শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

অনুপ চেটিয়া এবং ভারতের ‘আশ্বাস’ ও ‘আগ্রহ’


বাংলাদেশে বন্দী আসামের স্বাধীনতা সংগ্রামী উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়েছে সরকার। গত ৩ সেপ্টেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের সচিব পর্যায়ের ১৫তম বৈঠক শেষে এটা ঠিক ‘বন্দী বিনিময়’ নয় বলে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন, অনুপ চেটিয়াকে দ্রুতই ভারত সরকারের কাছে তুলে দেয়া হবে। আওয়ামী লীগ সরকার আগ বাড়িয়ে সিদ্ধান্তটি নিলেও অন্যদিকে ভারত কিন্তু তেমন কোনো আশার কথা শোনায়নি। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামী নূর হোসেনসহ ভারতে অবস্থানরত চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ সাড়া দেয়নি। আমাদের স্বরাষ্ট্র সচিব অবশ্য বলেছেন, তার প্রতিপক্ষ নাকি নূর হোসেনদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ‘আগ্রহ’ দেখিয়েছেন এবং ‘আশ্বাস’ দিয়েছেন। ব্যাস, এটুকুই। এতেই যারপরনাই খুশি হয়েছেন স্বরাষ্ট্র সচিব এবং বাংলাদেশ পক্ষের অন্য সদস্যরা। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, সীমান্তে হত্যা বন্ধ থেকে তিস্তা চুক্তি পর্যন্ত কোনো একটি বিষয়েই বাংলাদেশ সামান্য অর্জন করতে পারেনি। অবশ্য ‘আশ্বাস’ও শুনেছেন তারা যথারীতি।
ঘটনাপ্রবাহে প্রাধান্যে এসেছে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তটি। রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্বেগও যথেষ্টই ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হলো, অনুপ চেটিয়া সাধারণ কোনো বিদেশী নন। আসামের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন উলফা’র সাধারণ সম্পাদক তিনি। দিল্লীর বৈষম্যের শিকার অহমীয়রা ১৯৭৯ সালের এপ্রিল থেকে উলফার নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চালাচ্ছেন। অনুপ চেটিয়া তাদের নেতা। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর আদাবর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার তাকে তখনই ভারতের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হয়ে পড়ায় এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠায় পারেনি। পরে অনুপ চেটিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি পৃথক মামলায় তাকে মোট সাত বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছিল। কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হলেও তার মুক্তি বিলম্বিত হওয়ার কারণ, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার জন্য আবেদন করেছিল। এ সম্পর্কিত রিট আবেদনের এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এমন এক অবস্থার মধ্যেও ভারত অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দেয়ার দাবি তুলেছে, আওয়ামী লীগ সরকারও সম্মত হয়েছে। স্মরণ করা দরকার, ২০১১ সালের আগস্টে মাত্র ২৪ ঘণ্টার সফরে এসে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার দাবি প্রথমে আদায় করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন তাকে আইনগত সমস্যার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে প্রতিটি বিষয়ে সহযোগিতা করতে ‘প্রস্তুত’। কথাটা পি চিদাম্বরমেরও জানা না থাকার কারণ ছিল না। কেননা, তিনি বিরাট দেশ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সেদেশের কোনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই এ পর্যন্ত আমাদের কারো কারো মতো ফালতু কথাবার্তার জন্য অপদার্থ হিসেবে চিহ্নিত ও নিন্দিত হননি। মিস্টার চিদাম্বরম সুনির্দিষ্টভাবেই জানতেন, অনুরোধের আড়ালে ভারতের ইচ্ছাপূরণের জন্য সাহারা খাতুনরা ‘এক পায়ে খাড়া’ অবস্থায় রয়েছেন। থাকবেনও। সে কথাটারই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে এতদিন পর- যদিও এর মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটেছে। কংগ্রেসের স্থলে সরকার গঠন করেছে বিজেপি। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশের ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে নীতি ও কৌশলগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অন্যদিকে বন্দী নেতা অনুপ চেটিয়া আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, ভারতের কাছে তুলে দেয়া হলে ভারত সরকার সাজানো মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যা করবে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বলা হচ্ছে, সরকার সত্যিই যদি অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয় তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ তীব্র নিন্দা-সমালোচনার মুখে পড়বে। আইনের দিক থেকে উঠবে আদালত অবমাননার প্রশ্নও।
তাছাড়া রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার অর্থ হবে বিশ্বের দেশে দেশে চলমান মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে এ ধরনের পদক্ষেপ বিশ্ববাসী আশা করে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবেও বাংলাদেশ অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দিতে পারে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই অনুপ চেটিয়া আসামে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশীদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং তার মতো বাংলাদেশের একজন প্রকৃত বন্ধু ও স্বাধীনতা যোদ্ধাকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে না। তা সত্ত্বেও আমাদের উদ্বেগের কারণ হলো, পেছনে শর্ত রয়েছে বলেই বর্তমান সরকার সব কাজ ফেলে শুধু ভারতের ইচ্ছা পূরণের জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সেটাও প্রথম থেকেই। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আসামের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত সংগঠন উলফা’র চেয়াম্যান অরবিন্দ রাজখোয়ার কথিত আত্মসমর্পণ নিয়ে রহস্যময় ঘটনাপ্রবাহ হঠাৎ নাটকীয় মোড় নিয়েছিল। এর কারণ, ভারতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের সকল খবরেও বলা হয়েছিল, অরবিন্দ রাজখোয়া কক্সবাজারে ধরা পড়েছেন। অর্থাৎ তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, ১ ডিসেম্বর কক্সবাজারে গ্রেফতার করার পর ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার তাকে বিএসএফের হাতে তুলে দিয়েছে। কিন্তু দু’দিন না যেতেই নাটকীয়ভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা শুনিয়েছিল ভারত সরকার। সেদেশের পররাষ্ট্র সচিব জি কে পিল্লাই বলে বসেছিলেন, রাজখোয়াকে বাংলাদেশে গ্রেফতার করা হয়নি। তিনি সীমান্তে বিএসএফের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন! কিভাবে কি ঘটেছিল সে সম্পর্কেও কিছুই খোলাসা করেননি পররাষ্ট্র সচিব। তার পরিবর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস কে মিশ্র জানিয়েছিলেন, বিস্তারিত তিনি লোকসভায় জানাবেন। সে সময় দৃশ্যপটে সবশেষে এসেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম- যার আসলে প্রথমে আসার কথা। উল্লাসিত অবস্থায় সাংবাদিকদের তিনি ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ‘সুখবর’ যথাসময়ে জানানো হবে! এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও দারুণ শুনিয়েছিলেন। তিনি একেবারে ঝেড়ে-পুছে বলেছিলেন, রাজখোয়াকে নাকি বাংলাদেশে গ্রেফতার করা হয়নি। সুতরাং ভারতীয়দের হাতে তাকে তুলে দেয়ারও প্রশ্ন উঠতে পারে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফ কথা ছিল, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবর ঠিক নয়!
এখানেই রহস্যের সৃষ্টি হয়েছিল। এর কারণ প্রথমত, অরবিন্দ রাজখোয়ার কথিত আত্মসমর্পণের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমে জানিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জি কে পিল্লাই। অথচ বিষয়টি ছিল বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন এবং  সত্যিই রাজখোয়া আত্মসমর্পণ করে থাকলে তা প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই জানানোর কথা। তার পরিবর্তে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জানানোয় পরিষ্কার হয়েছিল, এর সঙ্গে পররাষ্ট্র বিষয়ক তথা বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও যোগসাজশের বিষয় জড়িত রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস কে মিশ্রও রহস্য ঘনীভূত করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। বলেছিলেন, সবকিছু লোকসভায় খুলে বলবেন তিনি। এর ফলে ধরে নেয়া হয়েছিল, ওই গ্রেফতারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল বলেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জড়িয়ে পড়েছিল। এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রেফতার ও হস্তান্তরের কথা অস্বীকার করলেও তার গলায় তেমন জোর ও ধার লক্ষ্য করা যায়নি! এখানে পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজারের একটি রিপোর্টেরও উল্লেখ করা দরকার। ৪ ডিসেম্বর (২০০৯) দৈনিকটি লিখেছিল, রাজখোয়া নাকি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের ‘মধ্যস্থতায়’ গ্রেফতারবরণ করেছিলেন! এনএসআইয়ের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ করেই তিনি নাকি কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। সেখানে নাকি সাক্ষী হিসেবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একজন প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন! ঘটনা সত্য বা মিথ্যা যাই হোক না কেন, আনন্দবাজারের রিপোর্টে একথা অন্তত পরিষ্কার হয়েছিল যে, রাজখোয়াকে বাংলাদেশেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা গিয়েছিল, অরবিন্দ রাজখোয়া এবং উলফার সামরিক শাখার উপপ্রধান রাজু বড়–য়া আসলে কক্সবাজার হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমারে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আগে থেকে আয়োজনের ভিত্তিতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর লোকজন তাদের অনুসরণ করে এবং এনএসআইয়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তাদের আটক করে। রাজখোয়ার সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে, দেহরক্ষী এবং কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে গ্রেফতার হওয়া শশধর বড়ুয়ার স্ত্রী-সন্তানসহ ১০ জন। কক্সবাজারে গ্রেফতার করার পর মেঘালয় রাজ্যের ডাউকিতে বিএসএফের ঘাঁটিতে নেয়ার আগে র-এর গোয়েন্দারা রাজখোয়াকে চট্টগ্রামে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। পরে ভারতীয় পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার আগে বিএসএফও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। হিন্দুস্থান টাইমসের ৩ ডিসেম্বরের খবরে বলা হয়েছিল, রাজখোয়ার স্ত্রী কাবেরী কাচারী ও দুই ছেলে বাংলাদেশে গৃহবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। হিন্দুস্থান টাইমস আরো জানিয়েছিল, স্বাধীনতাকামী আরেক সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা- এনএলএফটির নেতা বিশ্ব মোহন দেব বর্মাকেও আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। একযোগে চলছে উলফার কমান্ডার ইন চিফ পরেশ বড়ুয়াকে গ্রেফতার করার চেষ্টা। জানা গেছে, ওই বছরের জুলাই-আগস্টের দিকে পরেশ বড়–য়া নাকি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রথমে মিয়ানমার এবং সেখান থেকে ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড হয়ে চীন বা পাকিস্তানে গেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগিতায় র-এর গোয়েন্দারা পরেশ বড়ুয়ার পেছনে লেগে ছিল। উল্লেখ্য, পরেশ বড়ুয়ার স্ত্রী ও কন্যা খুবই ধর্মপরায়ণ মুসলমান এবং সে কারণে উলফার এই নেতাকে গ্রেফতারের জন্য ‘র’ সর্বাত্মক তৎপরতা চালিয়েছিল।
অরবিন্দ রাজখোয়ার গ্রেফতারের খবরের পাশাপাশি অন্য কিছু খবরও সে সময় প্রকাশ্যে এসেছিল। এরকম একটি প্রধান খবর হলো, ভারত সরকারের নির্দেশনায় আওয়ামী লীগ সরকার উলফাসহ ভারতের স্বাধীনতাকামীদের ওপর রীতিমতো ‘ক্র্যাকডাউন’ করেছিল। উলফা ছাড়াও এনএলএফটির কয়েকজন নেতাকেও সরকার ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল। উল্লেখ্য, রাজখোয়ার গ্রেফতারই  প্রথম ঘটনা নয়। তার আগের মাস অর্থাৎ ২০০৯ সালের নভেম্বরে উলফার অন্য দু’জন নেতার গ্রেফতারকে ঘিরেও একই ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছিল। তখনও ভারত সরকার দাবি জানিয়েছিল, উলফা’র পররাষ্ট্র বিষয়ক সম্পাদক শশধর চৌধুরী এবং অর্থ সম্পাদক চিত্রাবন হাজারিকা নাকি ওই বছরের ৪ নবেম্বর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ত্রিপুরার বিএসএফ আউটপোস্টে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন! অন্যদিকে উলফা’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, রাজধানী ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি বাসা থেকে ১ নবেম্বর তাদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের আইজি ও র‌্যাবের ডিজি পর্যন্ত প্রত্যেকে এক সুরে বলেছিলেন, তারা নাকি এ ব্যাপারে ‘কিছুই’ জানেন না! অন্যদিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলেছিল, বাংলাদেশই দুই উলফা নেতাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকায় গ্রেফতার না দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতে তাদের ‘পুশ ব্যাক’ করেছে! এদিকে সরকার অস্বীকার করায় প্রশ্ন উঠেছিল, তাহলে বাংলাদেশ থেকে কারা তাদের গ্রেফতার করেছিল? অমন প্রশ্ন ওঠার কারণ, উলফা জানিয়েছিল এবং অন্য কিছু সূত্রেও জানা গিয়েছিল, দু’জনকে ঢাকা থেকেই ধরে নিয়ে গেছে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন। এই সাদা পোশাকধারীরা যদি বাংলাদেশের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য না হয়ে থাকে তাহলে তারা কারা ছিল? সত্যিই তারা ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন কি না, সে প্রশ্নও উঠেছিল। কারণ, উলফা’র মতো সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত সংগঠনের এত উচ্চ পর্যায়ের দু’জন নেতা আত্মসমর্পণ করতে পারেন না। এই প্রেক্ষাপটে তখন বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যেহেতু বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই সেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করতে পারেনি। ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল অলিখিতভাবে, ভারত যাকে ‘পুশ ব্যাক’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। অরবিন্দ রাজখোয়ার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা লক্ষ্যণীয় হয়েছিল। সেবারও সরকার নিজে গ্রেফতার করে ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়ার কথা স্বীকার করতে চায়নি। সরকারের দাবি সত্য হওয়ার অর্থ ছিল, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর লোকজনই তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল। কারণ, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম পরিষ্কার ভাষায় জানিয়েছিল, রাজখোয়াদের গ্রেফতার করা হয়েছে কক্সবাজারে। এটা সত্য হলে কিন্তু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন থাকে না। সত্য যেটাই হোক না কেন, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে একই কায়দায় উলফার শীর্ষ নেতা রাজখোয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার ঘটনায় সচেতন মানুষ মাত্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। এখানে অন্য একটি দিকও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করা দরকার। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, শশধর বড়ুয়া ও চিত্রবন হাজারিকার মতো রাজখোয়াকেও আসলে ‘র’-এর গোয়েন্দারাই ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এটা অবশ্য প্রমাণিত সত্য যে, বাংলাদেশে ‘র’-এর ব্যাপক তৎপরতা রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সে তৎপরতা অনেক জোরদার হয়েছে। এর প্রথম প্রমাণ পাওয়া গেছে পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডের
ঘটনায়। কিন্তু বিষয়টি যাতে জনগণের পর্যায়ে জানাজানি না হয় সেজন্যই উলফা নেতাদের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণের নাটক সাজানো হয়েছিল। সত্য যেটাই হোক না কেন, এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিই চরম অবমাননা দেখিয়েছিল সরকার।
২০০৯ সালের এই ন্যক্কারজনক ভূমিকার কারণেই মনে করা হচ্ছে, দু’ দেশের মধ্যে যেহেতু বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই সেহেতু অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দিতে হলে সরকারকে হয় ‘পুশ ব্যাক’ করতে হবে নয়তো সাজাতে হবে কোনো নতুন নাটক। অথবা বন্দী বিনিময়ের অন্য কোনো ফর্মুলা।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads