শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

আওয়ামী লীগের স্ববিরোধী রাজনীতি

এই সেদিন প্রথম হজ ফাইটের হজযাত্রীদের উদ্দেশে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, তার সরকার ও রাজনৈতিক দল ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারে নিবেদিত। তার বক্তব্যে নিশ্চয়ই এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান উৎসাহ বোধ করবে; কিন্তু এ দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতির এ বক্তব্যকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূলনীতিবিরোধী হিসেবে গণ্য করবে। ধর্মনিরপেক্ষতা আওয়ামী লীগের চার মূলনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ। ধর্মনিরপেক্ষবাদী রাজনৈতিক দলের প্রধান কিভাবে দাবি করলেন যে, তার সরকার ও দল ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারে নিবেদিত। এটা স্ববিরোধী রাজনীতি ছাড়া আর কিছু নয়।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের ইসলামের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার দাবি কতটুকু বাস্তব, তা যারা ইসলাম সম্বন্ধে যৎসামান্য জ্ঞান রাখেন তাদের অজানা থাকার কথা নয়। মূর্তি নির্মাণ, তা প্রতিস্থাপন ও অর্ঘ্য প্রদান ইসলামবিরোধী। ইসলাম ধর্মের প্রধান স্তম্ভ তাওহিদ এবং তা হলো মূর্তি ও প্রতিমা সংস্কৃতিবিরোধী। তাই মূর্তি-সংস্কৃতি ইসলামে সর্বদা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। তাই আবহমানকাল থেকে এখানে প্রতিমা বা মূর্তি-সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বাঙালি সংস্কৃতির নামে মূর্তি, মঙ্গল প্রদীপ, ‘পুরাণসংস্কৃতির যতসব মুখোশ ইত্যাদিকে সচেতনভাবে বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে এ দেশে প্রচলনে সচেষ্ট। বাংলার বুকে বর্তমানে ভাস্কর্যের নামে যেভাবে মূর্তি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে, তা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী মুসলমানদের জন্য অশনিসঙ্কেত। যেভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানাদির সূচনা করছে এবং পয়লা বৈশাখে যেভাবে নানা পশুপাখি ও জীবজন্তুর মুখোশ নিয়ে মঙ্গল মিছিলের প্রচলন করছে, তা দেখে এ দেশের তৌহিদি জনতার আতঙ্কিত হওয়ার কথা। তার ওপর যখন উচ্চারিত হয় মা দুর্গার আশীর্বাদে এ দেশে এবার ভালো ফসল হবেতা শুনে চমকে যাওয়ার কথা। এতসব কর্মকাণ্ড ও আচরণ পর্যবেক্ষণের পর তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতির পরস্পরবিরোধী তৎপরতা প্রকাশ পায়।
এ গেল আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতির মঞ্চায়নে বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে অভিনয়ের একটি রূপ। এবার আসা যাক, এ দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথায়। তাদের নীতির চার স্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো অসাম্প্রদায়িকতা বা সম্প্রদায়হীন রাজনীতি। এ মূলনীতি রাষ্ট্রের সংবিধানেও সংযুক্ত করেছে এবং দাবি করছে, এটা নাকি স্বাধীনতার চেতনার অংশ। যদিও তাজউদ্দীন আহমদ ৭১-এর এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণায় এর কোনো অস্তিত্ব নেই; কিন্তু এরা অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ইত্যাদি চেতনা হিসেবে প্রচলন করতে সচেষ্ট, তাজউদ্দীনের ঘোষণায় গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবতাকে চেতনা হিসেবে দেখা যায়। বিভিন্ন সম্প্রদায়Ñ বর্ণ, গোত্র, ধর্ম ও অঞ্চলভিত্তিক সমাজ নিয়ে পৃথিবীর মানবসমাজ গঠিত। এভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্তিকে আল কুরআনে একে অপরের পরিচিতির বাহন হিসেবে মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে। এর গুরুত্ব শুধু এ পর্যন্ত। তাকওয়া বা ন্যায়নীতি মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রধান উপাদান। তাই সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও মানসিকতা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামে ন্যায়বিচার ও সামাজিক আচরণে সাম্প্রদায়িক বিবেচনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং বলা হয়েছেÑ ‘ইজা হাকামতুম বাইনান্নাসি আনতাহকুমু বিল আদলে। অর্থাৎ তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার-মীমাংসা করো তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার-মীমাংসা করো। (সূরা নিসা, আয়াত : ৫৮)। 
বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠী মানুষের বাস। তাই এ দেশে শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রচলন করে বাঙালিদের স্বীকৃতি দেয়া হলো আর অন্য জাতিসত্তার মানুষদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হলো। যখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোরা বাঙালি হয়ে যা। তখন এ দেশের পার্বত্য জনগোষ্ঠী এর বিরোধিতা করে এবং অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। যার কুফল আজ পর্যন্ত এ দেশের মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে। তাই বলা যায়, আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িকতার কথা বললেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ সর্বপ্রথম এ দেশে বপন করে। এটি হলো তাদের দ্বিমুখী রাজনীতির আরেক বহিঃপ্রকাশ।
আওয়ামী লীগের চেতনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালে এ দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়। এরা দেশের সব শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করে তার পরিচালনায় প্রশাসক হিসেবে আওয়ামী ক্যাডারদেরকে নিয়োগ দেয়। ফলে দেশে হরিলুট শুরু হয়ে গেল। প্রশাসকগণ এসব শিল্পকারখানা খেয়ে ফেলল। আইয়ুব খানের প্রতারণামূলক উন্নয়নের দশকে যা কিছু শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আওয়ামী সমাজতন্ত্রে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল; কিন্তু প্রশাসকগণ বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেল। এ দিকে এক অংশ এ সমাজতন্ত্রকে আরো আধুনিক করতে গিয়ে জাসদ নামে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশে তাণ্ডব সৃষ্টি করল; কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সরকার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে শক্ত হাতে দমন করল। পরিণতিতে কয়েক হাজার বিপ্লবী প্রলিতারিতকে আত্মাহুতি দিতে হলো। আর এ দিকে দেশে আওয়ামী সমাজতন্ত্রের ঠেলায় হাজার হাজার মানুষকে ৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের শিকার হতে হলো। বাংলার মানুষ আবার মন্বন্তরের সমাজতান্ত্রিক রূপ দেখল। এ দিকে সমাজতন্ত্র করতে গিয়ে এ দেশের সোনালি আঁশ গলার ফাঁস হিসেবে বাঙালি জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলল। দেশে সমাজতান্ত্রিক মাস্তান, গডফাদার, চাঁদাবাজেরা নানাভাবে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, গুম, খুন, অপহরণ নির্দ্বিধায় চালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। শেয়ারবাজার ও ব্যাংক বারবার লুটপাট হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেল; কিন্তু দেশের প্রধান কোষাধ্যক্ষ সাহেব একে মামুলি ব্যাপার হিসেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিলেন। তাই দেশে আওয়ামী সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার।
৬৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী দল গণতন্ত্রের মানসকন্যার নেতৃত্বে দেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে জ্বালাও-পোড়াও, হত্যার মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপিকে বাধ্য করল; কিন্তু যখন মানসকন্যা উপলব্ধি করলেন এভাবে স্থায়ী আওয়ামী গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, তখনই প্রধান বিচারপতির পূর্ণ রায় প্রকাশের আগে তড়িঘড়ি করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রথা বাতিল করে এ দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী হলেন সর্বক্ষমতার অধিকারী। নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও দেশের মানুষের ভোটের অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের এবং নির্বাচন কমিশনের; কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের সম্পূর্ণ নির্লিপ্ততা। কোনো ধরনের কর্মতৎপরতা দেখা গেল না, বরং শুধু ছলচাতুরী কূটকচাল, কূটকৌশল ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে সরকারি জোট ছাড়া আর সবার অংশগ্রহণ না করাকে নিশ্চিত করলেন। ভোটের সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান অনুগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তারা ৫ জানুয়ারি দেশে ভোট ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের আয়োজন করে দেশে প্রতিনিধিত্বহীন এক সংসদ প্রতিষ্ঠা করে বাকশাল ধরনের দেশে শাসনব্যবস্থাকে বিন্যস্ত করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
 স্কোয়াড্রন লিডার (অব:) এ কে এম এনামুল হক


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads