেছি। লাল ঘোড়া-নীল ঘোড়া ও কালো ঘোড়া দাবড়ানোর পর এবার দেশকে স্বাভাবিকতার দিকে যাত্রা করতে দেয়া উচিত। বিশেষ বাহিনী বিশেষ সময়ের মধ্যেই গুটিয়ে নেয়া প্রয়োজন। আমরা বলছি না, জাতি একেবারে অসহ্য হয়ে তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। তবে একটি অ্যাকশন প্রোগ্রামের সাফল্য-ব্যর্থতা পরিমাপের সময় হয়েছে। বিনা বিচার, মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং রাজনীতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবার আমলে নিতে হবে। আমরা আর কত লাশ গুনব। আরো বিলম্বে খামোশবলে থামানোর সুযোগ নিলে দেশ-জাতি ও সরকারের ভাবমূর্তি ুণœ হবে। অনির্ধারিত বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে যাবে।
রাজনৈতিক কারণে যারা র‌্যাব নিয়ে বিরক্ত তাদের মতো করে আমরা বলতে চাই না। তবে বিনা বিচারে মানুষ মারার কোনো যুক্তিই নীতিশাস্ত্রের ধোপে টিকে না। কথিত ক্রসফায়ার জনগণের চোখে একটা কৌশল। আমরা চাই দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে সুশাসন জরুরি। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি শিকড়সহ উপড়ে ফেলা সম্ভব না হলে সুশাসন নিশ্চিত হবে না। প্রয়োজনে কৌশল পাল্টান। ধরন পরিবর্তন করুন। আমরা মাথাব্যথার জন্য মাথাকাটার পরামর্শ দেবো না। সঠিক ওষুধ প্রয়োগেরই পরামর্শ অবশ্যই দেবো।
স্মরণে পড়ে, প্রথম দিকে র‌্যাব যখন বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারের গল্প সাজাত তখন অনেকেই সেটা কবুল মানতেন। তারপর একের পর এক ঘটনা তদন্ত হতে থাকল। সত্য বেরুল না। অসত্য দিয়ে সত্যকে আড়াল করার অন্তহীন চেষ্টা লক্ষ করার বাসনাটাই প্রাধান্য পেল। আমরা শুরুতেই এ ধরনের বাড়াবাড়ির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি। তখন যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা অসন্তুষ্ট হতেন। সাবধান করতেন। কোনো কোনো রাজনীতিবিদ প্রতিপক্ষ দমনে উৎসাহ বোধ করতেন। আসলে প্রতিটি কান্নার সাথে যে অভিশাপ যুক্ত হয় তা চোখে দেখা যায় না। সেটা বুঝতে হলে বাড়তি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হয়। রাজনৈতিকভাবে যারা বিকারগ্রস্ত, মতের দিক থেকে তারা অন্ধ। তাদের মানবিক অনুভূতি ভোঁতা। তাদের বিপর্যয়ের জন্য তাদের কৃতকর্মই যথেষ্ট। ব্যাপারটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আইনের লোকদের বেআইনি কাজ মানুষ মেনে নেয় না। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য অপকর্মে কিংবা অপরাধের সাথে জড়িয়ে গেলে পুরো বাহিনীর সুনাম ুণœ হয়। এমনিতেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। তার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক সদস্যরা যখন অপরাধজগতের সাথে জড়িয়ে যান তখন শুধু বাহিনীর সুনাম নষ্ট হয় না, অপরাধ জগৎ বেপরোয়া হয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। সম্প্রতি স্বর্ণ ও ডলার পাচার, অপহরণ ও জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে পুলিশের এক এএসআই, সাবেক এক সেনাসদস্য ও এক ইউপি চেয়ারম্যানসহ ছয়জন গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মডেল থানার এএসআই, পুলিশের সোর্স ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সংশ্লিষ্টতায় উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাদের গ্রেফতার অভিযানে পাল্টা হামলায় র‌্যাবের সহকারী পরিচালক গুরুতর আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। উল্লিখিত ঘটনাটি ঘটেছে গত শুক্রবার মধ্যরাতে। মফস্বল জেলা থেকে ঢাকা আসার পথে স্বর্ণ ও ডলার বহনকারীরা পরিকল্পিতভাবে অপহরণের শিকার হন।
আগেই উল্লেখ করেছি, আমরা তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধশব্দটির সাথে পরিচিত। পুলিশের ব্যাখাও সবার জানা। সরকার কী ভাষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করে তা-ও কারো কাছে নতুন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে সরকার প্রজাতন্ত্রের সন্তানতুল্য নাগরিকদের প্রাণ নিয়ে আর কত খেলবে? এখন দেশজুড়ে এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। মাঝে মধ্যে ধরা পড়ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক সদস্যও। আবার পুলিশ, র‌্যাব পরিচয়ে অপরাধ করছে কোনো কোনো সন্ত্রাসীচক্র।
এ ধরনের কিছু অপরাধ ও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা যেকোনো সময় যেকোনো সমাজে ঘটতে পারে। তবে বাংলাদেশে বর্তমানে যা ঘটছে তা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। এটি সামগ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির ফসল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপেশাদার ও অতি উৎসাহী সদস্যরা সুযোগ নেন। এরই জের ধরে খুন, গুম, হত্যা, ছিনতাই বেড়েছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি ও নিশ্চিহ্ন করার মতো ঘৃণ্য তৎপরতা।
তাই জোর দিয়ে বলব, এ সময়ের অপরাধগুলো মূল রোগ নয়, আসল রাজনৈতিক রোগের উপসর্গ। নীতিনির্ধারকদের এটি বিবেচনায় নিয়েই প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে; নয়তো পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। লাখো মানুষের অভিশাপ, কান্না, আহাজারি তখন শূন্যে মিলিয়ে যাবে না। কারণ মজলুমের যখন কোনো মানবিক সহায় থাকে না তখন খোদ সৃষ্টিকর্তাই সহায় হয়ে যান।


 মাসুদ মজুমদার

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads