বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

শেষ নাটকটিও ফপ!


রাজনীতির বড় পুঁজি আত্মবিশ্বাস ও বিশ্বাসযোগ্যতা। বিশ্বাসযোগ্যতা মৌলিক মানবীয় গুণাবলি দিয়ে অর্জন করতে হয়। আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়ার জন্য একটি আদর্শিক চেতনা লালন করা জরুরি। আদর্শ জন্ম নেয়ার জন্য একটি ধার্মিক মন থাকা প্রয়োজন। সেই ধার্মিক মন সৃষ্টির জন্য গতানুতিক ধর্মবিশ্বাস না হয়ে মানবিক ধর্মও হতে পারে। মানবিক গুণাবলি অর্জন করতে হলে নিজের বিবেকের কাছে তো বটেই যেকোনো আদর্শিক ভাবনার কাছে একটি জবাবদিহিতা থাকতে হয়। কুপ্রবৃত্তি মানুষকে অসৎপ্রবণ হতে উৎসাহী করে। সু এবং কুর ধারণার উৎস মানুষের মগজ নয়। তবে বিবেককে কাজে লাগাতে মগজের ভূমিকা অপরিহার্য। মনের তাড়না মগজের সিগন্যালের মাধ্যমে কার্যকর হয়। মানুষকে চালায় মন না মগজ, এ বিতর্ক এখানে তোলা যাক।

কেন যেন মনে হয় আমাদের ক্ষমতাসীনদের মগজ বিগড়ে গেছে, নয়তো পচে গেছে। কারো কারো বিবেক মরে গেছে। বাইবেলসহ অন্যান্য ধর্মগ্র্রন্থে এ বিষয় সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ বক্তব্য রয়েছে। তাতে বলা আছে- ওদের চোখ থাকবে কিন্তু দেখবে না, ওদের কান থাকবে কিন্তু শুনবে না, ওদের মগজ থাকবে কিন্তু বুদ্ধির জোগান দেবে না। আমাদের জাতীয় জীবন এবং রাজনীতির ধারা প্রকৃতি নিয়ে মন্তব্য করতে গেলে রূঢ় শব্দ চয়নের যেন কোনো বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্য, আমাদের জাতীয় নেতাদের কঠিন, কঠোর ভাষা ও শব্দে নিন্দা, সমালোচনা ও পরামর্শ দিয়েও আশাবাদী হতে পারছি না।

গত বেশ কিছু সময় ধরে আমরা বলে আসছি, ক্ষমতার বরফ গলে গেছে। এ যাত্রায় আর জমাট বাঁধবে না। এর জন্য প্রতিপক্ষকে দায়ী করে লাভ নেই। বিরোধী দল না থাকলেও বর্তমান সরকার নিজের দোষের ভারে কুপোকাত হয়ে যাবে। এই দোষ দশটা ভালো কাজ দশটা মন্দ কাজের বিষয় নয়। বিষয়টা জাতীয় ঐক্য ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। যেকোনো সরকার ভালো-মন্দের মিশ্রণে পরিচালিত হয়। জনগণ সব কর্ম-অপকর্মের সাক্ষী। তারা রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করতে যাবে না। কিন্তু ব্যালট পেপার হাতে পেলে প্রতিবাদের ভাষা প্রয়োগ করতে কার্পণ্য করবে না। জনগণের বিবেচনার বিষয় কিছু সাফল্য আর বেশির ভাগ ব্যর্থতারও ব্যাপার নয়। একেবারে মৌলিক প্রশ্নে সরকার জনগণকে বোকা ভেবে ও আহম্মক বানিয়ে দেশটাকে উল্টো দিকে ঠেলে নিতে চেয়েছে। 

এক সময়ের ছাত্রনেতা, বর্তমানের এক মন্ত্রীর ভাষায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতাই উপজেলা নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ। নিজের ও দলের রাজনীতিকে সেইফ করে এ ধরনের বক্তব্যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আছে, কিন্তু সঙ্কটের সমাধান নেই। মন্ত্রী প্রবর উপসর্গকে রোগ ভাবছেন, আসল রোগ চিহ্নিত করছেন না। এই সরকারের সামগ্রিক অনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নিচ্ছেন না। তারপরও প্রধানমন্ত্রী, দলীয় নেত্রী ও অন্যরা বাগাড়ম্বর না করে এতটুকুন বিষয়ে অকপট স্বীকৃতি দিয়ে ক্ষমতা ছাড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে ভালো করতেন। কে না জানে, পুরো ক্ষমতার মেয়াদে ছাত্রলীগ দাপটের সাথে অস্ত্রের মহড়া ও ক্ষমতার ঝাঁজ দেখিয়ে বেড়িয়েছে। যুবলীগ টেন্ডারবাজি আর বিরোধী দল দাবড়িয়ে বিরানি খেয়ে সময় কাটিয়েছে। আওয়ামী লীগ মাতোয়ারা ছিল নানা উপায়ে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণে। লেহন, চর্বণ ও চাটাচাটি ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর দফতর আওয়ামী লীগ অফিসের বর্ধিত অংশ হিসেবে কাজ করেছে, এখনো করছে। সরকার ও দলের মধ্যে এক সুতা পরিমাণও ফারাক রাখা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর দলীয় ক্যাডারদের মধ্যে সখ্য এতই দৃষ্টিকটু ও লজ্জাকর- মানুষ তা দেখেও লজ্জা পেয়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার লজ্জা পায়নি। আজো পাচ্ছে না।

তুলনাটা অসম কিন্তু প্রাসঙ্গিক। ১৪ ডিসেম্বর আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি। এবার থেকে প্রতিদিন ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী হত্যা দিবস পালন করতে হবে। টার্গেট করে এভাবে প্রতিপক্ষকে গুম করে ফেলা, হত্যা করার আংশিক নজির ৭৪ ও ৭৫ সালের সাথে তুল্য। তখন টার্গেট ছিল- সিরাজ সিকদার ও চৈনিক ধারার বামপন্থী, জাসদ কর্মী ও গণবাহিনীর সদস্য। এখন টার্গেট বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতা-কর্মীরা।

ভাবতেও কষ্ট হয়। দেখে লজ্জাও পাই। আওয়ামী বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী ও মিডিয়া সংশ্লিষ্টদের এবারই প্রথম লক্ষ করলাম অতিমাত্রায় ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের ধারক-বাহক হিসেবে। এত অনাচার, অনিয়ম, মানবাধিকার দলন, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ তাদের চোখে পড়ে না। ভাবখানা এমন কোনো কোনো দলের নেতা-কর্মীদের কোনো অধিকার থাকতে নেই। সরকারি দলের বিভিন্ন পার্শ্ব সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজির হাত থেকে মহল্লার পান-বিড়ির দোকানিও রেহাই পাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয় নেই। হালের সাংস্কৃতিক কর্মীরা মূলত বামপন্থী ঘরানার প্রতিনিধি। তারা আওয়ামী লীগের ওপর ভর করেছে; ঘর করছে। তারা এতটা বাড়াবাড়ি করেছে যা সাধারণের দৃষ্টি এড়ায়নি। আবহমান বাংলার বিশ্বাস বিধৌত ঐতিহ্যকে তারা চুরমার করে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার কিন্তু বিশ্বাসের ধারক-বাহক এই বাঙালি সমাজ আবার বুঝল বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু নামে আলাদা একটা পরিচয় আসলেই আছে। তার সাথে পরগাছা সংস্কৃতির লালনপালনকারী একটা ক্ষুদ্র অবিশ্বস্ত গণবিচ্ছিন্ন বামপন্থীও আছে। একটি বিশেষ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অতি উৎসাহ ও বাড়াবাড়ি দৃষ্টিকটুভাবে আগবাড়িয়ে চলার ঢঙ আমাদের সামাজিক বৈশিষ্ট্যকেও এবার চ্যালেঞ্জ করেছে। এই বাড়াবাড়ির জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কতটা দায়ী সেটা আওয়ামী লীগ ভাবুক, সাধারণ মানুষ কিন্তু এ ধরনের বাড়াবাড়ি মেনে নেয়নি। এর সাথে সাম্প্রদায়িকতা কিংবা সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু বিভাজনের কোনো সম্পর্ক নেই।

এখনো যেই কাঠামোতে উপজেলা ব্যবস্থা রয়েছে, সেই কাঠামোর উপজেলা নির্বাচন অত্যন্ত গৌণ বিষয়। জনগণের জাতীয় মানস ও হৃদয়স্পন্দন বুঝার জন্য সিটি করপোরেশন এবং উপজেলা নির্বাচন কোনো মুখ্য বিষয় নয়। তবে এ সময়ের প্রেক্ষাপটে এর জাতীয় তাৎপর্য রয়েছে। আমরা সরকারি দল ও বিরোধী দলকে বারবার একটা বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছি, আপনারা কেউ মৌলিক বিষয় নিয়ে ভাবছেন না। ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ ভাঙা-গড়ার খেলায় মত্ত। বিরোধী দল রক্ষণভাগে বসে ক্ষমতার জন্য ভিন্ন ধরনের খেলায় রত। সরকার ও বিরোধী দল কারো উচিত নয় এ দেশের ডেমোগ্রাফি বা জনমিতি পাল্টে দেয়া। কারো এতটা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করা উচিত হবে না, যাতে মানুষের বিশ্বাসকে আহত করে। এতটা দুঃসাহসও দেখানো উচিত নয়, যাতে আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধগুলো হোঁচট খায়। তা ছাড়া মানুষের প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলো ক্ষমতার জোরে উপড়ে ফেলানোর অভিজ্ঞতা কখনো সুখকর হয় না। দেশকে ইতিহাসের মৌলিক গ্রন্থি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া কিংবা ইতিহাসকে পেছনে ঠেলার খেসারতটা সব সময় বড় হয়ে যায়। কারণ তাতে মানুষ নিজেকে বিপন্ন বোধ করে। বাহাত্তরে ফিরে যাওয়ার নাম করে সরকার যা যা করেছে তা সরকার ও দলকে লাভবান করেনি। চার মূলনীতি নিয়েও জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে। আল্লাহর ওপর আস্থার বিষয়টি সরকার যতটা হাল্কাভাবে দেখে, জনগণ দেখে একেবারে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

আওয়ামী লীগ আমাদের রাজনৈতিক ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দল, ঐতিহ্যবাহীও। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ তার দলীয় বৈশিষ্ট্য লীন করে দিয়েছে। দলীয় মৌলিকত্বও বিসর্জন দিয়েছে। মূলত মডারেট দলের অবস্থান পরিবর্তন করে তারা নীতিভ্রষ্ট বামপন্থীদের জায়গা করে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করেছে। ওবায়দুল কাদেররা রাস্তা দেখভালে ব্যস্ত। আর ওবায়দুল কাদের জানেন না তার সমসাময়িক এক বাম ছাত্রনেতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সিলেবাস, নীতি, পাঠ্যসূচি ও মাদরাসা শিক্ষাকে কিভাবে তছনছ করে দিয়েছে। ওলট-পালট করে দিয়েছে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা। আমরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের চেয়ে নিজেদের বেশি বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও দলের বেশি সুহৃদ মনে করি না। এ কারণেই আমাদের পরামর্শের চেয়ে মূল্যায়নটা বেশি। প্রেসক্রিপশনের চেয়ে মন্তব্য অধিক। প্রবীণ আওয়ামী লীগাররা লাইমলাইটে নেই। তার ওপর আমাদের চেনাজানা আওয়ামী লীগও আর নেই। এই আওয়ামী লীগ শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও ওসমানীকে মূল্যায়ন করছে না। আওয়ামী লীগের বিদেশনীতি জাতির জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনেনি। আগেও উল্লেখ করেছি, একটি ক্ষমতাসীন দল সব ভালো কাজ করে না। তার ওপর কিছু ভুল করতেই পারে। তা ছাড়া দল হিসেবে নিজস্ব কিছু এজেন্ডাও থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ নিজ দলের ও দেশের জনগণের কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে বলে জনগণ মনে করে না। টেকসই উন্নয়ন ছাড়াও কিছু মনোলোভা কসমেটিক উন্নয়ন ও ডিজিটাল ভাবনা অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। এটা সব কিছু নয়, তবুও সমর্থনযোগ্য। ওবায়দুল কাদের দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা আবিষ্কার করেছেন, অথচ দলীয় ভুলগুলো চিহ্নিত করলে তারা আসলেই ভালো করবেন। এখনো কোনো প্রকৃত আওয়ামী লীগার বিএনপি-জামায়াত হয়ে যায়নি। বসন্তের কোকিল ও বাম অনুপ্রবেশকারী ছাড়া নতুন কোনো লোক আওয়ামী লীগে যোগও দেয়নি। বস্তুত আওয়ামী লীগ নৌকা ও ব্যানার ভাড়া দিয়ে দেউলে হয়ে গেছে। তারা ভেবে দেখেনি নেংটি ইঁদুর ঘরে ঢুকে মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তার সব বীজ সাবাড় করে ফেলছে। সেই সাথে ইতিহাসের নিবিড় বন্ধনের সুতাও কেটে দিয়েছে। তাতেই জনগণ পনেরআনা বিগড়ে গেছে। অবশিষ্টটুকু অনাচারের খেসারত। এটাই আমাদের গুণগত রাজনীতির জন্য দুঃসংবাদ। আমরা ক্ষমতায় ও ক্ষমতার বাইরে আওয়ামী লীগকেও বারবার দেখতে চাই, তবে আওয়ামী লীগকে, রূপান্তরিত ও অপভ্রংশকে নয়। আওয়ামী লীগকেই ঠিক করতে হবে- তারা জাতীয় ঐক্য ও সমৃদ্ধি চায়, না ভাড়াটে শাসকের খাতায় নামটা চিরস্থায়ী করতে চায়।

আলকায়েদা ইস্যুটি ছিল দুর্বল প্রযোজনা ও অদক্ষ পরিচালনার আনকোরা গ্রন্থনার নাটক, যার কারণে বিশ্বাসযোগ্য করা যায়নি। ফপ মেরেছে। আদালতের কাঠগড়া থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও আরেক নাটক। পুলিশকে বিরোধী দল ও মত দমনের জন্য এভাবে ঠেঙ্গাড়ে বাহিনীতে রূপান্তর করলে কোনো নাটকই সফলভাবে মঞ্চায়ন করা যায় না। কারণ, মিথ্যা ও অপরাধ চিহ্ন রেখে যায়-  এটাকেই বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এবার জেএমবি নাটকও বিশ্বাসযোগ্য করা সম্ভব হয়নি। মুম্বাইয়া ফিল্মি স্টাইলের নাটকটির প্রযোজনা- পরিচালনা ও চিত্রনাট্যই শুধু দুর্বল নয়, কাহিনীটাই দুর্বল গাঁথুনির। এটা বিশেষ মহলের সিম্প্যাথি পেতে এবং জঙ্গীবাদ আসিলো আসিলোস্লোগানকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সাহায্য করেনি। এর মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিধি বাড়ালমাত্র। এভাবে সিদ্ধি লাভ সম্ভব নয়। আবার স্মরণ করিয়ে দেবো- কোনো ভালো কাজ খারাপ পদ্ধতিতে হয় না। প্রতারণা, শঠতা ও অতি চালাকি দিয়ে জনগণের মনও জয় করা যায় না, নির্বাচনে জয়ও নিশ্চিত হয় না। অতএব প্রতারণা করবেন না। প্রতারিত হবেন না।

মাসুদ মজুমদার


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads