এখন ভাদ্রের শেষ। শ্রাবণের তো প্রায়
শুরু থেকেই প্রবল বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢল নেমে আসছিল বাংলাদেশে। সারা বছর
স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ না থাকায় নদী, খাল-বিল, জলাধার ভরাট হয়ে গেছে। সরকারের তরফ থেকে ভারতের কাছ থেকে আদায়
করা সম্ভব হয়নি পানির ন্যায্য হিস্যা। ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে আরো উঁচু হয়ে গেছে।
শুকনো মওসুমে মোটেও পানি পাওয়া যায়নি। তিস্তায় পানির ন্যায্য দাবিতে উত্তরাঞ্চলের
মানুষ মাসভর বিক্ষোভ করেছে। সরকার ফিরেও তাকায়নি। বরং কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন
মনমোহন সরকারের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে
সরাসরি দোষারোপ করেছেন। মনমোহন সিং যেমন বাংলাদেশের জনগণকে শিশু ভেবে তিস্তায়
বাংলাদেশের পানি না পাওয়া নিয়ে মমতাকে দায়ী করেছেন, তেমনি
তার সাথে সুর মিলিয়ে কংগ্রেস অনুগত বাংলাদেশ সরকারও একই কথা বলেছে।
কিন্তু ভারতে এখন মনমোহন সরকার নেই। গণেশ উল্টে গেছে। ভারতীয় জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রান্তকারী অর্থনীতিবিনাশী কংগ্রেস সরকারকে এমন শিক্ষাই দিয়েছে যে, তারা পার্লমেন্টে বিরোধী দল হওয়ার যোগ্যতাও হারিয়েছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার অনির্বাচিত সরকার যেন একেবারেই সর্বহারায় পরিণত হয়েছে। গত পাঁচ বছর এবং তার আগে মইন-ফখরের সামরিক সরকারের দুই বছর, এই মিলিয়ে সাত বছরে বাংলাদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। এখন শেখ হাসিনা দেখতে পাচ্ছেন, ‘কী ঘর বানাইনু আমি শূন্যেরও মাঝার’।
এই সাত বছরে ভারতীয় বিএসএফ ধারাবাহিকভাবে সীমান্ত হত্যা চালিয়েছে। এরা বাংলাদেশীদের প্রতিদিনই খুন করে যাচ্ছে। নদ-নদীগুলোর ন্যায্য পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আবার দেশের অভ্যন্তরে কোথায়ও কোথায়ও নদী খননের নামে শত শত কোটি টাকা লুট করে নিয়েছে সরকার দলের হোমরা-চোমরারা। এখনো নিচ্ছে। খনন যে হচ্ছে না, তা নয়; কিন্তু সে-ও পুকুরচুরি, নদীচুরির খেলা। নদীর তলদেশ থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ময়লা-আবর্জনা, বালি তুলে খনন করে নদীর কিনারায়ই ফেলে রাখা হয়েছে। বৃষ্টিতে তার সবকিছু ধুয়ে ফের নদীতে ফিরে এসেছে। ফিরে যদি না আসবে, তবে পরের বছর আবারো নদী চুরির ঘটনা কিভাবে ঘটানো হবে? এবার খেলাম, আগামী বছরও খাওয়ার আয়োজন রেখে গেলাম।
ফলে বৃষ্টি আর উজানের পানি যখন বিপুল বেগে ভাটি দেশ বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসতে থাকল, তখন উত্তরে দক্ষিণে জনপদের পর জনপদ, গ্রামের পর গ্রাম রাস্তাঘাট সবকিছুই তলিয়ে যেতে শুরু করল। লাখ লাখ মানুষ হঠাৎ করেই বিপন্ন হয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে থাকা মানুষ ঘরের ভেতরে পানির স্পর্শে জেগে উঠল। ধুয়েমুছে গেল গোয়ালের গরু, সংরক্ষিত ধান-চাল, কাঁথা-বালিশ, তৈজস, সবকিছু। যে মানুষের কারো কাছে হাত পাতার দরকার ছিল না, সে মানুষও ছেলে-মেয়েসহ কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে ত্রাণের অপেক্ষায় জলমগ্ন দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই বন্যার তোড়ে ভেঙে গেছে স্কুল, কলেজ, সড়ক, মহাসড়ক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সরকারি-বেসরকারি ভবন, মানুষের কাঁচাপাকা বাসভবন। এখন আবার পানি নামতে শুরু করেছে। পানি যখন নামে তখন ভাঙন প্রবল রূপ নেয়। সে অবস্থা পানি আসার সময়ের চেয়েও ভয়াবহ। ঘরের পানি হয়তো নেমে যায়; কিন্তু ভাঙনের কবলে পড়ে ঘরটি বিলীন হয়ে যায় নদীতে।
গত এক যুগের মধ্যে এতবড় ভয়াবহ বন্যা আর হয়নি। সরকারের যখন বন্যাদুর্গত এই বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা, তখন তারা ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত ছিল খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে, কুৎসিত গালাগালিতে আর পুলিশ-বাদী বিভিন্ন মামলার চার্জশিট দ্রুত তৈরি করতে। ত্রাণ উদ্যোগে তাদের মনোযোগ ছিল না। এরকম একটি বন্যা হলে আগে কত ধরনের মানুষের রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তার হাত প্রশস্ত হতে দেখেছি। এবার সেটি খুব বেশি চোখে পড়েনি। সরকারের তাড়া-খাওয়া বিএনপি নেতারা তবু কোথায়ও কোথায়ও সাধ্যানুযায়ী ত্রাণ নিয়ে গিয়ে হাজির হয়েছেন; কিন্তু এটা তো খুবই স্বাভাবিকÑ সরকারের পক্ষে যা সম্ভব, দৌড়ের-ওপর থাকা বিএনপির নেতাদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না।
সরকারের এই উদাসীনতার কিংবা নিঃস্পৃহতার কারণও সম্ভবত ছিল। সে কারণ হয়তো এই যে, বর্তমান সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। ফলে জনগণের প্রতিও তাদের কোনো দায়িত্ব নেই। এরকম পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার হলে আমরা আশা করতাম যে, এরা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিপন্ন মানুষকে যথাসম্ভব সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতেন এবং গোটা দেশবাসীকে সহায়তার হাত সম্প্রসারিত করার আহ্বান জানাতেন। দায়হীন ও দায়িত্বহীন সরকারের কাছ থেকে সেরকম সদিচ্ছা আশা করা যায় না। সরকার তা করেওনি। এটি অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিক ঐতিহ্যেরই অংশ। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়ও আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দু’হাতে ত্রাণ ও লঙ্গরখানার মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। ওই দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের পাঁচ লাখ লোক অনাহারে মারা গিয়েছিল। এখন লুটের এলাকা এত বেড়েছে যে, সরকার ত্রাণ-ট্রান নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তবে রক্ষা, এখনো ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী এই দুর্যোগকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে অভিহিত করেননি।
সরকারের এখন এক মারাত্মক রোগ হয়েছে। এ রোগের নাম ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। এ ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হলেন সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি সাধারণত ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। কখনো কখনো মনে হয় এই প্রতিমন্ত্রী সম্ভবত ভদ্রলোকই হবেন। কেননা, তিনি যা বলছেন, তার সবই যে তাকে শিখিয়ে দেয়া বুলি, সেটি কখনোই অস্পষ্ট থাকে না। নারায়ণগঞ্জে যখন একই সাথে সাত খুনের ঘটনা ঘটল, তখনো তিনি বললেন, উদ্বেগের কিছু নেই। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এরপর ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান একরামকে যখন গুলি করে হত্যা করে পুড়িয়ে অঙ্গার করে ফেলা হলো, তখনো তিনি বললেন, উদ্বেগের কিছু নেই। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এরপর রাজধানীর রাজাবাজারে চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠান উপস্থাপক মাওলানা ফারুকীকে যখন তার বাসায় দুর্বৃত্তরা গলাকেটে খুন করল, তখনো তিনি বললেন এটিও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একদল দুর্বৃত্ত মগবাজারের বাসায় ঢুকে একই পরিবারের তিনজনকে গুলি করে হত্যা করার পর কামাল সেই রেকর্ডই বাজিয়ে দিলেন, উদ্বেগের কিছু নেই। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। গত ৪ তারিখে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ব্যবসায়ী বাবা-ছেলেকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা ছিনিয়ে নিয়েছে ৪৮ লাখ টাকা। ছেলে খুন হয়েছেন। বাবা গুরুতর আহত। এই লেখা যখন লিখছি (৫/৯/১৪) তখন পর্যন্ত অবশ্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে অভিহিত করেননি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, কখন বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি ঘটে।
গত ৩০ আগস্ট ছিল বিশ্ব গুম দিবস। সে উপলক্ষে ঢাকায় গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের জাতীয় প্রেস কাবে সমবেত করেছিলেন ড. কামাল হোসেন, ড. শাহদীন মালিক প্রমুখ আইনজীবী। স্বজনহারা মানুষদের কান্নায় ভারী হয়ে গিয়েছিল সেখানকার পরিবেশ। মুহূর্তে সে আর্তধ্বনি পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রান্তে প্রান্তে। তারা বলছিলেন, খুন যদি করেও থাকেন করেছেন, লাশটি কোথায় পুঁতে রেখেছেন, জায়গাটা দেখিয়ে দিন।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৬ বছরে দেশে খুন হয়েছে ৩৩ হাজার মানুষ। গুম হয়েছে ৩৩০ জন এক বছরে। এ নিয়ে যখন মিডিয়ায় তুমুল তোলপাড়, তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনাব কামাল একইভাবে মাথা নিচু করে বললেন, যত প্রচার করা হচ্ছে ব্যাপারটা তত সিরিয়াস নয়। আর কত সংখ্যক মানুষ প্রতি বছর প্রতিদিন প্রাণ হারালে, খুন হলে, গুম হলে ব্যাপারটা সিরিয়াস হবে বোঝা দুষ্কর।
এ দিকে ছাত্রলীগকে দেয়া হয়েছে অবাধ ও নির্বিচার খুনের লাইসেন্স। ছাত্রলীগ এখন যখন যেখানে খুশি যাকে খুশি খুন করতে পারে। পুলিশ তাদের আটক করলে এরা থানা ঘেরাও করে অভিযুক্তকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তাদের উদ্ধার করতে আসেন প্রভাবশালী ও স্থানীয় এমপিরা। শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে নিয়েও যান। আইন বিচার কোথায় পাবে সাধারণ মানুষ? গত ৩১ আগস্ট মুজিব দম্পতি স্মরণে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ ডেকেছিল ছাত্রলীগ। প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। এ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে এরা অতিরিক্ত বগি দাবি করেছিল। স্টেশন মাস্টার অপারগতা প্রকাশ করলে ছাত্রলীগারেরা সমবেত হয়ে তাদের বেদম মারধর করে। পরদিন প্রকৃত রেলস্টেশনের ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাসপেন্ড করে ছাত্রলীগকে অতিরিক্ত বগি দেয়া হয়। গত ২৯ আগস্ট রাতে বান্দরবান সদরে এক সালিসি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। সেখানে ইউপি সদস্যের সাথে ছাত্রলীগের লোকদের বচসা হয়। এরপর তারা ওই ইউপি সদস্যদের মারধর করলে তাদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। কেন থানায় আনা হলো, এই ‘অপরাধে’ বান্দরবান সদর থানার তিন এসআই, এক এএসআই ও চার কনস্টেবলকে আশপাশের বিভিন্ন থানায় বদলি করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতারা থানা থেকে বীরদর্পে বেরিয়ে এসেছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, এর সবই কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা যদি হয়েই থাকে তাহলে তার ভার এত বেশি হচ্ছে যে, সেটি বইবার সাধ্য সম্ভবত আপনার সরকারের আর থাকবে না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
কিন্তু ভারতে এখন মনমোহন সরকার নেই। গণেশ উল্টে গেছে। ভারতীয় জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রান্তকারী অর্থনীতিবিনাশী কংগ্রেস সরকারকে এমন শিক্ষাই দিয়েছে যে, তারা পার্লমেন্টে বিরোধী দল হওয়ার যোগ্যতাও হারিয়েছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার অনির্বাচিত সরকার যেন একেবারেই সর্বহারায় পরিণত হয়েছে। গত পাঁচ বছর এবং তার আগে মইন-ফখরের সামরিক সরকারের দুই বছর, এই মিলিয়ে সাত বছরে বাংলাদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। এখন শেখ হাসিনা দেখতে পাচ্ছেন, ‘কী ঘর বানাইনু আমি শূন্যেরও মাঝার’।
এই সাত বছরে ভারতীয় বিএসএফ ধারাবাহিকভাবে সীমান্ত হত্যা চালিয়েছে। এরা বাংলাদেশীদের প্রতিদিনই খুন করে যাচ্ছে। নদ-নদীগুলোর ন্যায্য পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আবার দেশের অভ্যন্তরে কোথায়ও কোথায়ও নদী খননের নামে শত শত কোটি টাকা লুট করে নিয়েছে সরকার দলের হোমরা-চোমরারা। এখনো নিচ্ছে। খনন যে হচ্ছে না, তা নয়; কিন্তু সে-ও পুকুরচুরি, নদীচুরির খেলা। নদীর তলদেশ থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ময়লা-আবর্জনা, বালি তুলে খনন করে নদীর কিনারায়ই ফেলে রাখা হয়েছে। বৃষ্টিতে তার সবকিছু ধুয়ে ফের নদীতে ফিরে এসেছে। ফিরে যদি না আসবে, তবে পরের বছর আবারো নদী চুরির ঘটনা কিভাবে ঘটানো হবে? এবার খেলাম, আগামী বছরও খাওয়ার আয়োজন রেখে গেলাম।
ফলে বৃষ্টি আর উজানের পানি যখন বিপুল বেগে ভাটি দেশ বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসতে থাকল, তখন উত্তরে দক্ষিণে জনপদের পর জনপদ, গ্রামের পর গ্রাম রাস্তাঘাট সবকিছুই তলিয়ে যেতে শুরু করল। লাখ লাখ মানুষ হঠাৎ করেই বিপন্ন হয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে থাকা মানুষ ঘরের ভেতরে পানির স্পর্শে জেগে উঠল। ধুয়েমুছে গেল গোয়ালের গরু, সংরক্ষিত ধান-চাল, কাঁথা-বালিশ, তৈজস, সবকিছু। যে মানুষের কারো কাছে হাত পাতার দরকার ছিল না, সে মানুষও ছেলে-মেয়েসহ কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে ত্রাণের অপেক্ষায় জলমগ্ন দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই বন্যার তোড়ে ভেঙে গেছে স্কুল, কলেজ, সড়ক, মহাসড়ক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সরকারি-বেসরকারি ভবন, মানুষের কাঁচাপাকা বাসভবন। এখন আবার পানি নামতে শুরু করেছে। পানি যখন নামে তখন ভাঙন প্রবল রূপ নেয়। সে অবস্থা পানি আসার সময়ের চেয়েও ভয়াবহ। ঘরের পানি হয়তো নেমে যায়; কিন্তু ভাঙনের কবলে পড়ে ঘরটি বিলীন হয়ে যায় নদীতে।
গত এক যুগের মধ্যে এতবড় ভয়াবহ বন্যা আর হয়নি। সরকারের যখন বন্যাদুর্গত এই বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা, তখন তারা ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত ছিল খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে, কুৎসিত গালাগালিতে আর পুলিশ-বাদী বিভিন্ন মামলার চার্জশিট দ্রুত তৈরি করতে। ত্রাণ উদ্যোগে তাদের মনোযোগ ছিল না। এরকম একটি বন্যা হলে আগে কত ধরনের মানুষের রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তার হাত প্রশস্ত হতে দেখেছি। এবার সেটি খুব বেশি চোখে পড়েনি। সরকারের তাড়া-খাওয়া বিএনপি নেতারা তবু কোথায়ও কোথায়ও সাধ্যানুযায়ী ত্রাণ নিয়ে গিয়ে হাজির হয়েছেন; কিন্তু এটা তো খুবই স্বাভাবিকÑ সরকারের পক্ষে যা সম্ভব, দৌড়ের-ওপর থাকা বিএনপির নেতাদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না।
সরকারের এই উদাসীনতার কিংবা নিঃস্পৃহতার কারণও সম্ভবত ছিল। সে কারণ হয়তো এই যে, বর্তমান সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। ফলে জনগণের প্রতিও তাদের কোনো দায়িত্ব নেই। এরকম পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার হলে আমরা আশা করতাম যে, এরা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিপন্ন মানুষকে যথাসম্ভব সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতেন এবং গোটা দেশবাসীকে সহায়তার হাত সম্প্রসারিত করার আহ্বান জানাতেন। দায়হীন ও দায়িত্বহীন সরকারের কাছ থেকে সেরকম সদিচ্ছা আশা করা যায় না। সরকার তা করেওনি। এটি অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিক ঐতিহ্যেরই অংশ। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়ও আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দু’হাতে ত্রাণ ও লঙ্গরখানার মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। ওই দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের পাঁচ লাখ লোক অনাহারে মারা গিয়েছিল। এখন লুটের এলাকা এত বেড়েছে যে, সরকার ত্রাণ-ট্রান নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তবে রক্ষা, এখনো ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী এই দুর্যোগকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে অভিহিত করেননি।
সরকারের এখন এক মারাত্মক রোগ হয়েছে। এ রোগের নাম ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। এ ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হলেন সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি সাধারণত ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। কখনো কখনো মনে হয় এই প্রতিমন্ত্রী সম্ভবত ভদ্রলোকই হবেন। কেননা, তিনি যা বলছেন, তার সবই যে তাকে শিখিয়ে দেয়া বুলি, সেটি কখনোই অস্পষ্ট থাকে না। নারায়ণগঞ্জে যখন একই সাথে সাত খুনের ঘটনা ঘটল, তখনো তিনি বললেন, উদ্বেগের কিছু নেই। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এরপর ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান একরামকে যখন গুলি করে হত্যা করে পুড়িয়ে অঙ্গার করে ফেলা হলো, তখনো তিনি বললেন, উদ্বেগের কিছু নেই। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এরপর রাজধানীর রাজাবাজারে চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠান উপস্থাপক মাওলানা ফারুকীকে যখন তার বাসায় দুর্বৃত্তরা গলাকেটে খুন করল, তখনো তিনি বললেন এটিও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একদল দুর্বৃত্ত মগবাজারের বাসায় ঢুকে একই পরিবারের তিনজনকে গুলি করে হত্যা করার পর কামাল সেই রেকর্ডই বাজিয়ে দিলেন, উদ্বেগের কিছু নেই। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। গত ৪ তারিখে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ব্যবসায়ী বাবা-ছেলেকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা ছিনিয়ে নিয়েছে ৪৮ লাখ টাকা। ছেলে খুন হয়েছেন। বাবা গুরুতর আহত। এই লেখা যখন লিখছি (৫/৯/১৪) তখন পর্যন্ত অবশ্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে অভিহিত করেননি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, কখন বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি ঘটে।
গত ৩০ আগস্ট ছিল বিশ্ব গুম দিবস। সে উপলক্ষে ঢাকায় গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের জাতীয় প্রেস কাবে সমবেত করেছিলেন ড. কামাল হোসেন, ড. শাহদীন মালিক প্রমুখ আইনজীবী। স্বজনহারা মানুষদের কান্নায় ভারী হয়ে গিয়েছিল সেখানকার পরিবেশ। মুহূর্তে সে আর্তধ্বনি পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রান্তে প্রান্তে। তারা বলছিলেন, খুন যদি করেও থাকেন করেছেন, লাশটি কোথায় পুঁতে রেখেছেন, জায়গাটা দেখিয়ে দিন।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৬ বছরে দেশে খুন হয়েছে ৩৩ হাজার মানুষ। গুম হয়েছে ৩৩০ জন এক বছরে। এ নিয়ে যখন মিডিয়ায় তুমুল তোলপাড়, তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনাব কামাল একইভাবে মাথা নিচু করে বললেন, যত প্রচার করা হচ্ছে ব্যাপারটা তত সিরিয়াস নয়। আর কত সংখ্যক মানুষ প্রতি বছর প্রতিদিন প্রাণ হারালে, খুন হলে, গুম হলে ব্যাপারটা সিরিয়াস হবে বোঝা দুষ্কর।
এ দিকে ছাত্রলীগকে দেয়া হয়েছে অবাধ ও নির্বিচার খুনের লাইসেন্স। ছাত্রলীগ এখন যখন যেখানে খুশি যাকে খুশি খুন করতে পারে। পুলিশ তাদের আটক করলে এরা থানা ঘেরাও করে অভিযুক্তকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তাদের উদ্ধার করতে আসেন প্রভাবশালী ও স্থানীয় এমপিরা। শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে নিয়েও যান। আইন বিচার কোথায় পাবে সাধারণ মানুষ? গত ৩১ আগস্ট মুজিব দম্পতি স্মরণে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ ডেকেছিল ছাত্রলীগ। প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। এ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে এরা অতিরিক্ত বগি দাবি করেছিল। স্টেশন মাস্টার অপারগতা প্রকাশ করলে ছাত্রলীগারেরা সমবেত হয়ে তাদের বেদম মারধর করে। পরদিন প্রকৃত রেলস্টেশনের ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাসপেন্ড করে ছাত্রলীগকে অতিরিক্ত বগি দেয়া হয়। গত ২৯ আগস্ট রাতে বান্দরবান সদরে এক সালিসি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। সেখানে ইউপি সদস্যের সাথে ছাত্রলীগের লোকদের বচসা হয়। এরপর তারা ওই ইউপি সদস্যদের মারধর করলে তাদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। কেন থানায় আনা হলো, এই ‘অপরাধে’ বান্দরবান সদর থানার তিন এসআই, এক এএসআই ও চার কনস্টেবলকে আশপাশের বিভিন্ন থানায় বদলি করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতারা থানা থেকে বীরদর্পে বেরিয়ে এসেছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, এর সবই কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা যদি হয়েই থাকে তাহলে তার ভার এত বেশি হচ্ছে যে, সেটি বইবার সাধ্য সম্ভবত আপনার সরকারের আর থাকবে না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন