শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদ বৃদ্ধি ও নৈতিকতা প্রসঙ্গ


কোনো সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ফৌজদারি মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী, ঋণখেলাপী ও কালো টাকার মালিক যাতে তথ্য গোপন করে অথবা মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা প্রার্থনা করে সুপ্রিম কোর্টের ৩ আইনজীবী এডভোকেট আব্দুল মোমেন চৌধুরী, কেএম জাবির ও জহুরুল হক ২৩ এপ্রিল ২০০৫ যৌথভাবে এক রিট পিটিশন দাখিল করেছিলেন (রীটের নং-২৫৬১/২০০৫) এ রীটের পক্ষ হয়ে ড. কামাল হোসেন শুনানি করেন। হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি মোঃ আব্দুল মতিন এবং বিচারপতি এ এফএম আব্দুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ ২৪ মে এ ব্যাপারে ৮টি দিক নির্দেশনা দেন।
 নির্দেশনাগুলো হচ্ছে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে প্রার্থীর শিক্ষাগতযোগ্যতার সনদ। বর্তমানে কোন ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত আছে কি না? প্রার্থী সম্পর্কে পূর্বে কোন ফৌজদারী মামলা ছিলো কিনা। থাকলে সেটার ফলাফল, প্রার্থীর পেশা কি, প্রার্থীর আয়ের উৎস কি? পূর্বে এমপি ছিলেন কি না, এমপি হয়ে থাকলে ওই সময়ে জনগণকে দেয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অর্জনে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে কি ভূমিকা পালন করেছেন। প্রার্থীর এবং প্রার্থীর পোষ্যদের সম্পদ ও দায়-দেনার বিবরণ, প্রার্থীর নিজে ব্যক্তিগত বা যৌথভাবে বা পোষ্যদের নামে ব্যাংক কিংবা অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতেন কি না। করে থাকলে ঋণের পরিমাণ ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য তথ্য। প্রার্থী কোন ঋণগ্রহীতা কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিংবা পরিচালক থাকলে ওই কোম্পানির ঋণের পরিমাণ কত তার বিবরণ দাখিল।
হাইকোর্টের নির্দেশনায় অর্থ সম্পদ বিষয়ক বিবরণ দেয়া বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে হাইকোর্ট প্রকৃতপক্ষে কালো টাকার মালিক, ঋণখেলাপী ও অবৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য জাতীয় সংসদে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন। সংবিধানের পঞ্চম ভাগের অনুচ্ছেদ ৬৬ সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা-
১. কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হইলে এবং তাহার বয়স পঁচিশ বৎসর পূর্ণ হইলে এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বর্ণিত বিধান সাপেক্ষে তিনি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন।
২. কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবে না যদি (ক) কোন আদালত তাহাকে অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন, (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করিয়া থাকেন, (গ) কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন, (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদ-ে দ-িত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে, (ঘ-ঘ) তিনি প্রজাতন্ত্রের কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
১৯ ডিসেম্বর ২০০৬ এমপি প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে অর্থ-সম্পদের হলফনামা দান সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে করা আপিলের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন চেম্বার জজ বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীন এ আদেশ দেন। আপিলকারী ছিলেন সন্দ্বীপের স্বতন্ত্র এমপি প্রার্থী মোঃ আবু সাফা। তার পক্ষে শুনানি করেন এডভোকেট আজমামুল হোসেন কিউসি। সহায়তা করেন ব্যারিস্টার সাদত ওমর। চেম্বার জজের এ স্থগিতাদেশের ফলে নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীকে হাইকোর্টের দেয়া এ সংক্রান্ত কোন আদেশ প্রাথমিকভাবে মানতে হয়নি। অবৈধ উপায়ে অর্জিত কালো টাকার মালিকদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
আপিলকারী আইজনী ব্যারিস্টার সাদাত ওমর তখন বলেছিলেন, ২০০৫ সালের ২৪ মে হাইকোর্টের আদেশের স্থগিতাদেশ চেয়ে আগেই আমাদের আপিল করা ছিলো। আপিল বিভাগ আমাদের আপিল মঞ্জুর করেছেন। বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন হাইকোর্টের আদেশ কার্যকর করতে পারে না। আমরা আপিলে বলেছি, নির্বাচন কমিশনের এসব বিধান সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। আমার মক্কেল অষ্টম শ্রেণী পাস। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে স্বন্দ্বীপ থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দাখিলের বিধান সংবিধানে নেই। স্বল্প শিক্ষা সংবিধান নির্ণীত অযোগ্যতার মধ্যে নেই। নির্বাচন কমিশন যে আলোকে ফরম মুদ্রণ করেছে সেটি জাজমেন্ট ল’ এবং সংবিধান পরিপন্থী।
২০ ডিসেম্বর ২০০৬ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর পক্ষ থেকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের আট ধরনের ব্যক্তিগত তথ্যাদি হলফনামার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে সংগ্রহের জন্য হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশের সুপ্রিম কোর্টকে বিভ্রান্ত করে স্থগিতাদেশ নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় ।
 সুজন এর পক্ষে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, তথ্য জানার অধিকারহরণ করার উদ্দেশ্য কী আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি গোপনে হঠাৎ করে রায়ের স্থগিতাদেশ দেয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের বিচার পাওয়ার অধিকার আজ হুমকির মুখে। তবে তিনি স্থগিতাদেশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করেন না বলেই সাংবাদিকদের জানান।
সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, এ স্থগিতাদেশ থেকে স্পষ্ট হয়, রাষ্ট্রযন্ত্র কালো টাকা ও দুর্বৃত্তদের পক্ষে। এসব বন্ধ হোক রাষ্ট্রাতন্ত্র চায় না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, স্থগিতাদেশের পর অতি দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে যে সার্কুলার জারি করেছে তা বিস্ময়কর।
সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যে আবু সাফা স্থগিতাদেশের আবেদন করেছেন তাকে তার ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবু সাফা নামে বাস্তবে কেউ আছে কিনা প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, কারা আদালতকে বিভ্রান্ত করে স্থগিতাদেশ নিয়েছে তাদের শনাক্ত করতে হবে। মামলার রিটকারীর একজন এডভোকেট এ এম জাবিদ বলেন, মামলার রায় স্থগিত হওয়ার কারণে সৎ যোগ্য লোক নির্বাচনী প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি স্থগিতাদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদনের প্রস্তুুতি নিচ্ছেন বলে জানান।
পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন যার ফলশ্রুতিদে নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সকল প্রার্থীকে হলফনামার মাধ্যমে নিজের সকল তথ্য দিতে হয়। এই ‘ হলফনামা’-এখন কিছু প্রার্থীর কাল হয়েছে।
বিগত ৫ বছরে সংসদ সদস্যদের সম্পদ বেড়েছে কয়েক গুণ। নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা সরকারদলীয় এই সংসদ সদস্যদের হলফনামা পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া যায়। হলফনামা থেকেই ক্ষমতায় থেকে সম্পদশালী হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়। মন্ত্রী-এমপিদের একটি অংশ পাঁচ বছরে অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হয়েছেন। ক্ষমতা নামের আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ বদলে দিয়েছে তাঁদের স্ত্রীদেরও। অথচ দৃশ্যমান তেমন কোনো আয় অনেকেরই নেই।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার শর্ত হিসেবে নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামা থেকে তাঁদের স্বেচ্ছায় ঘোষিত এই সম্পদের হিসাব জানা গেছে। ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩ থেকে এসব তথ্য সাধারণের জন্য কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
নতুন এই তথ্যের সঙ্গে আগের নির্বাচনের সময় ২০০৮ সালে দেয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই অতি দ্রুত সম্পদশালী হয়েছেন। কেউ কেউ পাঁচ বছরে একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। এই সরকারের পাঁচ বছরে শেয়ারবাজারে যত বড় কেলেঙ্কারিই ঘটুক, মন্ত্রী-এমপিদের একটি অংশ সেখানে বিনিয়োগ করতেও পিছপা হয়নি।
শেখ হাসিনা
নির্বাচন কমিশনে দায়ের করা হলফনামা অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর মালিকানায় গত পাঁচ বছরে ২ কোটি ২ লাখ ৪৩ হাজার ১৩৫ টাকার সম্পদ বেড়েছে। কমিশনে জমা দেয়া ২০০৮-০৯ অর্থবছরের আয়কর বিবরণী অনুযায়ী শেখ হাসিনার নিট সম্পদ ছিল ৩ কোটি ৫৪ লাখ ২ হাজার ৯০৪ টাকার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের আয়কর বিবরণীতে তা বেড়ে হয়েছে পাঁচ কোটি ৫৬ লাখ ৪৬ হাজার ৩৯ টাকা। তথ্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নামে ৬ একর কৃষিজমি রয়েছে, যার আনুমানিক দাম ৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এখান থেকে তিনি বছরে ৭৫ হাজার টাকা পান। এছাড়া মৎস্য খামার থেকে বছরে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় করেন। গাছ বিক্রি থেকে বছরে তার আয় ১০ লাখ টাকা। ব্যাংকে তার ৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা আছে। আর ব্যাংকে প্রধানমন্ত্রীর স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রয়েছে ৫ কোটি টাকার কিছু বেশি। দান সূত্রে পাওয়া তার একটি গাড়ি রয়েছে। তার কাছে থাকা স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু ও পাথরনির্মিত অলঙ্কারাদির মূল্য ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। আসবাবপত্র রয়েছে ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকার। (সূত্রঃ  দৈনিক মানবজমিন ২২ ডিসেম্বর ২০১৩)
মাহবুব উল আলম হানিফ
দলীয় ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পাওয়ার পর মাহবুব উল আলম হানিফ তার প্রভাব কাজে লাগিয়ে অনেকগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিপুল সম্পত্তির মালিক হন। এর মধ্যে নিজের নামে নিবন্ধিত ও ব্যাংকে গচ্ছিত সম্পত্তির হিসাব হলফনামায় উল্লেখ করলেও এর বাইরে বেনামে ও আত্মীয়-স্বজনের নামে বিপুল সম্পত্তি কিনেছেন বলে অভিযোগ আছে।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করা হয় যে, বড় বড় সরকারি ক্রয়, টেন্ডার ও লেনদেনের ক্ষেত্রে হানিফ তাঁর প্রভাব কাজে লাগিয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। এ ছাড়া সরকারি প্রকল্পে নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে তদবিরকারী হিসেবে বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরে আলোচিত-সমালোচিত হন তিনি।
শামসুল হক টুকু
বিগত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর আইন পেশা থেকে বার্ষিক আয়ের উল্লেখ ছিল না হলফনামায়। ২০০৮ সালে আইন পেশা থেকে তার আয় ছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। দানসূত্রে তিনি ২৫ লাখ টাকার ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। নিজের ও স্ত্রীর নামে পোস্টাল ও সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ হয়েছে ১ কোটি ৮৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪২ টাকা। পূর্বে এ ধরনের কোন বিনিয়োগ তার ছিল না। পূর্বে তার ব্যাংকের কাছে কোন প্রকার দায় না থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তার দায় রয়েছে ৬৫ লাখ ৬৭ হাজার ৪০৯ টাকা।
ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা
সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্ (ঢাকা-১৬ আসন) পাঁচ বছর আগে কৃষি থেকে ২১ লাখ টাকা আয় করলেও এখন কৃষি থেকে তার কোনো আয় নেই। ব্যবসা থেকে তার আয় ছিল ৩০ লাখ টাকা। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। এ টাকা তিনি মৎস্য প্রকল্প থেকে আয় করেছেন। আগে বাড়িভাড়া থেকে কোনো আয় না হলেও বর্তমানে ২৮ লাখ টাকার বেশি আয় করেন। বর্তমানে মোল্লাহর মোট বার্ষিক আয় পাঁচ কোটি ৪২ লাখ ১৭ হাজার ৯৫৬ টাকা।
পাঁচ বছর আগে ইলিয়াস মোল্লাহর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল এক কোটি পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। পাঁচ বছরে তা বেড়ে হয়েছে সাত কোটি ৮৮ লাখ ৭১ হাজার ৯৩৩ টাকা। আগে কোনো গাড়ি না থাকলেও এখন তিনি দুটি গাড়ির মালিক। এর আগের হলফনামায় স্ত্রী বা নির্ভরশীলের নামে ৭৫ লাখ নগদ টাকা দেখানো হলেও এবারের হলফনামায় স্ত্রীর নামে কোনো নগদ অর্থ দেখানো হয়নি।
আব্দুল মান্নান খান
একসময়ের বাম রাজনীতি করা সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী (ঢাকা-১) আব্দুল মান্নান খান পাঁচ বছরেই অস্বাভাবিক অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনকে তিনি যে হলফনামা দিয়েছিলেন, তাতে দেখা যায়, নিতান্তই সাধারণ জীবনযাপন করতেন তিনি। কিন্তু পাঁচ বছরেই ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে তার।
২০০৮ সালে এই আয় ছিল ২৬ লাখ ২৫ হাজার, নির্ভরশীলদের কোনো আয়ই ছিল না। পাঁচ বছর পর তিনি ও তাঁর স্ত্রী বা অন্য নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় হয়ে গেছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।
আয়ের তুলনায় আব্দুল মান্নান খানের পরিবারের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে বহুগুণ। পাঁচ বছর আগে তাঁর সম্পদ ছিল প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকার। আর এখন সেই সম্পদ হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকার। পাঁচ বছরে ১০৭ গুণ বেশি সম্পদ বাড়ার এটি একটি নতুন রেকর্ড।
আব্দুল মান্নান খানের আয়ের বড় উৎস হচ্ছে মৎস্য ও প্রবাসী-আয়। এখান থেকে তাঁর আয় এক কোটি ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। একই খাতে তিনি নির্ভরশীলদের আয় দেখিয়েছেন এক কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এই আয়ের কোনো বিস্তারিত বিবরণ তিনি কোথাও দেননি।
মান্নান খানের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-নিজের ও স্ত্রীর কাছে নগদ ৫৫ লাখ টাকা, সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানত হিসেবে নিজের নামে ৪৩ লাখ ও স্ত্রীর নামে সাড়ে ছয় লাখ টাকা এবং ৪৪ লাখ টাকা মূল্যের একটি গাড়ি।
মান্নান খানের স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে  পৈতৃক সূত্রে পাওয়া পাঁচ একর কৃষিজমি। এ ছাড়া নিজ নামে ৩১ লাখ ৭৪ হাজার এবং স্ত্রীর নামে এক কোটি ৬৪ লাখ টাকার অকৃষি জমি রয়েছে। তার আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের মূল্য এক কোটি ৮১ লাখ টাকা। অ্যাপার্টমেন্টের দাম এক কোটি ৮১ লাখ টাকা। মাছের খামার পাঁচটি থাকলেও তার মূল্যমান উল্লেখ করেননি।
হাছান মাহমুদ
পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা হাছান মাহমুদের স্ত্রী নুরান ফাতেমা ৫ বছর আগে সাধারণ একজন গৃহিণী ছিলেন। সে সময় তার সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু বেড়ে পৌঁছেছে ১৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকায়। হাছান মাহমুদের সর্বশেষ পেশ করা আয়কর বিবরণী অনুযায়ী, ২০০৮ সালে তিনি ৩৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকার মালিক ছিলেন, যা ৪ গুণ বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ টাকায়। তিনি আরও দাবি করেছেন, স্ত্রী ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে তিনি ধার হিসেবে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা নিয়েছেন। অর্থাৎ এ দম্পতির মোট স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ এখন ১৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে দুই জনের মিলিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৮ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা গত ৫ বছরে ৪০ গুণ বেড়েছে।
হাছান মাহমুদের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ ছয় লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা আট লাখ, নয় লাখ টাকার শেয়ার, ৬৬ লাখ টাকার একটি গাড়ি ইত্যাদি। তার স্ত্রীর কাছে রয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ টাকার শেয়ার। ২০০৮ সালে তার স্ত্রীর কাছে নগদ ও ব্যাংকে জমা মিলিয়ে মোট ৬০ হাজার টাকা ছিল, কোনো স্থাবর সম্পত্তি ছিল না। বর্তমানে তার স্থাবর সম্পত্তির দাম চার কোটি টাকার মতো।
নজরুল ইসলাম বাবু
আওয়ামী লীগের এমপি নজরুল ইসলাম বাবু ও তার স্ত্রী গত ৫ বছরে তাদের সম্পদের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৭৮ গুণ বৃদ্ধি করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি যে হলফনামা পেশ করেছিলেন, তাদের স্থাবর ও অস্থাবর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। কিন্তু ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নির্বাচন কমিশনে পেশ করা আয়কর বিবরণী অনুযায়ী গত ৫ বছরে এ দম্পতির যৌথ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকায়।
জাহাঙ্গীর কবির নানক
আওয়ামী লীগ নেতা ও এলজিআরডি মন্ত্রী (ঢাকা-১৩ আসন) জাহাঙ্গীর কবির নানকের নামে বিভিন্ন সময়ে ১৪টি মামলা ছিল। বর্তমান সরকারের মেয়াদে তিনি সব মামলা থেকে অব্যাহতি অথবা খালাস পেয়েছেন। মন্ত্রী হওয়ার পর পাঁচ বছরে তিনিও যথেষ্ট সমৃদ্ধিশালী হয়েছেন। তবে তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন তার স্ত্রী। পাঁচ বছর আগেও এই দম্পতির সম্পদ ছিল এক কোটি টাকারও কম। এখন সেই সম্পত্তির পরিমাণ হয়েছে সোয়া আট কোটি টাকা। এর মধ্যে স্ত্রীর সম্পদ হচ্ছে পাঁচ কোটি টাকা। অথচ এর আগের হলফনামা অনুযায়ী সাবেক প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রীর ছিল মাত্র ৫২ লাখ টাকা।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তাদের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে নানকের স্ত্রীর সম্পত্তির পরিমাণ ৫ কোটি ৭ লাখ টাকা, যা ৫ বছর আগে ছিল ৫২ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে তাদের বার্ষিক আয় ছিল ৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তা দাঁড়ায় ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার টাকায়। অর্থাৎ এ দম্পতি যৌথভাবে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ ৮ গুণ বৃদ্ধি করেছেন।
জাহাঙ্গীর কবির নানকের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে নগদ ১১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ব্যাংকে জমা ৩৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা এবং সঞ্চয়ী আমানত ২৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা তার যানবাহনের আর্থিক মূল্য ৬৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া তার স্ত্রীর নামে নগদ ৮১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা, ব্যাংকে ৭৯ লাখ, পুঁজিবাজারে এক কোটি ৪৪ লাখ টাকার শেয়ার এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আছে এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল সাত লাখ ৪৩ হাজার টাকা। একই সময়ে তিনি ও তার স্ত্রীর কাছে নগদ ছিল ১১ লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা ছিল আড়াই লাখ, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ছিল ছয় লাখ টাকা।
নানকের স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে কৃষিজমি দুই একর (মূল্য অজানা)। তাদের আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের দাম এক কোটি ৩০ লাখ, স্ত্রীর নামে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের মূল্য ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অগ্রণী ব্যাংকে তাদের দেনার পরিমাণ দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে তার কোনো বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবনের উল্লেখ ছিল না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads