আমার মতো পাঠকদের অনেকেই হয়তো বিষয়টি লক্ষ্য করেননি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে যখন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিলের ওপর ভোটাভুটির নাটক মঞ্চায়ন করা হচ্ছিল, তখন অন্তত একজন দারুণ সৎসাহস দেখিয়েছেন। প্রকাশিত বিভিন্ন খবরে জানানো হয়েছিল, সংশোধনীর পক্ষে ভোট পড়েছে ৩২৭টি, কিন্তু বিপক্ষে একটি ভোটও পড়েনি। পরে জানা গেছে, একজন এমপি বিলের পক্ষে ভোট দেননি। তাই বলে ভাববেন না যে তিনি বিরোধিতা করেছেন। স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরী প্রথমে বিলটি পাস করা বা না করার প্রশ্নে কণ্ঠভোটের আয়োজন করেছিলেন। এতে ওই এমপি ‘হাঁ’ ভোট দিয়েছিলেন। এরপর এসেছিল গোপন ব্যালটে ভোট নেয়ার পালা। এই পর্যায়ে এসে তিনি ভোট দেননি, ভোটদানে বিরত থেকেছেন। অর্থাৎ বিলটিকে তিনি সর্বান্তকরণে সমর্থন করেননি। তা সত্ত্বেও ষোড়শ সংশোধনী অবশ্য পাস হয়ে গেছে। উল্লসিত স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরীও পরপর তিনবার ‘হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে’ বলে ঘোষণা করেছেন। উল্লেখ্য, খুবই হাস্যকর এই ভোটাভুটির আগে কয়েকজন এমপি বিলটির ওপর জনমত যাচাই করার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সে দাবি নিয়ে আলোচনা পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। দাবিটিকে কণ্ঠভোটে সরাসরি বাতিল করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জাসদের ওই এমপিরা তাই বলে ক্ষুব্ধ হওয়া দূরে থাকুক, সামান্য অভিমানের প্রকাশও ঘটাননি। ভোটাভুটির সময় ঠিকই ভোট দিয়েছেন ‘হাঁ’-এর পক্ষে! আগে থেকে সুচিন্তিত আয়োজনও সেরকমই ছিল।
তথ্যগুলো উল্লেখ করার পেছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। সে কারণটি দেশকে বাকশাল ধরনের একদলীয় শাসনের দিকে ফিরিয়ে নেয়ার অভিযোগ। বলা হচ্ছে, বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানও একই জাতীয় সংসদকে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদের মাত্র ১১ মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনীর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়ে যায় ১৬ জুন। উল্লেখ্য, দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক হত্যাকা-সহ বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দরকার যখন ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা, ক্ষমতাদর্পী শেখ মুজিব তখন উল্টো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে এগিয়েছিলেন বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে। সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকা-ের একমাত্র উদ্যোক্তা, নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। সর্বময় ক্ষমতাও তার হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। সে ছিল এক বিচিত্র অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি তথ্য হলো, বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন বিধানসংবলিত চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করা হলেও ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদের পক্ষ থেকে এক দলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় জনগণকে জানানো হয়নি যে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ এত মৌলিক ধরনের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন ঘটাবে। চতুর্থ সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। অথচ এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য যেমনটি পরবর্তীকালে, ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট করেছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। সেবার জাতীয় সংসদে শেখ মুজিব প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা সত্ত্বেও এ প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করেছিল বিএনপি সরকার। অন্যদিকে বাকশাল গঠন এবং চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় শেখ মুজিব কিন্তু এ ধরনের গণতন্ত্রসম্মত চিন্তাই করেননি।
বিচারপতিদের অভিশংসন ও অপসারণের বিধানসংবলিত ষোড়শ সংশোধনী পাস করার প্রক্রিয়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমও লক্ষ্য করা যেতে পারে। দেখা যাবে, তিনি আসলে নিজের পিতাকেই অনুসরণ করেছেন। যেমন ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিলটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছিল গত ১৮ আগস্ট। আইনমন্ত্রী বিলটি সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর। এরপর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সে বিলটিই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পাস করা হয়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ মন্ত্রিসভায় অনুমোদ পাওয়া থেকে সংসদে পাস হওয়া পর্যন্ত সময় লেগেছে মাত্র ৩১ দিন। পিতা শেখ মুজিবও কন্যা শেখ হাসিনার মতোই কম সময় নিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথমে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ২৯ দিনের মধ্যেই তিনি সব ‘কম্ম’ সম্পন্ন করেছিলেন। দু’জনের ক্ষেত্রে অন্য একটি বিষয়েও বিস্ময়কর মিল দেখা গেছে। বাকশাল এবং অভিশংসনের দুটি সংশোধনীই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয় হলেও কোনোটি নিয়েই সংসদে বিতর্ক দূরে থাকুক, তেমন আলোচনাও করতে দেয়া হয়নি। পিতা ও কন্যার নেতৃত্বাধীন দুই সংসদে কিছুটা পার্থক্যও অবশ্য লক্ষ্য করা গেছে। ১৯৭৫ সালের পরিবেশ এখনকার মতো দৃশ্যত খোলামেলা ছিল না। পরিস্থিতি বরং ছিল বিশেষ রকমের এবং বদ্ধ ওই সংসদে বিনা বাক্য ব্যয়ে প্রতাপশালী স্বৈরশাসক শেখ মুজিবের হুকুম পালন করা ছাড়া কারো কোনো উপায়ই ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই সংসদে চতুর্থ সংশোধনীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন কেউ কেউ। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তো সংসদ থেকেই পদত্যাগ করেছিলেন। অন্যদিকে এবার কিন্তু তেমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সাহসী কাউকে পাওয়া যায়নি। একজন মাত্র এমপি ভোটদানে বিরত থাকলেও সবাই শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদেশ পালন করেছেন। সে কারণেই একটি ভোটও পড়েনি প্রস্তাবের বিপক্ষে। যে কোনো দেশের সংসদের জন্য এ এক অভাবনীয় ঘটনাই বটে!
প্রসঙ্গক্রমে অন্য কিছু কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। শেখ হাসিনার তুলনায় অনেক বেশি ‘জনপ্রিয়’ ও ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭৩ সালের মার্চে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতেই তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’, ‘বুড়ারে জিততে দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ (‘বুড়া’ বলতে মরহুম আতাউর রহমান খানকে বুঝিয়েছিলেন শেখ মুজিব)। ওই সংসদেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানো হয়েছিল। সেটা টেকেনি। না টেকার কারণ, জনগণ বাকশালকে গ্রহণই করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরই দায়ভার টানতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখনো সে টানাটানির শেষ হয়নি। সুতরাং ইতিহাস স্মরণে রাখলে আওয়ামী লীগই কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এককালের জনপ্রিয় ও প্রচণ্ড ক্ষমতাদর্পী নেতাকে আবারও জনগণের মোটামুটি কাছাকাছি নিয়ে আসতে কতটা বছর সময় লেগেছে- সে হিসাবও মাথায় রাখা দরকার।
আশংকার বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে বলে এখনো মনে হচ্ছে না। এজন্যই ষড়যন্ত্রের পথে ক্ষমতায় এসে পর্যায়ক্রমে গণতন্ত্রকে তারা নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। সংসদকে শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যসব ক্ষেত্রকেও একেবারে তছনছ করে ফেলেছে শেখ হাসিনার সরকার। জনপ্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রই দলীয়করণ নীতির অসহায় শিকার হয়েছে। বিশেষ করে বিচার বিভাগ তথা আইন-আদালতকে ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার বানিয়েছে সরকার। সরকারের ইচ্ছার কাছে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার মানুষের সর্বশেষ ভরসার স্থল হিসেবেও কোনো প্রতিষ্ঠানকে থাকতে দিচ্ছে না। ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডে মোটেও বিস্মিত হচ্ছেন না। কারণ ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘সংগ্রামী’ দল হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এ ধরনের পন্থাই নিয়েছে। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। এ সংক্রান্ত উদাহরণের সংখ্যাও এত বেশি যে, সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে জানাতে হলেও দীর্ঘ নিবন্ধ লিখতে হবে। এখানে শুধু এটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট যে, বাকশালী শাসনের পতন-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। এ বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সঙ্গী বামপন্থীরা তো বটেই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সকল বিরোধী দলও এতে অংশ নিয়েছে, কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দেয়নি। শুধু তাই নয়, সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পরও দলটি আন্দোলনের সহযোগী ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোনো দলের কোনো নেতাকে মন্ত্রী বানায়নি। পরিবর্তে মন্ত্রিত্ব দিয়েছিল এমন দু’জন মাত্র নেতাকে, যাদের সঙ্গে সামরিক শাসক এরশাদের বিশেষ ধরনের সম্পর্ক ছিল। একজন দীর্ঘদিন তার মন্ত্রিত্ব করেছেন (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু), অন্যজন ছিলেন এরশাদের সংসদে বিরোধী দলের নেতা (জাসদের আ স ম আবদুর রব)। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ বাম ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের শুধু ব্যবহারই করেছিল।
পরবর্তীকালেও আওয়ামী লীগ প্রতারণা ও ঐক্যের অভিনয় থেকে সরে আসেনি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি মহাজোট গঠন করেছিল। নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মেলানোয় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। আসলেও কথাটা কঠিন সত্য। ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকে চারদলীয় জোট সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ তার সমর্থনে এক পা-ও এগিয়ে অসেনি। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ংকর প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজিরও শেখ হাসিনা বারবার স্থাপন করেছেন। এজন্যই জনগণও তার আহ্বানে কখনো সাড়া দেয়নিÑ তারা শেখ হাসিনার মতো জোট সরকারের পদত্যাগ রোগে আক্রান্ত হয়নি। একই কারণে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। জোট গঠনের এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের অক্ষমতা ও জনসমর্থনহীনতার কথাই প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। লগি-বৈঠার ধারাবাহিকতায় ভারতের এবং নিজেদের ‘নিয়ে আসা’ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ক্ষমতায় এসেছিল দলটি। গণতন্ত্রের ব্যাপারে এতটাই সততা আওয়ামী লীগের- বিশেষ করে নেত্রী শেখ হাসিনার! এবার তো আরো চমক দেখিয়েছেন নেত্রী। দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে সুকৌশলে বাইরে ঠেলে দিয়ে এমন এক সংসদ নির্বাচনই তিনি করিয়েছেন যার ১৫৪ জন সদস্যই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন। এজন্যই ষোড়শ সংশোধনীর প্রস্তাবে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এবং সে জনগণের পক্ষে ‘ক্ষমতা প্রয়োগের’ কথা বলা হলেও তা সামান্য গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি। কারণ, প্রমাণিত এবং দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, বর্তমান জাতীয় সংসদ কোনোদিক থেকেই ‘মালিক’ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ অর্ধেকের বেশি সদস্যকে তো ভোটার জনগণ চেনেই না! অন্যদিকে সেসব সদস্যকে দিয়েই তড়িঘড়ি করে সংবিধানে ষোড়শ তথা বিচারপতিদের অভিশংসন সংক্রান্ত সংশোধনী পাস করিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই কারণে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশকে একদলীয় শাসনের অধীনস্ত করে ফেলার দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য সম্পর্কে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, প্রথমে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার পর সরকার বিচার বিভাগকেও আজ্ঞাবহ বানাতে চাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে ‘গৌরবোজ্জ্বল’ অতীত রয়েছে বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেয়ার কথা শোনান এবং সে অনুযায়ী সংসদকে সেবাদাসের মতো ব্যবহার করেন তখন উৎসাহিত হওয়ার পরিবর্তে সচেতন মহলগুলোতে উল্টো ভীতি ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন ওঠে, শেখ হাসিনার মতো নেত্রীর কাছে গণতন্ত্র শেখার এবং ভালো কিছু পাওয়ার থাকতে পারে কি না। অনেকে বাতাসে এমনকি বাকশালের খুশবুও পেয়ে যান!
তথ্যগুলো উল্লেখ করার পেছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। সে কারণটি দেশকে বাকশাল ধরনের একদলীয় শাসনের দিকে ফিরিয়ে নেয়ার অভিযোগ। বলা হচ্ছে, বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানও একই জাতীয় সংসদকে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদের মাত্র ১১ মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনীর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়ে যায় ১৬ জুন। উল্লেখ্য, দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক হত্যাকা-সহ বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দরকার যখন ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা, ক্ষমতাদর্পী শেখ মুজিব তখন উল্টো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে এগিয়েছিলেন বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে। সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকা-ের একমাত্র উদ্যোক্তা, নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। সর্বময় ক্ষমতাও তার হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। সে ছিল এক বিচিত্র অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি তথ্য হলো, বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন বিধানসংবলিত চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করা হলেও ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদের পক্ষ থেকে এক দলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় জনগণকে জানানো হয়নি যে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ এত মৌলিক ধরনের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন ঘটাবে। চতুর্থ সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। অথচ এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য যেমনটি পরবর্তীকালে, ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট করেছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। সেবার জাতীয় সংসদে শেখ মুজিব প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা সত্ত্বেও এ প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করেছিল বিএনপি সরকার। অন্যদিকে বাকশাল গঠন এবং চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় শেখ মুজিব কিন্তু এ ধরনের গণতন্ত্রসম্মত চিন্তাই করেননি।
বিচারপতিদের অভিশংসন ও অপসারণের বিধানসংবলিত ষোড়শ সংশোধনী পাস করার প্রক্রিয়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমও লক্ষ্য করা যেতে পারে। দেখা যাবে, তিনি আসলে নিজের পিতাকেই অনুসরণ করেছেন। যেমন ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিলটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছিল গত ১৮ আগস্ট। আইনমন্ত্রী বিলটি সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর। এরপর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সে বিলটিই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পাস করা হয়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ মন্ত্রিসভায় অনুমোদ পাওয়া থেকে সংসদে পাস হওয়া পর্যন্ত সময় লেগেছে মাত্র ৩১ দিন। পিতা শেখ মুজিবও কন্যা শেখ হাসিনার মতোই কম সময় নিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথমে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ২৯ দিনের মধ্যেই তিনি সব ‘কম্ম’ সম্পন্ন করেছিলেন। দু’জনের ক্ষেত্রে অন্য একটি বিষয়েও বিস্ময়কর মিল দেখা গেছে। বাকশাল এবং অভিশংসনের দুটি সংশোধনীই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয় হলেও কোনোটি নিয়েই সংসদে বিতর্ক দূরে থাকুক, তেমন আলোচনাও করতে দেয়া হয়নি। পিতা ও কন্যার নেতৃত্বাধীন দুই সংসদে কিছুটা পার্থক্যও অবশ্য লক্ষ্য করা গেছে। ১৯৭৫ সালের পরিবেশ এখনকার মতো দৃশ্যত খোলামেলা ছিল না। পরিস্থিতি বরং ছিল বিশেষ রকমের এবং বদ্ধ ওই সংসদে বিনা বাক্য ব্যয়ে প্রতাপশালী স্বৈরশাসক শেখ মুজিবের হুকুম পালন করা ছাড়া কারো কোনো উপায়ই ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই সংসদে চতুর্থ সংশোধনীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন কেউ কেউ। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তো সংসদ থেকেই পদত্যাগ করেছিলেন। অন্যদিকে এবার কিন্তু তেমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সাহসী কাউকে পাওয়া যায়নি। একজন মাত্র এমপি ভোটদানে বিরত থাকলেও সবাই শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদেশ পালন করেছেন। সে কারণেই একটি ভোটও পড়েনি প্রস্তাবের বিপক্ষে। যে কোনো দেশের সংসদের জন্য এ এক অভাবনীয় ঘটনাই বটে!
প্রসঙ্গক্রমে অন্য কিছু কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। শেখ হাসিনার তুলনায় অনেক বেশি ‘জনপ্রিয়’ ও ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭৩ সালের মার্চে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতেই তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’, ‘বুড়ারে জিততে দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ (‘বুড়া’ বলতে মরহুম আতাউর রহমান খানকে বুঝিয়েছিলেন শেখ মুজিব)। ওই সংসদেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানো হয়েছিল। সেটা টেকেনি। না টেকার কারণ, জনগণ বাকশালকে গ্রহণই করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরই দায়ভার টানতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখনো সে টানাটানির শেষ হয়নি। সুতরাং ইতিহাস স্মরণে রাখলে আওয়ামী লীগই কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এককালের জনপ্রিয় ও প্রচণ্ড ক্ষমতাদর্পী নেতাকে আবারও জনগণের মোটামুটি কাছাকাছি নিয়ে আসতে কতটা বছর সময় লেগেছে- সে হিসাবও মাথায় রাখা দরকার।
আশংকার বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে বলে এখনো মনে হচ্ছে না। এজন্যই ষড়যন্ত্রের পথে ক্ষমতায় এসে পর্যায়ক্রমে গণতন্ত্রকে তারা নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। সংসদকে শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যসব ক্ষেত্রকেও একেবারে তছনছ করে ফেলেছে শেখ হাসিনার সরকার। জনপ্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রই দলীয়করণ নীতির অসহায় শিকার হয়েছে। বিশেষ করে বিচার বিভাগ তথা আইন-আদালতকে ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার বানিয়েছে সরকার। সরকারের ইচ্ছার কাছে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার মানুষের সর্বশেষ ভরসার স্থল হিসেবেও কোনো প্রতিষ্ঠানকে থাকতে দিচ্ছে না। ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডে মোটেও বিস্মিত হচ্ছেন না। কারণ ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘সংগ্রামী’ দল হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এ ধরনের পন্থাই নিয়েছে। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। এ সংক্রান্ত উদাহরণের সংখ্যাও এত বেশি যে, সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে জানাতে হলেও দীর্ঘ নিবন্ধ লিখতে হবে। এখানে শুধু এটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট যে, বাকশালী শাসনের পতন-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। এ বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সঙ্গী বামপন্থীরা তো বটেই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সকল বিরোধী দলও এতে অংশ নিয়েছে, কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দেয়নি। শুধু তাই নয়, সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পরও দলটি আন্দোলনের সহযোগী ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোনো দলের কোনো নেতাকে মন্ত্রী বানায়নি। পরিবর্তে মন্ত্রিত্ব দিয়েছিল এমন দু’জন মাত্র নেতাকে, যাদের সঙ্গে সামরিক শাসক এরশাদের বিশেষ ধরনের সম্পর্ক ছিল। একজন দীর্ঘদিন তার মন্ত্রিত্ব করেছেন (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু), অন্যজন ছিলেন এরশাদের সংসদে বিরোধী দলের নেতা (জাসদের আ স ম আবদুর রব)। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ বাম ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের শুধু ব্যবহারই করেছিল।
পরবর্তীকালেও আওয়ামী লীগ প্রতারণা ও ঐক্যের অভিনয় থেকে সরে আসেনি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি মহাজোট গঠন করেছিল। নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মেলানোয় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। আসলেও কথাটা কঠিন সত্য। ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকে চারদলীয় জোট সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ তার সমর্থনে এক পা-ও এগিয়ে অসেনি। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ংকর প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজিরও শেখ হাসিনা বারবার স্থাপন করেছেন। এজন্যই জনগণও তার আহ্বানে কখনো সাড়া দেয়নিÑ তারা শেখ হাসিনার মতো জোট সরকারের পদত্যাগ রোগে আক্রান্ত হয়নি। একই কারণে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। জোট গঠনের এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের অক্ষমতা ও জনসমর্থনহীনতার কথাই প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। লগি-বৈঠার ধারাবাহিকতায় ভারতের এবং নিজেদের ‘নিয়ে আসা’ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ক্ষমতায় এসেছিল দলটি। গণতন্ত্রের ব্যাপারে এতটাই সততা আওয়ামী লীগের- বিশেষ করে নেত্রী শেখ হাসিনার! এবার তো আরো চমক দেখিয়েছেন নেত্রী। দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে সুকৌশলে বাইরে ঠেলে দিয়ে এমন এক সংসদ নির্বাচনই তিনি করিয়েছেন যার ১৫৪ জন সদস্যই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন। এজন্যই ষোড়শ সংশোধনীর প্রস্তাবে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এবং সে জনগণের পক্ষে ‘ক্ষমতা প্রয়োগের’ কথা বলা হলেও তা সামান্য গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি। কারণ, প্রমাণিত এবং দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, বর্তমান জাতীয় সংসদ কোনোদিক থেকেই ‘মালিক’ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ অর্ধেকের বেশি সদস্যকে তো ভোটার জনগণ চেনেই না! অন্যদিকে সেসব সদস্যকে দিয়েই তড়িঘড়ি করে সংবিধানে ষোড়শ তথা বিচারপতিদের অভিশংসন সংক্রান্ত সংশোধনী পাস করিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই কারণে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশকে একদলীয় শাসনের অধীনস্ত করে ফেলার দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য সম্পর্কে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, প্রথমে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার পর সরকার বিচার বিভাগকেও আজ্ঞাবহ বানাতে চাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে ‘গৌরবোজ্জ্বল’ অতীত রয়েছে বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেয়ার কথা শোনান এবং সে অনুযায়ী সংসদকে সেবাদাসের মতো ব্যবহার করেন তখন উৎসাহিত হওয়ার পরিবর্তে সচেতন মহলগুলোতে উল্টো ভীতি ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন ওঠে, শেখ হাসিনার মতো নেত্রীর কাছে গণতন্ত্র শেখার এবং ভালো কিছু পাওয়ার থাকতে পারে কি না। অনেকে বাতাসে এমনকি বাকশালের খুশবুও পেয়ে যান!
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন